কওমি সনদ, শুকরানা মাহফিল এবং কওমি জননী।

লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ০৬ নভেম্বর, ২০১৮, ০২:৪৫:৫৭ রাত

সে অনেক কথার মাঝে, হঠাত মাঝখানে কথা বলা জটিল, কঠিন এবং সমস্যা। অতি সংক্ষেপে দুটি কথা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান ধারা আছে। শুধু বাংলাদেশ কেন কম বেশি পৃথিবীর সব দেশেই দুটি ধারা থাকে। কোন দেশে যদি গনতন্ত্রের সামান্যতম অস্তিত্ব ও থাকে সেখানে প্রধান দুটি ধারা থাকাই স্বাভাবিক। আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আর রিপাবলিকান পার্টি, ব্রিটেনে লেবার পার্টি আর কনজারভেটিভ পার্টি, মালয়েশিয়ায় উমনু (আমনু) এবং পাস। বাংলাদেশের দুটি ধারা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। দুটি ধারার এই ইতিহাস শুধু এখন নয়, এটা অনেকটা পৃথিবীর ইতিহাসের মত। আমরা ইতিহাসে উমাইইয়া খিলাফত এবং আব্বাসিয় খিলাফতের ইতিহাস জানি। এভাবেই আপনি যত পেছনেই যাবেন আর যেখানেই যাবেন। গণতন্ত্র যেখানে আছে দুটি ধারা থাকবেই। হাঁ, অপরদিকে স্বৈরতন্ত্র, একদলীয় শাসন, এসব ও ইতিহাসে ছিল এখনো আছে।

যুগে যুগে দালাল, রাজনীতির তল্পিবাহি ও ছিল, থাকাটাই পৃথিবীর ইতিহাসের আরেকটি অংশ।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলো, বা কওমি বা ট্র্যাডিশনাল ইসলাম পন্থীরা ‘মৌলিকভাবে’ কখনো রাজনীতিতে ছিলোনা, আমার আমার কথাটা আবার বলছি, “বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলো, বা কওমি বা ট্র্যাডিশনাল ইসলাম পন্থীরা মোলিকভাবে কখনো রাজনীতিতে ছিলোনা।“

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব কালে, এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে, সময়ের প্রেক্ষাপটে, কওমি ওলামারা রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। এটাকে যদি কেউ আরও পেছনে নিতে চান, কওমি ওলামাদের অগ্রজ বা বড় ভাই, ওলামায়ে দেওবন্দ এর রাজনৈতিক ভূমিকা অনেকটা সে রকম। যদিও এটা সত্য, দারুল উলুম দেওবান্দের মুহতামিম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানি এবং তাঁর পুত্র আল্লামা আসাদ মাদানি দুজনেই ভারতীয় কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন এবং কংগ্রেস সদস্য ও ছিলেন।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্বকালে নেজামে ইসলামি সহ দেওবন্দি ধারার কয়েকটি দল, রাজনীতির সাথে আংশিকভাবে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে নেজামে ইসলাম কিতাব মার্কায় নির্বাচন করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালের আগে কওমি ধারার আলেমরা রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রাখেন নি। ১৯৮১ সালে আল্লামা মোহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর বট গাছ মার্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে তওবার রাজনীতি শুরু করেন এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামে নূতন দল গঠন করেন। বলা বাহুল্য হাফেজ্জি হুজুরের সে নির্বাচন এবং খেলাফত আন্দোলন, সে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু বাংলাদেশে নয় আন্তর্জাতিকভাবে এমন টনক সৃষ্টি করেন যে, সে সময় ইরান ইরাক যুদ্ধের প্রক্ষাপটে হাফেজ্জি হুজুর তাঁর ১০ সদস্যার প্রতিনিধি নিয়ে ইরান এবং ইরাক সফর করেন এবং যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে কথা বলেন। তারপর সময়ের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের চিরাচরিত রাজনীতি এবং অন্য অনেকগুলু দলের মত খেলাফত আন্দোলন একাধিক ভাগে ভাগ হয় এবং ভূমিকা খীন হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে খেলাফতের গুরুত্ব কমলেও শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হোক এবং বাইতুল মোকাররমের খতিব আল্লামা ওবাইদুল হক একদিকে আলেম হিসাবে যেমন ছিলেন শিরোমণি, তেমনিভাবে তাঁদের বাক্তিত্বের কারণে তাঁরা রাজনীতিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এবং খতিব ওবাইদুল হক (রা) একদিকে তাঁদের ক্লাসিকাল ইলম অপরদিকে বাক্তিত্তের কারণে চির স্মরণীয় থাকবেন।

২০১০ সালে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়ে হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়। ২০১১ সালে তারা বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতি (২০০৯) এর কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে।

২০১৩ সালে তারা ইসলাম ও রাসুলকে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবী করে ব্যপক আন্দোলন ও সমাবেশ শুরু করে। এ প্রেক্ষিতে তারা ১৩ দফা দাবী উত্থাপন করে।

৫ই মে, ২০১৩ হেফাজতে ইসলাম সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ করে এবং ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরে তাদের প্রথম সমাবেশ করে। এই সমাবেশে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। শাপলা চত্বরে এবং বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের সাথে আইনশৃঙ্খলারক্ষী বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং কিছু হতা-হতের ঘটনা ঘটে, হতাহতের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কেউ দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সময় বেঙ্গ করে বলেছিলেন, হেফাজতের কর্মীরা রং মেখে শুয়ে ছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগ এবং সরাকারের অংশ অনেকেই আল্লামা শফি এবং হেফাজত সম্পর্কে অনেক অপমানকর কথা বার্তা বলে, সরকারের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রকাশ্যে তেঁতুল তুলে অনেক আজে বাজে মন্তব্য করতেন।

২০১৩ সালের সেই রক্তাক্ত রাতের ঠিক ৫ বছর পড় সম্প্রতি ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য হেফাজতের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে ৪ নভেম্বর ২০১৮ ঢাকায় শোকরানা মাহফিল। এই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে 'কওমি জননী' উপাধি দেয়া হয়।

৪ নভেম্বরের শোকরানা মাহফিল নিয়ে পত্র পত্রিকাগুলোর খুব বেশি একটা মাতবোল না থাকলে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরব। ব্যাপারটা বুঝতে কার অসুবিধা হবার কথা নয় যে সোশ্যাল মিডিয়ার এই সরব ভূমিকা বিশেষভাবে জামাত এবং বি,এন, পি কর্মী সমর্থকদের। অনেক কড়া সমালোচনার মধ্যে গালাগালি ও রয়েছে। আল্লামা শফি সাহেবকে কেউ কেউ। ব্যাপারটাকে রাজনিতিকভাবে দেখলে মনে হতে পারে হেফাজত বা আল্লামা শফি সাহেব বি, এন, পি, জামাতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। অপরদিকে রাজনীতিতে পরিপক্ব আওয়ামী লীগ সুযোগটাকে ঠিক মত কাজে লাগিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে হাজার মন্তব্যের মাঝখানে একটি মন্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বলা যায় আমার এ লেখা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। কামাল হোসেন বাদল নামে এই ব্যাকতি ওই কমেনটে হেফাজত সম্পর্কে লিখেছেন “উনারা ভাড়া খাটেন শাষক-শোষকদের পক্ষেে, যখন যেখানে বেশী সুবিধা পান সেখানেই যান।“ যিনি করেছেন, তাঁর ফেইসবুক এ গিয়ে তাঁকে আওয়ামী ঘেঁষা বাম পন্থী বলেই মনে হয়েছে। হেফাজত সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে আল্লামা শফি সাহেব সহ কওমি আলেমদের কাছে আমার প্রশ্ন, “ কি প্রয়োজন ছিল?” ২০১৩ সালেই আপনারা কেন এমন পদক্কেপ নিলেন যেটা আপনাদেরকে রাজনীতির প্যাঁচে ফেলবে আর এখন আবার ঘটা করে এত শোকরানার কি হয়ে গেল। “কওমি মাতা” কথাটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না কি ?” খোদার কসম আমার অনেক বন্ধু বান্ধব দের সাথে আমার মন মালিন্য হয়েছিল আল্লামা শফি সাহেবের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে, যখন তেঁতুল নিয়ে ইনু সাহেবরা ইঙ্গ বেঙ করে অপমানজনক কথা বলছিলেন, অনেক অভিযোগ করেছে আল্লামা শফি সাহেবের ছেলেকে নাকি রেলের জমি দেয়া হয়েছে, আল্লামা শফি সাহেবের ছেলেকে নাকি ব্যাবসা বাণিজ্য দেয়া হয়েছে। খোদার কসম আমি অনেকের সাথে প্রতিবাদ করেছি ঝগড়া করেছি, আমি মনে করেছি এখন করি এগুলো মিথ্যা, এগুলো রাজনীতি। আমি সামনে এ বিশ্বাস্য করতে চাই। কিন্তু আমি আল্লামা শফি সাহেব সহ কওমি ওলামা এবং ওলামায়ে দেওবান্দকে এ প্রশ্ন করতে চাই। আপনারা কি কওমি সত্য সত্যি সনদদের এত মুখাপেক্ষী ছিলেন, এই সনদ কি আপ্নাদেরকি এতয় উপরে তুলে দিল যে শেখ হাসিনা আপনাদের মাতা হয়ে গেল? না, হুজুর, আমি দেওবান্দি পরিবার সন্তান হিসাবে বলছি, আমি মনে করি ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। এটা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যে কোন কওমি আলমের জন্য বেদনার বিষয়।

আপনারা নিজেদেরকে এতই খেলনার পাত্র বানাতে পারলেন? আমি জামাত বি,এন,পি কর্মীদের অনেক কড়া মন্তব্য দেখেছি, গালাগালি জাতীয় শব্দও দেখেছি, সেগুলো দেখেও কষ্ট পেয়েছি, প্রতিবাদ করেছি। সেটাকেও অন্যায় মনে করেছি এবং করি। জামাত বি,এন,পির কর্মীরা যে কত দেউলিয়া হয়েছে সে সব কমেন্ট পড়লেই বুঝা যাবে।

তবে ওলামায়ে দেওবন্দ, কওমি ওলামাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন, আপনারা আজ যা করেছেন, তার কি খুব প্রয়োজন ছিল? কি দরকার ছিল ২০১৩ সালে লঙ মার্চ করার যদি সেটা সামাল দেয়ার মত সাধ্য আপনাদের না থাকে। রাজনীতি খুব জটিল বিষয়, যারা রাজনীতি বুঝেন না, তাঁরা রাজনীতিকদের পাঠার বলি হবার দরকার টা কি।

আমি একজন দেওবন্দি পরিবারের সন্তান, অনেক দেওবন্দি ওস্তাদের ছাত্র, আমার বাবার মুখে দেওবান্দের অনেক ঘটনা শুনেছি যেগুলো খুবই অনুপ্রেরনার। আমি খতিব আল্লামা ওবায়দুল হকের কাছে কয়েকবার জাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যে কারণে খতিব সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম সেঁতা ছাড়া আমার বাবার পরিচয়ে দেওবান্দ সম্পর্কে কথা এসেছিল, এক পর্যায়ে খতিব সাহেব বললেন, বাবা তিরিশ বছর আগে দেওবান্দ থেকে চলে এসেছি এখন দেওবান্দ আমাদের অনুপ্রেরণা।

সনদের স্বীকৃতি কি আসলেই এত বড় ব্যাপার? বাংলাদেশে কওমি ওলামারা কি সন্দের স্বীকৃতির ব্যাপারে এতই মুখাপেক্ষী ছিলেন? আল্লামা শফি সাহেব সহ “কওমি মাতা” খেতাবধারীদেরকে সর্বশেষ আরেকটি প্রশ্ন করে শেষ করতে চাই, আজ ৫ই নভেম্বর, ২০১৮, আমি প্রশ্ন করছি, দেখতে চাই আপনারা কতদিন এই উল্লাসে দিন কাটান, এঁর কতদিন আপনারা নিজেরা একত্রে থাকতে পারেন। আল্লাহ পাক আপনাদেরকে হেফাজত করুন।

বিষয়: বিবিধ

৯৩৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386117
০৬ নভেম্বর ২০১৮ রাত ০৮:৪৭
শেখের পোলা লিখেছেন : আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির কাছে নত হওয়া মুসলীমের কাম্য নয়। যারা করে তারা আর যাই হোক দুনিয়া পরস্ত হতে বাধ্য।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File