এক গভীর ষড়যন্ত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত আমিন ২৭ মে, ২০১৬, ০৪:২৪:০৭ বিকাল



শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আন্দোলন করছে।তাদের দাবি নাস্তিক্যবাদের প্রসার ঘটান হয়েছে নতুন প্রবর্তিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে।

একদিকে প্রায় শতভাগ পাশের হার,নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাস,শিক্ষাখাতে দুর্নীতির মহোৎসব,মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারী নজরদারি বাড়ান তার সাথে যুক্ত হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে নাস্তিক্যবাদের প্রসার নিয়ে এই আন্দোলন।সব মিলিয়ে শিক্ষাখাতে এক ভয়াবহ নৈরাজ্য!

এর আগের একটি লেখায় আমি তুলে ধরেছিলাম কামাল পাশা তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে তুর্কীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটান।এই লক্ষে প্রথমেই টার্গেট করা হয় শিক্ষা ব্যবস্থা কে।এই ব্যপারে বিস্তারিত পড়তে পারেন ফেসবুকে আমার এই লেখাটায়-https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10207876115413140&id=1603545510 এবং https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10207887800225253&id=1603545510

১ম থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক মানে বাইবেল,যেহেতু এর বাইরে কোন গল্প,সাহিত্য,বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাসের বই পড়ার এ সময়টাতে কোন ব্যবস্থা থাকেনা।তাই প্রজন্মকে আপনি নিজের মতাদর্শে চালিত করতে এই সময়টাকে বেছে নিতে চাইবেন।মাধ্যমিক পাশ করার পর সেই প্রজন্মকে আপনি আর নতুন করে কিছু শেখাতে পারবেন না।কেননা তার শিক্ষার ভিত্তিটা ততদিনে মজবুত হয়েছে।

আর নিজের মতবাদ কে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিটি বাহিনীতে,প্রতিটি সেক্টরে নিজের দীক্ষায় দীক্ষিত জনবল নিয়োগ করার মাধ্যমে এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবতার মুখ দেখে।

১৯৩৮ সালে তুরষ্কে কামাল পাশার পতনের পর তুরষ্কের রাজনীতিতে তার আদর্শের লোকদের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে পরবর্তী কয়েক দশক।১৯৬০ সালে ক্ষমতায় গেলে আরবীতে আযান পুনরায় প্রচলন করলে নতুন শাসক কে ক্ষমতাচ্যুত করে সেই কামালীয় আদর্শে দিক্ষীত গোষ্ঠী। পরে তাকে এই অপরাধে ফাসি দেয়া হয়।এই হল পরিবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফল।

এবার আমাদের পরিবর্তিত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় কি আছে একটু দেখে আসি-

১.

পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ‘এই দেশ এই

মানুষ’ রচনাটিতে মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন পেঁচার মুখোশ দেয়া হয়েছে অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে বৈশাখী  উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে।

শখের মৃৎ শিল্প রচনাটির অনুশীলনীতে হিন্দু,

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের চারটি পুরাকীর্তির ছবি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে নির্মিত ‘কান্তজির মন্দির’ স্থান পেলেও কোনো মসজিদ বা মুসলিম স্থাপত্য স্থান পায়নি।

একই বইতে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘মুনাজাত’ কবিতাটি ‘প্রার্থনা’ নামে সঙ্কলিত হলেও ‘এটি কুরআন শরিফের সূরা ফাতেহার ভাবানুবাদ’ শিক্ষার্থীদেরকে এই ধারণাটি দিতেও কার্পণ্য করা হয়েছে।অতীতেও এই কবিতাটি বিভিন্ন ক্লাসে পাঠ্য ছিল এমনকি আমাদের সময়ও। কিন্তু এবারই প্রথম ব্যতিক্রম লক্ষ করা গেল। যদিও শিক্ষার্থীর জ্ঞানের প্রসারতার জন্য বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।

বুঝতে কষ্ট হয়, শিক্ষার্থীদের কাছে এটা গোপন করা না হলে ধর্ম নিরপেক্ষতার এমন কী ক্ষতি হতো?

পঞ্চম শ্রেনীর এই বইটিতে স্বঘোষিত নাস্তিক  হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছে। সব ধর্মগ্রন্থের মূল বক্তব্য পাপের জন্য পরকালে শাস্তি এবং পুণ্যের জন্য  পুরস্কার। এ কবিতায় কবি প্রচ্ছন্নভাবে  ধর্মীয় গ্রন্থ বিশেষ করে কুরআন শরিফ না পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের তাগিদ দিচ্ছেন। 

এ কারণে যে ওটি তাকে ভয় দেখায়। এখন যদি কোনো শিক্ষার্থী ‘যে বই তোমায় ভয় দেখায়’ বলতে কোন বইটি, তা নির্দিষ্ট করে জানতে চায় বোর্ড কর্তৃপক্ষের জবাবটা কী হবে?

এছাড়াও এই কবিতাটি যে আমাদের সাংবিধানিক চেতনার সাথেও সাংঘর্ষিক তা অস্বীকার করবে কে? তারপরও এমন একটি  বিদ্বেষপূর্ণ কবিতা পাঠ্য হলো কিভাবে?

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে প্রবেশ করানো হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক একটি কবিতা। যেখানে রয়েছে হিন্দুদের দেবী দূর্গার প্রশংসা।

এই বইয়ে আরো সংযুক্ত হয়েছে ‘লাল গরুটা’ নামক একটি ছোটগল্প। যা দিয়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মত, অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ।এতে আরো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে

ভারতের হিন্দুদের তীর্থস্থান রাঁচি’র ভ্রমণ কাহিনী।

২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম ও  নৈতিক শিক্ষা বইয়ে কুরআন ও  হাদীসগুলোকে বিকৃতভাবে লেখা  হয়েছে। তবে ২০১৪ সালের বইগুলো  ঘেটে দেখা গেলো সেখানে ঐ  একইস্থানে কোন ভুল নেই। কিন্তু ২০১৬  সালে এডিট করে ভুলযুক্ত করা হয়েছে।সবাই পেছনের ভুল শুদ্ধ করে সঠিক হয়। আর এ বইয়ে শুদ্ধটা পরিবর্তন করে ভুল প্রবেশ করানো হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক না হলে  এটা কখনই সম্ভব নয়।এই বইয়ে কোরআন-হাদীসে অসংখ্য বিকৃত,

ভুলের সংখ্যা ৫৮টি !!

১) পৃষ্ঠা- ৪-৫, কালেমা শাহাদাত

লিখতে ১০টি ভুল।

২) পৃষ্ঠা-১১,২১, ২২, ২৮, ৩১ শিরোনাম

লিখতে ৭টি ভুল।

৩) পৃষ্ঠা-২৭, সূরা বাকারার ৪৩ নং

আয়াত লিখতে ১টি ভুল।

৪) পৃষ্ঠা-২৮, সূরা আন নিসার ১০৩ নং

আয়াত লিখতে ৫টি ভুল।

৫) পৃষ্ঠা-৩৮, সূরা আন নিসার ১০৩ নং

আয়াত লিখতে ফের ৫টি ভুল।

৬) পৃষ্ঠা-৪৭, সূরা আল-মুযযাম্মিলের ৪

নং আয়াত লিখতে ১টি ভুল।

৭) পৃষ্ঠা-৫৭, সূরা ফাতিহা লিখতে

১টি ভুল।

৮) পৃষ্ঠা-৫৯, সূরা আন নাস লিখতে ২ টি

ভুল।

৯) পৃষ্ঠা-৫৭,৫৯,৬২,৬৬ বিসমিল্লাহ

লিখতে ৪ বার ভুল।

১০) পৃষ্ঠা-৬৪, সূরা হুমাযাহ লিখতে ৪টি

ভুল।

১১) পৃষ্ঠা-৭১, দুটি হাদিস লিখতে ২টি

ভুল।

১২) পৃষ্ঠা-৮১, সূরা বণী ইসরাইল লিখতে

১টি ভুল।

১৩) পৃষ্ঠা-৮২, সূরা বাকারাহ এর ২১৫ নং

আয়াতে ১টি ভুল।

১৪) পৃষ্ঠা-৮২, হাদীস লিখতে ১টি ভুল।

১৫) পৃষ্ঠা-৮৩, সূরা আন নহলের ৯০ নং

আয়াত লিখতে ২টি ভুল।

১৬) পৃষ্ঠা-৮৫, একটি হাদীস লিখতে ৭টি

ভুল।

১৭) পৃষ্ঠা-৮৮, সূরা বাকারাহ’র ৪২ নং

আয়াত লিখতে ১ ভুল।

১৮) পৃষ্ঠা-৯১, হাদীস লিখতে ১ ভুল।

১৯) পৃষ্ঠা-৯২, সূরা বনী ইসরাইল, ২৭ নং

আয়াত লিখতে ২ ভুল।

মোট ভুলের সংখ্যা ৫৮টি।

২.

সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে `লালু’ নামক গল্পে

বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে পাঁঠাবলির নিয়ম কানুন।

অষ্টম শ্রেণীতে পড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘রামায়ণ’ এর সংক্ষিপ্তরূপ।‘সাহিত্য কণিকা’ অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বই। এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসিদ্ধ ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছে। আগ্রহভরে পাতাটা খুলতেই যে চিত্রটি নজরে পড়ল তা সত্যি অবাক হওয়ার মতো। অত্যাচারী ভূমি দস্যু বা জমিদার হিসেবে (কবিতার ভাষায় রাজা) লম্বা দাড়ি ও পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

অর্থাৎ প্রথম দর্শনেই জমিদারকে মুসলমান

না ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।অথচ কবিতাটির কোথাও জমিদারের নামের উল্লেখ না থাকলেও ‘বাবু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বারকয়েক। আর ‘বাবু’ শব্দটি সবসময় হিন্দু ভদ্রলোকের বেলায়ই ব্যবহার হয়ে আসছে। তা ছাড়া কবির কোনো রচনাতে কদাচ কোনো মুসলিম চরিত্র এসে থাকলেও তা চাষী, চাকর-বাকর, পিয়ন-চাপরাশির পদমর্যাদার ওপরে ওঠতে পারেনি,জমিদার বা রাজা তো দূরের কথা।

রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে যাদের এতটুকু ধারণা নেই তারা হেন কর্মে হাত দেন কেমন করে?তবে কী অসাম্প্রদায়িকতার আধুনিক ধারণা অনুসারেই এমনটি করা হলো?

  ‘মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য’ বইটিতে অনেকটা  পশ্চিমবঙ্গের আদলেই নির্বাচিত কবিতাগুলোর প্রথম থেকে ক্রমিক নং  ১১ পর্যন্ত এবং গদ্যের তালিকায় ৮ নম্বর  পর্যন্ত একজন মুসলমান লেখকও নেই। যদিও তাদের সাহিত্যকর্ম জ্ঞান-পন্ডিত্ব সম্পর্কে আমাদের কোন প্রশ্ন বা সংশয় নেই।

কিন্তু আমাদের সংশয় হলো এই তালিকা অতি সর্ন্তপনে ও কৌশলে শিক্ষার্থীদের মনোরাজ্যে হীনম্মন্যতার বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের তেমন  অবদানই নেই। শুধু নবম-দশম শ্রেণীর কেন  প্রতিটি ক্লাসের বাংলা বইয়ের সেই  এক ও অভিন্ন চিত্র। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম লক্ষ  করা গেল ষষ্ঠ শ্রেণীর বইতে। প্রথম লেখাটি এম ওয়াজেদ আলির লেখা ‘রাঁচি ভ্রমণ’।  কিন্তু লেখাটি রাঁচির ভ্রমণের স্থলে করাচি নয় যদি মক্কা বা আঙ্কারা ভ্রমণও হতো তাহলে ওয়াজেদ আলির লেখাটি আদৌ নির্বাচিত হতো কী?

নবম ও দশম শ্রেনীর এই বইটিতে প্রবেশ করেছে ‘সুখের লাগিয়া’ নামক একটি কবিতা, যা হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণের লীলাকীত্তন।

বইটিতে আরো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের বিকৃত যৌনাচার।

নবম-দশম শ্রেণীর এই বইটিতে ‘সাকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতা দিয়ে ৪৭ এর দেশভাগ কে হেয় করা হচ্ছে, যা দিয়ে কৌশলে ‘দুই বাংলা এক করে দেওয়া’ অর্থাৎ বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

মাধ্যমিক স্তরের এই বইটিতেই প্রবেশ করেছে‘আমার সন্তান’ নামক একটি কবিতা। কবিতাটি হিন্দুদের ধর্ম

সম্পর্কিত‘মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত, যা দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনাসূচক কবিতা।

এছাড়াও প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় গুলোতে দেওয়া হয়েছে (নিজেকে জানুন) নামক যৌন শিক্ষার বই।যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে রগরগে বর্ণনায় উপস্থান করা হয়েছে নারী-পুরূষের মিলন সহ গোপনীয় বিষয়াদি।

এছাড়া দৃষ্টিকটু লেগেছে বোর্ডের বইগুলোর মলাটে অঙ্কিত নকশা  ও আলপনাগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায়ের  শিল্পকলার প্রতিফলন থাকলেও কোনো  একটি বইতেও মুসলিম স্থাপত্য ও  শিল্পকলার প্রতিফলন দেখা যায় না।  শিক্ষার্থীদের মুসলিম শিল্পকলা সম্পর্কে অজ্ঞ রাখার নাম কী তাহলে অসাম্প্রদায়িকতা? এতে একজন শিক্ষার্থী শুধু অজ্ঞই থেকে গেল না বরং শিল্পগুণের তুলনামূলক বিচার  ক্ষমতা অর্জনেও ব্যর্থ হলো।

বাংলাদেশ কি গত ৪৫ বছর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না? নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতার আপডেট ভার্সন ইন্সটল করার দরকার কেন পড়ল?

৯০% মুসলিম আর ১০% অন্যধর্মের মানুষ নিয়ে গড়া বাংলাদেশে যদি আপনি নিরপেক্ষতার নামে সংখ্যাগুরুর অধিকার হরন করেন তবে এ আন্দোলন আমরা যৌক্তিক মনে করি।

বিষয়: রাজনীতি

১০০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File