অধ্যক্ষ মাসউদ খানের স্বপ্ন --- ফরীদ আহমদ রেজা

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ৩১ আগস্ট, ২০১৪, ০৩:৫৮:৫৬ রাত

আমাদের গর্ব এবং প্রিয়মুখ অধ্যক্ষ মাসউদ খানকে সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জেনে আমরা পুলকিত। এ আয়োজনের সাথে জড়িত সবাইকে তাদের মহতি উদ্যোগের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

বর্তমানে আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি যখন মানুষ খাঁটি সোনার চেয়ে চকচকে জিনিস অধিক পছন্দ করে। জ্ঞানীর মজলিসে বসার সময় আমাদের নেই, অথচ যে কোন ভাঁড়ের সমাবেশে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করতে দ্বিধা করি না। ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকারী লুটেরাদের দাপটে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। একজন শিক্ষাবিদ বা পন্ডিতের চেয়ে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পপতি বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী আমাদের কাছে অধিক সম্মানের পাত্র। যারা সততার পথে চলে আমরা তাদের বোকা মনে করি, পাত্তা দেই না। অসৎ ও লুটেরাদের আমরা খাতির-তোয়াজ করি। মাসউদ খান সরকারের কেউ-কেটা নয়। মন্ত্রী নয়, আমলা নয় এবং কখনো ছিলেন না। তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ও মর্যাদা থাকলেও তিনি অর্থ-বিত্তের মালিক নহেন। তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে নগদ অর্থ অথবা কারো কাছ থেকে কৃপাদৃষ্টি বা আনুকুল্য লাভের সুযোগ নেই। এমনি পরিস্থিতিতে অধ্যক্ষ মাসউদ খানের জন্যে সংবর্ধনার আয়োজন অত্যন্ত আনন্দের একটি বিষয় এবং উদ্যোক্তারা এ জন্যে অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

বিয়ানীবাজার থানার ঐতিহ্যবাহী কাকরদি গ্রামের খান পরিবারে অধ্যক্ষ মাসউদ খানের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষ শের খান কাঁকর পাঠান শাসক ও সৈনিক ওসমান খানের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। ওসমান খানের সৈন্যবাহিনীর সাথে আফগানিস্তানের কাঁকর এলাকা থেকে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং সিলেটে এসে বসতি স্থাপন করেন। কাকরদি গ্রামের নাম ইতিহাসের সে ঐতিহ্য এখনো বহন করছে।

অধ্যক্ষ মাসউদ খান ভাষা সৈনিক ছিলেন। কিন্তু এটাই তাঁর প্রথম এবং শেষ পরিচয় নয়। ভাষা আন্দোলনের সাথে বাঙালির আবেগ এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে হয়তো উদ্যোক্তারা এ পরিচয়ে মাসউদ খানকে সংবর্ধনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মাসউদ খান একজন কর্মবীর এবং মননশীল মন ও সুন্দর মেজাজের একজন মানুষ। সততা, ন্যায়পরায়নতা, মানবতাবোধ, সংবেদনশীলতা, সারল্য, খোশমেজাজ, বিনয়, প্রজ্ঞা, উদারতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা, কর্মস্পৃহা প্রভৃতি মৌলিক মানবিক গূণের আশ্চর্য সংমিশ্রণ আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পাই। তবে তাঁর আসল পরিচয় তিনি একজন খাঁটি পন্ডিত। মাসউদ খান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র ছিলেন। দর্শনকে বলা হয় মাদার অব ওল সাইনসেজ, সকল বিজ্ঞানের মা। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার কারণে তাঁর জন্যে জ্ঞানের সকল দরজা উন্মূক্ত হয়ে গেছে। আইন শাস্ত্র অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করেছেন। তবে তাঁর ব্যক্তিগত পড়াশোনার ক্ষেত্র অনেক বেশি গভীর এবং বিস্তৃত। ইতিহাস, ধর্ম, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি - সকল বিষয়েই তিনি সমান আগ্রহে পড়াশোনা করেন। তাঁর পিতা মওলানা ফৈয়য়াজ খানের তিনি সার্থক উত্তরসুরী।

তবে আমরা নিশ্চয়তা সহকারে বলতে পারি, পান্ডিত্য, বিভিন্ন পদ-পদবী বা বংশ-মর্যাদা মাসউদ খানকে অহঙ্কারী করেনি, বিনয়ী করেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন,

‘কহিল কঞ্চির বেড়া ওগো পিতামহ

বাঁশঝাড়, নুয়ে তুমি পড়ো অহরহ।

আমরা তোমারই বংশের ছোট ছোট ডাল,

তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল।’

হাঁ, শেকড়চ্যুত কঞ্চি সব সময় মাথা উঁচু করে রাখে, কিন্তু বাঁশঝাড়ের মাথা নুয়ানো থাকে। আমরা জানি, যে গাছে ফল ধরে, সে গাছের ডাল অবনত থাকে। মাসউদ খানের জ্ঞান তাঁকে অবনত করেছে এবং আত্মমর্যাদা দান করেছে। যারা তাঁর সহকর্মী এবং আমরা যারা নানা উপলক্ষে তাঁর সান্নিধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি তারা সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। তিনি নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু অহঙ্কারী নহেন, বিনয়ী।

মাসউদ খানের জ্ঞান তাঁকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি বৈরাগ্যবাদী হয়ে যাননি। তিনি এক অর্থে দরবেশ হলেও এমন দরবেশ যার মধ্যে অর্থ-বিত্ত এবং ক্ষমতার মোহ নেই। তাঁর আত্মসম্মানবোধ এতোটা তীব্র যে অর্থ বা ক্ষমতার কাছে তিনি আত্মসমর্পন করেননি। বিত্ত তাঁকে খরিদ করতে পারেনি, ক্ষমতা তাঁর নিকট থেকে কুর্নিশ আদায় করতে পারেনি। জোব্বা গায়ে এবং তসবিহ হাতে যারা প্রদর্শনী করে বেড়ায় তারা দরবেশ নয়, এ রকম ব্যক্তিই আসল দরবেশ।

জীবন-যাত্রায় বা চলনে-বলনে মাসউদ খান দরবেশ হলেও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে জীবন-যাপন করেন না। কিশোর বয়স থেকে শুরু করে উনাশি বছর বয়সে এসেও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিজের মেধা ও শক্তিকে উজাড় করে দিচ্ছেন। কারণ তাঁর নীতি হচ্ছে, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, বরং ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ।’

আমাদের গর্ব অধ্যক্ষ মাসউদ খানকে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা জানলেও অনেকে তাঁকে এখনো আবিস্কার করতে পারিনি। তাঁর লেখা কোন বই প্রকাশিত হয়েছে বলে আমরা জানি না, যদিও নামে-বেনামে তিনি অনেক লেখালেখি করেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে প্রকাশিত ‘তোমরা রব্বানী হইয়া যাও’।

অভিজাত বংশের সন্তান অধ্যক্ষ মাসউদ খানের কথা বলতে গেলে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তাঁর আব্বা মাওলানা ফৈয়য়াজ খান থেকে শাইনিং জুয়েল স্কুল পর্যন্ত তা বিস্তৃত। তাঁর ভাই সা’দত খান এবং স্ত্রী সৈয়দা সুরাইয়াও সেখানে আছেন। আছেন শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসেইন আহমদ মাদানী, আল্লামা আবুল হাশিম, ইমাম খোমেনী, মাওলানা ভাসানী, হাফেজ্জী হুজুর, অধ্যক্ষ আজরফ প্রমুখ। তাদের সাহচর্য ও সান্নিধ্য মাসউদ খানকে সমস্যা-সংকুল জীবন পথে আদর্শকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।

কর্মজীবনে মাসউদ খান বহুমুখি কাজ এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর প্রতিকৃতি নির্মাণে এ সকল কাজ ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিশোর বয়সে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এক সময় সিলেটে দুগ্ধ খামার এবং ঢাকায় সিটি আর্ট প্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন। প্রথমে বামধারার ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরে ইসলামী ধারার তমদ্দুন মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ডিস্ট্রিক বোর্ডের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। সিলেট বারের আইনজীবী, মদনমোহন কলেজের শিক্ষক ও ভাইস প্রিন্সিপাল এবং সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ব্লুবার্ড স্কুল পরিচালনা বোর্ডের সেক্রেটারী ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরিচালক হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।

মাওলানা মাদানীর সাথে মাসউদ খানের পিতা মাওলানা ফৈয়য়াজ খানের ঘনিষ্টতা ছিল। তাই তরুণ বয়সে তিনি মাওলানা মাদানীর সান্নিধ্য লাভ করেন। বড়ভাই সা’দত খান ছিলেন সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পন্ডিত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সে সুবাদে মাসউদ খান সিলেটের সমসাময়িক পন্ডিত ও উদীয়মান রাজনীতিকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান। তবে মাসউদ খানের মানস গঠনে তাঁর পিতার পর তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আবুল হাশেম এবং রাজনৈতিক মাঠের লড়াকু সৈনিক মাওলানা ভাসানীর অবদান সব চেয়ে বেশি বলে আমাদের মনে হয়। তমদ্দুন মজলিসের সাথে যোগাযোগের ফলে তিনি খলিফা ওমর এবং বিপ্লবী সাহাবী আবু জর গিফারীর মধ্যে তিনি নিজের অনেক জিজ্ঞাসার জবাব অন্বেষণ করেন। এক সময় ইরানের ইসলামী বিপ্লব তাঁর মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইরান বিপ্লবের প্রাণপুরুষ ইমাম খোমেনীর সাথে সাক্ষাতের জন্যে সুদূর ইরানে গিয়ে হাজির হন। মাওলানা ভাসানীর সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে নতুন ভাবে শোষণহীন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তিনি খেলাফত মজলিসে যোগ দেন। এ ভাবে জীবনের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে শিক্ষকতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, রাজনীতি, ব্যবসা-বানিজ্য, আইন ব্যবসা প্রভৃতি নানামুখি তৎপরতার সাথে জড়িত থেকে মাসউদ খান অভিজ্ঞতার ভারে সমৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর জ্ঞান হয়েছে আরো ঋদ্ধ এবং যোগ্যতা হয়েছে আরো শাণিত।

অধ্যক্ষ মাসুদ খান জীবনপথে চলতে গিয়ে অনেক বাঁধা-বিপত্তি এবং সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। সংকটের সময় তিনি নিজের আত্মীয় ও বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি তাঁর জীবন-সঙ্গী সৈয়দা সুরাইয়া মাসউদের নিকট থেকে। বিশেষ করে মাওলানা ভাসানীর আহবানে সিলেটে নিজের বাসা ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তোষে চলে যাওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেখান থেকে ঢাকায় গমন, আবার ঢাকা থেকে সিলেটে প্রত্যাবর্তন এবং সর্বোপরি নিজের যুবক ছেলের অকস্মাৎ ইন্তেকালের মুহুর্তে সুরাইয়া মাসউদের সহমর্মিতা, সহযোগিতা, আশ্বাস ও সাহস মাসউদ খানকে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সহায়তা করেছে। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সুরাইয়া মাসউদ বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রামের আইনজীবী সৈয়দ আওসাফ হোসেনের মেয়ে এবং তিনি নিজেও উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। মাসউদ-সুরাইয়া জুটি চিন্তা-চেতনা এবং জীবন-যাপনের বিভিন্ন ব্যাপারে একই মনোভাবের অধিকারী। মাসউদ খান মানুষের ব্যক্তি, সামষ্টিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্নের সহযোগী হিসেবে তিনি সুরাইয়া মাসউদকে পেয়েছেন। এ দিক দিয়ে মাসউদ খানকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলতে হবে। তারা দুজনই জীবন এবং পুস্তকের অনুরাগী পাঠক। তবে একটুখানি ব্যতিক্রম সেখানে আছে। মাসউদ খানের লেখালেখির অভ্যাস তেমন নেই। কিন্তু সুরাইয়া মাসউদ ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।

মাসউদ খানকে সংবর্ধনা প্রদানের আনন্দঘন সময়ে তিনি কি ধরণের সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন সে বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করা আমাদের বিবেচনায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অধ্যক্ষ মাসউদ খান একটি বৈষম্যমুক্ত শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। নিছক এ উদ্দেশ্যে তিনি তরুণ বয়সে প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরে তমদ্দুন মজলিসের যুবফ্রন্ট ছাত্রশক্তির সাথে জড়িত হন। নেতৃত্বের সকল ধরণের সুযোগ এবং যোগ্যতা থাকলেও নেতৃত্ব বা মানুষের বাহবা অর্জনের খাহেশ তাঁর মধ্যে ছিল না। নেতৃত্ব বা অর্থ-বিত্ত তাঁর কাম্য হলে স্বাধীনতা-পূর্ব বা স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে তিনি যে কোন সরকারী দলে যোগ দিতে পারতেন। মাওলানা ভাসানীর খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং পরবর্তী সময়ে খেলাফত মজলিসের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নেপথ্যে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্যে কাজ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

আমরা তমদ্দুন মজলিসকে ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী দল হিসেবে জানি। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামী ধারার রাজনীতির সাথে তমদ্দুন মজলিসের কি পার্থক্য ছিল তা আমরা অনেকে জানি না। তমদ্দুন মজলিসের সামনে ছিল খলিফা ওমর (রা) এবং মহানবী (স)-এর আরেক সাহাবী আবু জর গিফারী (রা)-এর আদর্শ। তারা সাহাবী আবু জর গিফারির নামে ঢাকায় একটি কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের মতে রাষ্ট্র পরিচালনা, জবাবদিহিতা, জনকল্যাণ, রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচন ইত্যাদির ক্ষেত্রে খলিফা ওমর (রা) ছিলেন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক। অপর দিকে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আবু জর গিফারীর মতামতকে তারা প্রাধান্য দিতেন। আবু জর গিফারীর মতে, ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নিজের অধিকারে রাখার অধিকার কারো নেই। অতিরিক্ত সম্পদ গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে অথবা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। তাঁর এ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি কুরআনের একটি আয়াত পেশ করতেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের কঠিন শাস্তির খবর দাও।’ (সুরা তওবাঃ ৩৪) খলিফা ওমরের পর মুসলমানদের মধ্যে প্রাচুর্য আসে এবং এর ফলে বিত্তশালী ও সরকারের দায়িত্ব নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিলাসিতার চিহ্ন দেখা দেয়। তখন সাহাবী আবু জর এ আয়াতের আলোকে এর কঠোর সমালোচনা শুরু করেন।

বিংশ শতকের পরিবর্তিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোকে ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান নিয়ে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ভিন্ন ধরণের এবং বিপ্লবী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভারত বর্ষে বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মাওলানা আজাদ সুবহানী তাদের মধ্যে একজন। বিংশ শতকের শুরুর দিকে উত্তর প্রদেশের কানপুরে মওলানা আজাদ সুবহানী এবং মওলানা হসরাত মোহানী, এ দু বন্ধু মিলে এক শক্তিশালী কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজাদ সুবহানীর অর্থনৈতিক ফর্মুলার সাথে সমাজতন্ত্রের সাযুজ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

আমরা জানি, পুজির শোষনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। ধন-সম্পদ কেন্দ্রিভূত করে রাখা এবং মজুতদারী ও মুনাফাবাজীর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থানের মধ্যে অস্পষ্টতা না থাকলেও ইসলামের অনুসারী অথবা ইসলামী দলসমূহের কর্মসূচী দেখে তা বোঝার উপায় নেই । ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বানিজ্য, ফল-ফসল, জমি-জিরাত বা কল-কারখানা থেকে উৎপাদিত সামগ্রী বা লভ্যাংশে যেমন গরীবদের হিস্যা রয়েছে, তেমনি তাদের অংশ রয়েছে কুক্ষিগত সম্পদে। ইসলামের আর্থিক বিধি-বিধান এমনভাবে রয়েছে যাতে করে কারো হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে না থাকে এবং তা জনগণের মধ্যে আবর্তিত হবার সুযোগ অব্যাহত থাকে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেনীকে আরো সম্পদ কুক্ষিগত করার অবাধ সুযোগ প্রদান করেছে। এর ফলে দেশে ভূমিহীন, দিনমজুর ও গরীবদের সংখ্যা ও ভোগান্তি বাড়ছে। মেহনতি মানুষদের দুর্দশামুক্ত করার লড়াইয়ে ইসলামপন্থীদের দেখা যায় না। কেউ কেউ এ নিয়ে কথা বললেও তাদের কন্ঠস্বর এতোই ক্ষীণ যে এটা যে তাদের অগ্রাধিকবার নয় তা সহজেই বোঝা যায়। অধ্যক্ষ মাসউদ খানের মতে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পুজির এ শোষণ বন্ধ করে নিম্নবিত্তের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ইসলামী রাজনীতির জন্যে এটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শ্রমিক-কৃষক এবং সকল শ্রেনীর মেহনতি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা ইসলামের ভূমি ব্যবস্থা, জাকাত-উশর, উত্তরাধিকার আইন, উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অধিকার, আবাদী-অনাবাদী জমিতে কৃষকদের অধিকার ইত্যাদিতে রয়েছে। নামাজ-রোজা মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। কিন্তু এ সকল অর্থনৈতিক বিধান বাস্তবায়ন করে সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরনের দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। শোষণমুক্ত একটি সুখি-সমাজ বিনির্মাণের জন্যে মাসউদ খান সব সময় চরমপন্থা প্রত্যাখ্যান করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি কখনো ‘গলাকাটা’ বা ‘সন্ত্রাসী’ চিন্তা লালন করেননি। গণসচেতনতা তৈরি করে এবং জনগণকে নিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় তিনি তা অর্জন করতে চেয়েছেন।

জীবনের ঊষালগ্নে তিনি শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে লড়াইয়ের আকাঙ্খা নিয়ে বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত হন। জীবনে চলার পথে অনেক মত ও পথ এবং চড়াই-উৎরাই তিনি অতিক্রম করেছেন। কর্মক্ষেত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতা, পুস্তক-লব্ধ জ্ঞান এবং মহৎ মানবদের সংস্পর্শ তাঁর মধ্যে গণমানুষের পক্ষে লড়াইয়ের আকাঙ্খা আরো শাণিত এবং তীব্র করেছে। তাঁর উপলব্ধি হচ্ছে, ‘সমগ্র সৃষ্টি জগত আল্লাহর পরিবার; আল্লাহ্র কাছে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে প্রিয় যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবারের জন্যে সবচেয়ে উপকারী।’ স্রষ্টার আনুগত্য এবং সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা তাঁর জীবনে মূলমন্ত্র। মাওলানা ভাসানীর নির্দেশে মাসউদ খান ‘তোমরা রব্বানী হইয়া যাও’ নামক যে পুস্তিকা প্রণয়ন করেন সেখানে তিনি একই কথা বলেছেন। রব্বানী শব্দের সঠিক সহজ বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘আল্লাহ ওয়ালা’। যারা খাঁটি আল্লাহ ওয়ালা তাদের অন্তরে সকল মানুষের জন্যে ভালবাসার ফল্গুধারা প্রবাহিত থাকে। ‘যারা দয়াবান, দয়াময় আল্লাহ তাদের উপর রহমত নাজিল করেন। পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া প্রদর্শন করো, তা হলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি করুণা বর্ষন করবেন।’ অধ্যক্ষ মাসউদ খানের চিন্তাধারা ও কর্মের ব্যাখ্যা মহানবী (স)-এর এ বানী থেকে আমরা বুঝতে পারি।

এখানে আমরা অধ্যক্ষ মাসউদ খানের সাথে আলাপচারিতার আলোকে তাঁর চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি তিনি নিজের পক্ষ থেকে বই-পুস্তক লিখে তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে আমাদের অবহিত করবেন।

আমরা তাঁর সুন্দর স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

লন্ডন, ২৯ আগষ্ট ২০১৪

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

259965
৩১ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:২৮
আবু নাইম লিখেছেন : [iএখানে আমরা অধ্যক্ষ মাসউদ খানের সাথে আলাপচারিতার আলোকে তাঁর চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি তিনি নিজের পক্ষ থেকে বই-পুস্তক লিখে তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে আমাদের অবহিত করবেন। [/i]


উপরে আপনি যে বর্ণনা দিলেন. এতে মনে হয় না. উনি নিজের সম্পর্কে কিছু লিখবেন. এ সমস্ত লোকদের থেকে নিজের সম্পর্কে লেখা আদায় করে নিতে হয়.

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File