পথের দিশায় দিয়া জ্বেলে যাই

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:৫৬:০৪ রাত



হাসপাতালে ঢুকতেই কড়া স্যাভলনের তীব্র গন্ধটা নাক এসে লাগে ! এক বিরহের ঝড় উঠে বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিতে চায়! বুকের জমানো কষ্টেরা দীর্ঘশ্বাষ হয়ে বেরোয়!

সামিয়া আজ ডাক্তারের কাছে ভিজিটে এসেছিলো, দুই দুইটা অ্যাক্সিডেন্টের পর হাসপাতাল জায়গাটা কারাগারের মতো মনে হয়! ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে সামিয়া। হাঁটতে হাঁটতে যখন থামলো, সামনে দেয়াল ছাড়া কিছু নেই! বোকার মতো কিছুক্ষন তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কোন জায়গায় আসলো ? অবচেতন মনে হাঁটছিলো, হাসপাতাল থেকে বের না উল্টো দিকে চলে এসেছে! আবার ঘুরে মাঝখানের সিঁড়ি বরাবর আসতেই বড় বোন সাবিহার সাথে দেখা।

-আপু, তুমি হাসপাতালে যে? কি করছো এখানে? শরীর খারাপ নাতো তোমার?

-তোর কান্ড কারখানা দেখছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ! হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে বের করতেই তুই হিমশিম খাচ্ছিস আর এতোটা পথ কিভাবে বাসায় যাবি একা একা বলতো ? সাথেও কাউকে আসতে দিলি না, এতোটা একরোখা হওয়া কি ঠিক বল? ( অভিমানী কন্ঠে বড় বোন সাবিহা)

-না, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম তো তাই! তুমি কি করতে এলে?(শুকনো একটু হাসি দিয়ে সামিয়া)

-আমি এসেছি তোকে নিয়ে যেতে। নিজে তো যাবি না, কাউকে পাঠালেও সাথে যাবি না, তাই নিজেই এসেছি। চল, এখন বের হই হাসপাতাল থেকে! ( দুই বোন হাঁটা ধরে বাসার উদ্দেশ্যে)

- কিন্তু আপু, ওকে তো বলা হয়নি! আর এভাবে বিনা নোটিশে যাওয়া কি ঠিক হবে? ( দ্বিধাযুক্ত কন্ঠে সামিয়া)

- আমি কথা বলেই এসেছি শফিকের সাথে। তুই কোন টেনশন করিস না। আর শফিকও অফিস শেষ করে চলে আসবে বলল সুতরাং চিন্তার তো কোন কিছু নেই।

তবু সামিয়া স্বস্হি পায় না, জীবনে যে বিপর্যয়গুলো এসেছে তারপর থেকে অনেক বদলে গিয়েছে সামিয়া! কোথাও যেতে তো ইচ্ছা করেই না, কারো সাথে কথা বলা, আড্ডা দেওয়া, বাইরে যাওয়া সবকিছুতেই অশান্তি আর বিরক্তি অনুভব করে!

দরজা দিয়ে ঢুকতেই খোলা বিশাল বড় ছিমছাম ড্রয়িং রুমটা চোখে পড়ার মতো সুন্দর! পরিচ্ছন্ন - পরিশীলিত রুচির ছাপ চারিপাশে! বড় আপাতো রোজ বলেন ওর বাসায় আসতে! সামিয়ারই সব কিছুতে অনীহা, তাই বছর খানেক হয়েছে আসা হয়না!

মনে পড়ে গতবছর শীতের শুরুতে সবাই আপার বাসায় একত্রিত হয়েছিলো, সামিয়ার তখন বিয়ে হয়েছে তিন কি চার মাস! সবাই মিলে কত আনন্দই না করেছিলো! এখান থেকে যাওয়ার পর পরই প্রথম বার কনসিভ করেছিলো! খুব প্রতীক্ষিত না হলেও অনাকাংক্ষীতও ছিলনা বরং হঠাৎ বৃষ্টির মতো একপশলা সুখের হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলো সামিয়া-শফিকের নব জীবনে! কিন্তু সুখেরা বেশি দিন স্হায়ী হতে পারেনি! তিনমাস যখন ছুঁই ছুঁই তখন মিসক্যারেজ হয়ে যায়!

প্রথমবারের দুর্ঘটনার পর সামিয়ার ভিতর মাতৃত্বের অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে থাকে আবার কবে মা হবে! নতুন পরিকল্পনা এবং ডাক্তারদের সাথে কাউন্সিলিং চলতে থাকে আবার এক চন্দ্রীয় অতিথির শুভাগমনের অপেক্ষায় !

অবশেষে এক সুন্দর সকালে সুসংবাদ দরজায় কড়া নাড়ে! নতুন অতিথির সুসংবাদ শুনতে পেয়ে সবার সে কি খুশি! বারে বারে ফোন করা, সাবধান করে দেয়া, খোঁজ নেয়া, কি খেতে ইচ্ছা করে, বমি হয় কিনা, গন্ধ লাগে কিনা কতকিছু ! সামিয়া নিজেও সচেতন ছিলো, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় পেটে যেনো বাড়তি চাপ না পড়ে কত ধীরে ধীরে সে নিচে নেমেছে, উপরে উঠেছে! সামান্য ছোট্র ব্যাগও তাকে নিতে দেয়া হয়নি পেটে চাপ পড়বে বলে! বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে রান্না করলে কষ্ট হবে তাই সব শর্ট কাট রান্না! সামান্য শারীরিক অসুস্হতা ছিলো তারপরো মনের মাঝে একগুচ্ছ সুখেরা বাসা বেঁধেছিলো!

প্রথম থেকেই সামিয়া -শফিক চেয়েছিলো তাদের নবাগত সন্তান ইসলামিক আদর্শে গড়ে উঠবে। শফিক রোজ সকালে জোরে জোরে কোরআন তিলাওয়াত করতো যেনো তাদের গর্ভস্হ সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই পবিত্র বানী শুনতে পায়! দুজনেই সুন্দর সুন্দর দোআ পড়ে সন্তানের জন্য দোআ করতো! এভাবেই কাটছিলো সুন্দর সময়গুলো! সময়ের পরিক্রমায় সামিয়ার পেটের আকার বড় হতে লাগলো। দুজনে মিলে একসাথে যখন বিকেলে চায়ের টেবিলে গল্প করতো হঠাৎ কোন হাসির কথা আসলে দুজনেই যেই হেসে উঠেছে ওমনি পেটের মধ্য থেকে ওদের বাবু হাত- পা নাড়িয়ে নিজের অবস্হান জানান দিতো যে আমিও আছি তোমাদের সাথে এই সুখ আলাপনে! ওরা তখন দুজনে মিলে পেটে হাত দিয়ে আদর করে দিতো!

দিন ঘনিয়ে আসছিলো, বিশাল পেট নিয়ে সামিয়ার হাঁটাচলা করতে বেশ কষ্ট হয়! হাতে পায়ে সামান্য পানিও এসেছে! এখন শুধু নতুন একটি সুন্দর দিনের অপেক্ষা!

রাতে ঘুমের মাঝে প্রচন্ড পেট ব্যথা করে সামিয়ার, অ্যাম্বুলেন্স কল করে হাসপাতালে আসলে তাড়াতাড়ি ডেলিভারি ওয়ার্ডে নেয়া হয়। ওদের একটি মেয়ে সন্তান হয়েছিলো কিন্তু সে ছিলো মৃত !

বুকভরা কষ্ট নিয়ে খালি হাতে, শূন্য কোলে বাড়ি ফেরা! তারপর থেকেই মনমরা হয়ে থাকে সামিয়া! বুঝতে পারে সবই জীবনের পরীক্ষা তবু..কেন যে মন মানেনা... বোঝে না..

দুপুরের খাবারের প[র দু-বোন ছাদ বসে টুকটাক গল্প করছে, বড়বোনই সব কথা বলে সামিয়া শুধু হু হা করে মাথা নাড়ায়! সেই কখন থেকে ফুলগাছ গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিয়া! বড়বোন বুঝতে পারে বেচারীর মানষিক অবস্হা! এই অবস্হায় সহানুভূতির বানী শোনানোও যে দুরহ!

চল হাঁটি, বলে উঠে দাঁড়ায় ! দুজনে সামান্য হেঁটে গোলাপ গাছ গুলোর কাছে আসে। বড়বড় দুটি গোলাপের পাশে ছোট্র একটি কলি! আঁধ বোজা এখনো প্রস্ফুটিত হয়নি! ফুলেরা পবিত্রতার প্রতিক তাই ফুল দেখলে মন ভালো হয়ে যায় সবার! সাবিহা ফুলের কলিটা নিয়ে সামিয়াকে দিয়ে বলে এই কলিটাকে ফুটিয়ে তোলতো!

সামিয়া অবাক হয়ে কলিটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এত সুন্দর যদিও অর্ধ প্রস্ফুটিত! কি সুন্দর পাঁপড়ি গুলো একে অপরের সাথে লেগে লেগে আছে! কিন্তু পাঁপড়িগুলোকে মেলে দেয়া তো অসম্ভব! কোন মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়!

দেখ, সামান্য একটা আধঁফোটা গোলাপের কলি, আল্লাহ কি সুন্দর করে এটাকে সৃষ্টি করেছেন তাইনা? আমরা নিজেদের এতো শক্তিশালী মনে করি কিন্তু আমরাও পারবো না কলিটাকে পূর্নাংগ ফুলে রুপান্তরিত করতে! অথচ এটা আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালার জন্য কত সহজ! তিনি যা চান তাই ঘটে! তিনি যদি চান এই কলি প্রস্ফুটিত হয়ে সুরভি ছড়াবে, ফুল বাগানের সৌন্দর্য বর্ধন করবে তবেই ফুলটি ফোটবে আর তিনি যদি চান এই কলি ফুল হয়ে কখনই ফোটবেনা পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই সেই ফুল ফোটাবার!

দুনিয়ার স্বল্প জীবন আমাদের জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র স্বামী, সন্তান, সম্পদ সব কিছুই দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সৌন্দর্য উপকরন! আল্লাহ তার বান্দাদের প্রিয় জিনিষের দ্বারাই পরীক্ষা করেন, পরীক্ষা যত কঠিন, পুরষ্কার ততো দামী! যাদের উপর পরীক্ষা নেয়া হয় তারাই বুঝতে পারে কত কঠিন এই পরীক্ষা, কত কঠিন বিপদে -দুঃখ -কষ্টে অন্তরে এবং মুখে হাসি ফুটিয়ে আল্লাহ'র সিদ্ধান্তের কাছে মাথা নত করা! এক্ষেত্রে ধৈর্য বা সবর মুমিনদের গভীর অন্ধকার বিপদসংকুল কন্টকাকীর্ন পথে আলো হয়ে পথ দেখায়। এই সবরের আলো সূর্যের আলোর মতো প্রখর, তেজস্ব! হাদীসে এই আলোকেই "দ্বিয়া" বলা হয়েছে। যখন বান্দা সকল সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়ে সবর করে তখন যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন সবর করে তখন তা দ্বিয়া হয়ে আলো জ্বালিয়ে জীবনকে আলোকিত করে তোলে! শুধু একটু সময়ের দরকার আলোকিত হওয়ার!

তোর জীবনে বড় বড় দুইটা ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য কেউ দায়ী নয়! আল্লাহ তো আমাদের সৃষ্টি করার ৫০,০০০ বছর আগেই আমাদের তাকদীর লিখে রেখেছেন তাই আমরা যারা মুমিন হতে চাই মুমিনের কর্তব্য হবে হতাশ না হওয়া, ভেংগে না পড়া! এক্ষেত্রে ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি অপরাজেয় হাতিয়াড়ের কাজ করে।

সামিয়া নিরবতা ভেংগে বড় বোনের দিকে তাকায়, মনের মাঝে যে অন্ধার কালো মেঘেরা গুমোট হয়ে ছিলো তাই এখন বড় বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে! আপু আসলে বুঝি, তারপরো কষ্ট হয়! আমি ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করছি সর্ববস্হায় আল্লাহ'র সিদ্ধান্ত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতে তোমরা শুধু আমার জন্য দোআ করো আমি যেনো সফল হতে পারি!

বড় বোন সাবিহা দুহাত দিয়ে বোনর চোখের অশ্রু মুছে দেয়, আল্লাহ আমাদের সবাইকে সবরের আলো দিয়ে উজ্জলপথে চলতে চলার শক্তি দিন!!



বিষয়: বিবিধ

২৫৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File