বিধ্বস্ত জীবন

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১০ জানুয়ারি, ২০১৯, ০১:৪৬:২৮ দুপুর



মাত্র কিছু সিঙ্গাড়া তুলে নিয়েছিলাম। সহ্য করতে পারিনি তাই। দূর্বল দেহে বেশীদূর আগাতে পারিনি। ধরে ফেললো ওরা। ভর দুপুরের প্রচন্ড খরতাপের পিচঢালা রাস্তার উপর কি নির্দয়ভাবে মারলো ওরা। রান্না করার বড় খুনতি দিয়ে আমার দূর্বল দেহের উপর অমানসিক নির্যাতন চালালো। যারা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো, তারাও কেউ খালি হাতে, কেউ লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটালো। আমি কিছু বলিনি, বলার কোনো শক্তি আমার ছিলোনা। তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা করে লাভ নেই তা জেনেও বলছিলাম, আমাকে ছেড়ে দিন। যখন আমাকে প্রচন্ড রক্তাক্ত করা হল, কেবলই পানি খেতে চাচ্ছিলাম। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। সকল ব্যাথা উপেক্ষা করে পিপাসাটা এতই প্রবল হল যে, ওদের পা ধরে বলেছিলাম আমাকে একটু পানি দেন, আমি পানিও খাইনি, আমি অভূক্ত।

ওরা বলতে শুরু করলো, এই নেশাখোর রাস্তায় ছিনতাই করে,চুরি করে। আজ ওকে ছেড়ে দিলে কাল আবারও একই কাজ করবে। সকলে সমস্বরে সমর্থন করলো। আবারও শুরু হল মাইর। কি ভয়ানক অত্যাচার ! এর ভেতর একেকজন একেকভাবে তাদের সক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকলো। অনেকে আবার আমাকে নিয়ে নানান সব হাস্য রসাত্মক কথা বলে অন্যদেরকে হাসাতে থাকলো, আবার মারতে লাগলো। কিন্তু পানি কেউ খেতে দিলনা। আমার চোখ মেলে তাকানোর মত শক্তিও ছিলোনা। কপাল কেটে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিলো। আমার চোখ মুখ রক্তে একাকার হওয়ার পরও ওরা ছাড়লো না। আমি চিন্তা করছিলাম একটু গড়িয়ে ড্রেনে পড়তে পারলেও পচা পানি খেতে পারতাম। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টায়ও শরীর নাড়াতে পারলাম না। ওদের ভেতর কি কোনো মায়া নেই !

আমি তো সিঙ্গাড়া খাইনি। আমি কিভাবে খাব ওই সিঙ্গাড়া, আমি কি তা খেতে পারি !! আমার ৪ টা ছোট ভাই-বোন উপোস করছে কদিন হল। আমি তো পেটে পাথর বেধে থাকতে পারি। ছোটবেলা থেকে কবার পেট ভরে খেয়েছি এখনও বলে দিতে পারি, কিন্তু না খাওয়া দিনগুলোর কোনো হিসেব নেই। বিশ্বাস করেন, সিঙ্গাড়াগুলো হাতে ধরার পর মনে হচ্ছিলো একটা মুখে পুরে দেই,,, কিন্তু আমি যেন ছোট ভাইবোনদের সিম্মিলিত চিৎকার শুনতে পেলাম.......বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। খেতে পারলাম না। না খাওয়া দূর্বল শরীর, আমি কি দৌড়াতে পারি ! তাই ধরা পড়ে গেলাম।

ওরা আমাকে নেশাখোর বলে,, হ্যা আমি নেশাখোর,, ডেন্টী শুকে শুকে নেশা করি। কি করব আমি ! বাপ মা মরলো বস্তি পুড়ানোর কারনে। ধনীদের দরকার আমাদের নি:শ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও। ওরা উচু অট্টালিকা বানাবে ওখানে। ঘরে আগুন দিল। মানুষ পুড়ে মরলো,ওদের কি ! তাও তোরা কিছু খেতে দিতিস,,কিন্তু না খেতে দেবে না। আমি জানি আমি নেশাখোর। নেশাখোররা খারাপ, কিন্তু আমরা কেন নেশাখোর কেউ জানতে চায়নি। আমার শৈশব,কৈশোর ডাস্টবিনে,,আমার যৌবনও ডাস্টবিনে। আমরা ডাস্টবিনের পোকামাকড় ! পোকামাকড়েরও তো খাবার আছে, কিন্তু আমাদের নেই।

ভীড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন বলল, ওকে আর না মেরে পুলিশে দাও। আহ, কথাটা কানে যেতেই চোখে ভেসে উঠলো জেলখানার নানান খাবার দাবার। লোভাতূর হয়ে উঠলাম, ভুলে গেলাম আমার ছোট ছোট চারটা ভাইবোনের কথা। পুলিশ আসলোও ,কিন্তু আমার চার হাত পা ধরে ওদের গাড়িতে ছুড়ে ফেলে দিল। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। পুলিশ আমার গায়ের উপর পা দিয়ে বসে থাকলো। কিন্তু ওরা আমাকে থানায় নিয়ে গেলনা। পুলিশ আমাদের অবস্থা খুব ভালোই জানে। আমাদের থানায় নিয়ে লাভ নেই, শুধু শুধু খেতে দেওয়া, সময় নষ্ট। কিছুদূর গিয়ে ওরা আমাকে রাস্তার পাশে একপ্রকার ছুড়ে ফেলে দিল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম।

অনেক পরে জ্ঞান ফিরলে দেখী আমার মাথার কাছে কে যেন পাউরুটি আর কলা রেখে গেছে, সাথে পুরোনো প্লাস্টিকের বোতলে পানি। আমি গো-গ্রাসে খেয়ে ফেললাম সবটুকু। এরপর আমার ছোটছোট ভাইবোনের কথা মনে পড়ল। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বললাম,,, হে মালিক ! আমি খুব খারাপ ! আমি আপনার কোনো বান্দার ভেতরই পড়িনা, কিন্তু আমি আপনাকে ভুলিনি, আপনি যে আমার রব তা আমি সর্বদা স্বীকার করি। আপনি আমাকে আর আমার ছোট ছোট ভাইবোনদেরকে তুলে নিয়ে যান ! আপনার বান্দাদের ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে যান এই নিষ্ঠুর শহর থেকে। আমাকে হত্যা করুন !

আমার মালিক আমার কথা শুনলো না। কিন্তু তারপরও তার উপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই, আমি তো আখিরাতে কিছু পাওয়ার জন্যেই অপেক্ষায় আছি। অনন্ত কালের জীবনে আমি প্রশান্তি পেতে চাই। মানুষেরা আমাকে অত্যাচার করে মাত্র একবারই মারতে পারবে, বারবার নয়। কিন্তু যারা আমাদের উপর যুলুম করে, ওরা সেদিন মরতে চাইবে কিন্তু ওদের কোনো মরন হবেনা ! ওরা প্রচন্ড কষ্টে,আফসোসে শেষ হবে কিন্তু পেছনে ফিরতে পারবে না। সেই দিন আমি ওদেরকে দেখে নেব। আমার রব নিশ্চয়ই আমাকে ভুলবে না, আমি জানি তিনি অনেক বেশী দয়ালু। কেবল কিছু দিনের জন্যে কষ্ট দিয়ে পরিক্ষা করছেন। আমি তার ইবাদত তেমন করিনা, আমি খারাপ, কিন্তু আমি তার উপর প্রবল বিশ্বাস করি।

আমি টলতে টলতে আমার ভাইবোনদের কাছাকাছি চলে আসলাম। কিন্তু আমি ওদেরকে কি বলব ! একেবারে ছোট ৩জন তো বুঝেই না। আমি তো ওদের খাবার নিয়ে আসিনি। ওরা তো পথ চেয়ে বসে আছে। আমি কিভাবে আমার এ মুখ দেখাবো ! কিভাবে ! কিভাবে !!

বিষয়: বিবিধ

৬৩১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386323
১০ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ০৮:৩৮
আমি আল বদর বলছি লিখেছেন : মনে করে দেখ, যখন আমি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম: “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই ইবাদত করবে না; বাবা-মার জন্য সবকিছু সবচেয়ে ভালোভাবে করবে; এবং নিকটাত্মীয়, অসহায়-এতিম আর গরিব-সামর্থ্যহীনদের সাথেও; মানুষের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলবে; সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে।” এরপরও তোমাদের কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে। তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখোনি। [আল-বাক্বারাহ ৮৩]

সমাজে যত মানুষ রয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাদের দেখাশোনা করা দরকার, একটু আদর, একটু ভালবাসা দরকার, তারা হলো এতিম বাচ্চারা। একজন বাচ্চার কাছে তার বাবা-মার থেকে বেশি জরুরি আর কে হতে পারে? ছোট বাচ্চারা অসহায়, দুর্বল। তারা নিস্পাপ, তারা অবুঝ। আজকের নিষ্ঠুর সমাজে বাবা-মা ছাড়া একটি শিশুর একা একা জীবন কী ভয়ংকর কঠিন, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সমাজের অন্য যে কারো থেকে তাদের সাহায্য দরকার সবচেয়ে বেশি। আমরা যদি তাদের সাহায্যে এগিয়ে না আসি, তাহলে তারা কোথায় যাবে?

পৃথিবীর মানুষ গুলি কখন বুঝবে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা গুলি মানুষ!

চোখে পানি চলে আসলো ভাই আসলে মনটা আমার খুবই নরম এইরূপ কোনো কাহিনী শুনলে চোখে পানি আটকে রাখতে পারি না।
১২ জানুয়ারি ২০১৯ সকাল ১০:৩৫
318207
দ্য স্লেভ লিখেছেন : অনেক সুন্দর করে অনেক ভালো বিষয় বলেছেন ভাই। ানেদ ধন্যবাদ
386324
১১ জানুয়ারি ২০১৯ রাত ১২:০৯
শেখের পোলা লিখেছেন : াচচা, গল্প হলেও বাস্তবটা এমনই। এদের জন্য আমাদেরও কৈফিয়ত দিতে হবে, কারণ আমরা তাগুতীদেরই জয়ধ্বনী করে চলছি। এরা কষ্ট করে দুনিয়ার কটাদিন পার করতে পারলেই বেঁচে গেল, কিন্তু আমরা ধরা খাব কম আর বেশী।
১২ জানুয়ারি ২০১৯ সকাল ১০:৩৫
318208
দ্য স্লেভ লিখেছেন : সঠিক বলেছেন চাাচাভাই। আমাদের কৈফিয়ত আছে অনেক

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File