শাহ আবদুল হান্নানের নির্বাচিত কলাম:কেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠক্রমে সংশোধন দরকার?

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার সিংহ ১১ মে, ২০১৫, ১০:০২:১৯ রাত

পবিত্র কোরআনে যে রাজনৈতিক মতবাদে ঘোষিত হলো, পরবর্তীকালে তারই বিভিন্নমুখী বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে বিভিন্ন দার্শনিকের হাতে। আল মাওয়ার্দি, ইমাম গাযযালী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল-ফারাবীর ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।দশম শতাব্দীর বিখ্যাত আইনবিদ আল মাওয়ার্দি অনেক বই লিখেছেন রাজনীতির ওপর। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল আহকামুস সুলতানিয়া’ অর্থাত্ রাষ্ট্র চালনা বিধি। এ গ্রন্থে তিনি খেলাফত ও ওজারত সম্পর্কে যে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন তা যে কোনো আধুনিক চিন্তাবিদকে চমত্কৃত করবে। তিনি রাষ্ট্র প্রধান ও মন্ত্রিসভার দু’ধরনের সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। এ দুটি ব্যবস্থা বর্তমান যুগের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম বা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং কেবিনেট সিস্টেম বা সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অনুরূপ। সুতরাং এই দু’রকম শাসন ব্যবস্থার আদি গুরু হিসেবে আমরা আল-মাওয়ার্দিকে গ্রহণ করতে পারি।একাদশ শতাব্দীর ইমাম গাযযালীর রাজনৈতিক পুস্তকাবলির মধ্যে কিতাব আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, কিতাব আল মুসতাজহাবী ও তিবরুল মাসবুক সুপ্রসিদ্ধ। তিনি গ্রিক চিন্তাধারার ওপর অনেক পুস্তক প্রণয়ন করেছেন।

shah abdul hannan 2

শাহ আবদুল হান্নান



লেখক : সাবেক সচিব

উৎসঃ আমার দেশ

আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার পাঠক্রম বা কোর্সে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এটি তুলে ধরা এবং এর সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

রাজনৈতিক ইতিহাস জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কলেজ স্তরে সামান্য কিছু আলোচনা হলেও একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে পড়ানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে যা পড়ানো হয় তাতে রয়েছে মৌলিক গলদ। কেননা, রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা সব সময়ই বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিত। কেবল কোনো একটি বা দু’টি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে শুধু পশ্চিমের চিন্তাধারাই শিক্ষা দেয়া হয়। পাশ্চাত্য দেশ ছাড়া অন্য কোনো জাতির ও অন্য কোনো দেশের রাজনীতি প্রবাহের ওপর বিন্দুমাত্র গুরুত্বারোপ করা হয় না। মনে হয় যেন রাজনৈতিক চিন্তা ও তার অনুশীলনে একমাত্র পশ্চিমের লোকদেরই অবদান রয়েছে! প্রাচ্যের কোনো দার্শনিকই বুঝি এ সম্পর্কে চিন্তা করেননি। এই একদেশদর্শিতার হয়তো বা কিছু কিছু কারণও দর্শানো যেতে পারে, কিন্তু কোনো যুক্তিতেই শুধু পাশ্চাত্য চিন্তাধারার পটভূমিকায় লেখা রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।এক্ষেত্রে উল্লিখিত সীমিত চিন্তাধারার আলোচনার ফলে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রথম পড়ানো হয় গ্রিক রাজনীতির কথা। বিশেষ করে সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটোর চিন্তাধারা।

তাদের পূর্বাপর অনেক দর্শন এবং গ্রিক সমাজের সাধারণ অবস্থাও তার সঙ্গে গুরুত্বসহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এ যুগের পর আসে রোমান রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে সিসেরুর রাজনৈতিক মতবাদ। প্রসঙ্গত রোমান আইনের ওপরও আলোকপাত করা হয়। অতঃপর খ্রিস্টীয় যুগের শুরু। এ পর্যায়ে এসে প্রধানত অগস্টাইন, এমবোর্জ, গ্রেগরি প্রমুখ খ্রিস্টান যাজকদের সঙ্গে, এদের দর্শনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। এ যুগের শেষ সীমা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক অবধি। পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় চিন্তাজগতে কোনো প্রতিভাবান রাজনৈতিক চিন্তাবিদের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায় না, নতুন কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বেরও সন্ধান মেলে না। সর্বশেষ দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু টমাস একুনাহ ও পদুয়ার মার্সিলিও থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত পশ্চিমের রাজনৈতিক চিন্তাধারা পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ যুগের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়বাদ আন্দোলন বা কনসিলিয়ার মুভমেন্ট বিশেষ প্রসিদ্ধ। ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে গতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং আমরা দেখতে পাই একের পর এক মেকিয়াভেলি, মন্টেস্ক, হবস, লক, রুশো প্রমুখ আরও অনেক রাজনীতি বিষয়ক চিন্তাবিদকে। উপরের আলোচনায় দেখা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কীয়দংশ ছাড়া পঞ্চম শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এক বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতা। এই সুদীর্ঘ সময়ে সাধারণভাবে রাজনৈতিক চিন্তা সামান্যই ছিল; যা ছিল তা-ও অত্যন্ত দুর্বল স্তরের। এ কারণেই দেখতে পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু একুনাহ, পদুয়ার মার্সিলিও-এর দর্শন এবং সমন্বয়বাদী আন্দোলন—সবই গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের মতো প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে। যদিও এ সমস্যা রাজনীতির মূল অধ্যায়ে পড়ে না, তথাপি ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা এই সামান্য ব্যাপারকেই খুব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখেছেন। এসব কারণে মধ্যযুগকে, বিশেষ করে আদি মধ্যযুগকে ইউরোপীয় রাজনীতিবিশারদরাই অরাজনৈতিক যুগ বা আনপলিটিক্যাল এজ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

আসলে তাদের এই মন্তব্য সত্য কিনা তার যৌক্তিকতা বিচার করা দরকার। এ বিচার গোটা দুনিয়াকে সামনে রেখেই করা উচিত। আমাদের মতে, উপরের মন্তব্য শুধু ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, সারা বিশ্বের জন্য সত্য নয়।

ইউরোপের যখন অরাজনৈতিক সময় তখন আরব বিশ্বে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল নতুন ধরনের ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি ছিল যে, আইন হবে আল্লাহর এবং সরকার জনগণের পছন্দের। এ সময়েই মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজে মানবাধিকারের ঘোষণা দেন। মদিনার সনদ ছিল একটি সংবিধান। এ সংবিধানে সব নাগরিককে সমান অধিকার দেয়া হয়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার দেয়া হয়। মদিনার সনদে উম্মাহর ধারণার মাধ্যমে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ হতে ভিন্ন আন্তর্জাতিক আদর্শিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এ সময় জাকাতের মতো কল্যাণকর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠিত হয় যাকে জনগণের সম্পদ গণ্য করা হতো। এসব বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোর্সে অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। এছাড়া মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

পবিত্র কোরআনে যে রাজনৈতিক মতবাদে ঘোষিত হলো, পরবর্তীকালে তারই বিভিন্নমুখী বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে বিভিন্ন দার্শনিকের হাতে। আল মাওয়ার্দি, ইমাম গাযযালী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল-ফারাবীর ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।দশম শতাব্দীর বিখ্যাত আইনবিদ আল মাওয়ার্দি অনেক বই লিখেছেন রাজনীতির ওপর। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল আহকামুস সুলতানিয়া’ অর্থাত্ রাষ্ট্র চালনা বিধি। এ গ্রন্থে তিনি খেলাফত ও ওজারত সম্পর্কে যে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন তা যে কোনো আধুনিক চিন্তাবিদকে চমত্কৃত করবে। তিনি রাষ্ট্র প্রধান ও মন্ত্রিসভার দু’ধরনের সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। এ দুটি ব্যবস্থা বর্তমান যুগের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম বা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং কেবিনেট সিস্টেম বা সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অনুরূপ। সুতরাং এই দু’রকম শাসন ব্যবস্থার আদি গুরু হিসেবে আমরা আল-মাওয়ার্দিকে গ্রহণ করতে পারি।একাদশ শতাব্দীর ইমাম গাযযালীর রাজনৈতিক পুস্তকাবলির মধ্যে কিতাব আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, কিতাব আল মুসতাজহাবী ও তিবরুল মাসবুক সুপ্রসিদ্ধ। তিনি গ্রিক চিন্তাধারার ওপর অনেক পুস্তক প্রণয়ন করেছেন।

গ্রিক চিন্তাধারা নিয়ে আরও যারা বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে আল ফারাবী ও ইবনে রুশদের নাম উল্লেখযোগ্য। ফারাবী গ্রিক চিন্তাধারার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক দিন পর্যন্ত তা ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় টেকস্ট বুক হিসেবে পাঠ্য ছিল। ইবনে রুশদ এরিস্টটলের সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাতা বলে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তার দর্শন ইউরোপে এভাররোস্ট এরিস্টটলিয়ানিজম নামে পরিচিত ছিল।

অন্যদিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের সত্যিকার প্রথম বিকাশ ঘটে মুসলিম চিন্তাবিদদের হাতে। আইন শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। অধুনা যে জুরিসপ্রুডেন্স অব ল’ পড়ানো হয় তার প্রথম নিয়মমাফিক বিকাশ লক্ষ্য করা যায় মুসলিম মনীষীদের হাতে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফীর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগের জার্মানদের আইন পড়ানো হয় অথচ মুসলিম আইনবিদদের চিন্তা-জগতের সঙ্গে পরিচয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে।

উপরের আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়, মধ্যযুগ আনপলিটিক্যাল ছিল না। ইউরোপের জন্য তা অরাজনৈতিক যুগ হলেও আরব ও মুসলিম বিশ্বে তখন পূর্ণ রাজনৈতিক যুগ। আমাদের উচিত রাজনৈতিক চিন্তাধারার এ শূন্যতাকে দূর করে বিশ্বে রাজনৈতিক ইতিহাসকে নতুন করে লেখা। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তানায়কদের তাদের যথাযোগ্য স্থান দিলে এ শূন্যতা দূর হবে—রাজনীতির ইতিহাস পাবে পূর্ণাঙ্গতা, সংশোধিত হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল।

বিষয়: বিবিধ

১৫৬২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319489
১২ মে ২০১৫ রাত ০১:৩৫
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ
১২ মে ২০১৫ সকাল ০৮:৫৩
260633
বাংলার সিংহ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
319509
১২ মে ২০১৫ সকাল ০৭:২৮
নীলাঞ্জনা লিখেছেন : জামাত গুরু হান্নান সাহেবের লেখা পড়ে মনে হল- 'সকল সুখের মূল ইসলাম'।
কিন্তু বাস্তবে সকল অশান্তির বিষফোঁড়া ইসলাম স্বয়ং।
১২ মে ২০১৫ সকাল ০৮:৫০
260631
বাংলার সিংহ লিখেছেন : এই ব্লগের সবচাইতে খারাপ ভাইরাস নীলাঞ্জনার মন্তব্যর কাছ থেকে আল্লাহ আমাকে হেফাজত করুক।
319518
১২ মে ২০১৫ সকাল ০৮:৪৫
শেখের পোলা লিখেছেন : মুসলীমরা আজ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অপদার্থের মত কাল কাটাচ্ছে৷ ভারবাহী গাধার মত তারা জানেনা তার পিঠে চিনির বস্তা রয়েছে৷ আলোচনা ভাল লাগল৷ ধন্যবাদ৷
১২ মে ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৭
260698
বাংলার সিংহ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
319523
১২ মে ২০১৫ সকাল ০৮:৫৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১২ মে ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৮
260699
বাংলার সিংহ লিখেছেন : ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File