ধর্মের নামে পতিতাবৃত্তি

লিখেছেন লিখেছেন কাজী সফি আবেদীন ২২ মার্চ, ২০১৭, ০৩:৫১:০২ রাত



ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি এখনও চলছে ভারতে। নারী যেভাবে মন্দির-গণিকা হয়ে যায়। আইন হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি......

ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি (ইংরেজি: Sacred prostitution) হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় পতিতা।

দেবদাসী প্রথার চর্চা ভারতে বেশি ছিল, যেখানে গ্রাম থেকে ছোট মেয়েদের ধরে এনে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী বিয়ে দেয়া হত দেবতার সাথে বা মন্দিরের সাথে এবং তাকে সেখানেই থাকতে হত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করে যে এভাবে উচ্চস্তরের হিন্দুরা দেবদাসীদের সাথে যৌন কর্ম করত জোর করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম।

ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সু্যোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেনঃ ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও গর্বিত ছিলেন তারা মিলিত হতে চাইতেন না। তাদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাকে আনা হত। মহিলারা বাড়িতে ফিরে যেতে পারত না যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে। অপরিচিত কোন লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন তা নিতে আস্বীকার করা পাপ। এভাবে সুন্দরী মহিলারা সহজেই মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোন লোকের সাথে মিলনের আগ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ঐ শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ঐ মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।

মাঝে মাঝে খ্রিস্টান সাধুদের বাধ্য করা হত ধর্মীয় পতিতাবৃত্তিতে। থিওদরা ও ডিদাইমুস এবং আন্তনিয়া ও আলেক্সজান্ডার নামক দু’জোড়া সাধুর ভাষ্যমতে একজন খ্রিস্টান কুমারীকে পাঠানো হচ্ছিল পতিতালয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। পথে একজন দয়ালু মানুষ তার সম্মান রক্ষার্থে শহীদ হন ঐ কুমারীর সাথেই।

ভারতীয় মন্দিরে নিষিদ্ধ দেবদাসী প্রথা আজও চলছে

নিষিদ্ধ হবার পরও ভারতীয় মন্দিরগুলোয় দেবদাসী প্রথা কেন বন্ধ হয়নি – কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার জবাব চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ ওদিকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নতুন করে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারগুলির কাছেও৷ কিন্তু...

শত শত বছর ধরে ভারতীয় মন্দিরগুলোতে চলে আসছে দেবদাসী নামে এই ধর্মীয় প্রথা৷ আসলে এ প্রথা ধর্মের তকমা দিয়ে পুরুষপ্রধান সমাজে নারীকে যৌন শোষণ করার আর একটি প্রক্রিয়া মাত্র৷

মেয়ে যেভাবে মন্দির-গণিকা হয়ে যায়

গরিব ঘরের নীচু জাতের মা-বাবা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুমতী হবার আগেই নিয়ে যায় মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী, আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী৷ অর্থাৎ এরপর অন্য কোনো পুরুষকে মেয়েটির বিবাহ করতে পারে না৷ বরং খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাদের সারা জীবন কাটে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ অনেক সময় সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকাও পালন করতে হয় তাকে৷ করতে হয় কায়িক পরিশ্রমও৷ বলা বাহুল্য, উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে৷

আইন হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি

১৯৮৮ সালে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করা হলেও, এখনও তা বন্ধ হয়নি৷ বিশেষ করে ভারতের দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের মন্দিরগুলিতে এই প্রথা আজও চলছে৷ খুব সম্প্রতি তার প্রমাণও পাওয়া গেছে৷ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাবদিহি করতে বলার পর, ৮০-র দশকের সেই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে পালন করার জন্য রাজ্য সরকারগুলির কাছে নির্দেশিকা পাঠায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর৷ নির্দেশিকায় বলা হয় –– কোনো অজুহাত বা ধর্মীয় ছদ্মনামে এ প্রথা যেন আর চালানো না হয়৷

আর এর জন্য বিশেষ অভিযান চালিয়ে জীবিত দেবদাসীদের খুঁজে বের করে তাদের পুনর্বাসনের কথাও বলা হয়৷ বলা হয়, এই কাজে বিভিন্ন বেসরকারি বা স্বয়ংসেবী সংস্থাগুলোরও সাহায্য নেয়া হতে পারে৷

সমাজবিদদের মতে, দেবদাসী প্রথার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে৷ যেমন ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কার, জাতিভেদ, পুরুষতান্ত্রিকতা, যৌন শোষণ এবং দারিদ্র্য৷ অনেকে আবার ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে দেবদাসী প্রথাকে যুক্ত করতে চান৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অতীতে জমিদার বা ভূস্বামীদের সঙ্গে উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অশুভ ষড়যন্ত্রের ফলে নীচু জাতের খুব গরিব মেয়েদের দেবদাসী বানানো হতো৷ পরে এরা যাথারীতি যৌন লালসার শিকার হতো, এমনকি শেষ পর্যন্ত অনেকের ঠিকানা হতো যৌনপল্লিতে৷ সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই, না মন্দিরে, না কোন ধনীর ঘরে৷

বিষয়: বিবিধ

৮৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File