সহিংসতা না সমঝোতাঃ শিবিরের অভিজ্ঞতা - চার

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ২৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:২২:৪০ দুপুর

আমি চট্টগ্রাম আসার আগেই ছাত্রলীগ নেতা তবারক নিহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শহর শাখার ১১ জন শিবির-কর্মীকে অভিযুক্ত করে তবারক হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সারা দেশে শিবির-বিরোধী প্রচারণার খবর আমার আগেই জানা ছিল। চট্টগ্রামে আসার পর মামলা সংক্রান্ত বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়।

ঘটনাটি সংক্ষেপে এ রকম। চট্টগ্রাম কলেজে শিবিরের সাথে ছাত্র লীগের মারামারি হয়। সংঘর্ষের সময় উভয় পক্ষের কেউ কেউ আহত হলেও কেউ নিহত হয়নি। শিবিরের সাথে টিকতে না পেরে ছাত্রলীগের কর্মীরা পালিয়ে যায়। কেচ্ছা এখানে শেষ হলেও শেষ হয়নি। পরে খবর পাওয়া যায়, শহর ছাত্রলীগের নেতা তবারক নিহত হয়েছেন। তখন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিবিরকে দায়ী করে থানায় মামলা হয়। মামলায় আসামী হিসেবে তাদের নাম দেয়া হয় যারা চট্টগ্রাম কলেজে শিবিরের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। সে সময় হত্যা মামলার আসামী হিসেবে তারা পলাতক ছিলেন। কলেজে ক্লাস করতে উপস্থিত হতে পারছিলেন না, এ কারণে তাদের লেখাপড়ায় মারত্মক রকম বিঘ্ন ঘটছিলো। তারা যে ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন, পরবর্তী সময়ে এর প্রমাণ তারা দিয়েছেন। তাদের ভবিষ্যত চিন্তা করে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন ছিলেন।

মামলা নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা ছিল। মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আনন্দের বিষয়, এ মামলা পরিচালনার ব্যাপারে আমাকে কোন ঝামেলার সম্মূখীন হতে হয়নি। সকল ব্যথা মাথায় পেতে নিয়েছিলেন এএইচএম নুমান। মামলা পরিচালনা করেছেন চট্টগ্রামের নামজাদা আইনজীবী বদিউল আলম। সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মফিজুর রহমানও এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেন। সকলের সহযোগিতায় সকল অভিযুক্ত এক সময় জামিনে বেরিয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত মামলার রায় কী হয়েছে তা আমার জানা নেই। মামলার শুনানী শুরু হবার আগেই আমি চট্টগ্রাম থেকে চলে এসেছি।

এ মামলার নৈতিক দিক নিয়েও আমি চিন্তিত ছিলাম। নীতিগতভাবে আমি শান্তপ্রিয় মানুষ। মারামারি করা দূরে থাক, জীবনে কাউকে একটা চড়ও মারিনি। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র শিবিরের দায়িত্ব পালনের সময় অনেক কঠিন সময় পার করেছি। অনেক স্থানে সংঘর্ষ হবার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার উপস্থিতিতে কোথাও খুনোখুনি বা সংঘর্ষ হয়নি। কোন কারণে কাউকে হত্যা করা বা হত্যার চেষ্টা করা অথবা হত্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা বৈধ হতে পারে না। নিরপেক্ষ আদালত কাউকে ফাঁসি দিলে সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। অপরাধ যত বড় হোক না কেন, কোন অপরাধীকে হত্যা করার অধিকার আমার নেই। আমি কুরআনের সে আয়াতে বিশ্বাসী যেখানে বলা হয়েছে, যে একজন মানুষকে হত্যা করবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করলো। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যে সমান বিধান। কেউ অমুসলিম হলেও তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। যদি হত্যাকারী আমার ছেলে হয় তা হলেও তাকে রক্ষার জন্যে আমি চেষ্টা করতে পারি না। এটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কুরআনের নির্দেশ, ‘কারো প্রতি শত্রুতার কারণে তোমরা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুত হবে না।’ একই নিয়মে ছাত্র শিবিরের কেউ হত্যাকারী হলে তাকে বাঁচানোর জন্যে আমি কাজ করতে পারি না।

নিহত তবারক ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কিন্তু ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান ছিলেন। তিনি অমুসলমান ছিলেন, এর কোন প্রমাণ নেই। এক মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না। কুরআনের ঘোষণা, যে ইচ্ছে করে কোন মুসলমানকে হত্যা করবে তার আবাস হবে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। প্রশ্ন হতে পারে, যারা সেকুলার রাজনীতি করে তারা কী মুসলমান? হাঁ, তারা অবশ্যই মুসলমান যদি তারা কালেমায় বিশ্বাসী হয়। সেকুলাররা মুসলমান নয়, এটা একটা রাজনৈতিক ফতোয়া। শরিয়াতে এর ভিত্তি নেই। ছাত্র শিবির অথবা অন্য কোন ইসলামী সংগঠনের বিরোধিতা করা মানেও ইসলাম বিরোধিতা নয়। আর কেউ ইসলাম বিরোধী হলেই তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যায় না। তা ছাড়া শরিয়াতের কোন বিধান প্রয়োগ করতে হলে তা হতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে, কোন ব্যক্তি বা দলের সেটা দায়িত্ব নয়। কোন ব্যক্তি যত বড় আল্লামা হোন বা কোন দল যত বড় আল্লাহওয়ালা হোক, তাঁর বা তাদের শরিয়াতের হুদুদ প্রয়োগ করার অধিকার নেই।

আরেকটা বিষয় পরিস্কার করা দরকার। সত্যিকার কোন ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি আপনি কোথাও জেহাদ বা লড়াই করতে যান তা হলে আপনাকে কিছু মূলনীতি মেনে চলতে হবে। এর একটা হলো, শত্রুদের মধ্যে যারা পালিয়ে যাবে অথবা আত্মসমর্পন করবে তাদের আপনি হত্যা করতে পারেন না। সম্ভব হলে আটক করে নিয়ে আসতে পারেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, তবারকের সাথে লড়াই ছিল ইসলাম ও কুফরের মধ্যে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি পালিয়ে যান। এ অবস্থায় কেউ তাকে ধরে এনে হত্যা করলে তা বৈধ হতে পারে না।

তবে হাঁ, কেউ যদি ব্যক্তিগত, ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোন কারণে আপনাকে মারতে আসে তা হলে তা ভিন্ন। আপনি নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে আঘাত করেছেন এবং সে মরে গেছে। আপনাকে তখন হত্যাকারী বলা যাবে না। বলতে হবে, আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ভুলক্রমে হত্যা করে ফেলেছেন, ইচ্ছে করে হত্যা করেননি। এমতাবস্থায় আপনাকে তওবা করে রক্তপণ আদায় করতে হবে।

এ সব চিন্তা মাথায় নিয়ে আমি সে সময় তবারক হত্যার পূর্বাপর ঘটনাবলীর খোঁজ নেয়া শুরু করি। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল, যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন কি না তা বের করা। সে সময় উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজনের সাথে আমি একা একা বৈঠক করেছি। তাদের নিকট থেকে জানতে পেরেছি, তবারক চট্টগ্রাম কলেজে সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হননি। কলেজ থেকে দূরে এক ছোট গলিতে নিহত হয়েছেন। যাদের আসামী দেয়া হয়েছে তারা সংঘর্ষের পর কলেজেই অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তাদের কারো পক্ষে তবারককে হত্যা করার সুযোগ ছিল না। এ তথ্য পেয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি, তবারক নিহত হবার পর এ ঘটনাকে ব্যবহার করে চট্টগ্রাম কলেজে শিবিরকে দুর্বল করার হীন উদ্দেশ্যে সেখানকার নেতৃস্থানীয় শিবির-কর্মীদের খুনের আসামী করে মামলা দায়ের হয়েছে। সুতরাং মিথ্যা মামলার অভিযোগ থেকে তাদের মুক্ত করা আমার দায়িত্ব।

তবে তবারক নিহত হয়েছেন, এতে কোন ভুল নেই। কে তা হলে তার হত্যাকারী? হতে পারে পূর্ব-শত্রুতার জের ধরে কেউ তাকে হত্যা করেছে। তিনি নিজেদের দলীয় কোন্দলে নিহত হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোন ব্যক্তি নিহত হলে তার হত্যাকারী অন্বেষণ করা আমাদের দায়িত্ব নয়। এ দায়িত্ব পুলিশের। আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীকে খুঁজে বের করে আইনের হাতে তাকে সপোর্দ করা।

সমস্যা হলো, তবারক যে দিন নিহত হন সে দিন শিবিরের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছে। এ কারণে সন্দেহের তীর শিবিরের উপর এসে পড়েছে। এমনি অবস্থায় শিবির নিজেদের স্বার্থেই সম্পূর্ণ দায়িত্ব-মুক্ত হতে পারে না। এটা তাক্বওয়ার দাবি। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় শিবিরের কেউ এ কাজ করেছে তা হলে তওবা এবং রক্তপণ আদায় করে তাকে দায় থেকে মুক্ত করা দরকার। তা হলে আশা করা যায়, রোজ কেয়ামতে আল্লাহ তাকে এ কারণে পাকড়াও করবেন না। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে আমি এ কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি। তবে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার সময় আমার এ অভিমত স্থানীয় এবং কেন্দ্রিয় দায়িত্বশীলদের অবহিত করে এসেছি।

হত্যার ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশে কোন ধরণের অস্পষ্টতা নেই। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত হতে পারে। আর যে ব্যক্তি ভুলবশত কোন মুমিনকে হত্যা করে তার কাফ্ফারা হিসেবে একজন মুমিনকে গোলামী থেকে মুক্ত করে দিতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে রক্ত মূল্য দিতে হবে, তবে যদি তারা রক্ত মূল্য মাফ করে দেয় তাহলে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু যদি ঐ নিহত মুসলিম ব্যক্তি এমন কোন দেশের লোক হয়ে থাকে যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে, তাহলে একজন মুমিন গোলামকে মুক্ত করে দেয়াই হবে তার কাফ্ফারা। আর যদি সে এমন কোন অমুসলিম দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে, তাহলে তার ওয়ারিসদেরকে রক্ত মূল্য দিতে হবে এবং একজন মুমিন গোলামকে মুক্ত করে দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি কোন গোলাম পাবে না তাকে পরপর দু’মাস রোযা রাখতে হবে। এটিই হচ্ছে এই গোনাহের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে তাওবা করার পদ্ধতি। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানবান।

আর যে ব্যক্তি জেনেবুঝে মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর গযব ও তাঁর লানত এবং আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ (কুরআনঃ ৪ নিসা: ৯২ - ৯৩)

চলবে ....

বিষয়: বিবিধ

১৩২২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

347551
২৮ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ০৩:১৭
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
347559
২৮ অক্টোবর ২০১৫ বিকাল ০৫:৫৬
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম চমৎকার পোস্ট, জাজাকাল্লাহুল খাইরান
347569
২৮ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : যতটুক জানি তবারক হত্যা মামলার এখনও কোন ফলাফল নাই। এটা একটা অমিমাংসিত রহস্য হয়ে রয়েছে। যখন সংঘর্ষ হয় তখন কারো মৃত্যু ঘটলে এটা বলা যায়না যে কে কাকে খুন করেছে। রাইট অফ প্রাইভেট ডিফেন্স এর নিতি অনুযায়ি আমার উপর হামলাকারীকে আমি হত্যা করতে পারি যদি সেই হামলাকারির উদ্দেশ্য আমাকে হত্যা না ও হয়। এমনকি সে যদি পুলিশ ও হয় সেই অধিকার থাকে। যদিও আমাদের দেশে পুলিশকে সকল আইেনের উর্দ্ধে স্থান দেওয়া হয়েছে। আক্রমনকারিকে হত্যা করার জন্য দিয়াত প্রযোজ্য হয়না। কারন নিজেকে রক্ষা করার অধিকার সবার আছে। শুধু ইসলামি আইনেই নয় বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনেও। এমনকি কেউ কাউকে অপমান করলেও হত্যা আইনে অনুমোদিত। বৃটিশ সেনাবাহিনির একটা ঘটনা আছে প্রায় শতবর্ষ আগের। এক মেজর এক সিপাহি কে সামান্য অপরাধে অতি কঠোর শাস্তি দেয় এবং ব্যাক্তিগতভাবে অপমান করে। সেই সিপাহি অফিসারকে হত্যা করে। বিচারে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এইজন্য যে সেই অফিসার তার সিমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং অপমানিতর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আছে। যদিও আমাদের দেশে সরকারি অফিসার দের সকল কিছুর উর্ধে বিবেচনা করা হয়।
যারা মুসলিম হয়েও স্রেফ ব্যাক্তিগত স্বার্থে অন্য মুসলিমএর উপর আক্রমন করে তাদের জন্য ইসলামি বিধান কি ভাবে প্রযোজ্য হবে এই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File