'মারেফতের' গুপ্ত রহস্য!!

লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯, ০৬:৩৫:৫৮ সন্ধ্যা

শিরোনাম দেখে যা ভাবছেন, তা নয়। অর্থাৎ, এ লেখাটি কোন (আসল বা নকল) মারেফতকে প্রমোট করবার জন্য নয়। আমি মূলত: সমাজে মারেফতের নামে প্রচলিত (অ)বিদ্যা ও (অ)কাজের গোপন রহস্য ও আসল উদ্দেশ্য বের করে আনার জন্য এ লেখাটির অবতারণা করেছি। যেসব মহান ব্যক্তি ও সত্যিকার পীরেরা সত্যিকার অর্থে তাসাউফ চর্চা ও আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা আমার আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নন। বরং বর্তমানে ধ্যান, সাধনা, মারেফত ও বাইয়াতের নামে যে ভ্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক বিষ সমাজে ছড়ানো হচ্ছে, সেই ভাইরাসটারই পোস্টমর্টেমের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার এ প্রবন্ধ।

বর্তমানে প্রচলিত এ বিকৃত মারেফত বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। কেউ ধ্যান, যোগসাধনা ও মেডিটেশনের নামে; কেউ মুরাকাবার নামে; কেউ সুফিবাদ ও মারেফতের নামে এগুলো চর্চা ও দীক্ষাদান করছে। কেউ বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণের নামে ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মহীন, আধুনিকমনা নির্বিশেষে সকলকে এই বিদ্যার সবক দিচ্ছে; আবার কেউ ধর্মের নামে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ও সরলতাকে পুঁজি করে এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এদের দেয়া ধ্যানের শিক্ষা ও অনুশীলনে এবং সেইসাথে কিছু ধর্মীয় বা নৈতিক নীতিকথায় খারাপ বা ক্ষতিকর কিছু থাকে না। কিন্তু এদের মূল লক্ষ্য থাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে মানুষকে বিশেষ ধ্যানধারণায় দীক্ষিত করা, যা ধর্মের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি মানবতার জন্যও ধ্বংসাত্মক। কিন্তু সরলপ্রাণ মানুষের কাছে এদের সূক্ষ্ম ফাঁদ সহজে ধরা পড়ে না। তবে অপরাধপ্রবণ ও দুর্বৃত্ত স্বভাবের লোকজনের কাছে এর উদ্দেশ্য ধরা পড়লেও তারা মনেপ্রাণে এটাই কামনা করে বিধায় একে খুশীমনে বরণ করে নেয়।

আমার চোখে এদের যে উদ্দেশ্যগুলো ধরা পড়েছে, তাহলো:-

(১) কুফর ও শেরেকী ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত করে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করা

(২) সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ঘুঁচিয়ে দেয়া এবং হক ও বাতিল একাকার করে দেয়া

(৩) আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব থেকে মানুষকে সরিয়ে এনে অপরাধী দুর্বৃত্তদের ধর্মদ্রোহী মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে নির্বিঘ্ন করে দেয়া

(৪) আল্লাহর হুকুম পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে দেয়া

(৫) মানুষের শরীর ও মনের উপর জিন শয়তানের আধিপত্য বিস্তারের দরজা খুলে দেয়া

(৬) গায়রুল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে উদ্বুদ্ধ করা

(৭) যাদুবিদ্যা শিক্ষাদানের মাধ্যমে একই সাথে মানুষের ঈমান ধ্বংস করা এবং পার্থিব জীবনকেও নরকে পরিণত করা

আমার পর্যবেক্ষণে আবিষ্কৃত এ উদ্দেশ্যগুলোর প্রমাণ হিসেবে তাদের কিছু কথাবার্তা ও প্রচারণা তুলে ধরছি। মারেফতের পতাকাবাহীরা বিভিন্ন ঘরানা ও প্লাটফরমে অবস্থান করলেও এবং একে অপরের জানের দুশমন হলেও তাদের কিছু অভিন্ন (common) মূল কথাবার্তা, প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড রয়েছে, যেগুলো সম্ভবত ইসলামের শত্রুদের কাছ থেকে ধার করা বলেই মনে হয়। যেমন-

(১) আল্লাহ ও রাসূল (স)-কে এক ও অভিন্ন সত্ত্বারূপে গণ্য করা, যা স্পষ্ট কুফর ও শিরক।

(২) সকল ধর্ম ও মতাদর্শকে এক পাল্লায় মাপা, যার দ্বারা সত্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। জাতধর্ম কিছুই নয়, মানবধর্মই বড় ধর্ম ইত্যাদি বুলি প্রচার।

(৩) উদারতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে এবং 'ইসলাম শান্তির ধর্ম' কথাটির উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা করে ইসলাম ও মানবতার শত্রুদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে সহ্য করা ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করা।

(৪) হাল জামানায় ধ্যানপ্রশিক্ষক ও তাসাউফের প্রবক্তা গুরু ও পীরেরা আল্লাহ ও রাসূলের (সা) নির্দেশ তথা শরীয়তের বিধান পালনকে যতটা সম্ভব খাটো করে পারা যায়, সেই চেষ্টাই করে। কোন কোন পীরেরা বোঝাতে চায়, ধ্যানী হলে আল্লাহকে পেয়েই গেলাম, এই স্তরে গেলে আর নামায-রোযা বা কোন আনুষ্ঠানিক এবাদত-বন্দেগির প্রয়োজনই পড়ে না, বরং সকল হুকুম-আহকামের ঊর্ধ্বে উঠে যায়। কোন কোন পীর আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রমযানের রোজার হুকুমকেই অস্বীকার করে। হাদীসে পুরুষের জন্য অহংকারবশত টাখনুর উপর কাপড় পরিধান হারাম করা এবং দাড়ি-গোঁফের ব্যাপারে মুসলিমদেরকে মুশরিকদের বিপরীত আচরণ করবার নির্দেশ দেয়া হলেও কোন কোন পীরের পদদ্বয় কাপড়ে আবৃত থাকে এবং কোন কোন গুরু গোঁফ ধোয়া পানি খায়। এককথায়, আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র ধ্যান ও যোগের দ্বারা আল্লাহকে পাওয়ার এক মনগড়া মিথ্যা স্বপ্নে বিভোর করে রাখার এক ফাঁদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয় এখনকার মারেফতি ধারাগুলো।

(৫) এখনকার প্রচলিত ধ্যানের সবচেয়ে মারাত্মক প্রবঞ্চনাটি হলো, মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের প্রলোভন দেখিয়ে শয়তানের গোলামে পরিণত করা হয়। মানুষ ভাবে, মোরাকাবা ও কাশফের দ্বারা আল্লাহর কুদরতে অদৃশ্য জিনিস দেখতে ও জানতে পারছে, অথচ এটা হয় শয়তানের সাহায্যে। [ওলী-বুযুর্গদের সত্যিকার মোরাকাবা ও কাশফের কথা এখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং বর্তমানকালের ভণ্ড যোগীদের বিশেষ এক ধ্যানের সম্পর্কেই এখানে বলা হচ্ছে।] তৃতীয় চক্ষু ওপেন করার নামে 'চক্র' নামক এক বিশেষ ধ্যান করিয়ে থাকে ধ্যানী গুরুরা, যেটা এসেছে পৌত্তলিক ধর্ম থেকে, সেখানে শরীরের নিচের দিক থেকে ক্রমে ক্রমে মেরুদণ্ডে বিদুৎপ্রবাহের ন্যায় অনুভূতি তাড়িত করা হয়। এখানে মূলত জিন শয়তানকে নিজের শরীরের উপর প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয় এবং এভাবে মানুষ শয়তান কর্তৃক অধিকৃত হয়ে পড়ে। আগের দিনে ওলী-বুযুর্গগণ ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহকে পেতেন, কিন্তু এখনকার যোগী গুরু ও ভণ্ডপীরেরা আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে পাইয়ে দেয়।

(৬) ধ্যানী, যোগী বা সুফীরা কেউ দেবদেবীর উপর, কেউ মরহুম ওলীগণের উপর আবার কেউবা প্রকৃতির উপর ভরসা করতে শেখায়। বিভিন্ন ধর্মে দেব-দেবী বলতে যা আছে তার কিছু কাল্পনিক, কিছু বিখ্যাত মৃত ব্যক্তিদের নামে তৈরি, আর কিছু আছে জিন। তবে যে দেব-দেবীকেই ডাকা হোক না কেন, যদি কেউ সাড়া দিয়ে থাকে বা ভাল-মন্দ কোন ঘটনা বা অঘটন কিছু ঘটিয়ে থাকে, সেটা জিন ছাড়া আর কারো করার কথা নয়। বলাবাহুল্য, কোন ভালো জিন মানুষের কাছে নিজের নামে উপাসনা বা উৎসর্গ কামনা করে না, এ কেবল শয়তান জিনদেরই কাজ। মুসলমানদের মধ্যে সুফীবাদীদের মধ্যে কবরবাসী ওলীগণের কাছে প্রার্থনা করা এমনকি মাজারে মানত করবার প্রচলন আছে। এখানেও মাজারের যত কেরামতি শোনা যায়, তাও মূলত জিনদের কারসাজি বৈ কিছু নয়। মাজারে কৃত মানত ভঙ্গ করবার দায়ে স্বপ্নে হুঁশিয়ারি পাওয়া এবং তারপর বাচ্চার জীবন হারানোর যে সকল কেচ্ছা-কাহিনী লোকমুখে শোনা যায়, সেগুলো সত্য হয়ে থাকলে জিন শয়তানদেরই কুকর্ম হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য, আফ্রিকায় কোন কোন মাজারে রুকিয়া করতে গিয়ে জিন ধরা পড়েছে এবং তারা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বিভ্রান্ত করবার কথা স্বীকার করেছে। এবার আসি ধর্মনিরপেক্ষ বা সর্বধর্মবিশ্বাসী আধুনিক ধ্যানী ও যোগীদের প্রসঙ্গে। এরা আবার মানুষকে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হতে শেখায়। নিজেকে প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু যেমন লোহা, তামা, সাগর, সাগরের ডলফিন ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া এবং তারপর এই মর্মে আশ্বাস দেয়া, "যেহেতু আপনি প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন, সেহেতু আপনার সমস্যাটি এখন আর আপনার একার সমস্যা নয়, বরং গোটা প্রকৃতির সমস্যায় পরিণত হয়েছে।" অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মুমিনদের একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত। যেখানে আল্লাহই মুমিনদের জন্য যথেষ্ট, সেখানে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা ও আল্লাহর উপর ভরসা করবার এ সরল পন্থা বাদ দিয়ে প্রকৃতির শক্তির উপর ভরসা করবার হেতুটা কি? দেব-দেবী বা কবরে শায়িত বুযুর্গদের কাছে সাহায্য প্রার্থনারই বা হেতু কি? এর সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহর কাছে কেবল বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত বিষয়েই সাহায্য চাওয়া যায়, কেবল যুক্তিসঙ্গত আবদারই পেশ করা যায়। তদুপরি আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে হলে নিজেও ব্যক্তিগতভাবে ঈমানদার, চরিত্রবান ও মুত্তাকী হতে হয়। কিন্তু প্রকৃতির কাছে বা জিনদের কাছে সাহায্য চাইবার জন্য আর ঐ শর্ত প্রযোজ্য নয়। স্রষ্টাকে পাশ কাটিয়ে সৃষ্টিকে বশ করা শয়তানী যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।

(৭) ধ্যান (মেডিটেশন/মুরাকাবা) শেখানোর ছলে শয়তানী যাদুবিদ্যা শিক্ষাদান করা। সুফীবাদী পীর থেকে শুরু করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যানী গুরু সবাইকেই যাদুবিদ্যার পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়। পীরেরা অনেকেই আছেন, যারা মানুষের চাহিদা ও বাসনা প্রদানের তদবির প্রদানের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম পার্থক্য করেন না। যেমন- কাউকে মনের মানুষকে কাছে পেতে সহায়তার জন্য জীবন্ত মুরগীর বাচ্চা চুলার উপর ছ্যাঁকার তদবির প্রদান করেন, যা স্পষ্টত শয়তানের কাজ। সুফীবাদী পীরের মুরীদগণকেও বিভিন্ন শেরেকী মন্ত্র চর্চা করতে দেখা যায়, যার মধ্যে মানুষের অনিষ্টকামনার কথাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর আধুনিক ধ্যান ও মেডিটেশনের গুরুরা শুধু শেরেকিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং কুফরী মন্ত্রও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তবে এই আধুনিক যোগী গুরু-শিষ্যরা সুফীবাদী পীর-মুরীদদের মতন প্রকাশ্যে যাদুমন্ত্র চর্চা করে না, বরং গোপনীয়তা বজায় রাখে।

ইতিপূর্বে ৫ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত 'চক্র' মেডিটেশনে জিন শয়তানদেরকে নিজের শরীরের উপর প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া ধ্যানের ভিতর অন্তর্গুরুর কাছ থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ ও সুরক্ষা গ্রহণ করা হয়। একজন মানুষ কিভাবে আরেকজন মানুষের মনের ভিতর ঢুকে নিয়মিত বুদ্ধি-পরামর্শ দেবে, তা বোধগম্য নয়। বিশেষ করে যখন গুরুকেই সব শিষ্যরা অন্তর্গুরু বানিয়ে ধ্যান করে থাকে, সেখানে একজন গুরুর পক্ষে ২৪ ঘন্টা ধ্যানের মধ্যে পরামর্শ দেয়া কি করে সম্ভব? মাইকে বক্তব্য না হয় হাজারো মানুষকে একসাথে শোনানো যায়, কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার অনুসারীকে ধ্যানের মধ্যে গাইড করা কি গুরুর একার পক্ষে সম্ভব? গুরু নিজে কি স্মরণ করে বলতে পারবেন, শিষ্যদের মধ্যে কাকে ধ্যানের মধ্যে কি পরামর্শ দিয়েছেন? তাহলে ধ্যানের মধ্যে গুরুর সুরতে কিংবা যেকোন পরিচিত বা অপরিচিত সুরতে আগমনকারী ব্যক্তি আসলে কে? এসব ধ্যানী শিষ্যরা কি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে একজন করে জিন শয়তানকেই নিজের অন্তর্গুরু বানিয়ে নিচ্ছে? এরকম ক্ষেত্রে ধ্যানের স্তরে কথিত অন্তর্গুরুর কাছ থেকে নিত্য নতুন কুফরী কালাম শিখে নেয়াও অসম্ভব নয়।

যাদুবিদ্যা মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করারই পন্থার নাম। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক জগতে বিরাজমান সকল পদার্থের মাঝে যে অণু-পরমাণু ও এনার্জি রয়েছে, মানুষের মনের ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করে সেই প্রাকৃতিক শক্তিকেই বশ করে নিজের কার্যসাধনে নিয়োজিত করা হয়। এ অনেকটা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মধ্যকার সংযোগের মত। ধ্যান ও যোগসাধনায় মনের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে প্রাকৃতিক শক্তিকে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে কাজে লাগানোরই শিক্ষা দেয়া হয়। আল্লাহর কমান্ডের অধীন সৃষ্টিজগতের চেইন অব কমান্ডে অনধিকার প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাটা আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। আল্লাহ যদিও সৃষ্টিজগতকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, কিন্তু তার একটা সীমাও আছে। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে প্রকৃতিকে নির্দিষ্ট দিকে চালিত করবার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহর এই প্রকৃতিকে অনধিকারভাবে বশ করে খেয়ালখুশীমত ব্যবহার করা হয় বলেই এটা কুফরী যাদুর অন্তর্ভুক্ত। তবে যাদুকর্মটি কুফরীর অন্তর্ভু্ক্ত হবার মূল কারণ হলো কুফরী কালাম বা কুফরী কাজের দ্বারা শয়তানকে খুশী করা।

কথিত মারেফতের প্রচারক গুরু বা পীরেরা মানুষের কাছে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হাসিলের জন্য কৌশলে কোরআনে বর্ণিত নেতার আনুগত্য সম্বলিত আয়াত এবং হাদীসে উল্লেখিত প্রত্যেক জামানায় একজন করে মোজাদ্দেদ বা সংস্কারক আগমনের কথা প্রচার করে। মজার ব্যাপার হলো, হাদীসে প্রতি যুগে একজন মোজাদ্দেদ আসার কথা থাকলেও আমরা আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে শত শত মোজাদ্দেদ হাজির আছেন! প্রত্যেক গুরু ও পীর সাহেবই নিজ নিজ ভক্তদের কাছে জামানার মোজাদ্দেদ, যার হাতে বাইয়াত না হলে ঈমানটা চলে যাবে! নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা, নেতার আনুগত্যের অপরিহার্যতা, বাইয়াতের জরুরত এগুলোর বয়ান করে ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে গুরু বা পীরের শিষ্য বানানো হয় এবং তারপর সেই অন্ধ আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে ধ্বংসাত্মক শয়তানী বিদ্যায় দীক্ষিত করা হয়।

খল প্রতারক ভণ্ড অনিষ্টকারী লোকদের কিছু চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, "আর এমন কিছু লোক রযেছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা সাক্ষ্য স্থাপন করে আল্লাহকে নিজের মনের কথার ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক। যখন ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণনাশ করতে পারে। আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না।" (সূরা বাকারা, আয়াত ২০৪-২০৫) ধ্যানী গুরু ও পীরদের কথাবার্তাও হয়ে থাকে মনভোলানো। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, যেন সত্য ও কল্যাণের দিকেই মানুষকে ডাকছে। কিন্তু তারা কার্যত এমন সব বিদ্যা শিক্ষা দেয়, যার দ্বারা মানুষের শস্যক্ষেত্রতুল্য নারীর গর্ভ এবং মানব শিশুর জীবন নষ্ট করা যায়, প্রসূতি হত্যা করা যায়। আর এদের এসব আকর্ষণীয় মনভোলানো কথাবার্তার উৎস কোথায়, তারও ধারণা পাওয়া যায় এই আয়াত থেকে, "এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি মানুষ ও জিনের মধ্যকার শয়তানদেরকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তার প্রত্যাদেশ পাঠায়।" (সূরা আনআত, আয়াত ১১২) এতে বোঝা যায়, তাদের কথাবার্তা ও যুক্তিতর্ক সবকিছু শয়তানের তরফ থেকেই তাদের মনের ভিতর নাযিল হয়ে থাকে। তাই তো তারা বিভিন্ন ঘরানার হলেও তাদের যুক্তিতর্কের ধরন একই রকমের হয়ে থাকে। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এক পরিবারে আল্লাহদ্রোহী এক শয়তান মহিলা শিশু নির্যাতনে অভ্যস্ত ছিল এবং ছলে-বলে-কৌশলে শিশুকে আল্লাহর দ্বীন থেকে সরিয়ে শয়তানের পথে পরিচালিত করতে নিবেদিত ছিল। বাচ্চা যাতে ভবিষ্যত জীবনে দ্বীনদার হতে না পারে, সেজন্য শৈশবেই বমি খাইয়ে শারীরিকভাবে অপবিত্র করে দেয়ার বন্দোবস্ত করেছিল। উক্ত পরিবারে সেই তাগূতী মহিলার দু'একজন কট্টর অন্ধ সমর্থক মেয়েলোক ছিল, যারা সর্বাবস্থায় তার ঐ নিষ্ঠুর শয়তানী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানাতো ও সহায়তা করত। প্রথমে এরা গায়ের জোরেই চড়া গলায় সেই জালেম মহিলাকে সমর্থন জানাতো। কিন্তু যখন তারা একজন ধ্যানী গুরুর কাছে কোর্স করে দীক্ষা গ্রহণ করল, তারপর থেকে সেই সমর্থনে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। অপরাধী জালেমের সমর্থনে সাজানো গোছানো যুক্তি পেশ করা শুরু হলো। ইসলামের দয়া, ক্ষমাশীলতা, পিতামাতার ফযীলত ইত্যাদি বয়ান করবার পাশাপাশি কিছু কিছু অভিনব চমকপ্রদ যুক্তি প্রদর্শন করা হলো, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি যুক্তি হলো— "আল্লাহই যেখানে শিশুটিকে ঐ অবস্থায় (অর্থাৎ, জালেম নারীর হাতে নির্যাতিত অবস্থায়) রাখতে চাচ্ছেন, সেখানে বাচ্চাটিকে ওখান থেকে উদ্ধার করবার চিন্তা 'খোদার উপরই খোদগিরি', আল্লাহর ফয়সালাকেই অস্বীকার করবার নামান্তর!" তার মাত্র সোয়া এক যুগ পার হতেই সুফী ঘরানার লোকজনের কাছে একই ধরনের যুক্তি শুনলাম, "ইসলাম হেফাজতের মালিক আল্লাহ। কোন মানুষ যদি ইসলামের হেফাজত করতে চায়, তাহলে সেটা কুফরী!" [উল্লেখ্য, সেই ব্যক্তি পরবর্তীতে কিছুকালের জন্য মজলুম শিশুর পক্ষে ও জালেম মহিলার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও যখন এ ব্যাপার নিয়ে গুরুর কাছে যায়, তখন গুরু তাকে ধমক দিয়ে বলেন, "যার নিজের জীবনই ব্যর্থ, সে আবার অন্যের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় কেন?" এরপর এক পর্যায়ে সেই ব্যক্তি নিজেই এক অনিষ্টকারী ধোঁকাবাজ শয়তানে পরিণত হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তার গুরুই তাকে মজলুমের পক্ষে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছে এবং জুলুমের পথে ধাবিত করেছে।]

মানুষকে আকৃষ্ট করবার জন্য সব সিলসিলার ধ্যানী সাধকরাই কিছু অভিন্ন আকর্ষণীয় বুলি ও শব্দ ব্যবহার করে। কেউ আত্মশুদ্ধি ও মানবসেবার নামে, কেউ বা নবীপ্রেমের নামে মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা করে। এর প্রত্যেকটা টার্ম শুনলেই মনে হবে, ন্যায় ও সত্যের পথেই তো দাওয়াত দেয়া হচ্ছে! কিন্তু এই ভালো ও সুন্দর শব্দমালাকেই কৌশলে খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কথিত সুফী সাধকদের মধ্যে যারা আল্লাহকে পাওয়ার কথা বলে মানুষকে পটায়, তারা আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে পাইয়ে দেয়, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যারা অতিরিক্ত নবীপ্রেমের কথা বলে নবীর উম্মতগণকে আকৃষ্ট করে, তাদের নবীপ্রেম বলতে শেষ পর্যন্ত নবীকে আল্লাহ সাব্যস্ত করা ছাড়া আর কিছু থাকে না। তবে প্রথম পর্যায়ে তারা শিষ্যদেরকে একথা নাও বলতে পারে, হয়তো বছর পাঁচেক তাদের সাথে থাকলে পরে এই দীক্ষা দেবে। যখন উদারতা ও ক্ষমাশীলতার কথা শেখানো হবে, তখন বুঝবেন; জালেম ও অপরাধীদেরকে সুরক্ষা প্রদান ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের লক্ষ্যে আপনাকে গড়ে তোলা হচ্ছে। যখন 'ইসলাম শান্তির ধর্ম' এ কথাটি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হবে, তখন বুঝবেন, ইসলামের শত্রুদের তাণ্ডব চালানোর পথকে কণ্টকমুক্ত করারই বাহানা মাত্র। যখন মানবপ্রেম ও মানুষের প্রতি মমতার বুলি কপচানো হবে, তখন বুঝবেন মানবপ্রেমের নামে অমানুষদের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রদর্শনেরই সবক দেয়া হচ্ছে। কারণ, এই ভণ্ডরা যতই উদারতা ও মানবদরদের কথা বলুক না কেন, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, তাদের এই উদারতা ও দয়াশীলতা কেবল শয়তান ও জালেমদেরই একচেটিয়া প্রাপ্য হয়, সত্যিকার মজলুম ও নিরপরাধ মানুষরা এদের কাছে সহানুভূতির যোগ্য বিবেচিত হয় না। এমনকি ধ্যানের শক্তিকে কুফরী জাদুর কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষের ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রেও তাদের ক্ষমা ও শান্তির বাণী কোন বাধা হয়ে দাড়ায় না।

আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, মুসলমানদের বা ইসলামের দাবিদারদের মধ্যে মাত্র একটা গোষ্ঠীই আছে, যাদেরকে ইসলামের শত্রুরাও লাইক করে। এরা যতই আল্লাহপ্রেম, নবীপ্রেম ও মানবপ্রেমের বুলি আওড়িয়ে দলে লোক জড়ো করুক না কেন, ইসলাম-কুফর ও মানব-দানবের দ্বন্দ্বে এরা সবসময় কুফর ও দানবের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। ধর্ম অবমাননার প্রশ্নে এরা সর্বদা নবীপ্রেমিক জনগণের বিপক্ষে নবীর অবমাননাকারী কুলাঙ্গারদের পক্ষে দলীল-প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়। ইসলামের লেবেল থাকার পরেও এরা কেন ইসলামের শত্রুদের কাছে এত প্রিয়? তা মূলত এদের তিনটি অবদানের কারণে:- প্রথমত, কুফর ও শিরকী আকীদা দিয়ে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করে শয়তানের ষোলকলা পূর্ণ করছে; দ্বিতীয়ত, সারাজীবন যতই নবীপ্রেমিক সাজুক না কেন, জরুরী সময়ে ঠিকই 'জাতে মাতাল তালে ঠিক' হয়ে ইসলামের বিপক্ষে সমর্থন প্রকাশ করছে; তৃতীয়ত, ধ্যানের নামে শয়তানী যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিয়ে মুসলমানদের দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাবেল শহরে যেই কুফরী যাদুবিদ্যার উৎপত্তি ঘটেছিল; তা মূলত কথিত ধ্যানী, যোগী ও সুফীরাই ধরে রেখেছে এবং আজকের জামানায় তার প্রচার ও প্রসার ঘটাচ্ছে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File