গুলবার্গ গণহত্যার রায় বিতর্ক

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ২১ জুন, ২০১৬, ১০:০১:৩৩ সকাল



সময় চলমান। ইতিহাসের গতিধারা কখনো চলৎশক্তিহীন নয় বরং বহতা নদীর মতই তা সদা চলমান। ভারতের গুজরাটের গুলবার্গ গণহত্যার একযুগ অতিক্রান্ত হয়েছে বেশ আগেই। ইতিহাসের এই নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যায় কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হতা করা হয়েছিল ৬৯ জন নিরাপরাধ নারী-পুরুষকে। বাদ যাননি লোকসভা সদস্য এহসান জাফরিও। উগ্রপন্থীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, ধবংসযজ্ঞ ও উম্মত্বতায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল প্রাণ রক্ষার আহাজারীতে। কিন্তু উগ্রবাদীদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করেনি। তারা উন্মুক্ত তরবারী হাতে হিং¯্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিম নর-নারীদের ওপর। কুপিয়ে ও অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয় বিপুল সংখ্যক বনী আদমকে। যা মধ্যযুগের হালাকু খানের বাগবাদ ধ্বংসের নির্মমতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

এই নিমর্ম ও নিষ্ঠুর ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় ১৪টি বছর। নিহতদের স্বজনরা মনে করেছিলেন হয়তো তারা প্রিয়জনদের হারানোর বিচারটা আর কখনোই পাবেন না। কিন্তু একযুগেরও অধিককাল অধীর আগ্রহের অপেক্ষার পর ১৭ জুন ঘোষণা করা হয়েছে ভারতের আলোচিত গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা মামলার রায়। যদিও রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে দাবি করেছেন নিহতদের স্বজন, মানবাধিকার সংগঠন ও স্থানীয় মুসলমানরা। এ ঘটনায় ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় একটি আদালত। এছাড়া দোষী সাব্যস্ত বাকি ১২ জনের সাতবছর ও একজনকে ১০ বছরের জেলদন্ড দেয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অতুল বৈদ্য। আর খালাস পাওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজেপি কাউন্সিলর বিপিন পটেল।

উল্লেখ, ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের আহমেদাবাদের অভিজাত গুলবার্গ সোসাইটিতে প্রায় ৪০০ জন উগ্রবাদী হিন্দু খুন করেছিল ৬৯ জনকে। জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল তাদের। মৃতদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন বর্ষীয়ান সাংসদ এহসান জাফরিও। এই মামলায় ৬৬ জন অভিযুক্তের মধ্যে ২৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। তথ্য-প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান অভিযুক্ত বিজেপি কাউন্সিলর বিপিন পটেল।

এদিকে এই রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি। তিনি বলেছেন, সমস্ত অভিযুক্তকেই যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া উচিত ছিল। তবে তাঁর ছেলে তনভি জাফরি বলেছেন, এদিনের রায়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু কয়েকজন অভিযুক্ত কেন দোষী সাব্যস্ত হল না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এই মামলায় অন্যান্য অভিযুক্তের খালাস পাওয়ার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

মূলত গুজরাটের গোধরা স্টেশনের কাছে সাবরমতি এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের অগ্নিকান্ডে প্রায় ৫৯ জন লোক পুড়ে মারা গিয়েছিল। সে ঘটনায় মুসলমানদের দায়ী করে সেখানকার হিন্দুরা। এবং ঘটনার পর দিন ২০০২ সালের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি গুলবার্গ সোসাইটির ২৯টি বাংলো ও ১০টি অ্যাপার্টমেন্টে হামলা চালায় প্রায় ৪০০ শতাধিক উগ্রবাদী হিন্দু। হিন্দু-মুসলিম সে দাঙ্গায় তখন প্রায় সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। যদিও তদন্তে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাথে মুসলমানদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি।

২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সকাল ৯টার দিকে উগ্রপন্থি হিন্দুরা বিশাল এক মিছিল নিয়ে মুসলিমবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে সমবেত হয় আহমেদাবাদের গুলবার্গ মুসলিম আবাসিক এলাকার সামনে। এক পর্যায়ে এ উগ্র হিন্দুরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে ঢুকে পড়ে ওই আবাসিক এলাকায়। আগুন দিতে শুরু করে আবাসিক বাড়ি-ঘরে। চারদিকে আগুন দেখে দিক-বিদিক ছুটতে থাকে মুসলমান নারী-পুরুষ। এ সময় হিন্দু উগ্রপন্থিরা কুপিয়ে অনেককে হত্যা করে। অনেকে দৌড়ে আশ্রয় নেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের এমপি এহসান জাফরি বাড়িতে।

এ সময় থানায় ফোন করে, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সহযোগিতা পাননি এহসান জাফরি বলে অভিযোগ আছে। নিরুপায় হয়ে জাফরি এগিয়ে এসে ঘটনার কারণ জানতে চাইলে উগ্রপন্থিরা তাকেও কুপিয়ে জখম করে। পরে তার বাড়ির চারদিক বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে জাফরিসহ আগুনে পুড়ে মারা যান অন্তত ৩৫ জন। প্রায় ঘণ্টা ছয়েক ধরে নৃশংস ওই গণহত্যা চালায় উগ্রপন্থি হিন্দুরা।

ইতিহাসের বর্বরোচিত এ হত্যার ঘটনার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুসলিমবিরোধী ভয়াবহ এ দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ উস্কে দেয়ার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের ভিত্তিতে মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র দেশটিতে মোদির সফরের উপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর মোদির ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় মার্কিন প্রশাসন।

গুলবার্গের ওই গণহত্যায় জড়িত থাকায় ৬৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। মামলা চলাকালীন মৃত্যু হয় ছয় অভিযুক্তের। এর মধ্যে ভিএইচপি নেতা অতুল বৈদ্যসহ ২৪ জনকে গত ২ জুন দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। বেকসুর খালাস করে দেয়া হয় ৩৬ জনকে। খালাস পাওয়াদের মধ্যে আছেন বিজেপি নেতা বিপিন পটেল এবং পুলিশ ইনস্পেক্টর কেজি এর্দা।

জানা যায়, এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করে হত্যাকান্ডের তদন্তে দাবি জানায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও ন্যায়বিচার এবং শাস্তির জন্য নাগরিক সমাজ নামে দু’টি সংগঠন।

পরে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালের মার্চে সাবেক কেন্দ্রীয় তদন্ত অধিদফতরের (সিবিআই) প্রধান আরকে রাঘবনকে প্রধান করে গুজরাট সরকারকে বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেয়। গঠিত তদন্ত দল এই মামলা চালিয়ে যায় আহমেদাবাদে গঠিত বিশেষ আদালতে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই মামলার বিচার কাজ শেষ হয়। সে বছরের ৩১ মে আদালতকে রায় ঘোষণার নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট।

সাত বছর ধরে বিচার প্রক্রিয়ার পর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ১৭ ঁজুন এই রায় দেওয়া হয়। তবে বিচারপ্রার্থী মুসলিমরা এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নিহত সংসদ সদস্য এহসান জাফরির স্ত্রী বলেন, ‘এটি ন্যায় বিচার নয়। আমরা এই রায়ে হতাশ’।

তিনি বলেছেন, ‘আমি এই সাজায় খুশি নই। দোষীদের কম সাজা দেয়া হয়েছে। আমাকে ফের প্রস্তুত হতে হবে। আইনজীবীদের সঙ্গে রায় সম্পর্কে আলোচনা করে এগোতে হবে। আমি সুবিচার পাইনি।’ গুলবার্গ সোসাইটিতে গণহত্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সেদিন সকাল ৭টা থেকে আমি সেখানেই ছিলাম। আমি নিজের চোখে সবকিছু দেখেছি। আমার চোখের সামনেই কত মানুষকে নির্মমভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমার স্বামী আহসান জাফরিকেও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এসব ঘটনায় দোষীদের কি এত কম সাজা পাওয়া উচিত? এটা ভুল বিচার। বেশিরভাগ লোককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সবাইকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া উচিত ছিল।’

এদিকে এই রায় নিয়ে গোটা ভারতেই বিতর্ক দানা বেধে উঠেছে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ বলেন, ‘এই বিচারে হতাশ হয়েছি। যে ১১ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল, তাদের তো যাবজ্জীবন হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু অন্য ১২ জনকে মাত্র ৭ বছরের কারাদন্ড দেয়া ঠিক হয়নি। কয়েক ঘণ্টা ধরে অপরাধীরা মুসলমানদের পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। আমার মতে এটা দুর্বল জাজমেন্ট। এ নিয়ে আমরা আপিল করব।’ কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভির বলেছেন, ‘গণহত্যাকারীদের রেহাই দেয়া উচিত নয়।’

অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ‘যদি সুশীল সমাজের ইতিহাসে গুলবার্গ হত্যাকান্ড সবচেয়ে কালো অধ্যায় হয়, তাহলে এই মামলায় দোষীদের মৃত্যুদন্ড দেয়া উচিত। যাবজ্জীবন বা ১০ বছরের সাজা যথেষ্ট নয়।’ এই মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর আর সি কোদকার বলেন, ‘২০০২ সালের ঘটনা সুশীল সমাজের কাছে অন্ধকারতম দিন ছিল।’

গুলবার্গ গণহত্যার রায় নিয়ে ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বেশ সোচ্চার। টুইটারে আশীষ ত্রিবেদী নামে একজন উপহাস করে লিখেছেন, ‘ওয়াও! সুতরাং আমি ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা করতে পারি। মাত্র ৭ বছরের জেল হবে! তাও আবার ১৪ বছর পরে। গুজরাটের হিন্দু হওয়ার জন্য আমার গর্ববোধ হচ্ছে!’ রাকেশ বুটকরি নামে একজন লিখেছেন, ‘এ দেশে কি কেবল মৃত্যুদন্ডের সাজা মুসলিমদের জন্য?’ করমবীর সিং ব্রার নামে একজন লিখেছেন, ‘গুলবার্গ মামলায় কারো মৃত্যুদন্ড হয়নি এটা লজ্জার কথা! তারা সন্ত্রাসী, তাদের ওইরকমই শাস্তি দরকার।’

মূলত গুজরাটের গুলবার্গ গণহত্যার একযুগের অধিককাল অতিকান্ত হওয়ার পর এই মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এই রায় নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের এই নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যায় ৪শ উগ্রপন্থী অংশ নিলেও সাজা হয়েছে সীমিত সংখ্যক উগ্রপন্থীর। তাই এই রায় ও ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে খোদ ভারতেই। নিহতদের পরিবার ও মুসলমানরা এই রায় তো মেনে নিতে পারেন নি বরং সেদেশের সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনও এই মামলার রায় নিয়ে রীতিমত হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নিহতদের পরিবার সুবিচার নিশ্চিতের জন্য উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এত ক্ষতিগ্রস্থরা কোন প্রকিতার পাবেন কিনা তা এখনো দিব্যি দিয়ে বলার সময় আসেনি। আর এর শেষ দেখার জন্য শান্তিপ্রিয় মানুষকে অপেক্ষায় করতে হবে বৈকি!

বিষয়: বিবিধ

১০৯৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

372701
২১ জুন ২০১৬ সকাল ১০:১৫
হতভাগা লিখেছেন : সে সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
২১ জুন ২০১৬ বিকাল ০৪:১১
309476
সৈয়দ মাসুদ লিখেছেন : Thanks
372718
২১ জুন ২০১৬ দুপুর ০১:৩৯
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ধবংসযজ্ঞ ও উম্মত্বতায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল প্রাণ রক্ষার আহাজারীতে। কিন্তু উগ্রবাদীদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করেনি। ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২১ জুন ২০১৬ বিকাল ০৪:১১
309477
সৈয়দ মাসুদ লিখেছেন : Thanks

372738
২১ জুন ২০১৬ দুপুর ০৩:৪৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সহ এতজন কে সম্পুর্ন পরিকল্পিত ভাবে হত্যা কান্ডের মাষ্টারমাইন্ড কে মুক্তি দিয়ে এই রায় আসলে স্রেফ লোক দেখান।
372747
২১ জুন ২০১৬ বিকাল ০৪:১১
সৈয়দ মাসুদ লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File