ইসলামে নারীর অবস্থান- এবনে গোলাম সামাদ

লিখেছেন লিখেছেন জেমস বন্ড ০০৭ ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:২৪:৪৫ দুপুর

নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্যটা প্রধানত শারীরিক। এ ক্ষেত্রে কোনো সমাজনীতি পারে না এই পার্থক্যকে ঘুচিয়ে দিতে। কেননা, এই পার্থক্যের উদ্ভব ঘটেনি প্রাতিষ্ঠানিক কারণে। এই পার্থক্যকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। নারী-পুরুষ জন্মগতভাবেই ভিন্ন। নারীরা সন্তান ধারণ করেন। মানবপ্রজননের ক্ষেত্রে জনক-জননীর ভূমিকা এক নয়, যদিও নর-নারীর যৌনমিলনের ফলে জন্ম হয় মানবশিশুর। মানবশিশু মাতৃদুগ্ধ পান করে। মায়ের সাথে থাকে সন্তানের খাদ্যসম্বন্ধ, যা থাকে না পিতার সাথে। সমাজে নর-নারীর ভূমিকা এক হতে পারেনি প্রধানত সন্তানের জন্মদানে ও প্রতিপালনে, আর পুরুষ ও নারীর বড় ধরনের প্রাকৃতিক পার্থক্য থাকারই কারণে। প্রজনন ছাড়াও পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য থাকতে দেখা যায়। ছেলেশিশুর চেয়ে গড়পড়তা মেয়েশিশুর ওজন হতে দেখা যায় বেশি। পুরুষের পেশিশক্তি নারীর পেশিশক্তি অপেক্ষা বেশি। গড়পড়তা একজন পুরুষ যে পরিমাণ ভার উত্তোলনে সক্ষম, একজন গড়পরতা নারী সে রকম ভার উত্তোলনে সক্ষম নন। পেশিশক্তির দিক থেকে পুরুষ নারীর তুলনায় অধিক ক্ষমতার অধিকারী। আর এক কথায়, নারীর চেয়ে গড়পড়তা পুরুষের গায়ের জোর বেশি। নারীরা যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে, পুরুষেরা সেই পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে না। নারীর চেয়ে পুরুষকে অধিক খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা জীবনে কথা বলে বেশি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বাকপটু বেশি। ছেলে ও মেয়ের পার্থক্য তাই নানা দিক থেকেই আছে, যে পার্থক্য রাষ্ট্রিক আইন করে উঠিয়ে দেয়া যাবে না। আর সেই চেষ্টা করতে যাওয়াটাও হবে ভুল। এসব কথা বলতে হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীস্বাধীনতা হয়ে উঠেছে একটা বিশেষ ইস্যু।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। শোনা যাচ্ছে, রাশিয়া ও তার সাথে যুক্ত থাকা ১৪টি রিপাবলিকের নারীরা এখন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন আরো গৃহমুখী। গড়তে চাচ্ছেন সুখী পরিবার। চাচ্ছেন শান্তিতে ঘরকন্না করতে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে কম্যুনিস্ট পার্টি বলছে, নারীদের ঘরসংসারে আটকে থাকা চলবে না। কারণ, তাহলে নারীদের করতে হবে পুরুষের বশ্যতা স্বীকার। তারা রাজনীতি করতে চাচ্ছেন নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। তারা বলছেন, ইসলাম নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী। কারণ, ইসলাম চায় নারীরা থাক গৃহমুখী হয়ে। এক কথায় গৃহবন্দী হয়ে। তারা ঘরের কাজকে দেখছেন ছোট করে। কিন্তু বাইরের কাজকে দেখছেন বড় করে। এ ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর মতাদর্শের দেখা দিচ্ছে সঙ্ঘাত। রাজনৈতিক কারণে তাই ইসলামে নারীর অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা সবার জন্যই আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। আসলে ইসলামে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে নারীর বিশেষ মূল্য। একসময় সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে মেয়ে জন্মালে তাকে মেরে ফেলা হতো; কিন্তু ইসলামে এভাবে মেয়েশিশু নিধনের বিরোধিতা করা হয়েছে। কুরআন শরিফে এভাবে মেয়েশিশু নিধনকে চিহ্নিত করা হয়েছে খুবই পাপকাজ হিসেবে। সাধারণভাবে বলা হয়েছেÑ মেয়েশিশু জন্মালে মুখ কালো কোরো না (সূরা ১৬ : ৫৮,৫৯)। কুরআন শরিফে স্বামীকে স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ, ইসলামি মতে, স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ করতে বাধ্য। যেহেতু স্বামীর আয়ে সাধারণত সংসার চলে, তাই স্বামীকে দেয়া হয়েছে স্ত্রীর ওপর কিছুটা কর্তৃত্ব করার অধিকার। কিন্তু এই অধিকার সীমাহীন নয়। কারণ, কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ নারীদের পৃথকভাবে সম্পত্তি রাখার অধিকার আছে। সেই সম্পত্তি থেকে আয় তার নিজের। এই আয়ের ওপর তার স্বামীর কোনো অধিকার নেই। মুসলিম মেয়েদের দেয়া হয়েছে স্বাধীনভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার বিশেষ অধিকার। তাই মেয়েরা যে অর্থনৈতিকভাবে কেবলই স্বামীনির্ভর, তা বলা চলে না। যদিও ইসলামে সম্পত্তির ওপর মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত, তবু কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ সম্পত্তি থেকে এবং নিজের শ্রমের আয় থেকে অভাবী মানুষ, অনাথ শিশু ও হঠাৎ বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে। ইসলামে যেমন সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি আবার বলা হয়েছে পরার্থপর হতে। বৃদ্ধ মাতা-পিতার ভরণপোষণ করতে, আত্মীয়স্বজনকে প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য দিতে। কেবল আত্মীয়স্বজনকেই নয়, পাড়াপ্রতিবেশীকেও সাহায্য করতে বলা হয়েছে। এই সাহায্যকে ধরা হয়েছে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে (সূরা : ৪ : ৩২-৩৬)। ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সৎক্রিয়াকে। সৎক্রিয়া বা ভালো কাজ বলতে ইসলামে সেই সব কর্মকে বোঝানো হয়েছে, যা মানুষকে বাঁচতে ও সুখী হতে সাহায্য করে। বেঁচে থাকার মাপকাঠি দিয়েই ইসলামে ভালো কাজ আর মন্দ কাজের বিচার হবে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, ভালো কাজের জন্য নারী ও পুরুষ উভয়েই আল্লাহর কাছে সমভাবে পুরস্কৃত হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবেন না ( সূরা ৩৩ : ৩৫)। অর্থাৎ নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্যকে কখনোই বিরাট করে তোলার চেষ্টা করা হয়নি। নারী ও পুরুষকে দেয়া হয়েছে ভালো কাজে উৎসাহ। বলা হয়েছে, মর্তে যারা ভালো কাজ করবে, তারা সবাই বেহেশতে যাবে। মানুষের মর্তের কাজ দিয়েই বিচার করা হবে কে বেহেশতে যাবে, আর কে দোজখে। মর্তের জীবনকে ছোট করে দেখা হয়নি ইসলামে। ইসলামে বলা হয়েছে সম্পদ মানুষের জন্য; মানুষ সম্পদের জন্য নয়।

এসব কথা বলতে হচ্ছে এই জন্য যে, এই দেশের বাম বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে, ইসলাম হচ্ছে একটি দক্ষিণপন্থী ধর্ম। কিন্তু ধর্ম হিসেবে ইসলামের অবস্থানকে বামের সাম্যবাদের কাছাকাছি। কারণ, ইসলাম চেয়েছে সম্পদের সামাজিকীকরণ। তবে ইসলামে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাকে অস্বীকার করা হয়নি। কারণ, তা হলে মানুষের কর্মোদ্যম ব্যাহত হবার সম্ভাবনা থাকে। ইসলামে সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। অন্য দিকে আবার চেষ্টা করা হয়েছে সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয়কে সামাজিকীকরণ করার চেষ্টা। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, মুসলমানদের হতে হবে মধ্যপন্থী (সূরা-২: ১৪৩)। বলা হয়েছে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি না করতে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার বলছে যে, দেশে ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় এলে নারীরা সুবিচার পাবেন না। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় নারীরা কি সুবিচার পেতে পারছেন? বাংলাদেশে আয়ের একটা বড় উৎস হচ্ছে বিদেশে তৈরী পোশাক রফতানি (শতকরা ৭৬ ভাগ)। তৈরী পোশাক শিল্পে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের শতকরা ৮০ ভাগ হলো নারীশ্রমিক। এদের কাজ করতে হচ্ছে খুবই বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে। ঢাকার সাভারে ইমারত ভেঙে পড়ে মারা গেলন বহুসংখ্যক নারীশ্রমিক। তাদের প্রায়ই নানা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হতে হচ্ছে যৌননিপীড়নের শিকার। সরকার এ বিষয়ে থাকছে উদাসীন। আমরা হংকং পাঠাতে চাচ্ছি নারীশ্রমিক। যারা সেখানে গিয়ে করবে চাকরানীর কাজ। জানি না ওই বিদেশে নারীশ্রমিকদের পড়তে হবে কতটা ঝুঁকির মধ্যে। আমরা পর্যটন শিল্পের উন্নতি ঘটাতে চাচ্ছি। ভাবছি পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়ে যথেষ্ট আয় করার কথা। কিন্তু পর্যটন শিল্প বাড়াতে গিয়ে অনেক দেশেই ঘটেছে গণিকাবৃত্তির প্রসার। হচ্ছে সমাজজীবনের ক্ষতি। ইসলামপন্থী দলগুলো নারীদের দারিদ্র্য বিমোচন চায়; কিন্তু ঠিক এভাবে নয়। অনেক কাজ আছে, যা নারীরা ঘরে বসেই করতে পারেন। যেমন সুইজারল্যান্ডের নারীরা ঘরে বসেই তৈরি করেন হাতঘড়ির নানা অংশ। কোম্পানির লোক বাড়ি বাড়ি এসে তাদের কাছ থেকে ঘড়ির ওই সব অংশ কিনে নিয়ে বানায় সম্পূর্ণ ঘড়ি। দেশ-বিদেশে ঘড়ি বেচে সুইজারল্যান্ড প্রভূত পরিমাণে আয় করে থাকে। একসময় এ দেশে মুসলমান মেয়েরা বাড়িতে সেলাইফোঁড়াই করে অর্জন করেছেন অর্থ। তারা বানিয়েছেন সুজনি, বানিয়েছেন নকশিকাঁথা। খ্যাতি পেয়েছে দেশ-বিদেশে। নারীরা অনেক কিছু ঘরে বসেই চিরচেনা পরিবেশে করতে পারেন, যা বাড়াতে পারে তাদের আয়। যেমন, তারা করতে পারেন মৌমাছির চাষ; করতে পারেন গো পালন। ঘি-মাখন তৈরি। কুটির শিল্পে তারা রাখতে পারেন বিরাট অবদান। বলা হচ্ছে, ইসলামপন্থী দলগুলো চায় না নারীরা রাজনীতি করুক। ইসলামপন্থী দলগুলো দেশে নারীনেতৃত্বের বিরোধী। কিন্তু এ রকম ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, কোনো ইসলামপন্থী দলই বলছে না নারীদের ভোটাধিকার কেড়ে নেবার কথা।

বিষয়: বিবিধ

১৫৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File