"যেভাবে আমার বিয়ে হল এবং অতঃপর"। জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান স্যার এর স্মৃতিকথা । বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ফেসবুকে প্রকাশিত)

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার সিংহ ০৮ মে, ২০১৫, ০৪:২০:৩৪ বিকাল

1975 সাল নভেম্বর মাস আমি শেরে বাংলা নগর সংসদ ভবনে 10 East Bengal Regiment এর একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে Battalion এর সাথে অবস্থান করছি। আমি 10 East Bengal Regiment এর ভেনগার্ড কমান্ডার হিসাবে পাবনা government public school ( বর্তমানে Pabna Cadet College) থেকে আমার কোম্পানি নিয়ে Commanding Officer Ltc নওয়াজেস ( পরে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যার সাথে ষড়যন্ত্রমুলক কোর্টমার্শালে নিহত) এর আদেশে প্রথমে বাঘাবাড়ী ঘাটে গিয়ে Battalion crossing area secure করি এবং ঐ এলাকায় কার্ফু জারি করি। পরে পুনরায় Commanding officer( CO) এর সংশোধনী আদেশে নগরবাড়ী ঘাটে এসে Battalion crossing area secure করে সমস্ত ঘাট এলাকায় কার্ফু জারি করি।কারন সিও সাহেবের আমার জন্য এই আদেশেই ছিল।সন্ধ্যার কিছু পূর্বে সিও লে: কর্নেল নওয়াজেস বগুড়া হতে ব্যাটালিয়ান সদরসহ নগরবাড়ী ঘাটে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমাদের ব্যাটালিয়ান ঐসময় Arms collection duty তে বগুড়া সদরে ব্যাটালিয়ান সদর স্হাপন করে বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলে কর্তব্যরত ছিল। সিও সব অফিসারদের ডেকে Informally জানালেন যে ঢাকায় ভালো কিছু ঘটেছে তাই আমাদের ব্যাটালিয়ান ঢাকা যাবে।রাত্রে আমার উপর আদেশ হল আমি আমার কোম্পানি নিয়ে যমুনা পার হয়ে আরিচা ঘাট নগর বাড়ী ঘাটের মত secure করব। সম্ভবত রাত তিনটার দিকে আমারা আরিচা ঘাটে এসে পাড়ে সারিবদ্ধ অনেক তিনটন ট্রাক দেখতে পেলাম। আমি আদেশ দিলাম খোঁজ নেয়ার জন্য যে এতো ট্রাক আমাদের নেয়ার জন্য এসেছে কিনা? আমার সিনিয়র জেসিও আমার সিনিয়র জেসিও আমাকে জানালো যে তারা একজন আর্মি সার্ভিস কোরের অফিসারকে এরেষ্ট করেছে। আমি অফিসারকে আমার সামনে আনতে বললাম দেখলাম সে একজন লেফটেনেন্ট পদবির । তাকে তিনটন ট্রাকসহ আমাদের ব্যাটালিয়ানকে ঢাকা নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। যাহোক সে খুব ভয় পয়েছিল। আমি তাকে অভয় দিলাম এবং সিও না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললাম। বেলা 12 টার দিকে ব্যাটালিয়ানের সবাইকে নিয়ে সাও সাহেব আরিচা এসে অবতরন করলেন। দুপুরের খাবার একসাথে হল। বেলা 2 টার দিকে সাও সাহেব আমাকে ডেকে আদেশ দিলেন আমি আমার কোম্পানি নিয়ে সাভারে রক্ষিবাহিনী অবস্হানে এসে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিয়ে সিওকে অবহিত করব।আমি রাস্তায় আসার সময় গভীর ভাবে চিন্তা করতে ছিলাম সাভারে রক্ষিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ক্যানাটনমেন্ট। এই সামান্য কোম্পানি স্ট্রেংথ নিয়ে কিকরে কি করা যাবে।তাছাড়া সাভার বাইপাস করে ব্যাটালিয়ান ঢাকা নেয়ার কোন পরামর্শতো আমি সিও সাহেবকে দেই নাই।তদুপরি আমার উপর যে আদেশ তাতো অবশ্যই পালন করতে হবে।এই ভাবতে ভাবতে সাভারের কাছাকাছি একস্হানে এসে থেমে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবছিলাম। এমন সময় দেখি দুজন মানুষ সাভারের দিকে মটর সাইকেলে যাচ্ছে। আমি ওদের থামাতে এবং আমার কাছে আনতে বললাম। ইতিমধ্যে মধ্যে আমি একজন এনসিওকে সিভিল কাপড়ে তৈরী করতে বললাম যে মটর সাইকেলের পিছনে বসে সাভারে রক্ষিবাহিনীর অবস্থান সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে আমাকে জানাবে। ওরা চলে গেল। অল্প সময়ের মধ্যেই ওরা ফিরে আসে জানাল যে সাভারে রক্ষিবাহিনী অবস্হানে কেউ নাই একদম ফাঁকা। ঘামদিয়ে যেন জ্বর ছেড়ে গেল। আমি নিজে যথেষ্ঠ সাবধানতার সাথে সাভার রক্ষিবাহিনীর অবস্থানে ঢুকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম কেউ নাই এবং মাইন বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকও দেখতে পেলামনা। পরে ওয়ারলেস সেটে ব্যাটালিয়ান সদরে অল ক্লিয়ার সিগন্যাল দিলাম।আমি সাভারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যাটালিয়ানের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।ইতিমধ্যে আমি জানতে পরেছি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কাউন্টার ক্যু করেছেন এবং জেনারেল জিয়া বন্দি অবস্থায় সেনানিবাসের বাসায়। আরো দু:সংবাদ যা জানতে পারলাম তাহচ্ছে ঢাকা সেনানিবাসের মধ্যে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গোপন সৈনিক সংস্থা লিফলেট বিলি করছে যার ভাষার মধ্যে একটি স্লোগান ছিল" সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই"। এবং সেনানিবাসের অবস্থা থমথমে যেকোন সময় সৈনিকদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখাদিতে পারে। হাওয়ায় গুজব উড়ছে। আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঐদিন রাতে ব্যাটালিয়ান সাভারে পৌছল। ভাবলাম এবারে নিস্তার পেলাম। রাতে সাভারে থাকলাম। পরদিন বিকেলে সিও সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেল কোম্পানি নিয়ে তৈরী হও তুমি শেরেবাংলা নগরে সংসদ ভবনে গিয়ে ঐএলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যাটালিয়ান পৌছানোর অপেক্ষা করবে। আমি আদেশ পয়ে ফিরে এসে কোম্পানির সবাইকে যখন জানলাম তখন সবার একটাই কথা স্যার আপনি ছাড়া আরোতো অনেক সিনিয়র অফিসার আছেন সিও সাহেব তাদের পাঠাতে পারেন। আমি সবাইকে শান্ত করলাম এবং বললাম এটা গর্বের কথা যে সিও সাহেব আমাদের কোম্পানির উপর বেশী আস্হা রাখেন বলে আমাদের কোম্পানিকে কঠিন কাজের দায়িত্ব দিচ্ছেন। যাহোক রাত প্রায় নটার দিকে আমারা কোম্পানিসহ সংসদ ভবনে পৌছে টানেল এরিয়াতে অবস্থান নিলাম। এখন যেটা চন্দ্রিমা উদ্যান সেখানে রক্ষিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল এবং আমি দেখলাম ওখানে রক্ষিবাহিনী অবস্হানে আছে। বুঝলাম আমদের আসার সংবাদ রক্ষিবাহিনী সদরে পৌচেছে এবং রক্ষিবাহিনীর কিছু জেসিও দেখা করতে এসেছে। ঐদিন তারিখ ছিল সম্ভবত 5 নভেম্বর 1975 সাল। হঠাৎই রাত 10 টার দিকে ব্যাটালিয়ান সুবেদার মেজর নজরুল ( মৃত) উৎকণ্ঠিত হয়ে আমাকে জানালো যে স্যার রক্ষিবাহিনীর যেসব জেসিও আমদের সাথে দেখা করতে এসেছিল তারা জানালো বাংলাদেশে নাকি আর্মি থাকবেনা সব রক্ষিবাহিনী হয়ে যাবে। আমি শুনে খুব চিন্তিত হলাম। সুবেদার মেজরকে বললাম এসব কথায় কাননা দিতে।আরো বললাম সিও সাহেব এলে সব জানা যাবে। সবাইকে সিও সাহেব না আসা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে বলেন। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মেজর আবার এসে জানালো যে সৈনিকদের মধ্যে গুজব রটেছে যে রক্ষিবাহিনী আমাদের attack করবে। শুরু হল অস্থিতিশীল অবস্থা আর গুজব। শেষে পুরো কোম্পানি হাতিয়ারসহ deploy করা হল। ইতিমধ্যে সিও ল: কর্নেল নওয়াজেস ব্যাটালিয়ানসহ শেরেবাংলা নগরে পৌছে সব অবহিত হলেন এবং এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে কোম্পানি deploy করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা বললে তিনি তা অনুমোদন করলেন।তার পরের ঘটনা সবার জানা। এর উপরে আমার একটি বিশদ লেখা " জিয়া তাহের বিতর্ক" শীরনামে publish হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তে সম্ভবত 2012 /13 সালের 21 শে মার্চে। এখানে স্বল্প পরিসরে কেবল অল্পে বর্ননা করছি।শুরু হল গোপন সৈনিক সংস্থার নেতৃত্ব সৈনিক বিদ্রোহ। সব অফিসারদের রেংক বেজ খুলে ফেলা হল। সিও তার কমান্ড হারালেন। এটা একটা অভিনব অভিজ্ঞতা দেখলাম কমান্ড কিভাবে চলে যায়! ঢাকা সেনানিবাসের ইউনিট থেকে সৈনিকরা এসে আমার কোম্পানির সৈনিকদের বলছে আমারা আমাদের ইউনিটের সব অফিসারদের মেরে ফেলেছি তোমারাও মরে ফেল। এবং এসব কথা হচ্ছে আমার সামনে। আমার কোম্পানি সিনিয়র জেসিও সুবেদার খায়ের আমাকে মারার জন্য তার সাব মেশিন গান আমার দিকে তাক করলে আমি দৃঢতার সাথে তাকে বললাম আমার বাবা আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন আমি অফিসার হয়েছি। আপনি লেখাপড়া করেননি আপনি জেসিও হয়েছেন এতে আমার দোষ কোথায়? আমার বাবা আমাকে আর্মিতে পাঠিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করে মৃত্যু বরন করার জন্য। আপনার হাতে মরার জন্য নয়।এই বলতেই সুবেদার মেজর নজরুল সাহেব এসে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। যাইহোক আমি দুতলায় সম্ভবত 5 নম্বর ব্লকে আমার নিজের রুমে চলে গেলাম এবং সৈনিকদের বলে গেলাম যে আমাকে মারতে চাও আমার রুমে এসে স্যালুট করে অনুমতি নিয়ে আমার পিস্তল দিয়ে সামনে থেকে আমাকে আমার হার্টে গুলি করবে।তার আগে আমি দুরাকাত নামাজ পড়ব। আমার ডেডবডি গোসল নাদিয়ে আমার ইউনিফর্মে আমার বাবা মার কাছে নিয়ে যাবে এবং তোমরা নিজেরা আমাকে গার্ড অব অনার দিয়ে আমাদের কবরস্থানে আমাকে কবরস্ত করবে। আমার ঐসময় কোন প্রকার ভয়, ডর, চিন্তা ভাবনা চাওয়া পাওয়ার কোন অনুভুতি ছিল না। এটা একটা অভিনব অনুভূতি যা ভাষায় বর্ননা সম্ভব নয়। কেবল মনে হচ্ছিল আমার মা আমার জন্য কেঁদে কেঁদে মরে যাবে।ইতিমধ্যে সৈনিকরা যেযারমত গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহরে গুলি ফায়ার করে ঘুরতে ফিরতে লাগল। আমার কোম্পানির সৈনিকরা বলল স্যার আমারা বিদ্রোহী সৈনিকদের সাথে যোগ না দিলে আমাদের নাকি অসুবিধা হবে। যাক শেষ পর্যন্ত কিছু সৈনিক বিদ্রোহে যোগ দিলনা। ইতিমধ্যে জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল নাজমুল হুদা আমাদের 72 ব্রিগেড কমান্ডার , লে: কর্নেল হায়দার আমাদের ব্যাটালিয়ানের বিদ্রোহী সৈনিক সংস্থার দ্বারা নিহত হলেন। আমি চেষ্টা করেছিলাম ওদের রক্ষা করতে কিন্তু ব্যার্থ হই। এই সব ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমরা শুধু চা আর বিস্কুট খেয়ে ছিলাম। বিদ্রোহ যখন কিছুটা কমে এলো তখন হঠাৎ মনে হল আমার বাড়িতে যোগাযোগ করা দরকার। আমি দিনাজপুর শহরে আমার চাচাতো বোনের বাসায় টেলিফোন করলাম। আমার এক ভাগনা ফোন ধরে কিছুতেই বিশ্বাস করবেনা যে আমি কথা বলছি। আমার ভাগনা আমাকে বলল যে আজ আমার মামার মানে আমার কুলখানি হচ্ছে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ওখানে সবাই গেছে। যখন সে বুঝল যে আমি বেঁচে আছি তখন সে রাতেই আমার বাবাকে গ্রাম থেকে এনে আমার সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য মটর সাইকেল নিয়ে চলে গেল। আমি ঐরাতে বাবার সাথে কথা বলি।প্রথমে তিনি বিশ্বাস করছিলেননা যে আমি কথা বলছি। তিনি আমাকে বলছিলেন তুমি কি ফজলুর বন্ধু বলছ ? আমি আনেক বলার পরে বিশ্বাস করেন যে আমিই কথা বলছি।বাবার সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম তাহচ্ছে এইরুপ:

আমার বাবা বললেন তাঁকে তিনবার ডিসি সাহেব গাড়ীতে করে দিনাজপুর সদরে নিয়ে গিয়ে লাশ সনাক্ত করিয়েছেন আমার লাশ কিনা? ঐবার গোপন সৈনিক সংস্থার হাতে মোট 20 জনের মত আর্মি অফিসার নিহত হন তার মধ্যে দিনাজপুরের তিনজন ছিলেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মাহবুব যার নামে খোলাহাটি সেনানিবাসের নামকরন করা হয়েছে। আমার বাবা আরো জানালেন আমাদের এলাকার প্রায় 5/6 জন সৈনিক ইউনিফর্মে হাতিয়ারসহ আমাদের বাড়ীতে যায়। ঐসময় আমার বাবা মা পাশাপাশি বারান্দায় চেয়ারে বসা ছিলেন। তারা জানায় যে আপনার ছেলে ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান সাহেব ঢাকায় গুলি খেয়ে মারা যায়। আমরা তাঁর লাশ রংপুর পর্যন্ত এনেছিলাম কিন্তু লাশ ফুলে যাবার কারণে এবং দুর্গন্ধের জন্য আমারা আপনার ছলের লাশ রংপুর সেনানিবাসের পাশে দাফন করে আপনাকে জানাতে এসেছি। এই কথা শুনে আমার মা বেহুশ হয়ে চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু বাবা নিজকে সামলে নেন। তিনি আমাকে বলেন যে আমি ওদের কথা বিশ্বাস করিনি। যাই হোক আমি বাবাকে বললাম আমি 2/1 দিনের মধ্যে ছুটিতে বাড়ী আসছি।মাকে বলবেন যেন কোনো চিন্তা না করেন।

আমি পরদিন সিও সাহেবের কাছে গেলাম তাঁর পাশে তাঁর ইন্টেলিজেন্স অফিসার ( আই ও) সে: লে: মুজিব ( পরে জেনারেল জিয়া হত্যায় ফাঁসিতে নিহত)ও ব্যাটালিয়ান এডজুটেন্ট আমার কোর্সমেট ক্যাপ্টেন মোক্তাদির বসা। আমি সিওকে গতকালের সব ঘটনা খুলে বলে 15 দিনের ছুটির আনুরোধ করলাম। আমার এখনও মনে আছে সিও একটি কাষ্ঠ হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে বললেন তুমি আমার কাছে ছুটি চাচ্ছ! কোন সৈনিক আমাকে সেল্যুট করেনা আমার কোনো কমান্ড নাই। তোমার ইচ্ছা তুমি যতদিন খুশী ছুটি চলে যাও।আমি ক্যাপ্টেন মোক্তাদিরকে বললাম দোস্ত আমাকে 15 দিনের part of p/ leave দাও।কেননা একদিন সব ঠিক হলে আমি without leave ব্যাটালিয়ান ত্যাগ করার অপরাধে শাস্তি পাব তা হয়না। আমি লিভ সার্টিফিকেট নিয়ে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। বাড়িতে পৌঁছে দেখি হৃদয় বিদারক দৃশ্য। লোকেলোকারণ্য। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনেকক্ষন কাঁদলেন যা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব।ধীরে ধীরে যখন সব শান্ত হয়ে এলো হঠাৎ ব্যাটালিয়ান সদর থেকে টেলিটেলিগ্রাম এলো leave cancelled join Bn immediately। আমি কিকরব ভাবে পাচ্ছিলামনা।হঠাৎ মনে হল দিনাজপুর বি ডি আর সেক্টর কমান্ডার লে: কর্নেল নজরুলের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করলে কেমন হয়? তিনি বললেন এই অবস্থায় ঢাকা না যেতে। আমাকে বললেন যদি জিজ্ঞেস করে বল টেলিগ্রাম পাইনি। তাঁর পরামর্শ মনপুত হল। পরদিন সকালে আমাদের বাসায় আমার এক ফুফা মটর সাইকেলে আসলেন বললেল আমি কি করছি। আমি বললাম তেমন কিছু না। তিনি আমাকে তৈরী হতে বললেন দিনাজপুর শহরে যাবার জন্য। আমি ভাবলাম ভালোই হল শহরে ঘুরে আসি। আসলাম শহরে। মালদাহ্পট্টিতে তখন একটি মিষ্টির দোকান ছিল যার সব মিষ্টি খাঁটি ঘিয়ে ভাজা। ফুফাসহ মিষ্টি খেয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার সাহেবের ভগ্নীপতি দিনাজপুরের বিখ্যাত ব্যক্তি জনাব ছালাম চৌধুরী সাহেবের বাসায় এলাম।তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।ছালাম চৌধুরী সাহেব আমাদের বর্তমানে আমর চাচা শশুর এডভোকেট আব্দুর রহিম সাহেবের বাসায় আসতে বললেন এবং তিনি সত্তর কাজ সেরে যোগ দেবেন একথা বললেন। আমরা রহিম সাহেবের বাসায় এলাম।রহিম সাহেব স্বাগত জানালেন। গল্পের মধ্যেই ছালাম চৌধুরী সাহেব এসে পৌছালেন। রহিম সাহেব এবং ছালাম সাহেব আমাকে জানালেন তাঁরা আমর বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন ।সব জেনে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চুপ মেরে গেলাম। এই situation এ বিয়ের কথা ভাবা যায়। কিন্তু এই দুই ব্যক্তির প্রভাব এবং অবদান আমার উপর এতো বিশাল যে আমি না করার শক্তি হারিয়ে ফেললাম।এটাই নিয়তি। বাবা মার অনুমতি এবং দোয়া নিলাম। তাঁরা উভয়ে ভিষন খুশী হলেন।পরদিন রাত 8.30 মিনিটে 5 ডিসেম্বর 1975 আমার বিয়ে হল।বিয়ের আগের রাতে স্বপ্নে দেখছি দুটো কবুতর আমাদের বাড়ীর আঙিনায় বসে আছে। একটা কবুতর উড়ে চলে গেলো অন্যটা আমার বুকে হার্টের উপরে এসে বসল। আমি কবুতরটির পিঠে হাত দিলে বুকের সাথে সেটে গেল। ঘুম থেকে উঠে বুঝলাম এবিয়ে আমার জন্য সুখের হবে। হয়েছেও তাই। বলব এর চেয়ে অনেক অনেক বেশী যা আমার ধারনারও বাইরে। এদিকে ছুটি শেষ হয়ে আসল। যাত্রার আগের দিন আমি আমার শশুরকে বললাম যে আমি আমার বৌ সাথে নিয়ে ঢাকা যাব। তিনি শুনে বললেন তুমি বলকি? তোমার ইউনিটে সেনা বিদ্রোহ এখনও শান্ত হয়নি। এই অবস্থায় তুমি হেনাকে ( আমার বৌয়ের ডাক নাম)নিয়ে কিভাবে ঢাকা যাবে? পরদিন বৌ সহ ঠাকুরগাঁতে বিমানে করে ঢাকা যাত্রা করলাম। আমার কোম্পানিতে জানিয়ে দিলাম আমি আসছি তেজগাঁ এয়ারপোর্টে আমার জীপ যেন থাকে। আমি বৌ সহ তেজগাঁ এয়ারপোর্টে নেমে হুডখোলা M38 জীপে বৌসহ নিজে জীপ চালিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে এসে ব্যাটালিয়ানে উপস্থিত হলাম। সবাই অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমাদের দেখছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের ব্যাটালিয়ান সুবেদার মেজর নজরুল সাহেব এক অভিনব কাজ করে বসলেন। তিনি উপস্থিত সব রেংক ও ফাইল সবাইকে ফল ইন করে একটা সুন্দর বক্তব্য দিলেন। তিনি ব্যাটালিয়ানের উপস্থিত সবাইকে বললেন দেখ ব্যাটালিয়ানে বেগম সাহেব এসেছেন। আমাদের সবাইকে এখন ডিসিপ্লিন ঠিক করতে হবে। আর বিদ্রোহ চলবেনা। এটা ব্যাটালিয়ানের মানসম্মানের ব্যাপার।দেখলাম সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে গার্ড অব অনার দিল। এবং ঐসময় থেকে সব সৈনিক শৃঙ্খলাবদ্ধ হল।বিদ্রোহের অবসান হল। আমাদের সম্ভবত তিন নম্বর ব্লকের দোতলায় বাসা দেয়া হয়েছিল। এখানে যা বলেছি সব সত্য ঘটনা। হয়তো সময় এবং বর্ণনার পরম্পরায় কছুটা হেরফের হলেও হতে পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৭৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

318871
০৮ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৪
বাংলার সিংহ লিখেছেন : সংবাদ পেলাম বংগবন্ধু নিহত অত:পর আমার উপর কি ঘটেছিল"?জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান স্যার এর স্মৃতিকথা । বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ফেসবুকে প্রকাশিত)Click this link
318872
০৮ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৬
বাংলার সিংহ লিখেছেন : "1975 সালে পাকশিতে ফুড মুভমেন্ট কন্ট্রোল অপারেশন
এবং আমি"।জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান স্যার এর স্মৃতিকথা । বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ফেসবুকে প্রকাশিত)Click this link
318881
০৮ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৩৪
শেখের পোলা লিখেছেন : মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধু পড়েই গেলাম৷ মনে মনে কি যেন খুঁজছিলাম কিন্তু পেলাম না৷ এই নওয়াজিস সাহেব কি আর্মড ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়েছিলেন? খুলানার আর্মড ব্যাটালিয়নে এমনই নামে একজন সি ও ছিলেন বলে মনে হয়৷ধন্যবাদ৷
০৮ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৯
260078
বাংলার সিংহ লিখেছেন : আপনার প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে ওনার ফেসবুক পেইজে প্রশ্ন করে উত্তর জানতে পারবেন।
318891
০৮ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২৪
বাংলার সিংহ লিখেছেন : জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান স্যার এর Facebook Page: Click this link
318911
০৮ মে ২০১৫ রাত ১০:৪৯
দ্য স্লেভ লিখেছেন : এই জেনারেলের সাথে আমি দুবার কথা বলেছি। সাংঘাতিক ধরনের লোক। ইসলামিক ঘরানার। তার মানুষিক দৃঢ়তা দেখার মত। উনার নেতৃত্বে বিডিআর বড়াইবাড়ি পাদুয়া সীমান্তে শতাধিক বিএসএফ বা তাদের পোষাকে আবৃত ভারতীয় সৈন্য মেরেছিলো...
০৯ মে ২০১৫ রাত ০৯:৫৪
260223
বাংলার সিংহ লিখেছেন : আপনি সৌভাগ্যবান,ওনার সাথে কথা বলেছেন। আমার কথা বলার সুযোগ হয়নি তবে সরাসরি ওনার বক্তব্য শুনেছি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File