হঠাৎ সফর৪

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৮ জুলাই, ২০১৩, ১১:১১:১৮ রাত



আমার বাড়ি থেকে সজীবের গ্রামের বাড়ী ৬০ কি:মি:। বাসে চেপে চলে গেলাম। বাংলালিংকের টাওয়ার বসিয়েছে ওদের বাড়ির ছাদে তাই চিনতে কষ্ট হলনা। দেখলাম সে বারান্দায় বসে আছে। বাড়িটা নতুন তৈরী করেছে। বেশ সুন্দর। ভেতরে ঢুকে দেখলাম আরও সুন্দর। ওর পিতা কাম বন্ধুর সাথে দেখা হল। আমি আমার জীবনে পিতা-পুত্রের এমন সু-সম্পর্ক দেখিনি। আঙ্কেল হলেন প্রচন্ড দিলখোলা এবং ভয়াবহ রসিক। তার পার্ফেক্ট শব্দচয়নে আপনাকে হাসতে হবে কিন্তু তার কথামালা সস্তা গোছের নয়। খেতে খেতে তিনি বললেন, এক কড়া নাস্তিক ইংরেজ বাংলাদেশে এসে গডকে বিশ্বাস করেছিল। কারণ সরকার নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছাড়াই যেহেতু এদেশ চলছে,তার মানে কেউ না কেউ এটি চালাচ্ছে। তিনি গড ছাড়া আর কে ?

বিকেলে তিনি গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এখানে আসার পর একপাল লোক জড় হল। তিনি যেখানেই যান,সেখানেই লোকজন জড় হয়। মানুষ তাকে সাংঘাতিক পছন্দ করে। কিন্তু এখানে আসা হয়েছে সজীবের কারনে। স্নেহা ফাউন্ডেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগীতা করে থাকে। আর সজীব এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে সম্ভবত জীবন দিতে প্রস্তুত। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধর তার বন্ধু এবং সে যে কোনো সময় এই প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচীতে এক পায়ে খাড়া হয়। এবারের ৫দিনের ছুটির দুদিনই এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে বরাদ্দ। সে আর তার পিতা মিলে ইয়াতিম খুঁজে বেড়াচ্ছে যাদেরকে পড়াশুনার ব্যাপারে বিশেষ বৃত্তি দেওয়া যায়। আমরা ঘন্টা দুই এখানে ছিলাম। সজীবদের পুরোনো বাড়ি আমার ভাল লেগেছে।

রাতে আমরা ভাটই বাজারে আসলাম। এখানে এক খোলামেলা চায়ের দোকানে বসলাম। আহ মন জুড়ানো বাতাস বইতে লাগল। শুনলাম আঙ্কেল সেদিন দুজন লোককে ঝগড়া করতে দেখে বলেছে- এই তোরা গালাগালি করছিস, এটা কি সংসদ নাকি ? এটা ভাটই বাজার,এখানে ওসব গালাগালি চলবে না।

রাতটা ভাল কাটল। আমরা গল্প করলাম প্রচুর। আমরা উভয়ে উভয়ের সংস্পর্কে থাকলে দিন,রাত কোনদিক দিয়ে চলে যায় আমরা বুঝতে পারিনা। আগে প্রতিনিয়ত দেখা যেত রাত ১১টা বেজে গেছে। আমার বাড়িতে রাত দশটার মধ্যেই ঢোকার নিয়ম ছিল কিন্তু আমি রাত ১১টার আগে বুঝতেই পারতাম না। অনেক রাত আমরা গল্প করে কাটিয়েছি। সে কুরআন সুন্নাহর ব্যাপারে আমার চাইতে ভাল ধারণা রাখে। কোনো একটা প্রসঙ্গ উঠলে আমরা তা নিয়ে কথা বলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতাম। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি আল্লাহ আমাকে কিছু অতি উত্তম মানের বন্ধু দিয়েছেন বলে। সজীবের মা সম্পর্কে সালাহউদ্দীন ভায়ের একটা মন্তব্যই যথেষ্ট। সে সজীবকে বলে-তোমাদের বংশে আমার দেখা ওই একজনই আছে। কিন্তু তোমরা সব ডিসকুয়ালিফায়েড। এই কথার অর্থ কি তা আপনারাই বুঝে নেন। তিনি সচীব হিসেবে কর্মরত আছেন সচীবালয়ে।

সকালে বৃষ্টি পড়ছিল। সজীবের বোন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। হটাৎ আমরা বললাম আমরাও সেখানে যাব। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে সরকারী গাড়িতে উঠে পড়লাম। এখান থেকে সম্ভবত ৩৫ কি:মি: দূর। বাসে আমি একজন হুজুরের পাশে বসলাম। ভাবলাম তিনি সম্মানিত শিক্ষক আমার মত পুলাপাইনের সাথে বোধহয় কথা বলবেন না। কিন্তু না তিনি আমার চিন্তার গুড়ে বালি দিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলেন। সাংঘাতিক মিশুক স্বভাবের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন । তার সাথে সারাপথ কুরআন ,সুন্নাহ,শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদী নিয়ে আলোচনা হল। তিনি আমার ফোন নাম্বার রাখলেন এবং আমিও তারটা রাখলাম। লোকটা বয়ষ্ক কিন্তু মানুষিকতায় তরুন। এটাই হওয়া উচিৎ। সামনের সিটে থাকা সজিব আরেক শিক্ষকের সাথে কথার খৈ ফোটাচ্ছে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর চলে আসলাম। এটা বেশ সুন্দর। ১৭০ একর জায়গার ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত। অধ্যাপক সাহেব তার কক্ষে আসার দাওয়াত দিলেন ,ধন্যবাদের সাথে বিদায় নিলাম। সজিবের বোনের চেম্বারে বসে পরিকল্পনাগুলো ঝালাই করলাম। তারপর বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপকের রুমে বসে আড্ডা দিলাম। এই লোকটি মাখন স্বভাবের। তার কথায় গলে যেতে ইচ্ছে করে। দারুন মিশুক এবং ভদ্র। খানিক পর এক ছাত্র আসল এবং তিনি তাকে কোনো এক ব্যাপারে অপারগতার কথা বলাতে ছাত্রটি বলল,স্যার আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে,আমি আত্মহত্যা করব। সে উত্তেজনায় ভালভাবে কথা বলতে পারছিল না।

সে চলে যেতে উদ্যত হলে সজিব তাকে থামালো এবং তাকে হিট করতে পারে বা ভাবাতে পারে এমন কিছু কথা বলল। স্যার তাকে বসতে বললেন। আমরা তার সাথে খানিকক্ষন কথা বললাম। তারপর আমরা তাকে সহ একজন সহকারী অধ্যাপকের রুমে গেলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে। ইনি ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক, পূর্বে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ইনি সাংঘাতিক রসিক এবং মিশূক স্বভাবের। ছাত্রলীগ সম্পর্কে যা শোনা যায় তিনি তার উর্ধ্বে। তিনি আমাদেরকে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। সজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীস বিভাগের অধ্যাপক ড: প্রফেসর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ইনি ইসলামী টিভিতে হাদীসের একটি অনুষ্ঠান করতেন। আমরা এই শিক্ষকের কাছ থেকে প্রফেসর জাহাঙ্গীর সাহেবের দুটি ফোন নাম্বার নিলাম কিন্তু দুটিই বন্ধ পেলাম। তখন হাদীস বিভাগে গিয়ে নাম্বার নিলাম। মূলত তিনি এখানে কম আসেন,কারণ তার বহু রকম কাজ আছে যা পরে জানলাম।

আমরা কয়েক জনের কাছে ফোন করে তার এসিসটেন্টকে পেলাম এবং তিনি সন্ধ্যায় বাড়িতে থাকবেন জানালেন।

আত্মহত্যা করতে চাওয়া ছেলেটাকে নিয়ে হাটলাম এবং অনেক কথা হল। শুনলাম সে খুবই গরিব। বাড়িতে বৃদ্ধ এবং পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পিতা। ছোট বোনটি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরতা এবং তার পড়ার খরচও সে দিচ্ছে। সে মেধাবী তাই ফ্রি পড়ছে কিন্তু অন্যান্য খরচ তো আছে। ছেলেটি মাত্র দুহাজার টাকা টিওশনি করে রোজগার করে। প্রতি বেলা সে আলু ভর্তা খায় জানালো। কিন্তু সে বিসিএস পরিক্ষায় প্রাথমিকভাবে টিকে গেছে। সামনের পরিক্ষার আগে তার রেজাল্টটা দরকার কিন্তু কিছু শিক্ষকের গড়িমশির কারনে তার খাতাগুলি ঢাকা থেকে ফেরত আসেনি। এদিকে হাতে সময়ও নেই,তাই সমাধানস্বরূপ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। আমি আলগোছে কিছু পয়সা তার পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম যদিও সে দুহাতে দু-পকেট চেপে রেখেছিল। সজিব তার নাম ঠিকানা লিখে নিল। স্নেœহা ফাউন্ডেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান যার জন্যে সে জীবন বাজি রেখে কাজ করে,সেখান থেকে ছেলেটির জন্যে কিছু করা যায় কিনা তা সে দেখতে চায়।

এক বাদামওয়ালার কাছ থেকে আমরা ২৫টাকার বাদাম কিনলাম,পরিমান প্রচুর। একস্থানে দাড়িয়ে চিবাতে থাকলাম। লোকজন তাকাচ্ছিল,তাতে বয়েই গেল। আমরা আবারও বাসে উঠলাম। এবার উদ্দেশ্য সজিবের গ্রামের বাড়ি যাওয়া। সেখানে প্রচুর গরিব লোক রয়েছে। এলাকার অন্যান্য গ্রামেও সে গরিব ধরা অভিযান চালাচ্ছে। লক্ষ্য ইয়াতিমদের স্কলারশিপ দেওয়া পড়াশুনার জন্যে।

এই ছ্যামড়ার ধৈর্য্য দেখলে গা জ্বালা করে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে আর ওর খাওয়ার নাম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু খেয়ে আমার কিচ্ছু হয়নি। একে একে নাম তালিকাভূক্ত করে যাচ্ছে,ছবি তুলে যাচ্ছে,কথা বলে যাচ্ছে। তিন ঘন্টা বসে থাকার পর হেটে গ্রামটা দেখতে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছোট গ্রামটা শেষ হয়ে গেল,তখন আবার ক্ষুধার অনুভূতী প্রবল হল। এক সময় একটি ছেলে এসে সজিবের পুরোনো বাড়িতে নিয়ে গেল এবং আম,কাঠাল ইত্যাদী খেতে দিল,বেশ ভাল লাগল। বিকেল পাচটার পর সজিবের কাজ শেষ হল এবং আমরা রাস্তায় কিছু না পেয়ে নসিমন নামক এক অত্যাধুনিক শ্যালো ইঞ্জিন চালিত যানে উঠে বসলাম। গায়ে হাওয়া লাগলে মনে হয় হাওয়ার বেগে উড়ে চলেছি। এই যান ব্রেক কষলে তা ১০মিটার সামনে গিয়ে কার্যকর হয়।

বিষয়: বিবিধ

২৩৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File