পলাশী ট্রাজেডি ও নবাব পরিবার

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ০১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৪:২১:৪৬ বিকাল



১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব মনসুরুল মুলক মীর্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা বাদশাহ কুলী খান হায়বত জং বাহাদুরের পরাজয় ঘটে। তিনি বাংলার হৃত স্বাধীনতা ফিরে আনতেই স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা, শিশু কন্যা উম্মে জোহরা ওরফে কুদসিয়া বেগম ও কয়েকজন বিশ্বস্ত সহচর সহ ২৪ জুন গভীর রাতে হীরাঝিল প্রাসাদ ছেড়ে নৌপথে পাটনা (আজিমাবাদ) অভিমুখে রওয়ানা হন। উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও মীর জাফরকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা পূনরুদ্ধার করা। কিন্তু ভাগ্যাহত নবাবের ভাগ্যটা মোটেই সুপ্রসন্ন ছিল না।

প্রতিকুল আবহাওয়া ও মহানন্দার শাখানদী কালিন্দিতে অপ্রচুল জল সম্ভাবের কারণেই তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী হতে হয়। শাখানদী কালিন্দির বৈরিতার কারণেই তাকে মালদহে যাত্রা বিরতি করতে হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার অবতারণা হলে তিনি দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু নদীতে ভাটার কারণে তার যাত্রায় আবারও বিঘœ সৃষ্টি হয়। তিনি ‘বখ্রা বরহাল’ গ্রামের কাছে এসে যাত্রা বিরতি দিতে বাধ্য হন এবং স্থানীয় একটি মাজারের তত্ত্বাবধায়কের আতিথ্য গ্রহণ করেন।

কথিত আছে দান শাহ ফকির বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবকে মীর জাফরের সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেন। কিন্তু মুজাফফরনামা গ্রন্থে একথা স্বীকার করা হয়নি। কারও কারও মতে, দানশাহ পীর সাহেব তখন জীবিতই ছিলেন না বরং তার পৌত্র তখন গদ্দীনশীন পীর ছিলেন। নবাব তারই আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। পীর সাহেব তাকে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি অন্দরমহলে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এ খবরটি দ্রুত মাজারের জনৈক ফকির রাজমহলে মীর জাফরের ভাই মীর দাউদের কাছে পৌঁছায়। মীর দাউদ কোন বিলম্ব না করে সৈন্য সহ ঘটনা স্থলে হাজির হয়ে নবাবকে গ্রেফতার করে তাঁকে রাজমহলস্থ (আকবর নগর) ফৌজদারের সদরদপ্তরে নিয়ে যান। পরে তাকে মীর জাফরের জামাতা মীর কাসেম আলী খানের জিম্মায় দিয়ে দেয়া হয়।

পরদিন সকালে বন্দী নবাবকে সড়ক পথে মুর্শিদাবাদ আনা হয়। হাতকড়া পরানো দোর্দন্ড প্রতাপশালী নবাবের এই করুণ অবস্থা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি। সকলেই নিরবেই অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন। নবাব জায়া বেগম লুৎফুন্নিসা ও তার শিশুকন্যা উম্মে জোহরা অসহায়ের মত তাদেরকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। অবশেষ জাফরগঞ্জ প্রাসাদে এসে নবাবকে তার স্ত্রী-কন্যাকে তার কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং বন্দী নবাবকে প্রাসাদের একটি নির্জন কক্ষে বন্দী করে রাখা হয় ।

২ জুলাই গভীর রাতে নবাবের শেষ বারের মত অজু করে নামাজ আদায়ের আকুতি উপেক্ষা করে মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মহম্মদী বেগ ও সঙ্গীরা আঘাতের পর আঘাত চালিয়ে, শিরোচ্ছেদ করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই ভাগ্যাহত নবাবকে। মূলত এই নারকীয় হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মীর জাফর ও তার দোসররা বাংলার ইতিহাসকে রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে। আর এই শহীদের রক্তের প্রায়াশ্চিত্য করতে আমাদেরকে প্রায় দু’বছরের গোলামী মেনে নিতে হয়েছিল। সে প্রায়াশ্চিত্য এখনও শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না।

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খান নবাব সিরাজের আত্মীয় ছিলেন। তিনি নবাব আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানম বেগমের স্বামী। কিন্তু অবৈধ ক্ষমতালিপ্সা তাকে পশুত্বেরও নিম্ম পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছিল। এসব নরপশুরা শুধু তরুণ নবাবকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নবাবের মৃতদেহের সাথেও বিভৎস আচরণ করেছে। তারা নবাবের মরদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে হাতির পিঠে করে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়েছে। নবাবের মা আমিনা বেগম নবাব পরিবারের সকল ঐতিহ্য ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে আসলে ঘাতকরা তাকে লাঠিপেটা করতে কুন্ঠারোধ করেনি। শেষ পর্যন্ত নবাবের খন্ড-বিখন্ড লাশ ময়লার স্তুপে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মীর্জা জয়নুল আবেদীন নামীয় এক নবাব ভক্ত মীর জাফরের অনুমতি নিয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে লাশের টুকরাগুলো ভাগিরথীর জলে গোসল করিয়ে নদীর ওপারে খোশবাগের শাহী কবরখানায় দাফন করেন। সে থেকেই ভাগিরথী তীরের খোশবাগ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে; থাকবে আগামী দিনেও।

নবাব সিরাজকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করার পরও মীর জাফর ও তার দোষরদের নির্মমতা থেমে থাকেনি। তারা নবাবের ১৫ বছর বয়সী ভাই মীর্জা মেহেদীকে কারাগারে তক্তা চাপা দিয়ে হত্যা করে। নবাব সিরাজের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে তাকে। নবাব সিরাজকে হত্যার পর নবাবের ১৭ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তার কবর জিয়ারতের জন্য আসলে মীর জাফরের পুত্র মিরন তাদেরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। মূলত পলাশী পরবর্তী সময়ে নবাব পরিবারের প্রায় পুরুষ সদস্যদেরই নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এমনকি নবাবের পক্ষের সেনাপতি ও নিকটজনদেরও নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকার কারণে এবং ভাগ্য জোড়েই বেঁচে যান নবাবের ছোট ভাই ইকরামুদ্দৌলার ( জন্ম ঃ ৩১/১২/১৭২৯-মৃত্যু ঃ ২৪/৫/১৭৫৩) পুত্র মুরাদউদ্দৌলা। পরবর্তীতে নবাব কন্যা উম্মে জোহরার সাথে তার বিয়ে হয়। এখন পর্যন্ত যারা নবাব পরিবারের অবশিষ্ট আছেন তারা সকলেই মুরাদউদ্দৌলা ও উম্মে জোহরা রক্তের বংশ ধারা।

পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনার পর নবাব পরিবারের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সিরাজ হত্যার পর বেগম লুৎফুন্নিসাকে মীর জাফর, তার পুত্র মীরন এবং নবাবের হত্যাকারী মহম্মদী বেগও বিয়ের প্রস্তাব দেন। এমনকি মীর জাফর লুৎফাকে হারেমে আমন্ত্রণ জানান। এরা কতবড় অমানুষ ছিলেন যে, একজন শোকসন্তপ্তা নারী পিতা-পুত্র যুগপৎভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বা পশু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার প্রস্তাব দিতে মোটেই কুন্ঠিত হয়নি। কিন্তু মহীয়সী এই নারী সকল প্রস্তাবই ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘যে নারী একবার হাতির পিঠে সওয়ার হয়, সে কখনো গাধার পিঠে সওয়ার হতে পারে না’।

যাহোক লুৎফুন্নিসা মীর জাফরের হারেমে যেতে অস্বীকার করলে তাকে সহ নবাব পরিবারের পুরনারীদের ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে দীর্ঘ আট বছর আটক রাখা হয়। সেখানে তাদের জীবন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে কাটে। তাদেরকে প্রায়শই শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। কোন কোন দিন তাদেরকে সারাদিনই অভুক্ত রাখা হতো। কিন্তু ইংরেজ সরকারের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদনের পর ১৭৬৬ সালে নবাব জায়া বেগম লুৎফুন্নিসা ও নবাব তনয়া উম্মে জোহরাকে খোশবাগে থাকার অনুমতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে নবাব পরিবারের সকল পুরনারীদেরকেই খোশবাগে আনা হয়। জনশ্রুতি আছে যে, নবাবের মহীয়সী মা আমিনা বেগম ও খালা ঘসেটি বেগম মীরনের লোকেরা মুর্শিদাবাদ আনার কথা বলে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে। কিন্তু ইতিহাসের চুলচেরা পর্যালোচনায় একথার সত্যতা পাওয়া যায় না। কারণ, মীরনকে ইংরেজরা হত্যা করেছিল ১৭৬০ সালে। নবাব জননী আমিনা বেগম স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন ১৭৬৬ সালে। তাই মীরনের নির্দেশে তার লোকেরা আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকে ডুবিয়ে মেরেছিল এটি কল্পকাহিনী হিসেবেই মনে করা যায়। মীরনের মৃত্যুর পরও তারা জীবিত ছিলেন। তাই আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলেই প্রমাণিত হয়।

লুৎফুন্নিসা খোশবাগে আসার অল্প দিনের মধ্যেই নবাব মাতা আমিনা বেগম (জন্ম ঃ ১৯/৩/১৬৯৯-মৃত্যু ঃ ১০/১/১৭৬৬) মাতামহী শরফুন্নিসাকেও (জন্ম ঃ ১৫/৫/১৬৭৮-মৃত্যু ঃ ২৪/৫/১৭৬৬) খোশবাগে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। মা শরফুন্নিসার ২ মাস আগেই নবাব মাতা আমিনা বেগম ইন্তিকাল করেন। মাত্র ২ মাস পরেই আলীবর্দী খানের স্ত্রী ও সিরাজের মাতামহী শরফুন্নিসাও মৃত্যুমুখে পতিত হন। কন্যা উম্মে জোহরা (জন্ম ঃ ৩১/১২/১৭৫৩-মৃত্যু ঃ ২৪/৫/১৭৯২)কে নিয়ে মা লুৎফুন্নিসা একা হয়ে পড়েন। অল্প দিনের মধ্যেই মাত্র ১৪ বছর বয়য়ে প্রায় সমবয়সী চাচাতো ভাই মুরাদউদ্দৌলার (জন্ম ঃ ১৯/৯/১৭৫৩-মৃত্যু ঃ ২/৭/১৭৯৫) সাথে উম্মে জোহরার বিয়ে দেয়া হয়।

এবার লুৎফুন্নিসা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি খোশবাগ ছাড়েন নি। তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সামান্য পেনশন পেতেন। তাই দিয়েই তিনি অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে সারাজীবন স্বামীর কবরের পরিচর্যা করেছেন। তিনি সব সময় ইবাদাত-বন্দেগী, তাসবীহ-তাহলিল ও বছরের প্রায় দিনই রোজা অবস্থায় থাকতেন। জানা যায় তিনি খোশবাগের কবরখানাকে সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখতেন। গাছের পাতাও তিনি পড়তে দিতেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘এখানে নবাব আছেন’। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই কাজটিই করে সার্থকতা ও আন্তরিকতার সাথেই করে গেছেন।

মূলত নবাব কন্যা উম্মে জোহরা ও ভ্রাতুষ্পুত্র মুরাদউদ্দৌলার মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলার রক্তধারার ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকালের পরিক্রমায় তাদের নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ইংরেজ সরকার কর্তৃক নবাব পরিবারের জন্য পেনশন বরাদ্দ করা হলেও তা নিয়মিত ছিল না বরং সেটি নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ফলে নবাব বংশধরদের সীমাহীন দারিদ্রতা ও বিভিন্ন ধরনের বৈরি পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। নবাবের পঞ্চম পুরুষ পর্যন্ত কাউকে সরকারি চাকুরিও দেয়া হয়নি।

আসলে নওয়াব সিরাজের চরিত্রের মতো সিরাজ বংশধরগণকে জনসাধারণ্যে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য পূর্বের সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত চিহ্নিত কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আর আগামী দিনেও এমন ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। যাহোক পলাশী পরবর্তী সময়ে বাংলার প্রশাসনিক ও রাজস্ব বিভাগ পর্যায়ক্রমে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ভারতের গভর্নর জেনারেলের পক্ষে বহুকাল যাবৎ মুর্শিদাবাদে একজন এজেন্ট জেনারেল নিযুক্ত থাকতেন। তিনি নওয়াব পরিবারের পেনশনাদির দেখভাল করতেন। নবাব পরিবারের ভাগ্যটা এই এজেন্ট জেনারেলের করুণা ও কৃপার ওপরই নির্ভরশীল ছিল। তাই নবাব পরিবারের সদস্যদের অসহায়ের মতই জীবন যাপন করতে হয়েছে।

১৭৭৩ সালের ১৬ই জুন তারিখের ৫৯৫নং আদেশ মূলে দেখা যায়, নওয়াব মুরাদউদ্দৌলা ও তার পরিবারের জন্য মাসিক ৪০০ টাকা এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নিসা বেগমের জন্য মাসিক ১০০০ টাকা ভাতা বরাদ্দ করে কোম্পানী সরকার। এর বাইরে নবাব পরিবারের আয়ের আর কোন উৎস ছিল না। নবাব সিরাজের কোন সম্পদই তার স্বজনরা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি। এমনকি ১৭৮৬ সালে লুৎফুন্নিসার মৃত্যুর পর কোম্পানি তার প্রদত্ত ভাতা বন্ধ করে দেয়। বিধি মোতাবেক লুৎফুন্নিসার ওয়ারিস উম্মে জোহরা মায়ের পেনশন পাওয়ার কথা থাকলেও তা তাকে দেয়া হয়নি। ১৭৯৫ সালের ৮ আগষ্ট তারিখে মুরাদউদ্দৌলার প্রাপ্য ভাতা তার ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টন সম্পর্কে চিঠিপত্র পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায়।

জানা যায়, সিরাজকন্যা উম্মে জোহরা ছাড়াও নওয়াব মুরাদউদ্দৌলার বদরুন্নিসা বেগম নামে আরেকজন স্ত্রী ছিলেন। আর তিনি ছিলেন সিরাজের স্ত্রী লুৎফার আপন ভাই ইরান খানের কন্যা। উম্মে জোহরার মামাতো বোন ছিলেন বদরুন্নিসা বেগম। মুরাদউদ্দৌলার ঔরসে উম্মে জোহরা বেগমের এক পুত্র ও দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পালক কন্যা ছিলেন চারজন। মুরাদউদ্দৌলার জীবনকালেই স্ত্রী উম্মে জোহরার মৃত্যু হয়েছিল। তাঁদের মৃত্যুর পর এক পুত্র শমসের আলী খান ( জন্ম ঃ ৭/১/১৮৮০-মৃত্যু ঃ ১০/১/১৮২৬) জীবিত ছিলেন এবং মুরাদউদ্দৌলার ২য় স্ত্রী বদরুন্নিসা বেগমের উলফাতুন্নিসা বেগম নামে এক কন্যা জীবিত ছিলেন। মুরাদউদ্দৌলার মৃত্যুর পর তার প্রাপ্য ৪০০ টাকা ভাতার অংশ হিসেবে পুত্র শমসের আলী খান ১৮২ টাকা, ২য় স্ত্রীর কন্যা উলফাতুন্নিসা ৯১ টাকা, ২য় স্ত্রী বদরুন্নিসা বেগম ৯১ টাকা এবং তাঁদের দেখাশুনার জন্য উকিলের বেতন মাসিক ৩০ টাকা এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ২ জন ক্বারীর বেতন মাসিক ৩ টাকা হিসাবে ৬ টাকা, মোট ৪০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়।

শমসের আলী খানের মৃত্যুর পর তাঁর প্রাপ্য ভাতা তাঁর ওয়ারিশদের মধ্যে নি¤েœাক্তভাবে বণ্টন করা হয়। পুত্র লুৎফে আলি (জন্ম ঃ ৮/১/১৭৯৭-মৃত্যু ঃ ১০/১/১৮৩৩) ৭০ টাকা, দ্বিতীয় পুত্র জয়নাল আবেদীন ও পালকপুত্র ৬০ টাকা, স্ত্রী ৩৬ টাকা, নিকট আত্মীয় ১৬ টাকা। মোট ১৮২ টাকা। মুরাদউদ্দৌলার ২য় স্ত্রী লুৎফার আপন ভ্রাতুষ্পুত্রী বদরুন্নিসা বেগম এবং কন্যা উলফাতুন্নিসা বেগমের মৃত্যুর পর তাদের প্রাপ্য ভাতা তাদের ওয়ারিশদের মধ্যে বরাদ্দ করা হয়। তার কোনো অংশ শমসের আলী খানকে দেয়া হয়নি। এতে সুষ্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, শমসের আলী খান বদরুন্নিসা বেগমের গর্ভজাত পুত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন সিরাজ কন্যা উম্মে জোহরার পুত্র। (মুর্শিদাবাদে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট ডাব্লিউ. বি. বাকলে কর্তৃক বেঙ্গল গভর্নমেন্ট সচিব অ্যাশলে ইডেনকে লিখিত ইং ১৮৬১ সালের ২৫শে জানুয়ারি তারিখের পত্র)।

শমসের আলী খানের পালক পুত্র মারা গেলে সরকার তার প্রাপ্য ভাতা শমসের আলী খানের পুত্রকে না দিয়ে দূরবর্তী আত্মীয় মির্জা আলী খানকে বরাদ্দ করেন। ফলে বোঝা যায় পেনশন বরাদ্দের ব্যাপারে ইংরেজ সরকার ইসলামের মিরাসী আইনের কোনো ধার ধারতো না। রেসিডেন্টের মর্জি মাফিক সিদ্ধান্তই কার্যকর হতো। সৈয়দ লুৎফে আলী ১৮৩৩ সালে একমাত্র কন্যা ফাতিমা বেগম ( জন্ম ঃ ৬/১/১৮১৯-মৃত্যু ঃ ১৮/১০/১৮৭০) কে রেখে ইন্তিকাল করেন। তিনি পিতার ৮০ টাকা, দাদির ৩৬ টাকা এবং আত্মীয়ের ২৫ টাকা, মোট ১৪১ টাকা পেনশন পেতেন। (গভর্নমেন্টের ২৫শে জানুয়ারি, ১৮৩৩ ও ২৮শে এপ্রিল, ১৮৪৭ তারিখের আদেশ)।

ফাতেমা বেগম ১৮৭০ সালে কন্যা হাসমত আরা বেগম (জন্ম ঃ ১/১/১৮৪৯-মৃত্যু ঃ ২/৮/১৯৩১) ও লুৎফুন্নেসা বেগমসহ এক পালক কন্যা রেখে মারা যান এবং তাদের নিম্নহারে ভাতা দেয়া হয়। হাসমত আরা বেগম ৩০ টাকা, লুৎফুন্নেসা বেগম ৮১ টাকা, পালক কন্যা ৩০ টাকা বরাদ্দ করা হয়। (১৮৭১ সালের ৪ঠা জানুয়ারির ৩নং আদেশ)। ফাতিমা বেগমের কন্যা হাসমত আরা বেগমের বিয়ে হয় চীৎপুর খান্দানের সৈয়দ আলী রেজার সাথে। সৈয়দ আলী রেজা ১৮৯৭ সালে এবং হাসমত আরা বেগম ১৯৩১ সালের ২রা আগস্ট তারিখে ইন্তিকাল করেন। হাসমত আরা বেগমের এক পুত্র সৈয়দ জাকি রেজা(জন্ম ঃ ৩১/১২/১৮৬৮-মৃত্যু ঃ ২৯/৯/১৯৩৪) এবং একজন পালক কন্যা ছিলেন।

নবাব হাসমত আরা বেগমের পুত্র সৈয়দ জাকি রেজা মাসিক ১৫ (পনের) টাকা ভাতা পেতেন (গভ: আদেশ নং-৪১৮০ তারিখ ৩০/১/১৯৩২ এবং ১৫২ এন তারিখ ১০/৩/১৯৩২) ইংরেজ সরকার ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর সুপারিশে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজাকে মুর্শিদাবাদের সাব রেজিস্ট্রার নিযুক্ত করেন এবং পরবর্তীতে ডিস্ট্রিক্ট সাব রেজিস্ট্রার পদে উন্নীত করেন। তখন থেকেই নবাব পরিবারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ ফিরে আসে। তিনি ১৯৩৪ সালে মুর্শিদাবাদে ইন্তিকাল করেন। খোশবাগে তাকে দাফন করা হয় বলে নবাবের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। খোশবাগে দাফনকৃত নবাব পরিবারের সর্বশেষ ব্যক্তি তিনি।

সৈয়দ জাকি রেজার পুত্র ছিলেন গোলাম মোর্তজা, সৈয়দ বাবু, কন্যা ছিলেন সৈয়দা কানজো ও চাঁদ বেগম। পালক পুত্র ছিলেন ৪ জন, পালক কন্যা ছিল ২ জন। এরা সবাই ছোটখাটো চাকরি ও ব্যবসা করে মুর্শিদাবাদও পূবর্ বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কেউ কেউ পূবর্ বাংলা ও পাকিস্তানে চলে আসেন। সৈয়দ জাকি রেজার পুত্র গোলাম মোর্তজা (জন্ম ঃ ১৭/১০/১৯১০-মৃত্যু ঃ ১৯/৭/১৯৯২) মুর্শিদাবাদে কালেক্টরেটে চাকরি করতেন। দেশ বিভাগের পর অপশন দিয়ে এদেশে আসেন এবং রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসে চাকরিতে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে অবসর নিয়ে খুলনায় বসবাস করতেন। গোলাম মোর্তজার পুত্র হলেন ইঞ্জিনিয়ার এস জি মোস্তফা (জন্ম ঃ ৬/৭/১৯৪৭-) ও গোলাম মুজতবা এবং কন্যা হলেন বেবি হামিদা বানু মুন্নি, পালক কন্যা-২ জন, পালক পুত্র-১ জন।

১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মত নবাব পরিবারের সাথে পরিচিত হন। সাংবাদিক ফজলে লোহানী তাঁর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’-এর মাধ্যমে নবাব সিরাজ পরিবারের ৭ম বংশধর গোলাম মোতর্জাকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন। একই অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচারে সংযোজিত হয় নবাব সিরাজ প্রজন্মের ৮ম বংশধর ইঞ্জিরিয়ার এস জি মোস্তফার সাক্ষাৎকার। আর এভাবেই এদেশে নবাব পরিবারের আত্মপ্রকাশের শুভ সূচনা হয়।

এস জি মোস্তফা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি চাকুরী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে বর্তমানে সমাজ সেবা করে যাচ্ছেন। স্ত্রী সৈয়দা হোসনে আরা বেগম ( লুৎফার ৮ম রক্তধারা ) ছিলেন সৎ, সত্যবাদী, মমতাময়ী ও প্রকৃতিপ্রেমী। তিনি আর্ত-মানবতার কল্যাণে নিরলসভাবে আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি এস জি মোস্তফার জীবনের প্রতিটি সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর ও চিরসঙ্গীনী ছিলেন। ২০০১ সালে এই মহীয়সী নারীর অকাল মৃত্যু ঘটে।

সৈয়দা হোসনে আরা বেগমের মাতা গুলশান আরা বেগমও ছিলেন সিরাজের স্ত্রী লুৎফার ৭ম রক্তধারা। সৈয়দ গোলাম মোস্তফা এবং সৈয়দা হোসনে আরা বেগমের ২ পুত্র (যমজ) সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদা আলী আব্বাসউদ্দৌলা ও সৈয়দ মোহাম্মদ আলী রেজা মাসুম, ২ কন্যা নাজনীন মুনমুন ও সাকিনা ইমু। এরা সকলেই নবাবের ৯ম বংশ ধারা। গোলাম আব্বাস ছাড়া সকলেই বিবাহিত এবং তাদের সন্তানাদিও আছে। এরা সকলেই ঢাকায় বসবাস করছেন।

ঐতিহ্যবাহী নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিবারের ৯ম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদা আলী আব্বাসউদ্দৌলা একজন স্বজ্জন ব্যক্তি। তিনি শহীদ নবাব সিরাজের চেতনা ও আদর্শ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামে একটি একাডেমী স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন নবাব সিরাজের এই সুযোগ্য উত্তরসূরী। এজন্য তিনি সরকার ও সমাজের বিত্তবান মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি ও তার পরিবার রাজকীয় মর্যাদাও আশা করেন। যা তাদের প্রাপ্য বলেই মনে করেন আত্মসচেতন মানুষ। তাই এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্পণ্য বা যেকোন প্রকার শৈথিল্য কাম্য নয়।

বিষয়: বিবিধ

১০০৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384523
০১ ডিসেম্বর ২০১৭ রাত ১১:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য ধন্যবাদ। নবাবের উত্তরাধিকারিদের এক অংশ মুর্শিদাবাদ থেকৈ এসে বরগুনায় বসতি করেছেন। তাদের একজন কে চিনি।
384525
০১ ডিসেম্বর ২০১৭ রাত ১১:৫৫
সৈয়দ মাসুদ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। তার নাম কী ? মোবাইল নং আছে ?



384532
০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সকাল ০৬:৫৪
মিজান২০১৩ লিখেছেন : Well written post. Thank you.
384533
০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ দুপুর ১২:৫৫
সৈয়দ মাসুদ লিখেছেন : Thanks

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File