কবর-৮১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৮:৪১:৪২ সকাল

শ্রাবন মাস, এখন আমন রোপনের সময়। সব জমি চাষ দেয়া হয়ে গেছে। কোন ক্ষেত লাগানো হয়েছে, কোনটা লাগানো (ধান রোপণ) হয়নি তবে খুব শীঘ্রই হবে। সবক্ষেতে কাদা, কাদার মধ্যে আধ হাত পরিমাণ পা ঢুকে যাচ্ছে। এমন কাদায় বাচ্চা কোলে নিয়ে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে হেঁটে যাওয়াই কষ্টকর সেখানে হাসানের মত অসুস্থ দুর্বল মানুষের পক্ষে তো অসম্ভব। তবুও সে দ্রুতলয়ে হাঁটছে, একটা তীব্র আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে তার মায়ের কাছে যাবে, বাচ্চাকে মায়ের কোলে তুলে দিবে। তার ক্লান্তি ও দুর্বলতা মাড়িয়ে এই আকর্ষণটাই তীব্রতর হয়ে উঠে। তাছাড়া সে ভাবছে রাস্তায় থ্যাকনা খেয়ে খেয়ে হাড় হাড্ডি ভাঙ্গার চেয়ে ক্ষেতের কাদার মধ্যে কষ্ট করে হাঁটাও ভাল। কিন্তু কাদার মধ্যে তার দুর্বল দেহ পা টেনে তুলতে পারে না, কষ্ট করে হাঁটছে, পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত পেরিয়ে আলে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, আবার চলে আবার বিশ্রাম করে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ল। আর তখন তার সামনে একটা গো- পাট পড়ল যা তার কাছে দুর্লঙ্ঘনীয় পাহাড়ের মত মনে হল। সে রাস্তাটার খাজে পা রেখে শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠতে চাইল কিন্তু পারল না, কাত হয়ে গোপাটে শুয়ে পড়ল। সে মনে মনে বলল, ভালই হল, শুয়ে শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নেয়া যাক। মেয়েকে বুকের উপর নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল।

কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে তার শরীর কিছুটা চাঙ্গা হল। সে এদিক সেদিক তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারল। এই গোপাটটা পশ্চিম দিকে চলে গেছে, আশপাশে কোন বাড়ি-ঘর নেই, অনেকটা দূরে ধনি ও অবস্থাপন্ন কয়েকটা কৃষকের বাড়ি আছে। এবার সে উঠল, এক পা রাস্তায় রেখে উঠতে চাইল কিন্তু পারল না। আবার পা রাখল, বাম হাতে মেয়েকে ধরে ডান হাতের আঙ্গুলগুলি রাস্তার কিনারে নরম মাটিতে গেথে হেঁচকা টানে কিছুটা উঠল। এভাবে আরেক টানে গোপাটে উঠে গেল। তারপর বড় রাস্তায় উঠে হাঁটা শুরু করল। ঘাট থেকে এ পর্যন্ত সে এক কিলো এসেছে, সামনে বাজার পর্যন্ত আরো এক কিলো বাকী আছে। বৃষ্টি অবিরাম চলছে, কখনো হালকা কখনো ভারী, সে দোয়া ইউনুস অবিরাম পড়ে যাচ্ছে, কখনো জোরে কখনো ধীরে। সে মেয়েকে কাধে ফেলে হাঁটছে। আবার শুরু হল গর্তে পড়ে যাওয়া, পিছল খাওয়া ও থ্যাকনা খাওয়ার পর্ব। শক্ত মাটিতে পায়ের নখ দাবাতে দাবাতে নখগুলি ভেঙ্গে গেছে, আস্তে আস্তে তার দুর্বল, কালের পীড়নে বিধ্বস্ত শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। সে বাড়ি যাওয়ার দুর্দম একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে হেঁটে চলেছে।

হায় ভাগ্যাহত হাসান, হায় অভিশপ্ত জীবন। তার শরীর কাঁপছে, পা টলমল করছে, সে ধুকছে, পা টেনে টেনে হাঁটছে। দু’হাতে মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর উর্ধ্বে তাকিয়ে অন্তহীন বেদনায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির (তুমি সর্ব বিষয়ে সর্ব শক্তিমান)। সকল শক্তির উৎস তুমি। মালিক আমার, আমাকে একটু শক্তি দাও, বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি দাও, আমার মেয়েকে আমার মায়ের কোলে তুলে দেওয়ার শক্তি দাও। তারপর আমাকে যা ইচ্ছা কর, বাঁচিয়ে রাখ বা মৃত্যু দাও তাতে আমার আপত্তি থাকবে না। সে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে আবার হাঁটা শুরু করল। পা তুলতে পারছে না, টেনে টেনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ গিয়ে গর্তে পড়ল, এভাবেই কাদার মধ্যে কিছুক্ষণ বসে থেকে বিশ্রাম করল, তারপর অনেকক্ষণ চেষ্টা করে উঠে আবার হাঁটা শুরু করল।

জীব জগত ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন। কোথাও টু শব্দ নেই, কোন কাক পক্ষির রা নেই, শিয়ালের হুক্কাহুয়া নেই, কুকুরের ডাক পর্যন্ত নেই। বর্ষার পীড়নে সব ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। প্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ। শুধু দুয়েকটা বুভুক্ষু নিশাচর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবলুস কাল অন্ধকার, আকাশে কাল মেঘের সাগরেরা ঘোরে বেড়াচ্ছে। এতক্ষণ হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, আবার তুমুল বর্ষণ শুরু হল। সড়কের মাঝপথে ভাসা পানি, কোথায় গর্ত কোথায় সমতল বুঝা যাচ্ছে না। হাসান রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে। হঠাৎ শুরু হল কাশি, সে সাথে সাথে বসে পড়ল কিন্তু ভয়ে তার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। কারণ সে জানে, কাশলে বেহুশ হয়ে যাবে। আর যেভাবে বুভুক্ষু শিয়ালগুলি ঘুরছে, বেহুশ হয়ে গেলেই তারা বাচ্চাটাকে টেনে নিয়ে যাবে। কাশির মধ্যেই সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘আল্লাহ্‌ গো একটু দয়া কর, এক অসহায় বাবাকে একটু রহম কর, এই অসহায় বাচ্চাটাকে দয়া কর, এই অবুঝ মা’সুম শিশুটার অসিলায় আমার কাশিটা বন্ধ করে দাও। নইলে আমি বেহুশ হয়ে গেলেই শৃগালগুলি আমার মেয়েটাকে খেয়ে ফেলবে’ বলতে বলতে সে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল আর কাশতে লাগল। কাশি বন্ধ করার জন্য সে একসাথে দম ও ঢোক আটকে রাখে কিন্তু অদম্য কাশি গলা ভেদ করে মুখ হা করে বেরিয়ে যায়, সাথে সাথে রক্তের দলা ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। আবার দম ও গলা বন্ধ করে দেয়, আবার দুর্দম কাশি মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, রক্ত ছিটকে গিয়ে পড়ে দূরে। এভাবে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর কাশি বন্ধ হল। মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে তার বুক ভেসে গেছে। সে ক্লান্ত হয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। অর্ধমৃতের ন্যায় অনেকক্ষণ এভাবেই পড়ে থাকল।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে উঠে আবার হাঁটা শুরু করল। আবার পিছল খেয়ে পড়ে, থ্যাকনা খায়, গর্তে পড়ে যায়, আবার উঠে আবার হাঁটে। এভাবেই পড়ি-উঠি, উঠি-পড়ি করতে করতে সে হেঁটে চলল। বস্তুত তার দেহে চলার মত বা হাঁটার মত বিন্দুমাত্র শক্তি নাই, কিন্তু মেয়েকে মায়ের কোলে তুলে দেয়ার তীব্র আকর্ষণ তাকে চুম্বকের মত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার অনুভূতি ও চিন্তা শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে, কোথায় এসেছে, এটা কোন জায়গা, বাজার আর কতদূর, এ সম্পর্কে তার কোন চেতনা নেই। তার চোখে শুধু ভাসছে তার মেয়েকে মায়ের কোলে তুলে দিচ্ছে, এ চেতনাই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জায়গাটা চিনতে পারলে সে বুঝতে পারত বাজার মাত্র আধা কিলো দূরে আছে। আর এই আধা কিলোর মধ্যেই রয়েছে তারাকান্দা থেকে বালিয়া পর্যন্ত এই সাত মাইল রাস্তার ভয়ঙ্কর দু’টি মৃত্যু গহ্বর।

এক সময় সে বুঝতে পারল পথে কোন কাদা নাই, পানি নাই। সে আশ্বস্ত হল কিন্তু একবার পা ফেলতেই মনে হল উচু মাটিতে পা ঠেকল, ভর দিতেই পিছলা খেয়ে পড়ে গেল। আবার উঠে পা রাখল আবার পড়ল। এভাবে কয়েক বার থ্যাকনা খেয়ে পড়ার পর ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল, রাস্তাটা ক্রমশ উচু হয়ে আকাশের দিকে চলে গেছে। পাহাড়ের মত খাড়া চড়াই, মাটি সাবানের মত পিছলা। সে চিন্তায় পড়ল এই চড়াই কেমনে পাড়ি দিবে। রাস্তার দু’পাশে দেখল, না কোন ঘাস নেই যে হেঁটে গিয়ে আকাশে চড়বে। আবার রাস্তার দু’পাশে গভীর খাদ। রাস্তাটা যেন ইল্লিন মানে আকাশ আর তার নীচের খাদ হল সিজ্জিন মানে পাতাল বা নরক। সে রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সাহস পেল না। কারণ একবার পা পিছলে গেলে গিয়ে পড়তে হবে গভীর খাদে, তখন সব শেষ হয়ে যাবে। তাই সে সড়কের মাঝ বরাবর এসে চড়াইয়ের উপর কাত হয়ে শুয়ে পড়ল, মেয়েকে বাম কাতের উপর রেখে বাম হাতে ধরে ডান হাত বাড়িয়ে দিল উপরে। তারপর পাহাড়ে চড়ার মত ডান হাত ও পায়ের আঙ্গুল মাটিতে গেথে গেথে উপরে উঠতে লাগল। এক সময় উঠে গিয়ে আকাশে চড়ে বসল। আসলে এটা একটা পুল, জাঙ্গাল ভাঙ্গার পুল।

১৯৮৪ সালের অকস্মাৎ বন্যায় ফুলপুরের অধিকাংশ পুল ভেঙ্গে যায় কিন্তু যে কয়টা উচু ও মজবুত পুল টিকে গিয়েছিল তার মধ্যে এটা একটা। এই পুলটা এতই উচু যে এর চড়াই উতরাই পাহাড়ের মত, পুলটা যেন পর্বতশৃঙ্গ। বৃটিশ আমলে নির্মিত লোহার এই পুলটার মেঝে বা পাটাতনের দুই প্রান্তে মোটা লোহার পাত বসানো। হাসান পুলের উপর বসে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর উঠে মরা বাছুরের মত নেতিয়ে পড়া মেয়েটাকে বাম কাধে ফেলে আবার হাঁটা শুরু করল। পুল থেকে নামার সময় প্রথমে সে ডান পা ফেলল, আর সাথে সাথে পা পিছলে গিয়ে শরীরটা আধা পাক ঘুরে ধপাস করে পড়ে গেল এবং কাধ সংলঘ্ন ডান বাহুমূলটা পুলের কিনারে দেয়া লোহার পাতের উপর পরেই প্রচণ্ড আঘাতে কট্টস করে উঠল। আর তৎক্ষণাৎ হতভাগ্য বেচারা, ‘ও আল্লাহ্‌, আল্লাহ রে’ বলে তীব্র আর্তনাদ করে মুখটা বিকট হা করে উঠল, কুকুর কুণ্ডলীর মত শরীরটা কুকড়ে এল, হাত পায়ে খিচুনি উঠল। হায় হতভাগিনী মায়ের সন্তান, কাধ সংলঘ্ন বুকের উপরের মূল হাড়টা ভেঙ্গে গেছে। দেড় মিনিট পর তার সুখের বিকট হা বন্ধ হয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর ‘আব্বা, আব্বা গো, আম্মা গো’ মা বাবার নাম ডেকে ডেকে কাঁদতে লাগল।

যে কোন অবস্থায় মেয়ের প্রতি তার মানসিক চেতনা ঠিক থাকে। মেয়েটা তখনো বাম কাতের উপর বাম হাতে ধরা আছে। হঠাৎ মেয়ের কথা স্বরণ হতেই বাচ্চাকে ঠিক করে কোলে নেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু দুর্ভাগ্য দুর্ভাগাদের পিছু ছাড়ে না। তার এই অনুভূতি নেই যে এখানে দাঁড়ানো যাবে না, পুলের ঢালুতে এটেল মাটি সাবানের ছেয়েও পিছলা। উঠতে যাওয়ার সাথে সাথে উভয় পা পিছলে একটানে চলে গেল নীচে- রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে, তারপর গড়াতে গড়াতে তার দেহটা দশ হাত নীচে ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল। দেহের নিম্নাংশ পানিতে পড়ে শরীরটা আটকে গেছে, পা থেকে বুক পর্যন্ত পানিতে ভাসছে, মাথাটা মাটিতে আটকে আছে, পানি থেকে নাকের দূরত্ব এক ইঞ্চি, পানির চাকচাক ঢেউ নাক ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে। সে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। বাচ্চাটা কোল থেকে ছিটকে গিয়ে দুই তিন হাত উপরে রাস্তার খাজে আটকে আছে।

থুতনি ফাটা, দাঁত ভাঙ্গা, হাত পোড়া, পায়ের গোড়ালি থেকে উরুমুল পর্যন্ত চামড়া কেটে দু’ভাগ হয়ে আছে। তার উপর এখন কাধের প্রধান পাজরটা ভেঙ্গে গেছে। হায় হতভাগ্য বাবার সন্তান, হায় হতভাগিনী মায়ের সন্তান। পৃথিবীর পিতা মাতারা কেন এমন হতভাগাদের অস্তিত্বে আনে। বল হে সৃষ্টির সৃষ্টা, কেন এদের পৃথিবীতে পাঠাও। এদের আহ বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত করে, এদের চোখের জল মর্তের মাটি সীসাক্ত করে, এরা পৃথিবীকে বেদনার আহ ও চোখের জল ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। এরা শুধু পৃথিবীতে বিষাদের পাল্লাটুকূ ভারী করে। এরা মানুষ হয়ে জন্মায়, ফুলের মত সুন্দর মন নিয়ে আসে, মানুষের সমাজে মানুষের মত বাঁচতে চায়, মানবতার জন্য নিজেকে উজার করে দেয়। কিন্তু পাথরের পৃথিবীতে পাষাণ মানুষের সংঘাতে এরা বারে বারে মুখ থুবড়ে পড়ে। এরা একটু আশ্রয় একটু সহানুভূতির জন্য মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ঘোরে কিন্তু দু’পেয়ে কুকুরের পদাঘাতে পদাঘাতে এরা বারবার পথের ধুলায় লুটায়, কেউ কোনদিন এদের মমতার আঁচলে বাঁধে না, এই নরকপুরীর কেউ এদের ভালবাসা দেয় না। এদের ফুলের মত পবিত্র আশার মুকুলগুলি মানবরুপি দানবের হুংকারে ঝরে পড়ে, এদের ব্যর্থ স্বপ্নগুলি হাহাকার হয়ে বুকের পাজরে মাথা ঠুকে মরে, নিয়তির হুংকারে এদের অতৃপ্ত আত্নার ঝড় হৃদয়ের তারে তারে বেজে রক্তাক্ত করে।

জাঙ্গাল ভাঙ্গার খাল, পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহমান একটা সরু জলধারা। খালের উত্তর পাশে রাস্তা সংলঘ্ন গভীর খাদ। সেই খাদের পানিতে এক ভাগ্যাহত বাবার নিস্পন্দ দেহটা দুলছে, আর তার অদূরেই পড়ে আছে তার সন্তান। বাচ্চাটাকে দেখে একটা শিয়াল এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে এক পা এগোয় এক পা পিছায়। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে চলে গেল। তারপর এল দু’টি শিয়াল, তারাও কিছুটা আগায় আবার পিছায়, এভাবে কিছুক্ষণ আগা পিছা করে চলে গেল। অবশেষে এল চার পাঁচটা শিয়াল, তারা দলবেধে এসে মেয়েটাকে ঘিরে ধরল। হাসান ডান কাতের উপর পড়েছিল। ফলে তার দেহের ভার পড়েছিল ডান কাধের ভাঙ্গা হাড়ের উপর। কাজেই তীব্র ব্যথায় তার চেতনা ফিরে এল, সে ককিয়ে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ার চেষ্টা করল। যে কোন অবস্থায় অবচেতন মনেও মেয়ের প্রতি তার চেতনা সর্বদা তুঙ্গে থাকে। হঠাৎ মেয়ের কথা মনে হতেই সে মাথা তুলে চারদিকে তাকাল। কাছেই কয়েকটা শিয়াল দেখে ‘হায় আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ গো’ বলে আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠল। চোখের পলকে মেয়ের কাছে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ল। শিয়ালগুলি দৌড়ে পালিয়ে গেল। সে দু’হাত বাড়াতে গিয়ে ডান কাধের ব্যথায় ককিয়ে উঠে মাটিতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বাম হাতে টেনে এনে বাম কাধে রাখল, কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম করল, তারপর উঠে ঢালু রাস্তার নরম মাটিতে দুই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি গেথে গেথে পাহাড়ের চড়াইয়ের মত অতিক্রম করে উঠে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল।

মেয়েটা তার কাধে ছাগলের মরা বাচ্চার মত নেতিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু সেদিকে তার হুস নেই। সে জানে এটা তার মেয়ে, তার মেয়ের কোন দিন কিছু হবে না, হতে পারে না। আবার সে হাঁটা শুরু করল। নিকষ কালো অন্ধকার, অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে, দুই হাত সামনে কিছুই দেখা যায় না। জগতটা যেন কোন আধার বিবরে বন্ধি হয়ে আছে, চলছে পথিক, আধার পৃথিবীর পথিক চলছে। দুর্লঙ্ঘনীয় পথ, রাস্তার প্রতি বাকে বাকে লুকিয়ে আছে মরণ ফাঁদ। নিয়তির টানে সে এগিয়ে যাচ্ছে তার নির্ধারিত লক্ষের দিকে।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ইন্ডিয়া সীমান্তে কোদালিয়া নামে একটা বাঁধ ছিল। এই বাঁধের উজানের লোকেরা পানিতে ভাসত, এজন্য তারা বারবার চেষ্টা করত বাঁধটা কেটে দিতে। কিন্তু ভাটির বিশাল অঞ্চলের লোকেরা বাঁধের উপরে পার্শ্বে ঘর বেধে পালাক্রমে সব সময় পাহারা দিত। এই বাঁধটা ছিল দুই অঞ্চলের লোকদের কুরুক্ষেত্র, এখানে নিত্যদিন লাশ পড়ত। কখনো উজানের লোকেরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করত, বাঁধ ভেঙ্গে দিতে চাইত, মারামারি হত কিন্তু ভাটির সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসংখ্যার সাথে তারা এটে উঠতে পারত না। শুনা যায় এখানে আগে থেকেই বহু খুনাখুনি হয়েছিল।

আশ্বিন মাস, ১৯৮৪ সাল। কোন সুযোগে বাঁধটা ভেঙ্গে দেয়া হয় আর সাথে সাথে সমগ্র উত্তর ময়মনসিংহ পানির তলায় তলিয়ে যায়, বানের স্রোতে অসংখ্য নর নারী ও গবাদি পশুর লাশ ভেসে আসতে থাকে। কয়েক হাত পুরু, হঠাৎ এই বন্যা ধেয়ে আসার সময় বহুদুর থেকে এর গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। চোখের পলকে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এই সর্বগ্রাসি বন্যা প্রথম ধাক্কাতেই অতদাঞ্চলের পুলগুলি ভেঙ্গে ফেলে এবং সাগর দিঘীর মত বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক ভাষায় এসব গর্তকে কুর বলা হয়। কুর ভেদে এগুলির গভীরতা ছিল দশ থেকে পঁচিশ হাত পর্যন্ত। এসব কুর কোনটা রাস্তার ভাটিতে, কোনটা রাস্তাসহ, কোনটা ভাটির সমান উজান থেকে মাটি ভেঙ্গে তৈরি হয়। সাধারণত এগুলির আয়তন ছিল কমবেশ একশ হাত প্রস্থ ও দুইশ হাত দৈর্ঘ্য। এগুলি কুদরতের শক্তির নিদর্শন হিসাবে এখনো বিশাল বিশাল পুকুরের আকৃতিতে বেঁচে আছে।

এমনি একটা কুর হয়েছিল হাসানদের বাড়ির পিছনে কিন্তু এটা হয়েছিল রাস্তার ভাটিতে। ফলে রাস্তা পুননির্মাণ করে পুল করা সম্ভব হয়েছিল। বালিয়া বাজার থেকে সামান্য দক্ষিণে আরেকটা কুর হয়েছিল, এটা রাস্তার পঞ্চাশ হাত উজান থেকে একশ হাত ভাটি পর্যন্ত গর্ত হয়েছিল। রাস্তা বরাবর পানির গভীরতা ছিল বিশ থেকে পঁচিশ হাত। রাতের বেলা পথিকরা সোজা এসে যাতে কুরে পড়ে না যায় এজন্য স্থানীয় লোকেরা রাস্তার দুই মাথায় বাঁশ পুতে আড়াআড়ি দুইটা করে বাঁশ বেধে দিয়েছিল। যাতে পথিকরা বেড়ায় বেজে মৃত্যু ফাঁদ থেকে সতর্ক হতে পারে। হাসানের বাহ্যিক কোন অনুভূতি ছিল না, শক্তিহীন অবশ দেহে পা টেনে টেনে সে হেঁটে যাচ্ছে। ডান পা সামনে বাড়াল, সেটা বেড়ার নিচের বাঁশ পেরিয়ে গোড়ালিতে বাজল। বাম পা তুলে কদম ফেলার জন্য সামনে ঝুকল, তখনি ডান পায়ের হাটু বেড়ার উপরের বাশে বাজল। অর্থাৎ বেড়ার উপরের বাশে বাজল হাটু আর নিচের বাশে বেজে থাকল গোড়ালি। সে ঝড়ের মুখে সুপারি গাছের মত সামনে ঝুকে পড়ল আর সাথে সাথে তার হাটু-টা কট্টস করে উঠল, হাটুর বাটি ছেড়ে দিল। হায় রে হতভাগা, সে ‘ও আল্লাহ্‌’ আর্তনাদ করে পিছনে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল। তীব্র ব্যথায় ‘আল্লাহ্‌ গো মা গো’ বলে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকল। কাঁদল, অবচেতন হয়ে অনেকক্ষণ পড়ে থাকল। মেয়েটা তার পাশেই পড়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর উঠল, মেয়েকে বাম হাতে টেনে বাম কাধে রাখল। তারপর লক্ষ্য করল সামনে বেড়া, রাস্তার পূর্ব পাশ দিয়ে ঢালু পথ নেমে গেছে। সে পঙ্গুর মত কোমর হেঁচড়ে হেঁচড়ে ঢালুতে গেল, সামনে দু’পা ছড়িয়ে বসল। তারপর বাম হাত মাটিতে রেখে শরীরটা সামনে ঠেলে দিল। আর সাথে সাথে সাবানের মত মাটিতে পিছল খেলার মত পিছলে নীচে চলে গেল। এরপর বাম পায়ে ভর করে দাঁড়াল, ডান পায়ে পদক্ষেপ দিল কিন্তু প্রচন্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠল। তারপর বাম পায়ে ভর রেখে কোন রকম খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল। পথের মাথায় গিয়ে সড়কে উঠতে চাইল কিন্তু ঢালু পথ সাবানের মত পিছলা। কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার পাশ ধরে ক্ষেত দিয়ে হাঁটতে লাগল কিন্তু ক্ষেতের কাঁদায় আধা হাত পরিমাণ পা ঢুকে যাচ্ছে। কোন সুস্থ সবল মানুষের পক্ষেও এমন কাদা ভেঙ্গে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। হতভাগ্য হাসান পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে ভাঙ্গা পায়ে মৃতবত হেঁটে যাচ্ছে। সামনে একটা আল পড়ল, আলে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। আবার হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সামনে আরেকটা উচু আল পড়ল। আলে পিঠ ঠেকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর অতিকষ্টে আলে উঠল, আল থেকে সামান্য উচু রাস্তা। এরপর রাস্তায় উঠে গেল।

সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল কিন্তু এ রাস্তাটা ভয়ানক খারাপ। কাদা ব্যতিত এক ইঞ্চি জায়গা নেই, ঘন ঘন গর্ত। সে বারবার গর্তে পড়ে যাচ্ছে আর ধীরে ধীরে তার হাঁটুটা একদম কিবল হয়ে আসছে। হাঁটুর প্রচণ্ড ব্যথা তাকে কাবু করে না, কারণ তার কোন চেন্স নেই, শারীরিক অনুভূতি মরে গেছে। হাটুটা লড়খড় করছে এর উপর আর ভর দিতে পারছে না, হাঁটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে তবুও হেঁটে যাচ্ছে, সে মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে, এই দুর্বার আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

উদার উন্মুক্ত আকাশ, তার নীচে সুবিস্তৃত পৃথিবী। তারই বুকে কাল যে যুবক ছিল টগবগে প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত, আজ সে ভাগ্যের চোরাবালিতে আটকা পড়ে ধুকছে, ধুকছে সে পৃথিবীর পথে। দিনের সুর্য আর রাতের তারকাপুঞ্জ পৃথিবীর বুকে এমন ভাগ্য বিড়ম্বিত মানব সন্তান খুব কমই দেখেছে।

( আর মাত্র দুটি পোষ্ট বাকী আছে)

বিষয়: সাহিত্য

১১৫৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File