ফেসবুক এক কৃষ্ঞগহবর - অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরী

লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৭:২২:৪৯ সন্ধ্যা

মহাকাশের ব্লাকহোল তথা কৃষ্ঞগহবরে বহু নক্ষত্র হারিয়ে যায়। ফেসবুকও অনেকটা কৃষ্ঞগহবরের মতই। আমাদের নতুন প্রজন্মের টিন এজার থেকে শুরু করে তদূর্ধ বয়সের ছেলেমেয়েরাও ফেসবুকে নানান গোষ্ঠীর সংসর্গ ও প্রভাবে ঈমান ও চরিত্র হারিয়ে বসছে। আর এই হারিয়ে যাওয়া বলতে যে নিছক প্রেম-প্রীতি করে নৈতিক বিপর্যয়ে জড়ানো তা নয়, বরং ধর্মদ্রোহিতা ও নাস্তিকতার করাল গ্রাসেও নিপতিত হচ্ছে বহু ছেলেমেয়ে। আপনার সন্তান আপনার পরিবারে হয়তো আপনাদের মতই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, মুসলিম হিসেবেই নামায-রোযা সব পালন করছে, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় যে কোন্‌ স্তরে চলে গেছে, সেই খবর কি আপনি রাখেন? আকীদা-বিশ্বাসে বিভিন্ন ভ্রান্ত গোষ্ঠীর পাশাপাশি খোদ ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়াটাও অসম্ভব নয়।

ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক বলেন, শিরকী চিন্তাধারার সুফীবাদী বলেন, আর উগ্র মারমুখী চিন্তাধারার সালাফী বা জেএমবি বলেন, সবাই কিন্তু ছেলেমেয়েদেরকে নিজ নিজ গোষ্ঠীর দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফেসবুক হচ্ছে তাদের মৎস্য শিকারের এক উপযুক্ত জলাশয়। বলাবাহুল্য, তারা কিন্তু শুরুতেই নিজেদের আসল পরিচয় ও উদ্দেশ্য audience দের কাছে ধরা দেয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কিছু বিষয় ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দেয়। নেশাজাতীয় দ্রব্য গেলাতে পারলে যেমন আপনাআপনি তাকে যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত করা যায়, তেমনি প্রত্যেকটি অশুভ গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ ক্ষতিকর ও ভ্রান্ত মতবাদে দীক্ষিতকরণের জন্য প্রথমে ভিন্ন কোন মুখরোচক ও আকর্ষণীয় বুলি দিয়ে আকৃষ্ট করে এবং এমন মানসিকতা গড়ে তোলে যে, এরপর যেকোন সময়ে সুযোগ বুঝে তাদের আসল কথাটা পাড়লেই ভিকটিম তা আত্মস্থ করে নেবে।

ছেলেমেয়েদের জন্য ক্ষতিকর বা ধ্বংসাত্মক মতবাদসমূহকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি; যথা-

১। ধর্মবিরোধী মত, অর্থাৎ সরাসরি ধর্মবিদ্বেষী করে গড়ে তোলা। এর আবার দুটি ক্যাটাগরি আছে:-

(ক) সেকুলারিজম বা ধর্মহীনতা তথা ধর্মবিমুখতা

(খ) এথেইজম তথা নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষ

২। ভ্রান্ত ধর্মীয় মতবাদ, অর্থাৎ ধর্মের নামেই কোন ভ্রান্ত ও বিকৃত মতাদর্শে দীক্ষিত করা। এর আবার দুটি শাখা আছে:-

(ক) চরমপন্থা ও অসহিষ্ঞুতা

(খ) বেদআত ও শেরেকী

আবারো বলছি, উপরোক্ত ক্ষতিকর মতাবাদগুলি কখনো ছেলেমেয়েদের কাছে একবারে প্রকাশ করা হয় না, বরং ধাপে ধাপে দীক্ষিতকরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোন লম্পট পুরুষ যদি কোন মেয়েকে বলে, "আমি তোরে ..মু", তাহলে কি মেয়েটা ভুলেও তাতে সাড়া দেবে? কামুক লোকটাকে কি তৎক্ষণাত জুতার বাড়ি খেয়ে বিদায় নিতে হবে না? কিন্তু যখন বলা হয়, "আমি তোমাকে ভালোবাসি, একটু কাছে আস না, একটু ভালবাস না"; তখন কিন্তু মেয়েটা তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না, বরং তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে; কিন্তু লম্পট লোকটার উদ্দেশ্য ঠিকই হাসিল হয়।

এবার আসি আসল কথায়। কিভাবে আপনার সন্তানকে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করবেন? ফেসবুক বন্ধ করার হুকুম জারি করবেন? ভুলেও না। এটা করলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। টিভি বা ইন্টারনেট বন্ধ করাটা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। বরং টিভি দেখার সময় আপনিও সন্তানের সাথে বসে দেখুন। আর ফেসবুক আপনারও থাকতে হবে এবং আপনার সন্তান-সন্ততিকে অবশ্যই আপনার ফ্রেন্ড হিসেবে অ্যাড করতে হবে। তাতে অন্তত তাদের লাইকগুলো আপনি দেখতে পারবেন। পোস্ট ও শেয়ারগুলো আপনার থেকে লুকানো সম্ভব হলেও লাইক গোপন করার অপশন আমার জানামতে নেই। এছাড়া লাইক কেউ গোপন করবার খুব একটা প্রয়োজনও বোধ করে না, যেহেতু নিছক লাইক দেবার দ্বারা খুব বেশি তিরস্কৃত বা অপমানিত হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু লাইক নামক ছোট্ট এই জিনিসটার দ্বারা আপনার সন্তানদের মন-মানসিকতা এখন কোন্‌ পর্যায়ে অবস্থান করছে, তা অনায়াসে নির্ণয় করতে পারবেন। মনে রাখবেন, ভুলবশত লাইক একটা, দুইটা বা তিনটা পর্যন্ত হতে পারে, কিন্তু বারবার হতে পারে না। যখন কোন একই জাতীয় লেখাতে আপনার সন্তানদের অনবরত লাইক প্রদান করতে দেখবেন, তখন বুঝে নেবেন, সন্তানের চিন্তাধারা ঐ দিকেই যাচ্ছে।

আপনার সন্তান কোন বিশেষ মহলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে কিনা বা বিশেষ চিন্তাধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে কিনা, তা চেনার আলামত নিম্নরূপ:-

(১) 'তাওহীদ', 'তাগূত' ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ (keywords) যুক্ত পোস্ট পছন্দ করবার নিদর্শন হলো, আপনার সন্তান কোন চরমপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী দলের পাল্লায় পড়েছে, যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বা এসব কাজের সমর্থক।

(২) সব ভুল, সব কুফরী, এটা সহীহ নয় ওটা সহীহ- এ টাইপের লেখাতে লাইক দিতে দেখলে বুঝবেন, হয় সালাফী তথা আহলে হাদীস গ্রুপের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, অথবা তোয়াহা, পন্নী বা তৌফিকুল হাসান টাইপের কোন লোকাল ভগলা লোকের খপ্পরে পড়েছে।

(৩) কারবালার 'প্রকৃত' ইতিহাসের ব্যাপারে যদি কাউকে আগ্রহী দেখেন, তাহলে নির্ঘাত ধরে নেবেন, এজিদপন্থী রাজকীয় সালাফী গোষ্ঠীর লেজুড় ধরতে যাচ্ছে।

(৪) 'খেলাফত', 'আল্লাহর আইন', 'তাওহীদ', 'তাগূত' ইত্যাদি কথামালাকে মনের মত ব্যাখ্যা সম্বলিত লেখালেখির সাথে কাউকে যদি একমত হতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, হিজবুত তাহরীর, হিজবুত তাওহীদ ইত্যাদি মাথামোটা কোন দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।

(৫) আল্লাহর রাস্তায় কোন ভুল করলে আল্লাহ মাফ করে দেন- এ জাতীয় উদ্ভট কোন কথার সাথে যদি কাউকে সহমত প্রকাশ করতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, ইসলামের ভ্রান্ত ব্যাখ্যার অনুসারী ও মনগড়া পন্থায় ইসলাম কায়েমের ব্যর্থ চেষ্টাকারী কোন রাজনৈতিক দলের পাল্লায় পড়েছে এবং যেকোন সময় যেকোন জিনিস সহ র‍্যাবের হাতে ধরা পড়ে ক্রসফায়ারে মরবে।

(৬) যদি শুধু আলী (রা), ফাতেমা (রা), হাসান (রা) ও হোসাইন (রা)-এর অতিরিক্ত প্রশংসা করতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, হয় শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হচ্ছে, অথবা কথিত সুফী নামধারী মাজারপন্থীদের দলভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুদিন এভাবে চলতে দিলে আবুবকর (রা), উমর (রা), উসমান, আয়েশা (রা) সকলের মুণ্ডুপাত করা শুরু করবে।

(৭) খাজাবাবা, ওরস, লালন ইত্যাদি নিয়ে যদি মাতামাতি করতে দেখেন; আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা) মাটির তৈরি নাকি নূরের তৈরি এ বিষয়ে বেশি উৎসাহী দেখেন; তাহলে বুঝে নেবেন, কথিত সুফী, মাজারী বা ভাণ্ডারীদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং দু'দিন পর বলতে শুরু করবে, আল্লাহ ও রাসূল (সা) এক ও অভিন্ন, কেউ কারো থেকে আলাদা নন, রসূলের রওজাকে আল্লাহর আরশের ঊর্ধ্বে না মানলে কাফের হবে ইত্যাদি।

(৮) ধর্মটা কোন ব্যাপার নয়, মানবধর্মই বড় ধর্ম, ধর্ম যার যার উৎসব সবার, ধর্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো- এসব কথায় যদি সায় দিতে দেখেন; 'অসাম্প্রদায়িক' ও 'সংস্কৃতিমনা' হবার দিকে যদি বেশি ঝোঁক দেখেন; তাহলে বুঝবেন সেকুলার মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে এবং ধর্মকে উপেক্ষা করবার মানসিকতা ক্রমে জাগ্রত হচ্ছে।

(৯) 'শ্রেণি সংগ্রাম', 'শ্রেণি চরিত্র', 'পুঁজিপতি', 'মেহনতি মানুষ', 'সাম্রাজ্যবাদ', 'মৌলবাদ', 'ধর্মব্যবসা' ইত্যাদি কথামালা সম্বলিত পোস্টে যদি আপনার সন্তানকে লাইক দিতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, সে কমুনিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

(১০) 'বিজ্ঞানমনষ্কতা', 'মুক্তবুদ্ধি', 'মুক্তচিন্তা', 'কুসংস্কার', 'অন্ধবিশ্বাস', 'ধর্মান্ধতা', 'কুপমণ্ডুকতা' ইত্যাদি শব্দমালা সম্বলিত পোস্টে লাইক দেবার প্রবণতা যদি আপনার সন্তানের মাঝে দেখতে পান, তাহলে বুঝবেন, সে কট্টর নাস্তিকদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে এবং আজ না হোক কাল সে আল্লাহ ও রসূলকে নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি শুরু করে দেবে।

(১১) আপনার সন্তানের মধ্যে যদি অতিরিক্ত নারীদরদ দেখতে পান, নারী স্বাধীনতা সংবলিত পোস্টে অতিরিক্ত লাইক দিতে দেখেন, 'নারী', 'মেয়ে' ইত্যাদি শীর্ষক পেজগুলো লাইক করতে দেখেন; 'ধর্ষণ' বিষয়টা নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি করতে দেখেন; তাহলে বুঝবেন সে নারীবাদী হয়ে উঠছে এবং দু'দিন বাদে বলতে শুরু করবে, ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে, পুরুষকে জিতিয়েছে, ইসলামের নবী নিজে পুরুষ হওয়ায় ইচ্ছে করে মেয়েদের বিপক্ষে ফয়সালা দিয়ে গেছে ইত্যাদি।

(১২) মুসলমানদের কিংবা নির্যাতিত নিরপরাধ মানুষের কোন সম্প্রদায়ের প্রতি যদি অন্ধ ও অযৌক্তিক বিদ্বেষ সম্বলিত অপবাদ ও গুজবমূলক পোস্টে কাউকে লাইক দিতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, সে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী দুষ্টচক্রের খপ্পরে পড়েছে এবং উগ্র নাস্তিক্যবাদী মনাদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ না করুন, ক'দিন পর সে হয়তো আমাদের নবীকে নিয়েই বলতে শুরু করবে, মোহাম্মদই যত নষ্টের মূল!

এতক্ষণ যা করলাম, তা হলো ডায়াগনোসিস বা রোগনির্ণয়ের কাজ। আপনার সন্তানকে যদি উপরোক্ত কোন ব্যাধির এক বা একাধিক ব্যাধিতে কিংবা অন্য যেকোন মানসিক বিভ্রান্তি বা বিপথগামিতার রোগে আক্রান্ত হবার আভাস পান, তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা কিভাবে করবেন, তা এবার আলোচনা করা যাক। সন্তানের সংশ্লিষ্ট পোস্ট, শেয়ার, কমেন্ট বা লাইককৃত পোস্ট মনোযোগ দিয়ে পড়বেন এবং সেগুলোর ভ্রান্ত কথাবার্তা খণ্ডনের উপযোগী সঠিক তথ্য ও সত্য আকীদা সম্বলিত লেখা তাকে পড়তে দেবেন। সরাসরি বইপত্র এনেও পড়তে দিতে পারেন, অথবা আপনার ফেসবুকেও পোস্ট বা শেয়ার দিতে পারেন, যাতে করে তা আপনার সন্তানের নজরে আসে। রোগ যদি নিরাময়যোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো নিরাময় হবে।

সবশেষে বলছি, প্রত্যেক পিতামাতার উচিত তার প্রত্যেক সন্তানের ফেসবুক আইডির সাথে নিজের আইডির বন্ধুত্ব করে রাখা এবং তাদের লাইক-পোস্ট ও শেয়ার একদম শুরু থেকেই মনিটর করা। অবশ্যই সেটা নিজের কম্পিউটারে বসে; কারণ কখনো সন্তানের কম্পিউটারে উঁকিঝুঁকি মারতে গেলে প্রাইভেসি নষ্ট হবার দরুন ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। যদি একদম প্রথম থেকেই সন্তানের আকীদা, স্বভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়ে, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে তা সহজে নিরাময় করা সম্ভব হতে পারে।

আল্লাহ আমাদের সকলকে নিজেরা জাহান্নাম থেকে বাঁচা এবং সন্তান-সন্ততিগণকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে রাখার তওফীক দান করুন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

৮০৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385576
২৩ জুন ২০১৮ সন্ধ্যা ০৭:১৮
হতভাগা লিখেছেন : ১১. শতকরা ১০০% নারী এই ধারনায় বিশ্বাসী।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File