চিরকুমার সংঘ - ৩

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২১ নভেম্বর, ২০১৮, ০৯:৪৩:৫৮ সকাল

তৃতীয় অধ্যায়



সিরাজ হায়দার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করার পর রাজনীতিতে ঢোকেন। বুর্জোয়া শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর চাকরি নামের গোলামী না করে তিনি দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ময়মনসিংহের বিখ্যাত কমরেড মণি সিংহের হাতে তার রাজনীতির হাতে খড়ি। তবে গুরুর সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়, কারণ মনিসিংহ ছিলেন মস্কোপন্থী কমরেড। কিন্তু সিরাজ হায়দার শীঘ্রই বুঝতে পারলেন বাংলাদেশের মতো মৌলবাদী রাষ্ট্রে মূল ধারার রাজনীতি করে কখনো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এখানে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করতে হলে মাও সেতুংয়ের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। কাজেই তিনি মাওপন্থী- পিকিংপন্থী সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠলেন। সর্বহারা ও বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলেন।

এর মধ্যেই শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ, তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হলো তার ও তার দলের ওপর নির্মূল অভিযান। তখন তার অনেক কর্মীকে হত্যা করা হয়, জেল-জুলুম-নির্যাতনসহ তাদেরকে ধ্বংসের জন্য রাষ্ট্র শক্তি মরিয়া হয়ে উঠে। উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা তিনি রাজনীতিতে ইস্তফা দিয়ে চিরকুমার সংঘ নামের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। এই গড়ে তোলার পেছনে শানে নুযুল হল- তিনি শাইমা নাম্নি এক খালাত বোনকে ভালোবাসতেন। শাইমার পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত ছিল সিরাজ লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নিবে, তারপর তারা বিয়ে দিয়ে দিবে। কিন্তু সে চাকরি না নিয়ে যখন রাজনীতিতে যোগ দিল তখন শাইমার পরিবার থেকে বলা হলো ‘চাকরি না করলে বিয়ে হবে না। সিরাজ বলল ‘আমি বর্জোয়া শোষকদের অধীনে চাকরি করব না। মানুষ হিসাবে আমার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে কৃষক শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, বর্জোয়া রক্ত চোষাদের নিশ্চিহ্ন করে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শাইমার বাবা সামাজিক সাম্যের চেয়ে নিজের মেয়ের সাম্যের চিন্তাটাকে অগ্রাধিকার দিলেন, তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সিরাজ অত্যন্ত মর্মাহত হলো।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এক সহকর্মী কলেজ শিক্ষিকা কমরেড গিরিবালার সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠল। সেই সম্পর্ক দৃঢ় হলো, তারা মস্কো গেল পিকিং গেল দিল্লি গেল, হোটেলে একই রুমে অবস্থান করল। সিরাজ তাকে বিয়ের চিন্তা ভাবনা করতে লাগল, মায়ের সাথে আলাপও করল। কিন্তু এর মধ্যেই দেখা গেল গিরিবালা তার দল ত্যাগ করে এক কলেজ শিক্ষকের ঘরনী হয়ে গেছে। সিরাজ খুব দুঃখ পেল, তার শেষ আশার বাসাটি ভেঙ্গে গেল। মেয়েদের প্রতি তার ঘৃণা ধরে গেল, সে সিদ্ধান্ত নিল জীবনে আর বিয়ে করবে না চিরকুমার থাকবে। তার বাবা নাই মা আছেন। একমাত্র ছেলের এই দুর্গতি ও দুর্মতি দেখে মা সব সময় কান্নাকাটি করেন, ছেলেকে বকাঝকা করেন, বিয়ের জন্যে উপর্যুপুরি চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু ছেলের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। অগত্যা মা নিজেই পাত্রী দেখা শুরু করলেন। অবশেষে ফুলপুরের একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন।

সিরাজ বলল ‘আমি বিয়ে করবো না। মা বললেন ‘আমি নাতি নাতনির মুখ দেখবো। ছেলে বলল ‘দুয়েকটা অনাথ এনে প্রতিপালন কর। মা বললেন ‘আমার বংশের প্রদীপ চাই। ছেলে বলল ‘কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষরাই আমার বংশ। মা বললেন ‘আমার বংশধর চাই, বংশের প্রদিপ চাই অন্যথায় আমার মরা মুখ দেখবি। এবার সিরাজ প্রমাদ গুনল। অগত্যা নির্ধারিত দিনে দলবল নিয়ে সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে নববধুর সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার জন্য কনের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। সে বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ সবাইকে দাওয়াত করেছিল। মেয়ের বাবা হাজ্বি, বড় ভাই আলেম। বরযাত্রীরা মণি সিংহকে মধ্যমনি করে বসে আছে দেখে মেয়ের বাবা নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘কি ব্যাপার হালুয়াঘাটের গারোটা এখানে এলো কিভাবে, কোন সাহসে? কিন্তু শীঘ্রই তিনি জানতে পারলেন তার হবু জামাতা মণিসিংহের শিষ্য, পিকিংপন্থী কমরেড বিখ্যাত বা কুখ্যাত কমিউনিস্ট সিরাজ হায়দার।

তিনি একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। তারপর বিষণ্ণ মুখে মেহমানদের আদর-আপ্যায়ন, খাওয়া-দাওয়া ও যত্ন আত্তি ঠিকমত করলেন। খাওয়া পর্ব শেষ হলে মেহমানদের উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় ‘আমার মেয়েটা মারা গেছে’ বলে তিনি বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। মেয়ের বড় ভাই বলল ‘আমার বাবা হাজী আমি আলেম। কাজেই একটা কমিউনিস্টের কাছে বোন বিয়ে দেয়ার চেয়ে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া আমাদের জন্য খুব সহজ এবং উচিতও বটে। তখন বরপক্ষ আত্মসমর্পণ করলো, কাতর মিনতি শুরু করল। কিন্তু কন্যাপক্ষ তাদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। সিরাজ বিষন্ন হাসি হাসল ‘পৃথিবীতে সবাই সব কাজের জন্য জন্মায় না, বিয়ে করার জন্য আমার জন্ম হয়নি। তারপর তারা শ্রাবণের আকাশের মতো থমথমে মুখে বিদায় নিল।

ওদিকে মেয়ের বড় ভাই ঘোষণা দিল বাঙালি মেয়েরা বিয়ের পাটিতে বসার পর বিয়ে ব্যতীত তাদেরকে পাটি থেকে ওঠানো হয় না। কাজেই আমার বোনের জন্য কেউ প্রার্থী থাকলে এগিয়ে আসো। যোগ্য-অযোগ্য যাই হোক আজকে আমার বোনের বিয়ে হবে। মেয়েটা ছিল প্রকৃত সুন্দরী, তার পাত্রের অভাব ছিলো না। আমন্ত্রিত মেহমানদের মধ্যে কয়েক যুবক এগিয়ে এল। তার মধ্যে একজন ছিল মেয়ের ফুফাতো ভাই- ব্যাংক কর্মকর্তা, তার সাথেই বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণে সিরাজের অসুস্থ মা প্রচন্ড মানসিক আঘাতে শয্যাশায়ী হলেন। কয়েকদিন রোগে-শোকে ভোগে তিনি মারা গেলেন। মায়ের মৃত্যুতে সিরাজের মনটা পাথর হয়ে গেল, পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরে গেল। মেয়েদের প্রতি তার ঘৃণা ও ক্রোধ চরমে উঠল। এরপর সে সিদ্ধান্ত নিল মেয়েদের উপর প্রতিশোধ নিবে, চরম প্রতিশোধ। কারণ মেয়েদের জন্যই তার জীবনটা নষ্ট হল, তার মায়ের মৃত্যু হল। কিন্তু প্রতিশোধটা কি করে নেওয়া যায়? দু’চার দশটা মেয়েকে হত্যা করলে বা ধর্ষণ করলে ব্যাপক নারী সমাজের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হয় না বরং নিজেকে ধ্বংস করা হয়। কাজেই অন্য কোন বিকল্প খুঁজতে হবে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে সিদ্ধান্ত নিল চিরকুমার সমিতি গঠন করবে। কারণ ছেলেরাই হল মেয়েদের অবলম্বন। কাজেই যত বেশি সংখ্যক ছেলেকে চিরকুমার রাখা যাবে ততবেশি সংখ্যক মেয়েকে শাস্তি দেয়া যাবে। কাজেই মেয়েদের শায়েস্তা করার উপায় একটাই।

স্বাধীনতা-উত্তর সিরাজ বহুদিন জেল খেটেছে। বাকশালীরা তার অসংখ্য কর্মীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, অনেকেই জেলে পড়ে পড়ে পচছে। জেল থেকে বেরিয়ে সিরাজ রাজনীতিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের কাজে আত্মনিয়োগ করল। কিন্তু সমস্যা হলো তার পরিবারে কেউ নেই, দুটি বোন ছিল বিয়ে হয়ে গেছে। মা মারা গেছে, একাকী সংসারে খাওয়া যায় কিন্তু থাকা যায় না। অগত্যা সে একটা ভাগ্নিকে এনে লালন-পালন করতে লাগল। এক বাপের এক ছেলে হিসাবে সে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হলো। এ সম্পদের অধিকাংশ সে চিরকুমার সমিতিতে ব্যয় করতে লাগলো। নারী বিদ্বেষী, ব্যর্থ প্রেমিক, স্ত্রী পরিত্যক্ত- এজাতীয় ছেলেদেরকে ধরে ধরে এনে সমিতির সদস্য করতে লাগল। সে সবকিছু ত্যাগ করে নিবিষ্ট মনে সমিতির কাজে আত্ননিয়োগ করল আর সমিতিও দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল।



আনন্দমোহন কলেজে ইংলিশে মাস্টার্স পড়ুয়া আদিল নামের একটি ছেলে পরপর তিনটা প্রেমে ছেকা খেয়ে চতুর্থ শিকার ধরতে গেল। কিন্তু বদমাশ শিকারটি নিজে ধরা না দিয়ে উল্টে তাকেই তার ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। পরিণতি যা হবার তাই হল, মেয়ের ভাইটা কয়েকজনকে সাথে নিয়ে জুতার যথার্থ প্রয়োগ করে তার দুই গালের উচ্চতা নাকের সমান্তরাল করে দিল। তখন বেচারা আদিল চিরকুমার সমিতিতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সিরাজের হাত ধরে বলল ‘আমি জীবনে তো কোনদিন বিয়ে করবো না করবোই না সেই সাথে বাংলাদেশের একটা মেয়েরও যাতে বিয়ে না হয় তার জন্য যা যা করণীয় সব আমি করব, আমাকে শুধু একটা সান্স দেন।

সিরাজ কয়েকদিন তাকে বাজিয়ে দেখে বুঝল যে, না ছেলেটা মেয়েদের বিরুদ্ধে বারুদ, এ কখনো ওদের পেলব বাহুবন্ধনে যাওয়ার জন্য লালায়িত হবে না। মেয়েদেরকে সাইজ করার জন্য উপযুক্ত একটা হাতিয়ার। সে আদিলকে সহ-সভাপতি পদে নিয়োগ দিল। আদিল সমিতির উন্নতি অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার জন্য মাঝে মধ্যে সভাপতির বাসায় যায়। একদিন সে আবিষ্কার করলো সভাপতি একা নয়, তার অন্দর মহলে কেউ আছে। যার চুরির রিনিঝিনি ও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। খোজ নিয়ে সে জানতে পারল সভাপতির ভাগ্নি আঞ্জুমান আরা। তখন থেকে সভাপতির বাসায় তার আনাগোনা বড্ড বেশি বেড়ে গেল।

আদিলের আনাগোনাটা কি সভাপতির উদ্দেশ্যে নাকি অন্দর মহলের উদ্দেশ্যে- সিরাজ তা বুঝে ওঠার আগেই একদিন দেখল তার ঘর খালি, সেই সাথে সমিতির সহ-সভাপতি উধাও। সিরাজ ক্ষেপে গেলো এবং ভেঙে পড়লো। আগে যাওবা নারীর ওপর থেকে তার আস্থা উঠে গিয়েছিল এখন ছেলেদের ওপর থেকেও আস্থা উঠে গেল। সে লজ্জা ও অপমানে সমিতিতে যাওয়া বন্ধ করে একদম ঘর বৈঠক হয়ে গেল। এই সুযোগে সমিতিতে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সমিতির প্রথম ধাপের সদস্যরা সবাই বিয়ে করে আগেই সমিতি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। এ জন্য দ্বিতীয় ধাপের সদস্যদের শপথ ও জামানত নিয়ে সদস্য পদ দেওয়া হত। এদের মধ্যে অনেকের যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে, কারো কারো প্রেমিকা আছে এবং বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, কারো পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছে, কেউ নিজেই পাত্রী খুঁজে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু এতদিন তারা কোন সুযোগও পাচ্ছিলো না সমিতিও ত্যাগ করতে পারছিল না।

কিন্তু এবার আদিল তাদের জন্য সেই পথটা খোলে দিয়ে গেল। তারা যখন শুনল সহ-সভাপতি সিরাজের ভাগ্নিকে নিয়ে উধাও হয়েছে, সমিতি ত্যাগ করেছে তখন তারা এটাকে দৈবের দান রুপে ধরে নিল, এই সুযোগটাকে কাজে লাগাল। তারা ঘোষণা দিল ‘সহসভাপতি আমাদের আদর্শ, তার নীতি অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। ব্যাতিক্রম করলে অবশ্যই পাপ হবে। কাজেই সহ-সভাপতির অনুসরনে আমরাও বিয়ের ঘোষণা দিলাম। এরপর তারা সবাই বিয়ে নামক মধুকুঞ্জে ঝাপিয়ে পড়ল। তবে তারা সভাপতির সন্মান রক্ষা করতে ভুলল না। তারা বাবা ভাই বা বন্ধুর মাধ্যমে তার কাছে বিয়ের কার্ড পাঠাতে লাগলো। সিরাজ ক্ষোভে-দুঃখে কোথাও যায় না, সবসময় বাসায় বসে থাকে। তার কাছে দৈনিক দশ-বারোটা করে বিয়ের দাওয়াতপত্র আসতে থাকে। তারই সমিতির সদস্যরা তাকে এভাবে উপহাস করছে দেখে নারীর ন্যায় পুরুষের প্রতিও তার ঘৃণা জন্মে গেল, সে সমিতি ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

কিন্তু সমিতিতে তখনও কিছু সদস্য বাকি আছে- যারা নিরেট ছাত্র, এখনো এদের বিয়ের বয়স হয়নি। তারা এসে সভাপতির সামনে নতজানু হয়ে পড়ল ‘স্যার আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, গাদ্দাররা গাদ্দারী করেছে বলে সবাই তো আর গাদ্দার না। আমরা আছি আপনার সাথে, আমাদের ওপর আপনি আস্থা রাখুন। আমরা জীবন গেলেও সমিতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবোনা। দেহে প্রাণ থাকতে কোনদিন নারী নামক আগুনে হাত পোড়াবো না। আপনি চলুন আমরা আবার সমিতিটাকে চাঙ্গা করে তুলি। তাদের কথায় সভাপতি আশ্বস্ত হলো, সমিতিতে গিয়ে পুরানদের ঝেটিয়ে বিদায় করে নতুনদের থেকে আবার শপথ নিয়ে সমিতি পুনর্গঠন করল। আবার নতুন নতুন সদস্যের আগমন শুরু হলো।

একদিন একটা সুদর্শন ছেলে এসে সভাপতির হাত ধরে কেদে ফেলল। তারপর বলল ‘আমি মেয়ে জাতটার উপর বিষিয়ে উঠেছি, ওদের প্রতি আমার মনে ঘৃণার আগুন জ্বলছে। যতক্ষণ আমি মেয়েদের উপর প্রতিশোধ না নিতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত আমার মনের আগুন নিভবে না, আপনি আমাকে একটু সুযোগ দিন। সভাপতি বুঝল ‘এই ছেলেটাকে দিয়ে কাজ হতে পারে। সে পরিচয় জিজ্ঞেস করল। ছেলেটা বলল ‘আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ, ঢাকা ভার্সিটিতে রসায়ন বিভাগে পড়ি, বাড়ি চরপাড়া। সিরাজ বলল ‘তোমার ঘটনা বল, সমিতিতে আসার যথার্থ কারণ দর্শাতে পারলে সদস্য পদ পাবে অন্যথায় নয়। কারণ নারীর চেয়ে বড় বেইমান পুরুষ। নারীরা প্রেম করে তারপর স্বার্থের টানে ছেকা দিয়ে চলে যায়। আর পুরুষরা সমিতিতে আসে, অঙ্গীকার করে জামানত দেয় তারপর নারী মাংসের লোভে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে জামানত ত্যাগ করে চলে যায়। কাজেই এরা মেয়েদের চেয়েও নিকৃষ্ট। এখন তোমার ঘটনা বল, আমি বাজিয়ে দেখবো যদি টিক তাহলে সদস্য হতে পারবে।

হুমায়ন বলা শুরু করল ‘আমি মুকুল নিকেতন স্কুলে পড়তাম। নিচের ক্লাসে পড়তো আমার পাশের বাসার শবনম। সে ছিল অপ্সরীর মতো সুন্দরী, তাকে দেখলে আমি নিজেকে ভুলে যেতাম, তার মধ্যে হারিয়ে যেতাম। এক সময় দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমরা নদীর কিনারে হাটতাম, একসাথে সিনেমা দেখতাম, মাঝে মধ্যে নিভৃতে সময় কাটাতাম। আমি ইন্টার পাশ করে ঢাকা ভার্সিটি ভর্তি হলাম। পরের বছর সে ইন্টার পাশ করে রেটিনা কোচিং করে ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেল। এরপর থেকে আমি যতই তার নিকটবর্তী হতে চাই ততই সে আমার থেকে দূরে চলে যেতে লাগল। এক বছর পর শুনলাম ময়মনসিংহ মেডিকেলের এক ডাক্তারের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি কঠিন আঘাত পেলাম।

তখন আমার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। মুক্তাগাছার একটা মেয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টে চান্স পেল। তার ভর্তি, হোস্টেলে সীট পাওয়া ইত্যাদি সব ব্যবস্থা করে দিলাম। তার মধ্যে আমি শবনমকে খুঁজে পেলাম। প্রতিদিন বিকালে তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম, চাইনিজ বা সে যা পছন্দ করত তাই খাওয়াতাম। মাঝে মধ্যে মার্কেটে গিয়ে তাঁর পছন্দনীয় উপহার সামগ্রি কিনে দিতাম। তার পেছনে অনেক খরচ করতে লাগলাম। সে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর অনেকদিন যাবত তাকে দেখি না, আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ, অনেক অনুসন্ধানের পর জানতে পারলাম কানাডা প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বার্থের টানে সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল।

আমার খালাতো বোন মৌসুমী পরীর মত মেয়ে। তাকে দেখলে আমি আত্মহারা হয়ে যেতাম। যদিও সে আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট তবুও তার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমি নিজে যেচে তাকে কাছে টানলাম, সেও আনন্দের সাথে ধরা দিল। আমার মায়ের সাথে আলাপ করলাম, মা বাবা সবাই রাজি খালাও রাজি। মৌসুমীর ইন্টার পরীক্ষার পর আমাদের বিয়ে হবে, কথা পাকাপাকি হয়ে থাকল। ইন্টার পরীক্ষা শেষ হল কিন্তু দুইদিন পর তার বিয়ে হয়ে গেল। আমার খালু এক আমেরিকা প্রবাসি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এরপর সে দু'হাতে মুখ ঢেকে ফুফিয়ে কেঁদে উঠল ‘এভাবে মেয়েরা আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। এরা পুরুষের জন্য আশীর্বাদ নয় অভিশাপ। আমি এদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাই, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন।

সভাপতি বুঝল ছেলেটার মনে দুঃখ আছে ক্ষোভ আছে, মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষ আছে একে দিয়ে কাজ করানো যাবে। সে বলল ‘দেখ মানুষ বড় বেইমান। পুরাতনদের কেউ নেই, আসছে আর শপথ ভঙ্গ করে চলে যাচ্ছে। শুধু একটা বুড়ো আছে, আর আছে এইজন্য যে সে নপুংশক। শুনেছি এখানে আসার আগেই নাকি সে একটা বিয়ে করেছিল কিন্তু বউটা তাকে ফেলে চলে গেছে। এরপর থেকে সে এখানেই আছে। পুরাতনদের মধ্যে আমিই একমাত্র আদি বাসিন্দা বাকি সবাই চলে গেছে। কাজেই যদি ঠিক থাকতে পারো তাহলে আস, অন্যথায় মিছামিছি শপৎ ভঙ্গ করে পাপিষ্ট হওয়ার দরকার নাই। হুমায়ুন দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানাল। তারপর সভাপতি তার কঠিন শপথ নিল এবং জামানত নিয়ে সদস্য পদ দিয়ে দিল।

হুমায়ন সদস্য হওয়ার পর সমিতির অবস্থার দ্রুত উন্নতি হতে লাগল। চারদিকে ব্যাপক প্রচার-প্রসার চলতে লাগলো। সভাপতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে, একাকী জীবনযাপন করা তার পক্ষে অসম্ভব ঠেকল, জীবনটা অভিশপ্ত মনে হলো। অগত্যা তার ভাগ্নি ও জামাইকে নিয়ে এলো। আদিল একটা কলেজে ঢুকেছে, তাদের একটা বাচ্চা হয়েছে। সিরাজ বাচ্চাটাকে নিয়ে সময় কাটায়, ভাগ্নিকে নিয়ে সে একটা পরিবার গড়ে তুলেছে। এখন এই পরিবার নিয়ে সে সুখী। সমিতির দায়িত্ব অনেকটা হুমায়ূনের উপর, তাতে সমিতির অবস্থা উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে। সে প্রথমবারের মতো চিরকুমার বার্তা নাম দিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ করল। সার্কিট হাউজ ময়দানে সমিতির পক্ষ থেকে ছোটখাটো একটা সভা হয়ে গেল। এতে সর্বত্র সমিতির নামডাক ছড়িয়ে পড়ল। ছাত্র ও যুবক ছেলেরা এদিকে আকৃষ্ট হতে লাগল।



সদস্য সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গেলো। সিরাজ খুশি হয়ে হুমায়ূনকে সহ-সভাপতির পদ প্রদান করল। হুমায়ুন বলল ‘আমাদের সদস্য সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, ওই ছোট্ট ঘরে এখন আর সদস্যদের বৈঠক সম্ভব হচ্ছে না, অনেককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আল্লাহ আপনাকে যথেষ্ট সামর্থ্য দিয়েছেন, আপনি দয়া করে সমিতির জন্য একটা কাজ করুন। শহরের মাঝখানে আপনার যে ফাঁকা জায়গাটা পড়ে আছে, সমিতির জন্য সেখানে একটা বিল্ডিং করে দেন। সমিতির অগ্রগতি দেখে সিরাজ সেখানে পাঁচতলা একটা ভবন করল, দ্বিতীয় তলার এক পার্শ্বে অফিসিয়াল দুতিনটা রুম করে বাকিটা বিশাল হলরুম বানিয়ে দিল। নিচতলা ও ওপরের তলাগুলি বাসা বাড়ির জন্য নির্মাণ করে এর আয় সমিতির নামে বরাদ্দ দিয়ে দিল। তারপর পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সমিতি স্থানান্তর করা হলো।

উদ্বোধনির দিন সিরাজ সহ-সভাপতির অনেক প্রশংসা করে বলল ‘হুমায়ূন আহমেদ আসার পর থেকে আমাদের সংঘের সর্বত্র জয়জয়কার শুরু হয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে সম্মেলন হচ্ছে, পত্রিকা বের হচ্ছে, সদস্য সংখ্যা হাজারের কোটায় পৌঁছে গেছে- এসব হুমায়ূনের কৃতিত্ব। কাজেই এ সংঘের দায়িত্ব আমি তার কাঁধেই অর্পণ করতে চাই। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, সমিতির জন্য শ্রম দেওয়া সময় দেওয়া দৌড়াদোড়ি করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কাজেই আমার দায়িত্ব আমার চেয়ে যোগ্য ও দক্ষ হুমায়ূন আহমেদের উপর অর্পণ করলাম। আজ থেকে সেই সমিতির সভাপতি, আমি অবসর নিলাম। আমি চাই এই সমিতি চিরজীবী হোক, দেশের ছেলেরা এর আশ্রয় গ্রহণ করুক। আর এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য হুমায়ুনই যথাযোগ্য। কাজেই আপনারা তার নেতৃত্ব গ্রহন করুন, তাকে মেনে নিন।

কিন্তু হুমায়ূন ও অন্যান্য সদস্যরা সিরাজকে ছাড়তে রাজি হল না। তাকে সভাপতি পদেই আমৃত্যু বহাল থাকার অনুরোধ করলো। কিন্তু সিরাজ তাদের পীড়াপীড়িতে অগত্যা সভাপতি পদের বদলে উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করতে রাজি হল। এরপর থেকে সে আর কোথাও যায় না, বাসায় শুয়ে বসে থাকে। ভাগ্নির সন্তানদের নিয়ে খেলাধুলা করে সময় কাটায়। কেউ আসলে তার চেম্বারে গিয়ে সাক্ষাত করে। বড়সড় একটা রুমে তার চেম্বার, একপাশে হুইল চেয়ার ও আবলুস কাঠের অফিসিয়াল দামি টেবিল, তিন পাশে বিদেশি সাইজের উন্নত মানের সোফা পাতা।

সিরাজ হায়দার চেম্বারে বসে আছে। তার সামনে সোফায় ও চেয়ারে ত্রিশ চল্লিশ জন চিরকুমার সদস্য বসে আছে। তাদের মধ্যে সভাপতি হুমায়ুন কথা বলা শুরু করল ‘স্যার আপনি জানেন যে আগে থেকেই মেয়েরা বিশেষত নারী নেত্রীরা আমাদের সমিতির বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু এবারকার বিরুদ্ধাচরণ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পত্রিকা প্রকাশের আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলারা আমাদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে পত্র পাঠিয়েছে। এর মধ্যে কিছু পত্রিকায় প্রকাশ করেছি আর জটিলগুলি বাদ দিয়েছি। কিন্তু সম্মেলনের পর থেকে হুমকি-ধমকি বেড়ে গেছে।

বিশেষত নারী সংগঠন ‘ঝাড়ু সংঘের’ সম্মেলনের পর থেকে আমাদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মোবাইল আসছে, মেসেজ আসছে আমাদের সমিতি বন্ধ করে দিতে হবে। বিশেষ করে ময়মনসিংহের মহিলা এম পি, মহিলা ওসি, মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকার কিছু নারী নেত্রী, একজন মন্ত্রী বারবার আমাকে মোবাইল করছে সমিতি বন্ধ না করলে তারা সংঘের অফিস গুড়িয়ে দিবে, আমাদের হাত-পা ভেঙ্গে রাস্তায় ফেলে রাখবে, তখন ভিক্ষে করে খেতে হবে। আমাদের একেকজনকে দশটা করে প্রতিবন্ধী মেয়ে বিয়ে করাবে, মেয়েদেরকে লেলিয়ে দেবে যেন তারা আমাদেরকে ঝাটা পেটা করে কাজীর অফিসে টেনে নেয়। আমাদের কারণে নাকি দেশে মেয়েদের জ্যাম বেজে যাচ্ছে, এখন আমাদের প্রত্যেক সদস্যকে চারটা করে বিয়ে করতে হবে। এরপরেও যদি আমরা চিরকুমারব্রতচারী হই তাহলে তারা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীকে বলে কয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সংসদে আইন পাস করাবে। তারপর আমাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠাবে এবং দাগী আসামি মেয়েদেরকে ধরে ধরে এনে আমাদের সাথে বিয়ে দিবে। এভাবে যে যেমন পারছে আমাদেরকে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে আমাদের মহিলা এম পি বায়না ধরেছেন তার চারটি মেয়ে এখনো বিয়ের বাকি। এখন যদি আমাদের সমিতি থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দেখে চারটা পাত্র তাকে দেই তাহলে সে আর সমিতির ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু যদি না দেই তাহলে তার দলবল নিয়ে এসে আমাদের অফিস ভেঙ্গে দিবে। ময়মনসিংহের মহিলা ওসি বারবার কল করছে- শীঘ্রই যদি আমরা সমিতি বন্ধ না করি তাহলে সে আমাদেরকে ইভটিজিং, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মেয়েদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকাবে। কারণ তিনি নাকি বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন এখনো তার বিয়ে হচ্ছে না, আর এজন্য নাকি আমরা দায়ি। কারন আমাদের জন্য নাকি উনি যোগ্য পাত্র পাচ্ছেন না, আমরা ভাল পাত্রদের আটকে রেখেছি। কাজেই তিনি আমাদেরকে দেখে ছাড়বেন।

আবার মুমিনুন্নিসা কলেজ ও ফুলপুর মহিলা কলেজের মাননীয়া অধ্যক্ষদ্বয় কখনো মোবাইলে কখনো চিঠি পাঠিয়ে কখনো লোক মারফত আমাদেরকে সতর্ক করছেন যে, তাদের কলেজের মেয়েরা নাকি সব ধাড়ি হয়ে যাচ্ছে, উপযুক্ত বয়সে পাত্র না পেয়ে মেয়েদের মাথা সব সময় গরম থাকে। তারা কলেজে এসেই মারামারি চুলোচুলি শুরু করে দেয়। এতে কলেজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, পড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, মেয়েরাও উন্মাদ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কাজেই শীঘ্রই যদি আমরা সমিতি বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে না বসি তাহলে তারা স্ব স্ব কলেজের মেয়েদেরকে আক্রমনের হুকুম দিবেন। তখন মেয়েরা আমাদের অফিস ধুলিস্যাৎ করে দিবে আর আমাদের প্রত্যেকের গলায় রশি লাগিয়ে গরু-ছাগলের মতো টেনে টেনে নিজ নিজ বাড়িতে বা কাজী অফিসে নিয়ে যাবে। এভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোন করে মেসেজ পাঠিয়ে চিঠি পাঠিয়ে লোক পাঠিয়ে মহিলারা আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এখন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আপনি দিকনির্দেশনা দিন, এই কঠিন সমস্যা ও বৈরী পরিবেশ থেকে আমরা কি করে মুক্তি পেতে পারি।

সিরাজ হায়দার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। সহসা মাথা তুলে গর্জে উঠলেন ‘তোমরা শৃগাল গর্ধব কাপুরুষ। ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা শুরু করলো ‘তোমরা কি কোন দিন এমন কোথাও দেখেছ যে, একটা গাভী ষাঁড়কে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে, একটা ছাগি পাঠাকে হাকিয়েছে, একটা কুকুরি কুকুরকে তাড়িয়ে নিয়েছে? এমন দৃশ্য সৃষ্টির সূচনা থেকে কোথাও দেখা যায়নি। অথচ তোমরা মেয়েদের তাড়া খেয়ে গাভী ও ছাগির মত ভ্যা ভ্যা করে দৌড়ছ আর আত্মসমর্পণের চিন্তা করছ। তোমরা পুরুষ নামের কলঙ্ক, গাভী ও ছাগির চেয়েও নিকৃষ্ট।

কবি-সাহিত্যিকরা বীরযোদ্ধা ও শক্তিমান পুরুষদেরকে বীর্যবান অভিধায় অভিষিক্ত করে। এর অর্থ হল যার মধ্যে বীর্য থাকে বা বীর্য আটকানো থাকে সেই বীর হয়, শক্তিমান হয়। এজন্যই ষাঁড়ের অণ্ডকোষ কেটে ফেলে দিয়ে বলদ বানানো হয় বীর্য আটকে বলবান করার জন্য। তারপর তাকে গাড়িটানা, পানিটানা হাল চষা ইত্যাদি কঠিন কাজে নিয়োগ করা হয়। কারণ এসব কঠিন কাজ ষাঁড় ও গাভী করতে পারবে না, কয়েকদিনেই মারা পড়বে। এসব কঠিন কাজ হল বীর্যবানদের কাজ। একই নিয়মে পাঠা ও মোরগকে খাসি বানানো হয় মোটাতাজা ও মাংসল করার জন্য।

ঠিক একইভাবে চিরকুমার সমিতির উদ্দেশ্য হলো কুমারত্বের মাধ্যমে খাসি বানিয়ে ছেলেদের বীর্যক্ষয় রোধ করে বীর্যবান করে তোলা, শক্তিমান রূপে গড়ে তোলা। তারপর তারা নিজেদের শক্তি দেশ জাতির সেবায় ব্যয় করবে, দেশের উন্নয়ন করবে, জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করবে। মেয়েদের পেছনে বির্যক্ষয়ে যে শক্তি ব্যয় হত তা অবরুদ্ধ করে জাতির কাজে লাগাবে, এরা হবে জাতির খাসি বা বলদ। কিন্তু এখন তো আমি উল্টোটা দেখতে পাচ্ছি, বীর্যক্ষয় রোধ করে তোমরা গাভী ছাগি হয়ে গেছ। মেয়েদের তাড়া খেয়ে দৌড়ে এসে আমার ডানার নিচে আশ্রয় খুঁজছ, যাও ভাগো কাপুরুষের দল। তোমাদের সাথে আমার কোন কথা নাই, বাড়িতে গিয়ে চুরি শাড়ি পরে ঘোমটা মেরে বসে থাকা গিয়ে’ বলে তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন।

কয়েকজন সদস্য লাফিয়ে উঠে কাতর স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, স্যার যাইয়েন না অন্তত আমাদেরকে একটু পরামর্শ দিয়ে যান। সিরাজ ঘুরে দাঁড়ালো ‘পরামর্শের দরকার কি, তোমরা কি কচি খোকা কিছুই বুঝ না? যাও মেয়েদের সামনে লেজ বিছিয়ে না দিয়ে শক্ত হয়ে দাড়াও, ব্যাপকভাবে মিছিল-মিটিং করতে থাক, সমিতির প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাক। তোমরা জোর তৎপরতা দেখালে নারী নেত্রীরা নাচতে নাচতে আপনিই ক্লান্ত হয়ে শান্তভাবে বসে পড়বে’ বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

পরদিন সন্ধ্যায় সমিতির অফিসে সবাই পরামর্শ সভায় বসল। আলোচনান্তে সিদ্ধান্ত হলো পরদিন তারা মিছিল বের করবে। নবাগত এক ছেলে জিজ্ঞেস করল ‘পিকেটারদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে তো? সভাপতি বলল ‘বিরিয়ানির প্যাকেট থাকবে। ছেলেটা মনে মনে বলল ‘তাহলে আর লোকের অভাব হবে না। এরপর তারা ব্যানার-ফেস্টুন ইত্যাদি লেখার কাজে আত্মনিয়োগ করলো।

পরদিন দুপুরে মিছিল বের হল, বিরাট মিছিল। যুবক তরুণদের মিছিল, তাদের সাথে অনেক বিবাহিত ও বৃদ্ধরাও যোগ দিয়েছে। অবশ্য তাদের অধিকাংশই এসেছে বিরিয়ানির প্যাকেটে ভাগ বসানোর জন্য। প্রত্যেকের মাথায় চিরকুমার সমিতির কিরীট আর হাতে ব্যানার ফেস্টুন। ব্যানার ফেস্টুনের রং যত বিচিত্র তার চেয়েও বহুবিচিত্র এর শ্লোগানগুলি। যেমন ‘শুক্রাণু আমার সিদ্ধান্ত আমার, জরায়ু নিপাত যাক শুক্রাণু মুক্তি পাক, দুনিয়ার পুরুষ এক হও লাঠি ধর নারীর প্রভুত্ব খতম কর, আমরা বিয়ে করবো না নারীর দাস হবো না, নারী আছে যেখানে আমরা নাই সেখানে, চিরকুমার সমিতি জয় হোক ইত্যাদি চমকপ্রদ শ্লোগান।



ময়মনসিংহের মহিলা এম পি মমতাজ মহলের আট মেয়ের মধ্যে চার মেয়ের বিয়ে হয়েছে চারজন বাকি আছে। এদের নাম সুমিতা কবিতা ববিতা ললিতা। তারাও ঠিক মায়ের মতোই অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে। লোকেরা মাকে ডাকে এম পি আর মেয়েদেরকে ডাকে এম সি ও এম এইচ। এম সি অর্থ মা কালী বা মহাকালী। এই নামকরণের কারণ হলো তাদের গায়ের রং মা কালীর রং বা পাঁতিলের তলার রংয়ের চেয়েও উন্নত বৈ অনুন্নত নয়। আবার এম এইচ নামকরণের শানে নুযুল হল মিটস হিল বা গোশতের পাহাড়। কারণ হিমালয়ে হিমের অভাব থাকতে পারে কিন্তু তাদের দেহে গোশতের কোন ভাব ছিল না। তারা হেঁটে গেলে মাংস দুলতে থাকে যেন গোশতের পাহাড় হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে।

আবার তাদের দৈহিক আকৃতিও অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্যাপের মতো, মাথাটা ছোট দেহটা বিশাল। নিগ্রোদের মতো কোকড়ানো চুল, থ্যাবড়ানো নাক, মর্তমান কলার মত মোটা ঠোট ও গলার পাশে গাল দুটি ব্যাঙের গ্যাগের মতো ঝুলে আছে। বুকের সাইজ সমতলে দুই পর্বত, পেট যেন ঠিক গিন্নিদের মটকার মত। পাছার অবস্থা সাতিশয় প্রশংসনীয়। কারণ দুনিয়ার সকল মাংস এই দুই উপত্যাকায় এসে ভিড় করেছে, যেমন সুবিস্তৃত তেমনি সুউচ্চ। হেটে গেলে দুই নিতম্বের ধাপাধাপি দেখে মনে হয় যেন দুইটা পর্বত ভীষণ টুকাটুকি শুরু করে দিয়েছে। মানচিত্রের মত তাদেরকে উত্তর মুখী করে দাঁড় করালে পেট যদি ইন্ডিয়ান বর্ডার স্পর্শ করে তাহলে নিশ্চয়ই পাছা গিয়ে বঙ্গোপসাগর ছুই ছুই করবে।

মেয়েগুলি আবার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। খাওয়া ও বরের সংজ্ঞা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন কিছুর সংজ্ঞা তারা জানে না। আবার লেখাপড়ায় বিপরীত দিক দিয়ে তারা তুখোড় প্রতিভাধর। কারণ সাধারণ ছাত্ররা যেখানে ক্লাশ পরীক্ষায় ফেল করার কৃতিত্ব বড় একটা দেখাতে পারে না- সেখানে তারা প্রতি ক্লাসে দুই- চার বার করে ফেল করার কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গত কারণেই যদিও বয়স অনুপাতে তাদের মাষ্টার্স পর্ব অতিক্রম করার কথা কিন্তু ফেলের কৃতিত্বের কারণে তারা আজও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আটকে আছে। বড় মেয়ে কয়েকবার এস এস সি ফেল করার পর মা দুইজন মাস্টার নিয়োগ করে দেন। একজন বই চিড়ে দিত আরেকজন পাশে বসে প্রশ্নোত্তর মিলিয়ে উত্তর কাটছাঁট করে সংক্ষিপ্ত করে দিত আর মা সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। শত হলেও এমপির মেয়ে বলে কথা। এভাবে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ হলেও ইন্টারে এসে বারবার ডাব্বা মেরে যাচ্ছে, অবশ্য এইবার এমপি সাহেবা মেয়ের বদলি পরীক্ষা দিইয়ে পাস করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মেয়েদের এসব বৈশিষ্ট্য অবশ্য হাওয়া থেকে উড়ে আসেনি, মায়ের বৈশিষ্ট্যে তারা বিশিষ্ট হয়েছে। মা চেহারায় যেমন ছিলেন মহাকালি দৈহিকভাবেও মাংসের পাহাড়, তেমনি ছাত্রী হিসেবেও একেবারে ধামাকা। চারবারে ম্যাট্রিক সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে যুগে আট দশ বছরের মেয়েদের বিয়ের প্রচলন ছিল তখন পঁচিশ বছরের ধাড়ি মেয়েকে রাজনৈতিক বাবা দুইটা বাসা যৌতুক দিয়ে এক ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই এখন তার মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রেও কিছুটা মাশুল তো দিতেই হবে। তিনি জানেন চিরকুমার সমিতির সদস্যরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং ভালো পরিবারের ছেলে পোলে, এটা হলো হাইব্রিড প্রজাতির বরকেন্দ্র। কাজেই তিনি সভাপতি হুমায়ূনকে একদিকে সমিতি বন্ধ করার চাপে রাখলেন অন্যদিকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছেলে চেয়ে সমিতির ব্যাপারে নমনীয়তার টোপ দিয়ে রাখলেন।

কিন্তু সমিতি যখন তাঁর আহবানে সাড়া না দিয়ে উল্টো মিছিল মিটিং শুরু করল তখন তিনি সত্যি সত্যিই ক্ষেপে গেলেন। একদিন লোক পাঠিয়ে হুমায়ূনকে বাসায় ডেকে আনলেন। গেস্টরুমে যত্নসহকারে বসিয়ে আদর আপ্যায়ন করলেন, চা-নাস্তা করালেন। তারপর রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়ে বললেন ‘দেখো তোমরা কম বয়েসী পোলাপান, জ্ঞানে অজ্ঞানে কত অন্যায় করে ফেল কিন্তু আমরা সেগুলি ধরি না, ধরতে পারি না। কারণ তোমরা আমাদের ছেলের মত, এমনকি ছেলেই। আমরা রাজনীতি করি বিধায় তোমাদের অভিভাবক- তোমাদের মা। কাজেই তোমাদের ভালোমন্দ দেখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও ধর্মীয় কর্তব্য। এজন্যই তোমাদের সমিতি বন্ধ করার জন্য চাপ দিচ্ছি, কারণ এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা, খোদাদ্রোহীতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। আমরা চাই তোমরা সামাজিক ধারায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো।

এরপর তিনি আরও কিছু ওয়াজ নসিহত করে থামলেন, গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর ইতস্তত করে গলা টেনে মিনমিনিয়ে বললেন ‘আচ্ছা তোমাকে যে বলেছিলাম কয়েকটা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দিতে তার কি করলে? হুমায়ন বলতে চাইল আমরা তো আপনাদের মেয়েদের জন্য গোলামখানা বা ঘটকখানা খুলিনি কুমারখানা খুলেছি। কিন্তু বিনয়ের সাথে বললো ‘ম্যাডাম আপনার পরিবারের জন্য উপযোগী ছেলে পাচ্ছি না বলেই কিছু করতে পারছিনা। এমপি তার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘তোমার বয়স কত? হুমায়ন উত্তর দিল ‘বত্রিশ। এমপি বলল ‘তোমারও তো বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল ‘দেখো আমি রাজনীতি করি যা বলার সরাসরি বলি। তোমরা জানো আমি স্পষ্টবাদী, কাউকে ভয় পাই না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর চাঁচাছোলা সমালোচনা করি।

কাজেই ভনিতা না করে ঘটকের মাধ্যম না ধরে তোমাকে সরাসরি বলছি। তুমি যদি আমার মেয়েকে বিয়ে কর তাহলে অনেক লাভবান হবে। আমার ঢাকা ও ময়মনসিংহে অনেকগুলি বাসা, একটা বাসা তোমাদেরকে দিয়ে দিব। ইচ্ছা করলে আধুনিক ডিজাইনের এই চার তলা ভবনটাও নিতে পার। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার আর চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কোন পেশার প্রয়োজন পড়বে না, বাসা ভাড়ার টাকা দিয়েই রাজার হালে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। এরপরেও তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য ভাল একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিব।

সমিতির শপৎ যৌবনের যে আগ্নেয়লাভা ভিতরে ছাই চাপা দিয়ে রেখে ছিল সহসা যেন তা বিস্ফোরণোন্মুখ হল। তার উপর লোভনীয় অফারে হুমায়ুন একেবারে হতবিহবল হয়ে উঠল। ঠিক তখনি ঘর অন্ধকার করে মা কালী দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অমাবস্যার রাতে আকাশের দূর দিগন্তে দুটি উজ্জল তারকার মতো বিশাল দুই চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হাসিমুখে এগিয়ে আসতে আসতে বললো ‘ওমা কি সুন্দর নায়কের মত চেহারা। মম এই হনুমানটাকে কোত্থেকে ধরে এনেছ, কার জন্য এনেছ আমার জন্য? সহসা মেয়ের উপস্থিতিতে মা হকচকিয়ে গিয়ে ধমকে উঠলেন ‘এই এই তুই এখানে কেন ঘরে যা, ঘরে যা বলছি। কিন্তু মায়ের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। সে নিগ্রোদের ন্যায় সাগর কলার মত দুই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল।

হুমায়ুন বেচারা এই কিম্ভূতকিমাকার মাংসের কালাপাহাড় দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। পাহাড়টা যেভাবে হেলে দুলে এগিয়ে আসছে যদি তার ওপর পড়ে যায় তাহলে চিড়া চ্যাপ্টা হয়ে যাবে, যদি ঝাপটে ধরে তো দম আটকে মারা যাবে। সে ভড়কে গেল, বুঝতে পারছে না দৌড়ে পালিয়ে যাবে নাকি সরে যাবে। ইতোমধ্যে পাহাড়টা এসে তার পাশে সোফায় বসল আর বেচারা সোফা দশ টন ওজনের ভারে ক্যাচ ক্যাচ রবে আর্তনাদ করে উঠল। কালাপাহাড়টা তার কাঁধে হাত দিয়ে বললো ‘হ্যাঁ গা তুমি বুঝি আমার বর, ইশ কি সুন্দর, তুমি আমার বর হলে অনেক মজা হবে’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। হুমায়ুন ভয়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে দ্রুত সরে গেল, তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে পাহাড়টার দিকে এমন অসহায় ও ভীতিগ্রস্ত চোখে তাকাল যেভাবে কোন মুমুর্ষ ব্যাক্তি তার ঘাতকের দিকে তাকায়।

ততক্ষনে এমপি মহোদয়া উদ্ধার করলেন ‘এই এই আক্কেলের ঢেঁকি তুই এখানে কেন ঘরে যা ঘরে যা’ বলে মেয়েকে হাত ধরে টেনে তুলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু মেয়ে বাইরে না গিয়ে অপর পাশের সোফায় বসল। মা ধমকাতে লাগল কিন্তু মেয়ে ভেংচি কেটে বলল ‘একটু থাকলে তোমার সমস্যা কি, আমি হনুমানটাকে দেখব। এমপি হেসে উঠে হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে তার মেয়ের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতার ব্যাখ্যা দিল ‘দেখলে আমার মেয়েটা কত সহজ সরল, ওর রংটা কালো হলে কি হবে মনটা খুব সাদা। ওকে বিয়ে করলে তুমি জেনো রাজকুমারী বিয়ে করলে, বেহেশতের মত সুখ শান্তি পাবে, সিংহাসনের মত বাসাটাও পাবে। আসলে তুমি চরম ভাগ্যবান কি বল? ‘জ্বী’ হুমায়ুন উত্তর দিল।

কালাপাহাড়টা তার দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে এমন হা করে তাকিয়ে আছে যে দেখে মনে হয় গিলে খাবে। বিয়ের কথা শুনে আনন্দে তার চোখ চকচক করছে। হাসিমুখে বলল ‘বিয়ের পর আমার মাথার উকুন এনে দিতে হবে কিন্তু, আমার মাথায় উকুন ছাড়া আর কিছু নাই। আর আমার পা টিপে দিতে হবে, বুসির মা (কাজের মেয়ে) ভাল করে টিপতে পারে না, পা- কোমর না টিপলে আমার ঘুম আসে না। মা ধমক দিল কিন্তু ততক্ষনে বাকি তিন মেয়েও এসে গেছে। হুমায়ূনের মনে হলো ঘরটা বুঝি অন্ধকারে ঢেকে গেল আর কয়েকটা কাল মহিষ অন্ধকারে ছুটাছুটি শুরু করছে। মেয়েরা তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল ‘ওমা কি সুন্দর ঠিক হৃত্বিক রোশন। মম এই নায়কটা কার জন্য আমার জন্য নাকি আপার জন্য? এটা আমাকে দিয়ে দাও আপাকে আরেকটা কিনে এনে দাও। এভাবে একেকজন নিজ নিজ দাবি পেশ করতে লাগল।

হুমায়ন বেচারা আতঙ্কে বা লজ্জায় বা অবজ্ঞায় তাদের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না, নতমুখী হয়ে বসে রইল। এম পি বেচারী লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েদেরকে কয়েকটা করে থাপ্পড় দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। তারপর শান্ত হয়ে বসে বলল ‘আমার মেয়েগুলি খুব আদূরে, এজন্য ওরা একটু বেসামাল তুমি কিছু মনে করো না। আচ্ছা যাক তুমি গিয়ে তোমার মা-বাবার সাথে আলাপ করে আমার কাছে পাঠাও, তাদের সাথেই আমি বিয়ের কথা পাকাপাকি করব। হুমায়নের মনে উল্কার মত যে বিয়ের স্বপ্নটা উদয় হয়েছিল এক হালি কালাপাহাড় দেখে তা এমনভাবে অস্তমিত হলো যে ইহজন্মের তরে তার বিয়ের সাধ মিটে গেছে। সে উঠে দাড়িয়ে বলল ‘ম্যাডাম আমরা বরকেন্দ্র বা ঘটকালয় খুলিনি কুমারালয় খুলেছি, এখন আসি।

সে দরজার কাছে পৌঁছতেই গর্জন শোনা গেল ‘দাড়াও। হুমায়ুন পিছন ফিরে তাকাল, এমপি তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন ‘তুমি কি আমার প্রস্তাবে রাজি নয়? সে বলল ‘আমি আপনার মেয়ের যোগ্য নই, আমাকে মাফ করবেন’ বলে দ্রুত হাঁটা শুরু করল। এমপির কর্কশ গলা তার কানে ভেসে এলো ‘শুয়োরের বাচ্চা, আমার মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে আমাকে অপমান করলে, এর মাসুল তোদেরকে চরম মূল্য দিয়ে আদায় করতে হবে।



এরপর থেকে শহরের আবহাওয়া কেমন গুমোট বেঁধে উঠতে লাগল, ভিতরে ভিতরে কি যেন একটা বিষাক্ত গ্যাস পাকিয়ে উঠছে। চিরকুমাররা একটা কালবৈশাখীর পূর্বাভাস অনুভব করতে লাগলো। প্রতিদিনের ন্যায় তারা বিকালে অফিসে বসে পরামর্শ করছে এমন সময় মেঘ গর্জনের মতো আওয়াজ শোনা গেল। তারা বারান্দায় গিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল- দিগন্ত বিস্তৃত মহিলাদের বিশাল মিছিল। তারা আকাশ মাটি কাঁপিয়ে স্লোগান দিতে দিতে সমিতির দিকে এগিয়ে আসছে। মিছিলের সর্বাগ্রে দেখা গেল মহিলা এম পি, ময়মনসিংহ ফুলপুর ও অন্যান্য মহিলা কলেজের অধ্যক্ষগন, কিছু নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী, তাদের সাথে আছে চিরকুমারদের বাবা-মায়েরা- যারা সন্তানের বিয়ের সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রতিপক্ষে যোগ দিয়েছে। আর তাদের পিছনে বিভিন্ন মহিলা কলেজ ও শহরের ধাড়ি মেয়েদের এক দেড় কিমিঃ লম্বা বিশাল মিছিল।

নদীর মতো আঁকাবাঁকা সাপের মতো গতিশীল মিছিল ‘চিরকুমার সংঘ ধ্বংস হোক নিপাত যাক, চিরকুমারদের জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভবনের সামনে রাবিশ ও ইটের টুকরার স্তুপ ছিল, মেয়েরা সেগুলি নিয়ে আক্রমন করল। সভাপতি হুমায়ুন চিৎকার করলো ‘এই সবাই ভিতরে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দাও। ছেলেরা ভিতরে ঢুকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল ‘মেয়েরা আমাদেরকে আক্রমণ করবে আর আমরা কি এখানে চুড়ি হাতে বসে থাকবো নাকি? হুমায়ুন চেঁচাল, উপায় কি এখানে এম পি, মহিলা নেতৃবৃন্দ ও আমাদের অনেকের মা-বাবারা এসেছেন, তোমরা কি মুরুব্বীদের ওপর আক্রমণ করতে চাও, মেয়েদেরকে আক্রমন করতে চাও? যদি তাই চাও তাহলে যেতে পারো। তখন সবাই শান্ত হল।

ধাড়ি মেয়েগুলি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। খালি ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করছে, গৃহবন্দী শত্রুর উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছে। ছেলেরা পলায়ন করেছে দেখে তাদের সাহস আরো বেড়ে গেছে, তারা চারিদিক থেকে ইট পাথরের টুকরা কুড়িয়ে এনে অফিসের দিকে তীরের মত ছুড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইনবোর্ডটা তুলার ন্যায় উড়িয়ে দিল। এবার খোলা বারান্দা দিয়ে খটাখট শব্দে দরজা জানালার উপর ঢেল পড়তে লাগল। অল্পক্ষনেই কাচের জানালা চুর চুর করে ভেঙ্গে পড়ল আর ইট-পাথর গিয়ে ছেলেদের নাকে মুখে মাথায় আঘাত হানতে লাগল, কেউ কেউ যখমি হয়ে গেল। তখন ছেলেরা চিৎকার করতে লাগলো ‘আমরা কি গরু ছাগল নাকি যে মেয়েরা আমাদেরকে তারিয়ে তারিয়ে মারবে আর আমরা চুড়ি পরে ঘোমটা টেনে বসে থাকবো? ঐ ধাঙ্গর মেয়েগুলিকে আজ বুঝিয়ে দিবো’ বলে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাইল।

নেতারা প্রাণপনে আটকে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। এক দঙ্গল ধাক্কায় দরজা খুলে বিশ পঁচিশ জনের একটা দল বেরিয়ে গেল আর সাথে সাথে নেতারা দরজায় দাঁড়িয়ে বাকিদের আটকে দিল। ছেলেরা নিচে নামতেই মেয়েরা বাঘিনীর মত তাদের ওপর হামলে পড়ল, অনবরত কিলঘুষি লাথি মারতে লাগল। ছেলেরা রাগে অন্ধ হয়ে গেছে, তারা মেয়েদের শায়েস্তা করার সহজ পথ অবলম্বন করল- একেক জনের চুলে ধরে ঘোরান মারে আর তারা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। মেয়েরা উঠে পিছন দিক থেকে ছেলেদের কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে কিন্তু এসব কিল-ঘুষিতে ছেলেরা গা টিপে দেয়ার মত আরাম অনুভব করে। এভাবে তারা বিনা বাধায় অবলীলায় মেয়েদের চুল ধরছে আর টান মেরে মাটিতে ফেলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাত্র বিশ পঁচিশ জন ছেলের হাতে মেয়েরা ঘায়েল হতে লাগল।

এম পি ও মহিলা নেত্রীরা এই জিনিসটাই চাইছিল, মহিলা সাংবাদিকরা পুরো দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দি করে নিল। এমপি মহোদয়া আগেই থানা ঠিকঠাক করে রেখেছেন। আবার ছেলেরা নিচে নামার সাথে সাথে কল করে রোডের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না, পুলিশ আগে থেকে রেডি হয়েই ছিল। তারা পৌঁছেই প্রায় বিশজন ছেলের হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে হেচড়ে নিয়ে গাড়িতে তোলল। তারপর ওসি মহোদয়া একদল পুলিশ নিয়ে উপরে উঠে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কয়েকটা মুখের দিকে তাকিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কারণ প্রিয় বাঞ্চিত যে কয়টা মুখাকৃতি তার হৃদয় মুকুরে গ্রথিত হয়ে আছে তারা এখনকার বাসিন্দা, দুজন ডাক্তার একজন ইঞ্জিনিয়ার আর স্বয়ং সভাপতি হুমায়ূন আহমেদ।

নববধূর থুতনিতে হাত দিয়ে তুলে গণ্ড চুম্বন করার মত সে হাতের ছড়িটা হুমায়ূনের থুতনিতে লাগিয়ে ঠেলা মেরে মুখটা উপরে তুলে চোখে চোখ রেখে বললো ‘কি সভাপতি সাহেব, আগেই তো বলেছিলাম এসব ভণ্ডামি ছেড়ে দেশ ধর্ম ও আইন মেনে চলেন। নিজেকে সমাজের কাজে লাগান কিন্তু কথা তো শুনলেন না। এখন আপনাদেরকে পেদিয়ে পেদিয়ে বৃন্দাবন পাঠানো হবে। যেহেতু বিয়ে করবেন না সংসার করবেন না কাজেই লোকালয়ে থাকার আপনাদের কোন অধিকার নাই। যোগি, সাধু-সন্ন্যাসী সেজে বৃন্দাবন গিয়ে বসে বসে রুদ্রাক্ষের মালা জপ করেন গিয়ে। তারপর সে দুই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের কাছে গিয়ে একই অভিনয় করলো। কারণ প্রিয়জনের উপর ক্ষমতা ও প্রভুত্ব খাটানোর মত আনন্দ ও শিহরণ অন্য কোনো কিছুতে নাই। এরপর সে পুলিশের প্রতি তাকিয়ে গর্জে উঠল ‘এদের সবগুলির পাছায় লাথি মারতে মারতে বের করে দেন, এই ঘর সিলগালা করে দেয়া হবে।

ছেলেরা নিচে নামতেই মেয়েদের মধ্যে হাসির হিড়িক পড়ে গেল, হাসতে হাসতে তারা একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়ে, একে অন্যকে দেখিয়ে বলে ‘দেখ দেখ কত সুন্দর হুতোম পেঁচা, কেউ বলে হাড়িমুখা কেউ এলে আরিচাচা। কিন্তু ছেলেরা কিছু না বলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেল। এ অবস্থা দেখে মেয়েরা শ্লোগান তুললো ‘পিক পিক হুররে, গোলাম যায় গোলাম যায়- জিন্দাবাদ ইত্যাদি। এম পি সাহেবা হাসতে হাসতে ওসিকে বলল ‘ওরা বিয়ে করে মেয়েদের গোলামী করবে না এখন দেখেন বিয়ে না করেই কত সুন্দর গোলাম সেজে গেছে, মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করেছে। ছেলেরা সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করল আর বিশজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল।

পরদিন তাদেরকে আদালতে তোলা হলো। সমিতির পক্ষ থেকে বাঘা বাঘা উকিল নিয়োগ দিয়ে শত চেষ্টার পরও তাদের জামিন করা গেল না। মেয়েদের গায়ে হাত তোলার অপরাধে সবাইকে জেলে পাঠানো হলো। চিরকুমারদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তারা চোখ মুছে হাসিমুখে জেলিদের বলল ‘আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা যেহেতু বিয়ে করবো না কাজেই শ্বশুরবাড়িও যেতে পারবো না। কিন্তু তোমাদের ভাগ্য ভালো, আল্লাহ তোমাদের শ্বশুরবাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সরকারই তোমাদের শ্বশুর, সরকার তোমাদেরকে সুন্দর একটা ঘরে জামাই আদরে রাখবে আর বসে বসে খাওয়াবে, কোনো কাজকর্ম করতে হবে না। তবে তোমাদের প্রতি আমাদের ইর্ষা আছে, তোমাদের এত সুখ আমাদের সইবে না। নিশ্চিত থেকো খুব শীঘ্রই জেলের তালা ভেঙ্গে হলেও তোমাদেরকে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।

রাতে তারা কাঁদতে কাঁদতে উপদেষ্টার বাসায় গিয়ে হুমরি খেয়ে পড়লো। সিরাজ তাদেরকে ধমকাল তিরস্কার করল ‘তোমরা হলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, মেয়েদের চেয়েও অধ্ম। মেয়েদের হাতে প্যাদানিও খেলে জেলেও গেলে এখন আবার ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার নিকট আশ্রয় নিতে এসেছ। আসলে তোমরা হলে মেয়েদের প্রকৃত গোলাম, তোমাদের আর চিরকুমার থাকার দরকার নেই বিয়ে করে ওদের গোলামী করা গিয়ে সেই ভালো। এভাবে তিনি তাদেরকে ভৎর্সনা করতে লাগলেন। অবশেষে কথা কাটাকাটির পর উপদেষ্টা উপদেশ দিলেন ‘দেখো আমি অসুস্থ, কোমর ও হাটুর হাড় ক্ষয়ে গেছে ঠিকমত উঠতে বসতে পারি না, হাঁটতে পারি না, বাইরে যেতে পারি না। আমি সুস্ত থাকলে আজ সমিতির এই করুন অবস্থা হতে পারতো না। এতগুলি উচ্চ শিক্ষিত ছেলেকে জেলে নিল আর তোমরা কিছুই করতে পারলে না?

আসলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বড় বড় রাজনীতিবিদ লেখক সাহিত্যিক সবাই মেয়েদের পক্ষে, তোমাদের সাথে কেউ নেই। বিশেষ করে নকিবুদ্দিন ওরফে লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবী মেয়েদের পক্ষে কাজ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে টিকতে পারবে না, মেয়েরা তোমাদেরকে ধুলিস্যাৎ করে দেবে। তোমরা বরং এক কাজ কর ঢাকা যাও, বড় বড় রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে আলাপ কর। টাকা পয়সা খরচ করে হলেও তাদেরকে দলে ভিড়াও, দুয়েকজনকে আনতে পারলেও টিকতে পারবে। অন্যথায় মেয়েরা তোমাদেরকে বিয়ের পিড়িতে বসাবে এবং তোমাদের সমিতি নিশ্চিহ্ন করে দিবে। আরো কিছু পরামর্শ দিয়ে তিনি তাদেরকে বিদায় দিলেন।



তারপর তারা পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল সমিতির প্রধান তিন নেতা হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবকে লবিং-গ্রুপিং করার জন্য ঢাকায় পাঠাবে। সমিতির টাকার অভাব নাই, পরদিন তারা এক ব্যাগ টাকা নিয়ে ঢাকায় গিয়ে এক বিলাসবহুল হোটেলে উঠল। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো সর্বপ্রথম যাবে বাংলার বাঘের কাছে, যার হুংকারে বাঘে মোষে একঘাটে পানি খায়, যার বীরত্বগাথা বাংলার গ্রামে গন্জে কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে, যাকে দেশ-বিদেশের মানুষ স্বনামে চিনে। তিনি বঙ্গবীর- বাঘা বাঙালী আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তাকে দলে টানতে পারলে সমিতির জয় নিশ্চিত। কারণ তিনি কাউকে কেয়ার করেন না, কাউকে পরোয়া করে কথা বলেন না।

পরদিন সন্ধ্যায় তারা গিয়ে বঙ্গবীরের বাসায় উপস্থিত হলো। বঙ্গবীর তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। সভাপতি হুমায়ুন কথা বলতে শুরু করল ‘সর্বমান্য জনাব, চিরকুমার সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো দেশ ও জাতির সেবা করা। কিন্তু নারী নেত্রীদের উস্কানিতে মেয়েরা হঠাৎ আক্রমণ করে সমিতির দরজা জানালা ভেঙ্গে দিয়েছে, বিশজন সদস্যকে জেলে ঢুকিয়েছে, সমিতির অফিস সিলগালা করে দিয়েছে। ইত্যাদি ঘটনা বর্ণনা করার পর সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল ‘স্যার আমরা তো শুধু নিজের অধিকারটুকু চেয়েছি, নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করিনি নাক গলাইনি। কোন মেয়ের বুকে হাত দেইনি অথচ ওরা আমাদের গায়ে হাত দিল, মারল, আমাদের বিশটা ভাইকে জেলে পাঠালো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। নারী নেত্রীসহ সবাই মেয়েদের পক্ষে। কেন আমাদের ওপর এই জুলুম, আমরা কি মানুষ না, আমরা কি মেয়েদের ক্রীতদাস যে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ওদের দাসত্ব করতেই হবে? স্যার বড় আশা নিয়ে আমরা আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমাদের জন্য একটা কিছু করুন, নইলে মেয়েদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা ব্যতিত আমাদের গত্যন্তর থাকবে না। আর তখন ছেলেদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আপনারা বহির্বিশ্বে মুখ দেখাতে পারবেন না’ বলে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো। সাথিরাও তার সাথে সাথে কান্না শুরু করলো।

বঙ্গবীর মাথা নীচু করে বসে আছেন, বুঝা যাচ্ছে সভাপতির বক্তব্য জিনের আছরের মত তার ওপর আছর করেছে। সহসা তিনি মাথা তুলে সিংহের মত গর্জে উঠলেন ‘এজন্যই কি যুদ্ধ করেছিলাম, এজন্যই কি দেশটা স্বাধীন করেছিলাম? মেয়েরা প্রভুত্ব করবে আর ছেলেরা গোলামি করবে- এটা কি মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল? আজ সর্বত্র নারীর জয়জয়কার, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী এমপি সর্বত্র নারী। অর্ধেক এম পি, বিচারপতি, জেলা ও থানা প্রশাসক, পুলিশ আর্মি শিক্ষক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি সকল বিভাগে আধাআধি নারী। সংসদ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র নারীরা ক্ষমতার আসনে জাঁকিয়ে বসেছে আর ওদিকে ছেলেরা রিক্সা ও ঠেলা গাড়ি টানতে টানতে পাজরের হাড় ক্ষয়ে ফেলেছে। এই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি?

স্বাধীনতার সুফল সবটাই তাদের আচলে বাঁধা আর ছেলেদের গামছা শুণ্যে উড়ছে’ বলেই তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন, কোথায় ছিল এসব মেয়েরা মুক্তি যুদ্ধের সময়? আমরা যখন মাঠে ময়দানে যুদ্ধ করেছি, দিনের পর দিন না খেয়ে বনে-জঙ্গলে পড়ে থেকেছি, নদীর চড়ায় খেয়ে না খেয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছি, অনাহারে-অর্ধাহারে সময় কাটিয়েছি, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র শত্রু প্রতিরোধ করেছি, শত্রুর বুলেটে আমাদের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, কত সহযোদ্ধার সলিল সমাধি হয়েছে, কতজনের জঙ্গল সমাধি হয়েছে তার হিসাব কে রাখে? অথচ আজ নারীরা সর্বত্র দাদিগিরি করছে। তখন এই কায়েমী স্বার্থবাদী নারীরা কোথায় ছিল? তারা তো তখন রান্নাঘরে ঝাল মরিচ দিয়ে শুটকি ভর্তা বানিয়ে খাটের ওপর বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে মজা করে খেয়েছে আর হেমামালিনী ও উত্তম কুমারের ভারতীয় সিরিয়াল দেখেছে।

অথচ আজ তারা অর্থবিত্ত মান সম্মান ও ক্ষমতার প্রতিটা আসন দখল করে নিয়েছে আর মুক্তিযোদ্ধারা ডাস্টবিনে বসে বসে মাছি মারছে। মুক্তিযোদ্ধাদের করুন অবস্থা দেখলে কান্না পায়। অবশ্য আমার অবস্থা ততটা নাজুক হয়নি, এখনো আমি টাঙ্গাইল গেলে লোকেরা সম্মান দেখায় দু-একটা পানসে চমচম খেতে দেয়- এটাই আমি বাপের ভাগ্য মনে করি। কারণ শুন নাই একবার মেয়েরা শ্লোগান তুলেছিল ‘কাদের সিদ্দিকী রাজাকার এই মুহুর্তে বাংলা ছাড়। কায়েমী স্বার্থবাদী নারীরা মুক্তিযুদ্ধাদের দেখতে পারে না, নিজেদের ক্ষমতার অন্তরায় মনে করে। আর ছেলেদের অবস্থা তো আরো নাজুক, এরা গার্মেন্টসে পথে ঘাটে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে করতে চান্দু হয়ে যাচ্ছে, কম বয়সে মারা যাচ্ছে। আর মেয়েরা সত্তর আশি বছর পর্যন্ত দুনিয়া উপভোগ করছে।

আবার মেয়েরা যেভাবে চাকরি বাকরিসহ ছেলেদের সকল অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, পুরুষ নির্যাতন করছে এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেখা যাবে পৃথিবী থেকে পুরুষ নামের প্রজাতিটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। না না এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না, এত জুলুম মেনে নেয়া যায় না এটা আল্লাহ সইবেন না। আমি এখনও বেঁচে আছি, আবার যুদ্ধ করব, ছেলেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করব, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করব। বঙ্গবন্ধু নাই তো কি হয়েছে, তার প্রধান শিস্য হিসেবে আমি তো আছি। আমিই স্বাধীনতার ডাক দিব ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম পুরুষতণ্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

আমি সরকার ও জনগণকে জানিয়ে দিতে চাই, একাত্তরে অস্ত্র জমা দিয়েছি ট্রেনিং জমা দেইনি। তারপর নিচু স্বরে বললেন ‘শোনো তোমাদেরকে আশার বাণী শুনাই- আমার সব অস্ত্র জমা দেইনি একটা অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম। সেটা দিয়ে আবার যুদ্ধ শুরু করব, আবার একাত্তরের মতো ছেলেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে করতে নিজের রক্ত মাংস বাতাসে ওড়াব, ছেলেদেরকে মুক্ত করবে করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ--- কথা শেষ হল না ঠিক তখনই গৃহকর্ত্রী হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে বঙ্গবীর একেবারে চুপসে গেলেন যেমন কোনো দুষ্ট বালক অন্যায় দুষ্টামি করার সময় কর্তাকে দেখে চুপসে যায়।

বেগম সিদ্দিকী বললেন ‘সাব্বাস বাঘা, এই না হলে কি আর তুমি আমার বর। অবশ্যি আর একটা যুদ্ধ করতে হবে, বেয়ারা ছেলেগুলি দেশটাকে রসাতল বানিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই ইভটিজিং আর ধর্ষণের সয়লাবে মেয়েরা অস্তিত্ব সংকটের মোকাবেলা করছে, সেখানে আবার গোঁদের উপর বিষ ফোড়ার ন্যায় কিছু বখাটে ছেলে মিলে ময়মনসিংহে কি জানি চিকামারা নাকি চালকুমড়া না কি জানি একটা সংগঠন করেছে। পত্রিকায় দেখলাম এই হারামজাদা ছেলেরা মেয়েদের গায়ে হাত তুলেছে, চুলে ধরে টানাটানি করেছে। এই লোচ্চা ছেলেগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কালই গিয়ে ওদেরকে ঠুসঠাস গুলি করে মারবে বুঝলে?

বঙ্গবীরের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি কাচুমাচু করে বললেন ‘এসব মারামারি খুনাখুনির কী দরকার? কর্ত্রী ধমকে উঠলেন ‘মানে, কাল খুব ভোরে চারটে পান্তা খেয়ে বিদায় হবে, রণাঙ্গনে গিয়ে সিংহের মত ঝাপিয়ে পড়বে। বঙ্গবীর মোসাহেবি হাসি দিয়ে বললেন ‘না বলছিলাম যে কয়টা দিন দেখি না কি হয়, মামলা নাকি চলছে। এবার কর্ত্রি খেকিয়ে উঠলেন ‘আসলে তুমি একটা আস্ত বোকা, রাজনীতি বুঝ না আর এজন্যই তোমার গামছাও কেউ ব্যবহার করে না। এখন তোমার কর্তব্য হচ্ছে মেয়েদের পক্ষে আর ওই বখাটে চালকুমড়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। তাহলে দেশের মানুষ তোমার প্রশংসা করবে, গামছায় ভোট দেবে নির্বাচনে তুমি অধিকাংশ আসন দখল করতে পারবে। এখন কি বল কাল যাচ্ছো তো? তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন ‘তুমি যখন বলছ যেতে তো হবেই, তোমার হুকুম তো আর অমান্য করা যাবে না।

এরপর কর্ত্রি একটা একটা করে কথা বলেন আর বাংলার বাঘ মোসাহেবি হাসি দিয়ে বলেন ‘তুমি বললে তো আর অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না বা তোমার কথা তো আর ফেলতে পারি না বা তোমার কোন কথা কি আমি জীবনে অমান্য করেছি ইত্যাদি। এভাবে তাদের মধ্যে কথোপকথন চলতে থাকে। প্রতিনিধি দল বাংলার বাঘের এমন আত্মসমর্পণ দেখে ভিড়মি খেল, তারা কানাঘুষা শুরু করল। তখনই তাদের দিকে কর্ত্রীর দৃষ্টি গেলো ‘তোমরা কারা বাবা, কোত্থেকে এসেছে’ জিজ্ঞেস করলেন। হুমায়ুন সালাম দিয়ে বলল ‘জ্বি আমরা ময়মনসিংহ থেকে এসেছি। বঙ্গবীর সাপ দেখার মতো লাফিয়ে উঠে বললেন ‘না না ওদের বাড়ি টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ থেকে লেখাপড়া করে। কর্ত্রি বললেন ‘তা কেন এসেছ বাবারা?

বঙ্গবীর তাদেরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলছেন, কারণ তিনি জানেন গিন্নি যদি জানতে পারে এরাই চালকুমড়া (চিরকুমার) তাহলে তার কপালে দুর্গতি আছে। এজন্যই তিনি হড়হড় করে বলতে লাগলেন ‘না মানে ওরা কি জানি একটা সমিতি টমিতি করেছে, আমার সহযোগিতার জন্য এসেছিল। - কি সমিতি গরু ছাগলের? - না অন্য জাতীয়? - তাহলে কি ধর্মসভা জাতীয় কিছু? এবার বঙ্গবীর হালে পানি পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হা হা এটাই এটাই, ওরা চাঁদার জন্য এসেছে। তারপর তিনি স্ত্রীর দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাদেরকে চোখে টাই মারতে লাগলেন আর চলে যাওয়ার জন্য নাক মুখ খিঁচিয়ে মরিয়া হয়ে ইঙ্গিত করতে লাগলেন। কর্ত্রি বললেন ‘ধর্মসভা তো ভালো, ওদেরকে বেশি করে চাঁদা দিয়ে দাও। ছেলেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে দেখে বঙ্গবীর নিরুপায় হয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন ‘আসো বাবারা আমি যথাসাধ্য তোমাদের জন্য চেষ্টা করবো’ বলে ফিসফিসিয়ে বললেন ‘মূর্খের দল জীবন বাঁচাতে চাইলে তাড়াতাড়ি পালাও।

তখন ছেলেরা চলে যাচ্ছে দেখে কর্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন ‘আরে আরে ওদেরকে চাঁদা না দিয়েই বিদায় করে দিচ্ছ যে, এই ছেলেরা দাঁড়াও চাঁদা নিয়ে যাও। কিন্তু তারা থামছে না দেখে দৌড়ে তাদেরকে থামাতে গেলেন আর ছেলেরা ভয় পেয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এবার তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘তুমি কিসের রাজনীতিবিদ, ধর্মসভায় চাদা দাও না, ভালো কাজে দান করতে পার না, কোথায় রাজনীতি করতে হবে কিভাবে নাম ফাটাতে হবে কিছুই বুঝ না, তাহলে রাজনীতি কর কেন ইত্যাদি মালামত চলতে লাগলো।



প্রতিনিধিরা বাসা থেকে নেমে হাসিতে ফেটে পড়ল। জাফর বলল ‘মহাবিস্ময় বাঘা বাঙ্গালির মত ব্যক্তিও যে গিন্নির সামনে ছাগল হয়ে থাকেন, চার্লি চ্যাপলিনের মত মোসাহেবি করেন আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। হাবিব বলল ‘শুন মনে হয় আমরা প্রজাতি চিনতে ভুল করেছি। যে জাতি বাঘা বাঙালির মতো সিংহকে ছাগল বানিয়ে রাখে, নাকে রশি দিয়ে ঘুড়ায় তাদের সাথে সংগ্রাম করে আমরা কোনোদিন বিজয়ী হতে পারবো না, পাহাড়ের সাথে টক্কর দিলে শুধু নিজের মাথাটাই ভাঙ্গে। চল সমিতি ভেঙ্গে দিয়ে ওদের পদ কমলে আত্মসমর্পণ করি গিয়ে। হুমায়ুন বলল ‘দুঃ এক বঙ্গবীর বউয়ের চামচামি করে দেখে সব পুরুষ সমান নাকি, চল আমরা হোটেলে গিয়ে সাক্ষাৎ যোগ্য ভি আই পিদের একটা লিস্ট করি। তারপর প্রতিদিন এক একজনের কাছে যাব।

পরদিন তারা গেল ডক্টর কামালের কাছে। সেখানে সহ- সভাপতি জাফর ইকবাল সমিতির আদি-অন্ত সবিস্তার বর্ণনা করে বলল ‘স্যার আপনার কাছে আমাদের দাবী হলো আপনি আইনি সহযোগিতা দিয়ে আমাদের জেলবন্দি ভাইদের মুক্তি ও আমাদের সমিতির তালাটা খোলার ব্যবস্থা করে দিন। সম্ভব হলে আপনি আমাদের সমিতির উপদেষ্টা হন। ডঃ কামাল কিছুক্ষণ বিষন্ন হয়ে বসে রইলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ‘সবই আমার কপাল। সেই তো তোমরা এলে কিন্তু সময় মতো আসলে না। আমার বিয়ের আগে যদি আমি এই দাওয়াত পেতাম তাহলে আজ আমার এই পরিণতি হতো না। অথবা আমি নিজে যদি সংবিধান রচনা না করে একটা চিরকুমার সমিতি রচনা করতাম তাহলে এটা হত দেশের ও মানবতার প্রকৃত খেদমত আর আমি নিজেও মুক্তি পেতাম। কিন্তু বিয়ে করে জীবনটা ধ্বংস করে দিলাম।

যাক নিজের দুঃখ নিজেরই থাকুক, তোমাদেরকে আর নিজের দুঃখে অংশীদার করতে চাই না। তবে আমি স্বীকার করছি তোমাদের সমিতিটা খুবই ভালো, সময় উপযোগী, মানব সেবার উত্তম প্রতিষ্ঠান। বিশেষত ছেলেদের মুক্তির জন্য একটা আলোকবর্তিকা। কিন্তু বাবারা আমি তোমাদের কোন উপকার করতে পারবোনা। কারণ আমি অক্ষম শৃংখলাবদ্ধ, আমি বন্দি, তোমাদের জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নাই। প্রতিনিধিরা জিজ্ঞেস করল ‘কে আপনার এমন করুণ অবস্থা করলো?

তিনি কিছুটা রাগতস্বরে বললেন ‘কে আবার করবে আমার মেয়ে, সরি আমার মেয়ে বলছি কেন ওটা আমার মেয়ে না ওর মায়ের মেয়ে। ওরা মা মেয়ে মিলে আমাকে জিম্মি করে ফেলেছে। আমি স্বাধীন মত কোন কাজ করতে পারি না, ওদের ইচ্ছা মাফিক সবকিছু করতে হয়। বলতে পারো আমি একটা মেশিন- যার মালিক হলো তারা মা মেয়ে। মেশিনটাকে দিয়ে তারা টাকা উপার্জন করায়, অন্যান্য সব কাজ করায়। কিন্তু টাকা-পয়সা ও অন্য সব কিছুর মালিক তারা, তারাই ভোগ বিলাস করে আনন্দ-উল্লাস করে তাতে মেশিনের কোন অধিকার নাই। তার অধিকার শুধু সচল থাকার জন্য দু’বেলা-দুমুঠো খাবার পায়। এই হলো বিয়ের পরিনতি। আজ যদি বিয়ে না করতাম তাহলে সবকিছুই আমার থাকতো, নিজেই সবকিছু ভোগ করতে পারতাম। এজন্যই দেশের যুবক তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান ‘তোমরা আমার মত বিয়ে নামক ভুলটা করবে না, সবাই চিরকুমার সমিতির সদস্য হয়ে নিজেদের ধন-সম্পদ ও স্বাধীনতার মালিক নিজে থাকবে।

হুমায়ন বলল ‘স্যার গোপনে কি আমাদেরকে একটু আইনি সহায়তা দিতে পারেন না? ডঃ কামাল বললেন ‘তোমরা আসলে মূর্খ, আমার কথাই বুঝতে পারোনি। আমার প্রকাশ গোপন বাহ্য উহ্য সবকিছুর মালিক তারা। কারন আমার মেয়ে আমার পি এস, সব কিছু তার হাতে নিয়ন্ত্রণ করে, আমি শুধু মেশিনের মতো কাজ করি। অনেক কাজ আমি করতে চাই না কিন্তু সে আমাকে বাধ্য করে। কয়েকবার চেষ্টা করেছি তাকে আউট করে অন্য লোক সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দিতে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি, মেয়ের ধমক খেয়েছি। এভাবে তারা আমাকে একেবারে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে। আরে শুন বাঙালিরা আমাকে ব্যর্থ রাজনীতিবীদ বলে গালি দেয়, তিরস্কার করে কিন্তু আমি কেন ব্যর্থ হলাম- এই বিষয়টা কি তারা কোনদিন চিন্তা করে দেখেছে, নাকি গবেষণা করেছে?

আমি হলাম পৃথিবীর অন্যতম সংবিধান বিশেষজ্ঞ, দেশের শ্রেষ্ঠ আইনবিদ। এরপরেও কেন ব্যর্থ হলাম সেই শানে নুযূলটা শোন। আমি যখন দেখলাম আমার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না বরং ওরা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি তাদের মালিক না বরং তারাই আমার মালিক। তখন আমি ঘাবড়ে গেলাম, ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রী কন্যাকে শাসন করতে পারেনা সে একটা দেশ কি করে শাসন করবে, যার প্রভু স্ত্রীলোক সে একটা দেশের প্রভুত্ব কি করে করবে? তাও যদি দেশের সকল নাগরিক পুরুষ হত তবুও আগ্রহ থাকতো কিন্তু অর্ধেক নাগরিক নারী। আর নারীদেরকে নিয়ন্ত্রন করা আমি তো দূরের কথা আমার মরা বাপ উঠে এলেও পারবে না।

এ কারণেই আমার মন ভেঙ্গে গেল, রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করলাম। অন্যথায় খালেদা হাসিনা এরশাদ জিল্লু হামিদ ইত্যাদিরা তো ছিল আমার সামনে নিতান্ত বালক-বালিকা, আমার সামনে ওদের কোন খাওয়া ছিল না। আমি হলাম দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক কাজেই আমিই থাকতাম দেশের আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বিয়েই আমার জন্য কাল হয়েছে, আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে। এ জন্যই দেশের যুবসমাজের প্রতি আমার আহ্বান, তোমরা বিয়ে করে আমার মত বোকামি করো না, চিরকুমার থাক জীবনের স্বাদ আহ্লাদ পোরা কর, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাও—

তখনই ‘আব্বা’ ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেল। সাথে সাথে ডঃ কামালের মুখটা কালো হয়ে গেল। তিনি তিক্ত কন্ঠে বললেন ‘ওই যে আসছে বিচ্ছুটা। একটা মেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ‘আব্বা ময়মনসিংহে গন্ডগোল চলছে চলো ঘুরে আসি। প্রতিনিধিদের দেখে জিজ্ঞেস করল ‘আপনারা কারা ভাই, কোত্থেকে এসেছেন? জাফর বলল ‘আমরা ময়মনসিংহ থেকে এসেছি। তারপর আগমনের কারণ বর্ণনা করলো। ঘটনা শুনে মেয়েটা টেলিফোনের বোতাম টিপতে লাগলো। বাবা জিজ্ঞেস করলো ‘কোথায় ফোন করবি? মেয়ে বলল থানায়। -কেন? - কেন আবার, এরা দাগী আসামী শ্বশুরালয়ে পাঠাতে হবে না? - কি পাগলামি করছিস? - পাগলামি আমি করছি না তুমি করছ। এরা মেয়েদের গায়ে হাত তুলেছে, চুলে ধরে টানা হেঁচড়া করেছে অথচ এই ভয়ঙ্কর অপরাধীগুলিকে সোহাগ ভরে সামনে নিয়ে বসে আছ। এই ক্রিমিনালগুলি তোমার বাসা থেকে নিরাপদে চলে গেলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না।

ডঃ কামাল মেয়েকে আর কিছু বলার সাহস না পেয়ে ওদের প্রতি তাকিয়ে ধমকে উঠলেন ‘মূর্খের দল জেলে যাওয়ার খুব শখ হয়েছে নাকি, এখনো বসে আছো কেন ভাগো তাড়াতাড়ি, ভাগো। সাথে সাথে তারা লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলো। মেয়েটা পিছু দৌড়ে তাদেরকে ধরতে গেল কিন্তু পারল না। ব্যর্থতার ক্রোধে সে বাবার উপর হামলে পড়ল ‘তুমি কিসের আইনবিদ সংবিধানবিদ, কতগুলি অপরাধীকে ভাগিয়ে দিয়ে তুমি নিজে অপরাধ করেছ, সংবিধান লঙ্ঘন করেছ। কাজেই তোমার আর আদালতে গিয়ে উকালতি করার অধিকার নাই, এতে আদালত অবমাননা হবে। এখন থেকে তুমি বটতলায় গিয়ে ওকালতি করবে।



পরদিন তারা গেল সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কাছে। প্রেসিডেন্ট তাদের বক্তব্য শুনে আফসোস করে বললেন ‘বাবারে সেই তো আসলে কিন্তু সময় থাকতে আসলে না। আমার বিয়ের আগে যদি আসতে তাহলে যেমন আমার উপকার হতো তেমনি দেশ ও জাতির কল্যাণ হতো। আমিও প্রেসিডেন্ট না হয়ে চিরকুমার সমিতির সভাপতি হয়ে নিজেকে ধন্য করতাম। এখন বিয়ের পরিণতি এই হলো যে, আমি আমার ধন সম্পদ মান ইজ্জত সবকিছু হারালাম। আমার গিন্নি আর তার ষণ্ডা ছেলেটা মিলে আমার সবকিছু দখল করে নিয়েছে, এমনকি তারা আমার ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করেছে। আমি স্বাধীনভাবে মুখের কথাটা পর্যন্ত বলতে পারিনা, কোন কাজ করতে পারি না। তারা মা ছেলে মিলে যে চক দিবে সেই চক ধরেই আমাকে চলতে হয়, ব্যতিক্রম করলে একেবারে লঙ্কা কান্ড। তোমরা তো জানো আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলাম, তখন ভাবলাম মন্ত্রী-এমপি দলের কিন্তু প্রেসিডেন্ট সকলের। এই ভেবে আমি বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম তখন বিএনপি আমাকে ইমপিচমেন্ট করল।

তখন আমি মনে মনে একটা অট্টহাসি দিয়ে বললাম ‘অন্য দলের প্রেসিডেন্ট হয়ে মাজার জিয়ারতের হুজুর হওয়ার চেয়ে নিজে দল গঠন করে নিজেই রাষ্ট্রপ্রধান হব। সুতরাং দল গঠন করে গণতন্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সত্য মিথ্যা সমালোচনা শুরু করলাম। কারণ অন্যের সমালোচনা না করে রাজনীতি চলে না। কিন্তু আমার ষণ্ডা ছেলেটা তার মাকে নিয়ে বাঁধ সাজল, তারা শর্ত দিল অন্য সকলের সমালোচনা করা যাবে কিন্তু বিএনপির নয়। তখন তাদের সাথে আমার মতের মিল হলো না, শুরু হলো স্নায়ুযুদ্ধ, যুদ্ধে আমার লাঞ্ছনাদায়ক পরাজয় ঘটল। এই তো কয়েকদিন আগেও তারা আমাকে হুমকি দিল- বিএনপির সমালোচনা করলে কপালে দুঃখ আছে।

এখানেই আমি মারটা খেয়ে গেলাম, কারণ আমি শুধু আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতাম। তখন দেশের মানুষ ভাবল আমি বিএনপির দালাল, এজন্য শুধু লীগের গুষ্টি উদ্ধার করি আর বিএনপিকে তাফাতং দেই। ফলে জনগণ আমাকে বর্জন করল আর আমি হয়ে গেলাম রাজনীতির ত্যাজ্য পুত্র এবং জনগণের চক্ষুশূল। নইলে আমার মতো এমন ঝানু প্লেয়ার, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, সবজান্তা রাজনীতিজ্ঞ, তেতুল তলার ডাক্তারকে একাকী বসে বসে আঙ্গুল চুষতে হয়? আমি আমৃত্যু দেশের রাজাগিরি করতাম। এভাবে আমার গুন্ডা ছেলেটা আমাকে ধ্বংস করে দিল, থুক্বু থুক্বু, আমার ছেলে বলছি কেন সে তো তার মায়ের ছেলে আমার শত্রু। আমার ছেলে হলে তো আমার কথায় চলত ওর মায়ের কথায় নাচত না।

আসলে কি জানো, যে কোনো ব্যক্তি বিয়ে করে বউ ঘরে তুলল মানে একদল শত্রু ডেকে আনল। কারণ বাচ্চা কাচ্চা হলে ওই মহিলাটা তাদেরকে নিয়ে জোট গঠন করে পুরষটার ধন-সম্পদ সবকিছু দখল করে বসে আর তাকে দাস হিসাবে ব্যবহার করে। এই পুরুষটা তখন দুধ-কলা খাইয়ে সাপ পোষে, একদল শত্রু গড়ে তুলে। তারপর এই শত্রুদের মধ্যে বসবাস করে কোন অধিকার না পেয়ে এক সময় রিক্ত নিঃস্ব হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এখন আমারও স্ত্রী সন্তানের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে। তোমরা আমাকে মাফ করে দিও, দেশের জনগণের সেবা করার কথা দিয়েও কথা রাখতে পারলাম না, তারা যেন আমাকে ক্ষমা করে। আর একটা ওসিয়ত করছি- তোমাদের সমিতির নাম পাল্টে রাখবে পুরুষ মুক্তি সংঘ। কারণ পুরুষ জাতির মুক্তির একটাই মাত্র পথ, সেটা হলো চিরকুমার থাকা। এ ছাড়া মেয়েদের দাসত্ব থেকে তাদের মুক্তির দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই। কাজেই সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেশের যুবসমাজকে আমি ওসিয়ত করছি তারা যেন সবাই তোমাদের সংঘের সদস্য হয়ে ইহকাল ও পরকালের কামিয়াবি হাসিল করে।

প্রেসিডেন্টের অসহায়ত্ব আর বিয়ের নির্মম পরিণতি দেখে প্রতিনিধিরা অতিশয় দুঃখিত হল। হাবিব কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘স্যার আপনার দুঃখের কথা শুনে আমার গরুর মত কাঁদতে মন চাইছে। আপনি এক কাজ করেন, ওই গুন্ডা ছেলেটাকে বাসা থেকে বের করে দেন। প্রেসিডেন্ট চমকে উঠল, ভয়ে তার মুখ নীল হয়ে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে হেসে বলল ‘সর্বনাশ তাহলে কি আমার রক্ষে থাকবে। তোমরা জানো না ওর বুকের পাটা ঠিক জাহাজের পাটাতনের মত, হাত দুটি ইস্পাতের, কলজেটা পাথরের। আরে শুন, কয়েকবছর আগে আমি ভাবলাম একজন প্রেসিডেন্টের বাসার বাউন্ডারি নাই এটা ঠিক না। তাই বাসার চারপাশে দেয়াল তুলা শুরু করলাম, একদিন ছেলে এসে আমাকে বলল ‘আব্বা আমার জানালার সামনে দেয়াল তোলা যাবে না, আমার মুক্ত বাতাস প্রয়োজন। কিন্তু একটু জায়গা বাদ দিয়ে তো আর দেয়াল তোলা যায় না আমি কাজ চালিয়ে গেলাম।

একদিন বিকালে শুনতে পেলাম ভূমিকম্প হচ্ছে আর টর্নেডোর মত ভাঙ্গা চোরার গর্জন শোনা যাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। মনে হল যেন আমার শরীরের রক্ত জমে যাচ্ছে, গুন্ডাটা একটা করে ঘুসি মারছে আর দেয়ালের ইটগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পেঁজা তুলার মত উড়ে যাচ্ছে। তোমরা এই ষণ্ডাটাকে জান না, ওর গায়ে দশটা হাতীর শক্তি ধরে। কিন্তু আফসোস এই অতুল শক্তি ওর মা আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে কিন্তু জাতির খেদমতে কাজে লাগাচ্ছে না।

তখনই দরজা ঠেলে একজন ভিতরে ঢুকল। প্রেসিডেন্ট চমকে উঠলেন, মুখটা কালো হয়ে গেল। নড়েচড়ে বসে ফিসফিসিয়ে বললেন ‘ওই যে পাণ্ডাটা এসে গেছে। ছেলে এসেই বলল ‘বাবা ময়মনসিংহের খবর জান তো, কয়েকটা হারামজাদা পোলাপান শয়তানি সংঘ বানিয়েছে, মেয়েদেরকে মেরে চুল ধরে টেনে মাটিতে গড়াগড়ি করেছে। তুমি ওদেরকে ফাঁসির দাবি জানিয়ে একটা বিবৃতিতে দিয়ে দাও আমি এখনি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাবা কর্কশ গলায় বললেন ‘আমি কোন বিবৃতি টিবৃতি দিতে পারব না। ছেলে বলল ‘এই তো হল তোমার সমস্যা। জিয়াউর রহমান বলে গেছেন ‘ঝোপ বুঝে কোপ মার। কিন্তু তুমি মুরব্বীদের কথা মান না, শুধু ঝাড়ে জঙ্গলে গিয়ে কোপাকুপি কর। এজন্যই তুমি উচ্ছন্নে গেছ আর তোমার দল গোল্লায় গেছে।

বাপ রাগে অধীর হয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন ‘দূর হ আমার সামনে থেকে হারামজাদা, আমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না। তোদের মা ছেলের উপদেশ শুনতে শুনতে এখন আমার নিরুদ্দেশ হবার জোগাড় হয়েছে, বেরিয়ে যা আমার বাসা থেকে, এক্ষুনি বেরিয়ে যা। ফুটপাতে গিয়ে ক্যানভাসারদের মত মানুষকে উপদেশ দে গিয়ে।

ছেলে লজ্বিত কণ্ঠে বলল, আবার তুমি আমাকে অপমান করলে? তুমি আমার বউয়ের সামনে রাত দিন গালাগালি কর, বাসা থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দাও। তখন আমার বউ বলে ‘আচ্ছা তুমি কি আমার শ্বশুরের দত্তক পুত্র নাকি, পেটের ছেলে নয়? পেটের ছেলে হলে এভাবে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় কেন’ বলে কান্নাকাটি জুরে দেয় ‘তোমরা আমার সাথে প্রতারণা করেছ, আমার শ্বশুর নিজের ছেলে বলে একটা রাস্তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে, আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, আমি তোমাদেরকে অভিশাপ দিচ্ছি’ বলে রাগিণী তুলে। তখন আমি তাফাতং দিয়ে শান্ত করি।

এখন আবার বাইরের লোকের সামনে আমাকে অপমান করলে। আচ্ছা তোমার এতই যখন শখ আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার তাহলে বিয়ে করিয়েছিলে কেন, এখন আমি চলে গেলে এই সুন্দরী মেয়েটার কি দশা হবে। সে আবার রাতে একাকী শুইতে পারে না, ভূতের ভয় পায় আমি না থাকলে কে তার সাথে শোবে? আমিও তো মানুষ আমারও তো একটা মান ইজ্জত আছে, দুদিন পরপর তোমার এত অপমান আমি আর সইতে পারব না। ঠিক আছে আজ এসপার-ওসপার একটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাক। আমার শেষ কথা শোনো, আমি এক্ষন এ মুহূর্তে বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। সোজা গিয়ে ময়মনসিংহে চিরকুমার সমিতির সদস্য হব, তারপর পোটলা পাটলি নিয়ে তাবলীগের সাথে মিলে মসজিদে মসজিদে ঘুরব আর চিল্লা দিব। জীবনেও কোন দিন বাসায় ফিরব না, বউয়ের সাথেও দেখা করব না। তুমি কি এই শর্তে রাজি আছ?

তখন প্রেসিডেন্ট একটা মোসাহেবি হাসি দিয়ে বললেন ‘দেখ দেখ পাগল ছেলে আমার কয় কি, এটুকুতেই রাগ করতে হয় বাবা। আমি এখন বুড়ো হয়ে গেছি নাট বল্টু সব ঢিলা হয়ে গেছে, কি বলতে কি বলে ফেলি নিজেই জানি না। তোকে কিছু বললে রাগারাগি করিস, তোর মাও রাগ করে এখন আমি যাই কোথায় বল। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে কি আছে? আমার এই বিশাল বিত্ত-বৈভব রাজনৈতিক দল এসব কার জন্য, তোর জন্যই তো। আমি তো ব্যর্থ হলাম কিন্তু আমার আশা একদিন তুই রাজনীতি করে অনেক বড় নেতা হবি, দেশের রাজা হবি। তখন কবরে থেকেও আমার আত্না শান্তি পাবে। যাও বাবা রাগ করোনা ঘরে যাও, বৌমা তোমার জন্য লেমনচুক রান্না করেছে অনেক আদর করে খাওয়াবে যাও।

এবার ছেলে শান্ত হল। প্রতিনিধিদের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমরা কারা ভাই কোত্থেকে এসেছ? তারা বলল ‘আমরা ময়মনসিংহ থেকে এসেছি, সাহায্যের আবেদন নিয়ে এসেছি। সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট চেঁচিয়ে উঠলো ‘আরে আরে ওদেরকে তুই বুঝবি না, ওরা দেখতে ভদ্রলোক মনে হলেও আসলে খুব গরিব, টাকার অভাবে লেখা পড়া করতে পারে না সাহায্য চাইতে এসেছে। ছেলে বলল ‘ঠিক আছে ওদের লেখাপড়ার খরচ তুমি বহন কর, আমিও ওদের কাপড়-চোপড়ের জন্য টাকা দিব। বাবা বলল ‘ঠিক আছে বাবা, আমি সব ব্যবস্থা করছি তুমি বৌমার কাছে যাও। ছেলে চলে গেল।

এরপর তিনি চিরকুমারদের ওপর হামলে পড়লেন ‘মূর্খের দল এখনো বসে আছিস কেন, আমার ছেলে যদি জানতে পারে তোরাই চিরকুমার তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। ওর বাহু দেখেছিস, একটা করে ঘুসি মেরে একেবারে তুলোধুনো করে উড়িয়ে দেবে। হালার পুতেরা আকাম করে আবার এসেছে সাহায্যের জন্য, যা ভাগ শয়তানের বাচ্চারা। চিরকুমাররা পরি মরি দৌড়ে পালিয়ে গেল।



রাত্রে তারা পরামর্শ সভায় বসল। জাফর বলল ‘দেখ নেতা খেতা, রাজা উজির, ভি আই পি যাই বলিস আসলে সবাই স্ত্রীর দাস। আর এই দাসদের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে কোন লাভ নেই, কেউ আমাদের সাহায্য করবে না, চল ফিরে যাই। হুমায়ুন বলল, শেষ একটা সান্স নিয়ে দেখি কি হয়। আমাদের রেলমন্ত্রী মুজিবুর রহমান চিরকুমার, চল তার কাছে যাই।

পরদিন তারা মন্ত্রীর বাসায় উপস্থিত হলো। তাদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে বলল ‘স্যার আপনি তো চিরকুমার, আপনি আমাদের সমিতির সভাপতির পদ অলংকৃত করুন। মন্ত্রী আফসোস করে বলল ‘আসলে কি জান মানুষ যখন যা কামনা করে তখন তা পায়না কিন্তু যখন পায় তখন আর চায় না। আমি আজীবন একটা চিরকুমার সমিতির কল্পনা করেছি কিন্তু পাইনি, এখন আর পেয়েও লাভ নেই। কারন আমি একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছি, আহ কি রুপ কি যৌবন কি মনোরম কি মোলায়েম। ওকে দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। তখন আমি গান গাই ‘আমি যে ফুলেরি গন্ধে পাগল হইলাম তুমি সে ফুলের বৃক্ষ। অথবা মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম ইত্যাদি।

হাবীব বলল ‘আপনি এই সত্তর বছর বয়সে প্রেম করেন মেয়েটার বয়স কত? মন্ত্রী হাসলেন ‘আরে প্রেমের আবার বয়স আছে নাকি, আমাদের রাসুল (সাঃ) বিয়ে করেছেন, বঙ্গবন্ধু বিয়ে করেছেন আমি তাদের উম্মত কাজেই আমিও বিয়ে করবো এবং ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো। মেয়েটার বয়স পনেরো বিশ বছর হবে, এর বেশি আমি আর কিছু বলবো না। কারণ বিএনপি নেত্রী শুনলে আমার বারোটা বাজাবে, বিয়েই হতে দেবে না। যাউক গা তোমাদের কথা শুনলাম, তোমরা আমার সম শ্রেণী- একই প্রজাতি। এজন্য তোমাদের প্রতি আমার মায়া লাগছে। বিষয়টা আমি পয়েন্ট অব অর্ডারে দিয়ে সংসদে উত্থাপন করব, চিরকুমারত্বের আইন পাশ করানোর চেষ্টা করব বাকিটা আল্লাহ ভরসা। এখন তোমরা যাও, নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও গিয়ে। আমার ওপর আস্থা রাখো, আমি আগের রেলমন্ত্রী নই। তিনি রেলের কালো বিড়াল ধরার ঘোষণা দিয়ে নিজেই কাল বিড়াল হয়ে গেলেন। ফলে তার মন্ত্রীত্ব চলে গেল আর আমার কপাল ফুটল। এখন যাও হালকা ড্রিঙ্ক করে ঘুমাও গিয়ে।

সংসদে দাঁড়িয়ে রেলমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলেন ‘মাননীয় স্পিকার আপনার মাধ্যমে আমি মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, কমমান্য মন্ত্রীবর্গ ও সামান্যমান্য সংসদ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ময়মনসিংহের কিছু শান্ত ভদ্র ও নিরীহ ছেলে মেয়েদের পুংটিজিং থেকে বাঁচার জন্য চিরকুমার সমিতি নামের একটা সংগঠন গড়ে তুলেছে। মেয়েদের নাগিনী নিশ্বাস থেকে বাঁচতে তারা সমিতিতে বসে সাহিত্য চর্চা করে, পত্রিকা পড়ে, গল্পগুজব করে সময় কাটায়। কিন্তু ময়মনসিংহের ধাড়ি ও সন্ত্রাসী মেয়েগুলি তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিল না। তারা স্থানীয় এম পির নেতৃত্বে সমিতির ওপর হামলা করল, সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করল। শান্ত সুবোধ ছেলেগুলিকে মেরে পিটিয়ে লাথিয়ে জেলে পাঠাল, সমিতি সিলগালা করে দিল। এখন বাকি ছেলেরা আশ্রয় হারিয়ে রাস্তায় পরে কান্নাকাটি করছে। কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংসদের কাছে আমার দাবি হলো- চিরকুমার সমিতিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক, যারা জেলে আছে তাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হোক এবং জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হোক। আর চিরকুমার সদস্যরা যেহেতু চাকরি করে না বিধায় তাদেরকে মন্থলি ভাতা দেওয়া হোক। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ছেলেরাই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে আর মেয়েরা তখন বসে বসে মাথার উকুন মেরেছে।

আবার বঙ্গবন্ধু ছেলেদের জন্য দেশ স্বাধীন করেছেন মেয়েদের জন্য নয়। কারণ ছেলেরা হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, সেই পঞ্চাশের দশক থেকে ছেলেরাই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রেখেছে, বঙ্গবন্ধুর ব্যানার পোস্টার নিয়ে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও ধর্মঘট করছে, শত্রুর বুলেট বুকে ধারণ করেছে, রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগকে চিরঞ্জীব করেছে। আর মেয়েরা তখন বসে বসে শুধু ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখেছে। বস্তুত ছেলেরাই হল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, আওয়ামীলীগের প্রকৃত সেবক। আর মেয়েরা হল দুধের মাছি- সুসময়ের বন্ধু, ওদেরকে কোন আন্দোলন সংগ্রামে দেখা যায় না। কাজেই ছেলেরা না থাকলে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানাও থাকবে না। কিন্তু নিরিহ ছেলেদের উপর যেভাবে মেয়েদের আক্রমণ চলছে শীঘ্রই তা প্রতিরোধে না করলে এরা ডাইনোসরের মত পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাজেই আমি জোর দাবি জানাচ্ছি চিরকুমার সদস্যদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হোক আর তাদের শত্রু ধাড়ি মেয়েগুলিকে পাছায় লাথি মেরে মেরে জেলখানায় পাঠানো হোক----

তার বক্তব্য শেষ না হতেই ময়মনসিংহের মহিলা এম পি রোষে দাঁড়িয়ে উঠে ঝড়ের বেগে বক্তৃতা শুরু করল ‘মাননীয় রেলমন্ত্রী মহোদয় অসত্য ভাষণ দিয়েছেন। কারণ মেয়েরা ছেলেদেরকে মারেনি বরং ছেলেরাই মেয়েদেরকে মেরেছে, চুলে ধরে চরকার মতো ঘুরিয়েছে। কাজেই এসব ছেলে জেলে পচে মরা উচিত। আবার তিনি ওই শয়তান সমিতিকে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন- এটাও তার অন্যায় আবদার। কারণ চিরকুমার সমিতির ছেলেরা যুগপৎ খোদাদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী ও বঙ্গবন্ধুদ্রোহী। কারণ আল্লাহ ছেলেদেরকে দুনিয়াতে পাঠানোর উদ্দেশ্যই হলো তারা বিয়ে করে স্ত্রীর নিরাপত্তা দিবে, তার অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ইত্যাদির সংস্থান করবে, এক কথায় দাসত্ব করবে। আবার রাষ্ট্রদ্রোহি এজন্য যে বাংলাদেশে চিরকুমার থাকার কোনো আইন নেই, বঙ্গবন্ধু এ জাতীয় কোনো দিকনির্দেশনা দিয়ে যাননি বরং সংবিধান অনুযায়ী একুশ বছর পার হতেই প্রত্যেকে ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। কাজেই এ দেশে থাকতে হলে দেশের আইন মেনেই থাকতে হবে।

পুনশ্চ তারা বঙ্গবন্ধু দ্রোহিও। কারণ এদেশের মেয়েরা হলো নিগ্রোদের মত বিশ্বসুন্দরী, এদেরকে দেখে বিদেশিদের রসনা লকলকিয়ে উঠেছিল। তা দেখে বঙ্গবন্ধুর আত্মসম্মানে ঘা লাগল, তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বিদেশিদের তাড়িয়ে দেশের ছেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। কাজেই প্রত্যেক ছেলে একটা করে বিয়ে না করলে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে, বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে। সংগত কারণেই তারা বঙ্গবন্ধু দ্রোহী বলে গণ্য হবে। কিন্তু না, এখন আর একটা করে বিয়ে করলে চলবে না। কারণ দেশে মেয়ের উৎপাদন বেড়ে গেছে, প্রত্যেক ছেলের মাথাপিছু সাড়ে তিনটা করে মেয়ে পড়ে গেছে। কাজেই প্রত্যেক ছেলেকে সাড়ে তিনটা করে বিয়ে করে সেই মেয়েদের দেহরক্ষী ও দাসত্বের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখন চিরকুমার সমিতির ছেলেরা যদি সেই দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করে তাহলে ওদেরকে পেদিয়ে পেদিয়ে জেলে ঢুকাতে হবে। এটাই সম্মিলিত নারীসমাজের দাবি।

তখন আওয়ামীলীগের উজিরে আ’লা আব্দুল কাদের জিলানী ওরফে ফাটা কেষ্ট উঠে দাঁড়ালেন। এই নামকরণের শানে নুযুল হল পার্শ্ববর্তী দেশে এক নায়ক ছিল যে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলত, উজিরে আ’লা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন বিধায় জনগণ তাকে এই উপাধি দিয়েছে। তিনি বললেন ‘বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন প্রত্যেকের ব্যক্তি, বাক ও কর্মের স্বাধীনতার জন্য। রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন যেকোন কাজ যে কেউ করতে পারে। কাজেই ছেলেরা নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার্থে চিরকুমার সমিতি গঠন করেছে, এতে দোষের কিছু নাই। ইচ্ছা করলে মেয়েরাও চিরকুমারী সমিতি গঠন করুক, কেউ বাধা দিবে না। আমরা নারী-পুরুষ সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছি, স্বাধীনতা দিয়েছি। কাজেই দেশের সবাই চিরকুমার সমিতি গঠন করুক, এতে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করব। তাতে দেশেরও প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। কারণ সবাই চিরকুমার থাকলে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হ্রাস পাবে, দেশের আয় উন্নতি হবে। তখন আমি প্রতিবছর জাতিকে একটা করে পদ্মা সেতু উপহার দিতে পারবো। এভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। আবার আমাদের এমপি মহোদয়া অভিযোগ করেছেন- ছেলেরা মেয়েদের চুলে ধরেছে। এটা ছেলেদের জন্মগত অধিকার, তারা মেয়েদের চুলে ধরে মারবে এটা কোন অন্যায় নয়। কারণ মেয়েরা চুল রাখেই মার খাওয়ার জন্য আর ছেলেরা চুল রাখে না মার না খাওয়ার জন্য। কাজেই প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ছেলেরা মেয়েদের চুলে ধরে মারবে- এতে কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়।

তখন মহিলা এমপি লাফিয়ে উঠে বাজখাই গলায় উজিরকে আক্রমন করল ‘উজিরে আজম আপনি ছেলেদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। আপনি ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পাঁয়তারা করছেন। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে না, আমরা আপনাকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করলাম। সেই সাথে মাননীয় স্পিকার আপনার মাধ্যমে আমি মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, কমমান্য মহিলা সাংসদবৃন্দ ও দুর্মান্য বিরোধী দলীয় নেত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি ‘আসুন আমরা দলাদলির চুলাচুলি বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হই। পুরুষরা সবাই জাত শিয়াল, তাদের সকলের একই রা। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে কোনো মিল নেই, বেঙের মতো কখনো এক পাল্লায় ওঠেনা, এই সুযোগে তারা আমাদের চুলের মুঠি ধরে ঘোরায়। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে নারীতান্ত্রিক বা মাতৃকেন্দ্রিক পরিবার ব্যবস্থার প্রবর্তন করি। নইলে আমাদের বাঁচার উপায় নাই, ঐক্যবদ্ধ পুরুষ জাতি আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেবে।

সর্বোপরি আমাদের দাবী হল এক্ষন এই মুহূর্তে আইন পাস করতে হবে যে, ছেলেদেরকেও মেয়েদের ন্যায় লম্বা চুল রাখতে হবে। কারণ চতুর ও স্বার্থবাদী পুরুষ নারীকে ঘায়েল করার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে মধুর কন্ঠে বলল ‘তুমি লম্বা চুল রাখ, তাহলে খুব সুন্দর দেখাবে আদর আহ্লাদও বেশি বেশি পাবে। মূর্খ নারীও পুরুষের ছলনায় ভুলে গিয়ে লম্বা চুল রাখল, এই সুযোগে পুরুষ কথায় কথায় নারীর চুল ধরে টান মেরে মাথাটা নিচু করে ফেলে। আর একজন মানুষের মাথা নিচু হয়ে গেলে তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, এই সুযোগে পুরুষ নারীকে পিটায় পাছায় লাথি মারে। আর এই সুযোগেই সমিতির ছেলেরা আমার মেয়েদেরকে ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছিল। নইলে আমার মেয়েরা ওদেরকে ধরে ধরে কাঁঠালের কোষের মত চিপে রসটা খেয়ে ফেলত। কারণ সমিতির ছেলেদের বুকটা টিকটিকির বুকের মত আর পাছাটা চোঙ্গার মত। কিন্তু আমার ময়মনসিংহের মেয়েদের বুকের পাটা ও পাছার ফাটার সাথে সারা দুনিয়ার মেয়েদের কোন তুলনা চলে না। এজন্যই যে কোনো দেশের ছেলেরা ময়মনসিংহের মেয়ে দেখলে পাগল হয়ে যায়। কাজেই ছেলেদেরও লম্বা চুল রাখতে হবে- যাতে মন চাইলেই মেয়েরা পুরুষের চুলে ধরে পেটাতে পারে। সুতরাং মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, বঙ্গবন্ধু নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়ে গেছেন, তার মেয়ে হয়ে আপনি সেই সমানাধিকার বাস্তবায়ন করুন। মেয়েদের ন্যায় ছেলেদেরও লম্বা চুল রাখার আইন পাস করুন। জয় বঙ্গবন্ধু জয় নারীতন্ত্র।

প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বললেন ‘আমিও তো তাই মনে করি। কারন সর্বক্ষেত্রেই আমরা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, সংসদ থেকে নিয়ে অফিস-আদালত মিল ফেক্টরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাঠে ঘাটে বাসে গাছে আকাশে সর্বত্রই নারী-পুরুষের সমানাধিকার। তাহলে আর এই একটা বিষয় বাদ থাকবে কেন, আমারও মনে হয় মেয়েদের ন্যায় ছেলেদের লম্বা চুল রাখা উচিত। তখনই পুরুষ সাংসদরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল ‘কখনোই না আমরা লম্বা চুল রাখতে পারবো না। মহিলারা চেচাতে লাগলো ‘অবশ্যই রাখতে হবে। শুরু হয় চিৎকার চেঁচামেচি। চিৎকার ধুন্ধুমারে রূপ নেয়, চরম হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। পুরুষরা দৌড়ে গেল মহিলাদের চুল ধরতে, মহিলারা নিরুপায় হয়ে তাদের লুঙ্গি ও প্যান্ট টান মেরে খুলে ফেলতে লাগল। তা দেখে লজ্জা পেয়ে স্পিকার চিৎকার শুরু করলো ‘থামুন থামুন, দুর্মান্য সদস্যগণ আপনারা শান্ত হউন। চুল নিয়ে চুলাচুলির জায়গা সংসদ নয়, এই কাজটা বেডরুমে গিয়ে করবেন। কাল থেকে সংসদে আসতে চাইলে চুল টুল কামিয়ে আসবেন। এভাবে চুলাচুলি করে সংসদকে নাপাক করা যাবে না। আমিও কাল থেকে মাথা মুড়িয়ে ফেলবো। ততক্ষনে সবাই শান্ত হয়ে এসেছে।

মহিলারা দাঁড়িয়ে সমস্বরে বলতে লাগল ‘ঠিক আছে নারী-পুরুষ সবাই হয় লম্বা চোল রাখবে অথবা সবাই মাথামুণ্ডিয়ে রাখবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি ঘোষণা দিয়ে দিন। প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বললেন ‘আপনারা তো দেখছি বাঁশ খাওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে উঠেছেন। আপনারা কি জানেন না যে, বিএনপি নেত্রী সব সময় সাপের মতো ফণা তুলে থাকে, সুযোগ পেলেই আমাকে দংশন করতে চায়। আসলে এটা বিএনপি নেত্রীর একটা চাল। আমরা মেয়েদের সমান অধিকার দিয়েছে, সংসদ থেকে নিয়ে সর্বত্র তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। কাজেই তারা জানে যে মেয়েরা তাদেরকে ভোট দেবে না। আর এ কারণেই মেয়েদের শায়েস্তা করার জন্য তারা বিএনপির ছেলেদেরকে দিয়ে চিরকুমার সমিতি নামের ঐ শয়তানি সংগঠন তৈরি করেছে। এতে তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে চাইছে। একদিকে মেয়েদেরকেও শায়েস্তা করবে অন্যদিকে আমরা এই স্পর্শকাতর বিষয়ে কিছু বললে আমাদেরকেও পাকড়াও করবে। কাজেই এখন যদি আমি ছেলেদের লম্বা চুল রাখার ঘোষণা দেই তাহলে সে আমাকে ধর্মদ্রোহী ও পুরুষ বিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে জেহাদ ঘোষণা করবে। তারপর সকল পুরুষকে ঐক্যবদ্ধ করে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে, আমার আঁচল ধরে টেনে হেঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে। আর আমি ক্ষমতায় না থাকলে জানবেন আপনাদের অবস্থা রোহিঙ্গাদের চেয়েও করুণ হবে। কাজেই ঘোষণাটা বিএনপি নেত্রীর মুখ দিয়ে দেওয়ান, তাহলে সাপও মরবে লাঠিও আস্ত থাকবে। তখন মহিলা এমপিরা বিএনপি নেত্রীর বাড়ির দিকে দৌড়লো।

আর তখনই অর্থমন্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলো ‘রাবিশ রাবিশ রাবিশ, এক কোটি রাবিশ, হাজার কোটি রাবিশ। হলমার্কের ব্যাপারে আমি বলেছিলাম চার হাজার কোটি টাকা কোন টাকাই নয়। তখন মূর্খ বাঙ্গালিরা আমাকে রাবিশ মন্ত্রী বলে আখ্যা দিল। অথচ এখন যে জনগণের কোটি কোটি টাকায় পরিচালিত সংসদে বসে সাংসদরা চুলাচুলি করছে এটা কি মূর্খ বাঙালীরা চোখে দেখে না, এখন তাদের মুখে রা নাই কেন? আসলে ওরা সব রাবিশ, এই রাবিশ দেশে আমি আর থাকব না আগামী নির্বাচনেও অংশ নেব না। এই রাবিশ দেশের মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে সোমালিয়া গিয়ে সে দেশের পুরুষদের মতো দৈনিক একটা করে বিয়ে করব আর কয়েক হাজার সন্তান পয়দা করব। তারপর অন্তত পরকালে গিয়ে তো বলতে পারব, প্রভু গো কিছু না করতে পারলেও অন্তত আপনার বান্দার সংখ্যা বৃদ্ধি করে এসেছি। আসি তাহলে, সবাই দোয়া করবেন’ বলে তিনি চলে গেলেন।

১১

পরদিন প্রতিনিধিদল রেলমন্ত্রীর বাসা থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এল। রাত্রে তারা পরামর্শ সভায় বসলো এখন কি করা যায়? হুমায়ুন বললো, নিরাশ হলে তো চলবে না, কোরানে নৈরাশ্য সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারি দল আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে- এটা বিরোধীদল জানতে পারলে অবশ্যই তারা আমাদেরকে লোফে নিবে। কাজেই সরাসরি বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে দেখা করে দেখি কী হয়। ভার্সিটি জীবনে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ছিল, সে বি এন পি-পন্থী একটা টিভি চ্যানেলে কাজ করে। আশা করি সে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। পরদিন হুমায়ুন একাই সাংবাদিক বন্ধুর সাথে দেখা করে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। বন্ধু বলল ‘আজ সন্ধ্যায় নেত্রীর একটা কনফারেন্স আছে, সেখানে তোকে নিয়ে যাব।

সন্ধায় কনফারেন্স শুরু হলো। বিএনপি নেত্রী গুরু গম্ভীরভাবে বক্তব্য শুরু করলেন ‘সাংবাদিক বাবাজিরা আজ আপনাদের সকলের উপস্থিতি দেখে আনন্দে আমার মনটা ভরে উঠেছে, আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ইতোপূর্বে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ নেত্রী ডাকলে আপনারা গৃহপালিত কুকুরের মত লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে জড়ো হয়েছেন তার মোসাহেবি করেছেন, তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে কলম ধরেছেন, তাদের অপকর্মগুলি ঢেকে রেখে প্রশংসা করেছেন, মোসাহেবী করে চেটেপোটে খাওয়ার ধান্দা করেছেন। কিন্তু আমি ডাকলেই আপনাদের পিছুটান শুরু হয়ে যেত, গোমরাহ মুখে দু-একজন আসলেও বাকিদেরকে মোমবাতি জ্বালিয়েও খুজে পাওয়া যেত না। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি ক্ষমতায় গিয়ে পাপারাজ্জিদের সরষে ফুল দেখাব কিন্তু আজকের উপস্থিতি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেছি। কাজেই আমার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলাম।

এক সাংবাদিক দাড়িয়ে বলল ‘ম্যাডাম খাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই তো সবাই এসেছে, নইলে কেউ আসত না। নেত্রী মুচকি হেসে মিনমিনিয়ে বলল, কোন খাওয়াটা যে আছে কনফারেন্স শেষেই বুঝতে পারবেন। আসল ঘটনা হলো বিএনপি সম্মেলন ডাকলে সরকারি বাহিনীর লাঠিপেটার ভয়ে সাংবাদিকরা আসে না। এ জন্যই মন্ত্রকরা নেত্রীকে পরামর্শ দিল ‘আপনি খাওয়ার ঘোষণা দেন তবে খাওয়ানোর দায়িত্বটা আমাদের উপর থাকলো। তারপর বিএনপির ছেলেদেরকে বলল ‘তোমরা হাতে লাঠি দিয়ে সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে গোপন স্থানে অপেক্ষা করবে, সাংবাদিকরা যদি খেতে চায় বা গন্ডগোল করে তাহলে ওদের বাশ খাওয়াবে এবং ভালো করেই খাওয়াবে।

নেত্রী বলতে লাগলেন ‘সাংবাদিকরা হলো জাতির বিবেক। কাজেই বিবেকের আদালতে কয়েকটি জটিল বিষয় উত্থাপন করতেই আমি আপনাদেরকে ডেকেছি। প্রথমটি হলো রোহিঙ্গা প্রকল্প, আপনারা শুনেছেন সরকার রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেমন দেশ-বিদেশে ভিক্ষা প্রকল্প, হাতিয়া, ভাসান চর গরুর চর, ছাগলের চর ইত্যাদিতে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করে রোহিঙ্গাদের থাকা- খাওয়া ও হাগা মুতার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি হল লোক দেখানো বাহ্যিক প্রকল্প। কারন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো- নতুন দশ লাখ রোহিঙ্গা সৃষ্টি করে হত্যা গুম ও বহিষ্কারের মাধ্যমে মগের মুল্লুক থেকে আগত রোহিঙ্গাদের চাপ নিয়ন্ত্রন করা।

অর্থাৎ মগের মুল্লুক থেকে এদেশে দশ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, গরীব দেশে এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে চাল-ডালসহ বিড়ি-সিগারেট ও পান জর্দার দাম বেড়ে গেছে। এখন দ্রব্য মুল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে দশ লক্ষ লোক কমাতে হবে। আর সেই দশ লক্ষ লোক হবে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী। বর্মি বাহিনীর মতো তাদেরকে গুলি করে গুম করে হত্যা করবে, বাকিদেরকে দেশ ছাড়া করবে। এটাই হল আসল রোহিঙ্গা প্রকল্প। আর এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগ কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। অসংখ্য সাধারণ মানুষসহ বিএনপি ও জামাতের কমান্ডিং নেতাদের গুম খুনের বাজার গরম করে দিয়েছে।

কাজেই আমরা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, আওয়ামী লীগ যদি এই প্রকল্প অব্যাহত রাখে তাহলে আমরাও কলকাতা রোহিঙ্গা প্রকল্প হাতে নিব। এ প্রকল্পের শানে নুযুল হল- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগ যুদ্ধ তো করেইনি বরং তারা দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণকে সশস্ত্র পাকিস্তানি রাক্ষসদের মুখে ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় পালিয়ে গেছে। সেখানে বিলাসবহুল হোটেলে বসে বসে সারাদিন উত্তম কুমারের সাথে তাস খেলেছে আর রাতে সুচিত্রা সেনের খেমটা নাচের জলসা ঘরে মজলিস করেছে। তখন জিয়াউর রহমান দেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে মাঠ ঘাট দাবড়িয়ে যুদ্ধ করে জীবন বিপন্ন করে দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু সেক্টর কমান্ডার দাবিদার তাহের ও খালেদ মোশাররফরা তখন রণক্ষেত্রে না গিয়ে আখড়ায় বসে বসে গলা পর্যন্ত মদ গিলেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলকাতার রোহিঙ্গা তথা আওয়ামী লীগ নেতারা দেশে ফিরে এসেই ক্ষমতা দখল করল, বাকশাল গঠন করল। তারপর জহির রায়হান শহীদুল্লা কায়সার সিরাজ শিকদারের মত প্রকৃত দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে গুম করলো ও হত্যা করলো। এখন আবার তারা প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেই বাকশালী তাণ্ডব শুরু করেছে, দেশের জনগণকে রোহিঙ্গায় পরিণত করেছে।

শুধু তাই নয় আওয়ামীলীগ আসাম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ভারতের সম্প্রদায়িক সরকার আসামের চল্লিশ লক্ষ মুসলমানকে বাংলাদেশি দাবি করে ফেরত পাঠানোর পায়তারা করছে। অথচ আওয়ামীলীগ এর প্রতিবাদ করছে না। কারন তাদের বিশ্বাস দাদাদের দেশের মানুষ আসলে তাদেরকে ভোট দেবে। এজন্য তারা আসামের চল্লিশ লাখ মানুষ এনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএনপি-জামায়াত ইত্যাদি শত্রুদলের চল্লিশ লাখ মানুষ মেরে ফেলবে, এটাই হলো আসাম প্রকল্প।

তারপর নেত্রী বললেন ‘সাংবাদিক বাবাজিরা আপনারা দয়া করে এ বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিন। আওয়ামী লীগের ভয়ংকর প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলুন। তারা রাস্তায় নেমে জ্বালাও-পোড়াও ধর্মঘট করুক, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে আমাদেরকে ক্ষমতায় বসাক। তাহলে আমি ওয়াদা দিলাম এবং নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করলাম- আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকান স্বাধিন করে দিব আর বাংলাদেশী রোহিঙ্গা আওয়ামীলীগকে কলকাতায় ফেরত পাঠাবো। সেই সাথে ভারত যদি শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের চল্লিশ লক্ষ নাগরিককে আমাদের দেশে পাঠাতে চায় তাহলে আমরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব।

তারপর তিনি মুচকি হেসে বললেন ‘আপনাদের কি ধারনা এই যুদ্ধে কারা জিতবে, ভারত নাকি আমরা? নিশ্চিত থাকুন, জয় আমাদের হবে। আর এ জয়ের জন্য আমাদের সেনাবাহিনি ডাকতে হবে না, একটা গুলি ছুড়তে হবে না এমনকি একটা পয়সাও খরচ হবে না। তাদের জন্য আমাদের পিচ্চি বিচ্ছু বাহিনীই যথেষ্ট। আপনারা দেখেছেন আমাদের ছোট ছোট পোলাপানেরা বিয়ে বা বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের সময় আতশবাজি করে, পটকা ফোটায়। আমরা মধ্যরাতে এই বিচ্ছু বাহিনীকে তাদের মায়ের কোল থেকে টেনে তুলে বলবো ‘যা এগুলি নিয়ে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাংকার ঘিরে ফটকা ও আতশ আক্রমণ কর। তাহলে প্রত্যেককে একটা করে লজেন্স দিব, বেশি চাইলে আরো বেশী দিব। তখন ইন্ডিয়ান বাহিনী পারমাণবিক অ্যাটাক মনে করে পাদতে পাদতে পলায়ন করবে। কারণ ওরা হলো ভীতু কাপুরুষ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ই তাদের বাহাদুরি আমাদের জানা হয়ে গেছে। এই হল জাতির সাথে আমার ওয়াদা আর নির্বাচনী অঙ্গীকার, আপনারা দেশবাসীকে জানিয়ে দিন।

আমার দ্বিতীয় বিষয় হলো প্রতিশোধ প্রকল্প। বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় কিন্তু আপনাদেরকে আমি আপনজন মনে করি বিধায় বলছি, দয়া করে কাউকে বলবেন না পত্রিকায়ও প্রকাশ করবেন না। প্রকল্পটা হল, বঙ্গবন্ধু তিল তিল করে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, আর জিয়াউর রহমান মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু মীরজাফরের বংশধর চিরগাদ্দার বাঙালি জাতি এই অবিসংবাদিত মহান দুই নেতার কৃতিত্বের প্রতিদান দিল তাদেরকে হত্যা করে, তাদের রক্তে দেশের মাটি কলুষিত করল। তখন আমি আর হাসিনা খুবই অসহায়, এই অসহায়ত্বের মধ্যে দুজনে বসে বসে শলাপরামর্শ করে একটা চুক্তি সম্পাদন করলাম। সেই চুক্তিটার নাম প্রতিশোধ প্রকল্প। চুক্তির শর্ত ছিল আমরা দুজন পালাক্রমে ক্ষমতায় যাব। যারা বিরোধী দলে থাকবে তারা হরতাল ও ধর্মঘটের নামে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও করে গাদ্দার বাঙ্গালীদের আগুনে পুড়িয়ে মারবে, তাদের ধন সম্পদ, বাড়ি- ঘর, গাড়ি- ঘোড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেবে। গার্মেন্টসসহ ব্যবসা সেক্টরে দৈনিক হাজার কোটি টাকা লোকসান করাবে। আর তখন সরকারি বাহিনী জনগণের টাকায় কিনা গুলি চালাবে জনগণের বুকে। এভাবে গাদ্দার জাতির উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

আর এ নিয়মেই প্রতিশোধ প্রকল্প এগিতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ হাসিনা গাদ্দারি শুরু করল। গতবার বিরোধী দলশূন্য প্রহসনের নির্বাচনের সময় আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমাল আর সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেল তারা এম পি হয়ে গেছে। সেই থেকে তারা মসনদে জেঁকে বসেছে, এদিকে আমরা রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াও করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আর তারা সিংহাসনে বসে ঘুমাচ্ছে। এখন আপনারা হাসিনাকে বুঝিয়ে বলুন, তারা রাজপথে নেমে মানুষ পোড়ানোর দায়িত্বটা পালন করুক আর আমরা ক্ষমতায় বসে বন্দুকের ট্রিগার টিপে টিপে বাঙালি মারার সহজ কর্তব্যটা সম্পাদন করি। আমি শুধু কষ্টের কাজ করব আর সে আরামের কাজ করবে এটা তো আমাদের চুক্তি ছিল না, এটা তো গণতন্ত্র না। আপনারা তাকে বুঝান, এর পরেও যদি সে চুক্তি ভঙ্গ করে তাহলে তাকে আল্লাহর দরবারে কঠোর জবাবদিহি করতে হবে। আর আমরাও বসে থাকব না জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। তখন তাকে পরিবারসহ রোহিঙ্গা বানিয়ে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। তারপর তিনি আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে লাগলেন।

তখন হুমায়নের সাংবাদিক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো ‘ম্যাডাম ময়মনসিংহে তো খুব গন্ডগোল চলছে, চিরকুমার সমিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি? নেত্রী ঝংকার মেরে উঠলেন ‘আর কতোবার বলব এটা শয়তানের সমিতি। আওয়ামীলীগ নাস্তিক-মুরতাদের দল কিন্তু এদেশের মেয়েরা সবাই ধার্মিক। এজন্য তারা আওয়ামী লীগে ভোট দেয় না। তাই মেয়েদের উপর প্রতিশোধ নিতে তারা ছাত্রলীগের দুষ্ট ছেলেদেরকে দিয়ে এই সমিতি গঠন করিয়েছে।

তাছাড়া এটা হল আওয়ামীলীগের একটা বুড়ো বিয়ে প্রকল্প। আপনারা জানেন হাসিনা ক্ষমতায় এসেই তার দলের বুড়োদের কচি কচি নতুন আনকোরা মেয়ে দেখে বিয়ে করায়। মনে আছে সুনামগঞ্জের সামাদ আজাদের কথা? হাসিনা তাকে পঁচাশি বছর বয়সে বিয়ে করিয়েছিল। এবার দেখেন হাসিনার রেলমন্ত্রী সত্তর বছরের বুড়া মজিবরকে বিশ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করাচ্ছে। দু’দিন পর এই বুড়াটা মরে গেলে মেয়েটার কি হবে, আপনারাই বলুন? এই বুড়াদের জন্য যাতে সহজে কচি কচি মেয়ে পাওয়া যায় এজন্য সে লীগের ছেলেদেরকে দিয়ে সমিতি গঠন করেছে। কারন যুবকরা বিয়ে না করলে বুড়োদের জন্য পাত্রি পাওয়া যাবে। এভাবে হাসিনা দেশের মেয়েদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। কাজেই আপনাদের মাধ্যমে আমি মেয়েদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি ‘তোমরা আন্দোলন করে আমাকে ক্ষমতায় বসাও, তাহলে আমি রেল মন্ত্রিকে জেলে পাঠাব, তার বিশ বছরের বউটাকে পনের বছরের ছেলে দেখে বিয়ে দিব। আর চিরকুমার সমিতির হারামজাদাগুলির পাছায় লাথি মেরে মেরে একেকটাকে একডজন করে বিয়ে করাব, সেই সাথে তাদের বাপদেরও একহালী করে বিয়ে করাবো। এটাও আমার নির্বাচনী অঙ্গীকার। নেত্রীর কথা শুনে হুমায়ূনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার বন্ধু বলল ‘সংবাদিকরা তোকে দেখলে সমস্যা হবে তুই চলে যা। সে মানে মানে কেটে পড়ল।

১২

রাত্রে আবার তারা হোটেলে পরামর্শ সভায় বসল। জাফর বলল ‘শুন মেয়েরা হলো স্বর্গীয় ফুল, এরা ছলনাময়ি, জাদুকরী। নারী-পুরুষ সবাই ওদের পক্ষে আমাদের জন্য কেউ কিছু করবে না। বৃথা চেষ্টা না করে চলে যাওয়াই ভাল। হুমায়ুন বলল, শেষ চেষ্টা করে দেখি কি হয়। প্রেসিডেন্ট ময়মনসিংহের মানুষ, তিনি ফুলপুরের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে চ্যাকা খেয়েছিলেন। মেয়েদের প্রতি তার সেই ক্ষোভটা হয়ত আমাদের কাজে লাগতে পারে। তারপর তারা সুযোগমত বঙ্গভবনে গিয়ে হাজির হলো, নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা জানিয়ে বলল ‘স্যার ময়মনসিংহের মেয়েদের হাতে আপনিও মজলুম আমরাও মজলুম। কাজেই আমাদের জন্য একটা কিছু করেন। অনেক আশা নিয়ে আমরা আপনার দরবারে এসেছি।

প্রেসিডেন্ট ধমকে উঠল ‘এই আমাকে স্যার ডাকলে কেন, স্যার ডাকলে কেন? সাবধান আরেকবার স্যার ডাকলে কিন্তু জেলে পাঠাব। আমাকে হুজুর ডাকবে। প্রতিনিধিরা ভয়ে থিতিয়ে উঠেছে। হাবিব সাহসে ভর করে গলা টেনে বলল, হু—জু—র, হুজুর ডাকবো মানে, স্যার--- তিনি আবার খেঁকিয়ে উঠলেন, ফের স্যার ডাকে। আরে স্যারের কাজ তো হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর অফিস-আদালতে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাজটা কোথায়? তার কাজ তো মাজারে, শুধু মাজার জিয়ারত করা। আর মাজার জিয়ারত কারা করে? হুজুররা করে, কাজেই আমাকে হুজুর ডাকবে। তবে হুজুরদেরও অবশ্য স্বাধীনতা থাকে, তারা যে কোনো মাজারে যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সেই সুযোগ নেই। কেন জান না বিএনপি'র প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারতে গিয়েছিল বলে ইমপিচমেন্টের শিকার হয়েছিল। কিন্তু আমি খুব চালাক, জিয়ার মাজারে যাবো তো দূরের কথা সেই রুট দিয়েই আনাগোনা করিনা। তজ্জন্য অবশ্য তোমরা আমাকে বদ হুজুর, একচোখা হুজুর বলতে পারো সমস্যা নাই।

তারপর তিনি হেসে বললেন, দেখ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ক্ষেত-খামারে যেতাম, কৃষকদের সাথে কামলাদের সাথে বসে বসে আড্ডা দিতাম, বিড়ি তামাক খেতাম, মনটা ফ্রেশ থাকত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আর কোথাও যেতে পারি না, একা একা গোমড়া মুখে বসে থাকতে থাকতে মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, দম বন্ধ হয়ে আসে। তোমরা আমার এলাকার মানুষ, তোমাদেরকে পেয়ে খুব আনন্দিত হলাম। এসো ছুটিয়ে আড্ডা দেই মনটা ফ্রেশ হবে। তোমাদেরকে আমার ইতিহাস শুনাই, ছোটবেলায় খুব সিনেমা দেখতাম। তখনকার দিনের বিখ্যাত দুজন কৌতুক অভিনেতা ছিল রবিউল ও হাসমত। তাদেরকে দেখে আমার কৌতুক অভিনেতা হওয়ার খুব শখ জাগলো, চেষ্টা তদবির করে একটা ছবিতে চান্স নিলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, ডায়লগ বলার সময় আমার মুখ দিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চের মতো বক্তৃতা আসে, পারফরমেন্স করতে পারি না। তখন পরিচালক এ কে ফজলুল হক আমার পিঠ চাপড়ে বললেন ‘বাবা অনেক বড় কাজের জন্য আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অভিনয়ের জন্য নয়। যাও রাজনীতি কর গিয়ে, ইনশাআল্লাহ, দেখবে একদিন তুমি এ দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছ। আমি তোমার জন্য দোয়া করব, বন্দুকের গুলি মিস হতে পারে কিন্তু আমার দোয়া কখনো মিস হয় না।

তখন এসে রাজনীতিতে যোগ দিলাম, এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এম পি হলাম মন্ত্রী হলাম দিনকাল ভালোই চলতে লাগল। কিন্তু যেই না প্রেসিডেন্ট হলাম তো সর্বনাশ করলাম, মূর্খ বাঙালি আমাকে বটতলার উকিল বলা শুরু করল। প্রথম যেদিন কথাটা শুনলাম আমার মনটা ভেঙ্গে আবোল তাবোল হয়ে গেল। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে সারারাত ডুকরে কাঁদলাম আর অভিশাপ দিলাম। তখন মনে পড়ল রাসূলের (সাঃ) কথা, উহুদ যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি বলেছিলেন ‘সেই জাতি কি করে সফলকাম হবে যারা তাদের নবীকে কষ্ট দেয়। তেমনি আমিও বললাম ‘সেই জাতি কি করে সফলকাম হবে যারা তাদের নিষ্কলুষ প্রেসিডেন্টকে কষ্ট দেয়, বটতলার উকিল ডাকে। হে আল্লাহ তুমি তো জানো ওকালতি করতে আমি কোনদিন বটতলায় যাইনি, হা গিয়েছি হাগু-মুতু করতে গিয়েছি ওকালতি করতে নয়। কাজে কাজেই যারা আমার উপর এমন অপবাদ দিয়েছে তাদেরকে তুমি ধংস করে দাও, ঝাড়ে-বংশে নিপাত করে দাও।

কিন্তু সহসা মনে হল রাসূলুল্লাহ উহুদ ও তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হয়েও বদ দোয়া করেননি বরং তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করেছেন। তখন আমিও দোয়া করলাম ‘হে আল্লাহ আমার কওম বুঝে না, ওরা অবুঝ। তুমি তাদেরকে মাফ করে দাও, হেদায়েত দাও। কিন্তু যদি তাদের কপালে হেদায়েত না থাকে, আমাকে আবার বটতলার উকিল বলে তাহলে তাদেরকে ধ্বংস করে দাও, একেবারে নির্মুল করে দাও। এই দোয়ার পর থেকে আমাকে আর কেউ বটতলার উকিল বলেনি।

কিন্তু বিপদ কাটল না। এভাবে একাকী নিস্কর্মা বসে থাকতে থাকতে আর ভাল্লাগেনা। আফসোস হল, আমার কৌতুক অভিনেতা হওয়াই ভালো ছিল, কর্মব্যস্ত সময় কাটত। ভাবলাম কাজটা আবার শুরু করি। তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ও বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গিয়ে জুকারি শুরু করলাম। বক্তৃতা দেই, ‘আরে আমি ছিলাম রামছাত্র মেট্রিক ইন্টার কয়েকবারে পাশ করেছি, ঢাকা ভার্সিটি চান্স পাইনি কিন্তু আজ আমি সকল ভার্সিটির চ্যান্সেলর। দেখো বাঙালিরা দেখো, বটতলার উকিলের সম্মান দেখ, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। এভাবে কৌতুকাভিনয় করে নিজেও হাসি অন্যদেরও হাসাই। তাতে মাজার জিয়ারতের হুজুরের সময়টা ভালোই কেটে যায়।

আচ্ছা যাক, তোমাদের দুঃখের কথা শুনলাম আর নিজের দুঃখের কথাও বললাম। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হলো ময়মনসিংহের অপ্সরীদের দেখে দেখে তোমরা কি করে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলে, এতটা আত্মসংযম কি করে অর্জন করলে যা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মনে হয় তোমরা আল্লাহর তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্ত বিশেষ বান্দা খাঁটি বান্দা, পীর-মাশায়েখ এবং দরবেশ। আচ্ছা তোমরা কি আমাকে মুরিদ করবে? জাফর বলল ‘হুজুর আসল কথা হল আপনি মুরিদের শর্ত ভঙ্গ করে ফেলেছেন, কারন আপনি বিয়ে করে ফেলেছেন। আবার আমরা কোন দরবেশ টরবেশ নই তবে আমরা শরীয়তের একটা হুকুম খুব কঠোরভাবে পালন করি, সেটা হলো দৃষ্টির পর্দা। কোন মেয়ের দিকে আমরা তাকাই না, সামনে এসে গেলে চোখ বন্ধ করে ফেলি। কারণ আল্লামা হুজুররা বলে থাকেন যে, দৃষ্টি হলো নারী লালসা সুপরিবাহী। তামার তারে বৈদ্যুতিক প্রবাহের ন্যায় দৃষ্টির মাধ্যমে নারী লালসা শরীরে প্রবেশ করে কলবকে কলুষিত করে, একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়। এজন্যই আমরা দৃষ্টি পর্দার আমলটা ঠিক মত করে থাকি।

প্রেসিডেন্ট বিস্ময়ের সুরে বললেন ‘এবার বুঝলাম তোমাদের কেরামতিটা। নইলে ময়মনসিংহের মেয়েদের প্রতি অনীহা প্রকাশ করা স্বয়ং খাজা মইনুদ্দিন চিশতির পক্ষেও সম্ভব না, সেখানে তোমরা তো হলে কোন ছার। যাই হোক এই বয়সে এত শরিয়ত মানা শুভ লক্ষণ নয়, হা মান অন্যান্য গুলি মান এটা বাদ দাও। প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমি তোমাদেরকে হুকুম করছি, মেয়েদের প্রতি তাকাবে। বিশেষত ওরা যখন হেটে যায় তখন পাছার দিকে তাকাবে। ময়মনসিংহের মেয়েদের ফিগার হলো বিশ্ব বিখ্যাত, পৃথিবীতে এর কোন জুড়ি নেই। বিশেষত ফুলপুরের মেয়েরা হল হাইব্রিড, সবচেয়ে উন্নত। কাজেই তোমরা এসব ভন্ডামি ছেড়ে মেয়েদের প্রতি তাকাও, ওদের তনুদেহের স্পন্দন দেখলেই তোমাদের কুমারত্ব টুমারত্ব ভেঙ্গে হৃদকম্পন শুরু হয়ে যাবে। কারন রুবির কথা মনে হলে আমারই হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়।

হাবিব জিজ্ঞেস করল, স্যার না সরি হুজুর রুবিটা কে? প্রেসিডেন্ট কাতর স্বরে বলল, রুবি আমার রুবি, আমার জীবন, সে ফুল্পুরের মেয়ে। ওর জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু রামছাত্র দেখে ওর বাবা বিয়ে দেয়নি। সে এখন মুমিনুন্নিসা কলেজের অধ্যাপিকা। আচ্ছা যাক মরা পুত (পুত্র) নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই নতুন পুতের চিন্তা করতে হবে। শুন আমাদের নেত্রীর বুড়ো বিয়ে নামের একটা প্রকল্প আছে। কচি নতুন মেয়ে পেলে তিনি নিজ দায়িত্বে তার দলের বাবুদের (বুড়ো) বিয়ে দেন। কাজেই তোমাদের প্রতি আমার একটা অনুরোধ, তোমরা আমার জন্য নতুন কচি আনকোরা দেখে একটা মেয়ে দেখবে। তখন প্রধানমন্ত্রী নিজ দায়িত্বে বিয়ে দেবেন। কারণ ময়মনসিংহের মেয়ে ছাড়া আমার আর চলছে না। ঘটকালির জন্য তোমরা প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে মোটা পুরস্কার পাবে তার উপর আমার হাদিয়া তো আছেই।

আমি এখনই তোমাদের চা-নাস্তা আনছি’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন ‘দেখো আমি তো আবার হযরত উমরের মতো জীবন-যাপন করি। তিনি যেমন গোলামদের আজাদ করে দিতেন তেমনি আমিও আমার কর্মচারীদের বলেছি ‘দেখ বাবারা বটতলার উকিলের জন্য তোমাদের এত কষ্ট করতে হবে না। হাত জোর করে মূর্তির মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। যাও তোমরা আজাদ, স্ফুর্তি কর গিয়ে।

কথায় বলে, এমনিতেই নাচনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি। এরপর আর তাদের টিকিটিরও নাগাল পাইনি। এখন শুনতে পাই তারা নাকি একেকটা নায়িকা বগলদাবা করে পার্কে আর সিনেমা হলে ঘুরে বেড়ায়। আর আমার কাজকর্ম আমি নিজ হাতেই করি’ বলে তিনি চলে গেলেন। একটু পর চা ও পিঠা নিয়ে এসে বললেন ‘এটার নাম চ্যাপা শুঁটকির পিঠা, আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। এটা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে খুব প্রিয়, আমাদের জাতীয় পিঠা খেয়ে দেখ কত স্বাদ, খাটি দেশী খাদ্য। তোমরা যদি আমাকে দশ পনের বছরের একটা দেশি মেয়ে মানে ময়মনসিংহের মেয়ে দিতে পার তাহলে আমি তোমাদেরকে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি খাদ্য খাওয়াব।

জাফর বললো ‘হুজুর ঘটকালি করার জন্য আগে তো আমাদের বিপদ মুক্ত হতে হবে। আমাদের অফিস বন্ধ, সদস্যরা জেলে পচছে, এ সম্পর্কে আপনি কী বলেন? প্রেসিডেন্ট কিছুক্ষণ মাথা নত করে চিন্তা করলেন, তারপর স্মিত হাস্যে বললেন ‘দেখো আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছি। তিনি যা বলেছেন এবং করেছেন তা করা আমাদের জন্য ফরয। আর যা বলেননি বা করেননি তা আমাদের জন্য হারাম। কাজেই চিরকুমারত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কি বলে গেছেন তা আমার জানা নাই, জানা থাকলেও স্বরন নাই- যেহেতো আমি রাম ছাত্র। এখন তোমরা যাও আমি তোমাদের বিষয়টা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মাজারে যাবো, তিনি রাত্রে স্বপ্নের মাধ্যমে আমার কাছে অহি বা ইলহাম পাঠাবেন। তখন ওহী অনুযায়ী আমি তোমাদের ফয়সালা দিব। এখন যাও তাহলে ওয়া আলাইকুম সালাম, কচি মেয়ের কথা স্মরণ থাকে যেন। প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্টের কচি মেয়ের বায়না আর সালাম না দিয়ে উত্তর দেয়া নিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নিল।

১৩

হোটেলে গিয়ে জাফর বলল ‘শুন আর বৃথা দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই, কেউ আমাদের সাহায্য করবে না। প্রেসিডেন্ট বল আর পিছের ঠ্যাং বল সব হালার পুতদের জানা হয়ে গেছে। সবাই মেয়েদের চওড়া পাছার পিছনে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়। প্রেসিডেন্ট আছে কচি মেয়ের সন্ধানে, প্রধানমন্ত্রী আছে তার দলের বুড়োদের কচি কচি মেয়ে বিয়ে করিয়ে ভাঙ্গন থেকে দল রক্ষার চিন্তায়, বিরোধী নেত্রী আছে বিচারকদের কচি কচি মেয়ে উপহার দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা থেকে খালাস পাওয়ার ধান্ধায়। কাজেই আমাদের দুঃখের কথা কেউ শুনবে না, চল ফিরে যাই। উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধানের চেষ্টা করি গিয়ে।

হুমায়ুন বলল ‘হা চলে তো যাবই তবে আমি ভাবছি পাকা চুলওয়ালা কবিদের মধ্যে একমাত্র আল মাহমুদ বেঁচে আছেন। ঢাকায় আসলামই যখন তাকে একটু দেখে গেলে ভালো হয় না? হাবিব লাফিয়ে উঠল, ‘ঠিক ঠিক দাদা কবিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই আছেন। তাকে না দেখে যাওয়াটা কাব্য শাস্ত্রের অবমাননা হবে। চল এক নজর দেখেও যাই আর আমাদের দুঃখের কথা জানিয়ে অনুরোধ করে যাই তিনি যেন ‘চিরকুমার সংঘ’ নামের একটা মহাকাব্য রচনা করে দেন।

তারা বাসার কাছে পৌঁছতেই আবৃত্তি শুনতে পেল ‘যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন ধান্যের দোয়ার, অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে আমার এ হাত---- তারা ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধ কবি চেঁচিয়ে উঠলো ‘ওঃ আমার হাত ধরতে এসেছ বুঝি, আমার এ হাত সর্বদা তোমাদের জন্য উন্মুক্ত অবারিত। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আরে তোমরা তো ছেলে মানুষ হাত ধরবে কি। আচ্ছা তোমরা কি কোন অনাথ অসহায় নদী ভাঙ্গা মেয়ের আর্তনাদ শুনেছ, তারা কারো হাত ধরতে চাইছে বা প্রেম করতে চাইছে? দেখ আমার বড় ভাই শামসুর রাহমান কবিতা লিখল- সে নাকি ষাট বছর বয়সে প্রেম করে, বুড়ি ও ধনি দেখে দেখে প্রেম করে। তখন আমি সোনালী কাবিন লিখে ঘোষণা দিয়েছিলাম- অনাথ ও অসহায় মেয়েরা প্রেম করতে চাইলে আমার হাত ধরতে পারে, আমি দুনিয়ার সকল অসহায় মেয়েদের সাথে প্রেম করতে প্রস্তুত। ঠিক তখনই শুনলাম আমার ভাই মৃত্যুশয্যায় শায়িত, আমি দৌড়ে গেলাম, তার শিয়রে বসে কান্নাকাটি শুরু করলাম। সে ধমক দিয়ে বলল ‘আরে মূর্খ কাদিস কেন আমি তোর অগ্রজ, আমি আগে গিয়ে ভালো ভালো হুরগুলি বেঁচে আমাদের জন্য আলাদা করে রাখবো, তুই আসলে অর্ধেক পাবি। তারপর সে চলে গেল।

আচ্ছা বাদ দাও, তোমরা কেন এসেছ বল। তারা নিজেদের বিপদের কথা জানিয়ে সাহায্য চাইলো আর চিরকুমার সংঘ নামে একটি মহাকাব্য রচনা করে দেওয়ার অনুরোধ করলো। কবি বলল ‘বুঝতে পারছি তোমরা তাহলে অবিবাহিত মানে নপুংশক অথবা প্রেমহীন ব্যর্থ পুরুষ। আচ্ছা ঠিক আছে বলতো বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে কারা ব্যর্থ ছিলেন আর কারা সফল ছিলেন? জাফর কাচুমাচু করে বলল ‘মুজিব-জিয়া সফল ছিলেন। তখন কবি একটা অট্টহাসি দিয়ে বললেন ‘মূর্খ মূর্খ গন্ডমূর্খ। আরে মুজিব জিয়া হল বাংলাদেশের সব চাইতে ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট। কারণ তারা ছিল এমন অযোগ্য যে তাদের বাবা-মা তাদেরকে যে একটা করে বিয়ে করিয়েছিলেন এর বাইরে আরেকটা বিয়ে করা বা প্রেম করা তাদের মুরোদ হয়নি। কাজেই তারা ছিলেন ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট। পক্ষান্তরে দেখ মহামান্য এরশাদ, তার স্ত্রী ও প্রেমিকার সংখ্যা কত এ দেশের মানুষ জানবে তো দূরের কথা সে নিজেই জানে না। কাজেই তিনি শুধু বাংলাদেশে নয় সমগ্র বিশ্বের সর্বকালের সেরা সফল প্রেসিডেন্ট, আমাদের কৃতিসন্তান, জাতীর গৌরব, সকলের সেরা।

আচ্ছা বলতো বাংলাদেশের সুভাগা আর দুর্ভাগা প্রেসিডেন্ট কারা? হাবিব বলল ‘মজিব জিয়া সুভাগা প্রেসিডেন্ট। কবি আবার অট্টহাসি দিয়ে বললেন ‘মূর্খ, আরে ওরাতো দুর্ভাগা প্রেসিডেন্ট। কারণ মুজিব আন্দোলন-সংগ্রাম করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিল আর জিয়া মাঠে ময়দানে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলো অথচ তারা মাত্র দু'দিন দুদিন করে চারদিন রাজাগিরি করতে পেরেছিল। আর দেখ মহামান্য এরশাদ যুদ্ধ না করেও আজীবন রাজনীতি ও রাজাগিরি করে যাচ্ছেন। কাজেই মজিব জিয়া হল দুর্ভাগা প্রেসিডেন্ট আর এরশাদ হল সুভাগা প্রেসিডেন্ট।

ঠিক তখনই কমবয়সী একজন মহিলা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কবি হেসে উঠে বললেন ‘দেখো দেখো ওই মেয়েটা আমাকে বাপ ডাকে। দেখ আমি কত সুভাগা, মেয়ে জন্ম দিলাম না হাগা মুতা সাফ করলাম না, কোলে নিলাম না অথচ ফাও একটা ধাড়ী মেয়ে পেয়ে গেলাম। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা মেয়ে তুমি কি প্রেম টেম করেছ? সে বলল হা। জিজ্ঞেস করলাম ‘কার সাথে? সে বলল ‘আপনার ছেলের সাথে। তখন আমি আনন্দ চিত্তে একটা হাসি দিয়ে বললাম ‘তাহলে তো তুমি আমার একটা গতি করতে পারো। তোমার মায়ের সাথে আমার একটু লাইন ঘাট--- ওমা সাথে সাথে সে আমাকে এত জোরে ধমক মারলো যে আমি কান্নাকাটি শুরু করলাম। তখন সে আমাকে আদর করে শুইয়ে দিল, হাত পা মাথা টিপে দিল আর আমিও হাসলাম। কারণ আমার মা-ও ঠিক এভাবেই আদর করত।

কবির পুত্রবধূ টেবিলে নাস্তা রেখে এসে ধমক দিল ‘আপনি আবার বকবক শুরু করেছেন? আর একটা কথা বলবেন না, একদম চুপ। ধমক খেয়ে কবি একেবারে শিশুর মতো চুপসে গেল। তারপর মহিলা প্রতিনিধিদের ধমকালো ‘আপনাদেরই বা কেমন আক্কেল, দেখতেই পাচ্ছেন বয়সের ভারে কবি কোমায় চলে গেছেন কি বলেন না বলেন নিজেই জানেন না। কথা বলতে ডাক্তারের মানা অথচ আপনারা এসে তাকে বকবক করাচ্ছেন, যান বেরিয়ে যান। তারা লজ্জা পেয়ে কবিকে সালাম দিয়ে বলল ‘তাহলে আসি দাদা কবি। কবি বলল ‘আচ্ছা আসো তবে তোমরা আমার সোনালী কাবিনটা পড়ো, তাহলে বিয়ে না করেও প্রেম করার কৌশলটা শিখতে পারবে। এরপর প্রতিনিধিরা ময়মনসিংহে ফিরে গেল।

১৪

চিরকুমার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা সিরাজ হায়দার একেবারে অচল হয়ে বিছানায় পড়ে গেছেন, তিনি হাঁটাচলা করতে পারেন না। সমিতির সদস্যরা তার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে, তিনি তাদেরকে বেডরুমে ডেকে পাঠালেন। হুমায়ুন ঢাকার কারগুজারী বর্ণনা করে বলল ‘কোথাও থেকে কোন সাহায্যের আশ্বাস পাইনি, কেউ আমাদের সাহায্য করবে না। আমাদের সমিতি তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে, বিশজন সাথী জেলে পচে মরছে, এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কি আপনিই বলে দিন। সিরাজ বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলল ‘মনে করেছিলাম শেষ বয়সে একটু আরামে মরবো কিন্তু এখন তো দেখছি তোমরা আমাকে শান্তিতে মরতেও দিবে না। দেখ সারাজীবন আল্লাহর দরবারে অনেক অপরাধ করেছি। এখন আল্লাহ'র কাছে গিয়ে কি জবাব দিব তাই ভাবছি।

জীবনভর সর্বহারা করেছি কিন্তু এজন্য ভয় পাইনা। জুমা ঈদ ব্যতীত সারা জীবন নামাজ রোজা খুব কমই পড়েছি কিন্তু তজ্জন্যও ভয় পাই না। আল্লাহ মানুষকে ধনী-দরিদ্র দুই ভাগে সৃষ্টি করেছেন। প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর দুরবস্থা দেখে দুঃখ পেয়েছি, তখন আল্লাহকে বকেছি, দোষারোপ করেছি এজন্যও অবশ্য ভয় পাই না। এসব বিষয় আমি আল্লাহর সাথে বুঝা পড়া করে নেব। কারণ এগুলি আল্লার অধিকার বিধায় আমি জোর করে হলেও মাপ নিয়ে নেব। কিন্তু আল্লাহ প্রত্যেক নর-নারী সৃষ্টি করার সময়ই কার সাথে কার বিয়ে হবে তা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। কাজেই আমার সাথেও তো কোন একটা মেয়ের বিয়ের আকদটা লিখে দিয়েছেন কিন্তু আমি বিয়ে করিনি, চিরকুমার থেকেছি। কাজেই আমার জন্য বরাদ্দকৃত ওই মেয়েটিরও নিশ্চয়ই বিয়ে হয়নি, সে আমার অপেক্ষায় চিরকুমারী হয়ে রইল। এখন চিন্তার বিষয় হল- এই মেয়ে যদি আল্লার দরবারে আমাকে অভিশংসিত করে তাহলে তো আমার আর রক্ষে থাকবে না।

একটি মেয়েকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপরাধে অবশ্যই আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। এই চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে গেছি। আল্লামা হুজুরদের ডেকে এনে তওবা তাছির করছি, তাদের হাত ধরে কান্নাকাটি করছি, নফল রোজা ও তাহাজ্জুদ পড়ছি। ওই মেয়েটির অভিযোগ থেকে কিভাবে মুক্তি পাব সেই চিন্তায় আমি যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তোমরা বলখিল্লাপনা করতে এসেছ। তোমাদের মত অপদার্থরা পৃথিবীর কিছুই করতে পারবে না। এতগুলি উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মিলে কিছুই করতে পারলে না এখন আমার মত শয্যাশায়ী একজন মূমূর্ষ রোগীর কাছে এসেছ সাহায্যের জন্য, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। তোমরা ব্রহ্মপুত্রে ডুবে মর গিয়ে, আমার সামনে থেকে যাও অপদার্থের দল আর কোন দিন আসবেনা আমি তোমাদের মুখ দেখতে চাইনা বেরিয়ে যাও। আজ থেকে আমি তোমাদের সমিতি থেকে পদত্যাগ করলাম। এখন বাকি সময়টা আমি আল্লাহ বিল্লাহ করে শান্তিতে মরার একটু ফুরসত পেতে চাই।

লজ্জায় চিরকুমারদের মুখটা কালো হয়ে গেল। তারা চলে যেতে উদ্যত হতেই সিরাজ আবার বলল ‘দেখ অনেক চেষ্টা সাধনা ও অর্থ ব্যয় করে এই সমিতিটা আমি তিল তিল করে গড়ে তুলেছি। এর প্রতিটি অক্ষরে আমার রক্ত ঘাম জড়িয়ে আছে। কাজেই সমিতিটা ধ্বংস হয়ে গেলে বা কোন ক্ষতি হলে আমি মরেও শান্তি পাব না, আমি স্বর্গে গেলেও সমিতির জন্য আমার আত্না নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। তাই আমার অন্তিম সায়াহ্নে তোমাদের প্রতি আমার ওসিয়ত যেকোনো মূল্যে সমিতিটা বাঁচিয়ে রেখো, মরতে দিয়ো না। এই সমিতির মাধ্যমে আমি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকব, বলে তিনি শিশুর মতো ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন। প্রিয় নেতার কান্না দেখে হুমায়ুন জাফরসহ অন্যান্য সদস্যরা ডুকরে কাঁদতে লাগল, তারা সিরাজের পা ধরে কাঁদতে লাগলো।

সিরাজ চোখ মুছে তাদেরকে টেনে তুলে বললেন ‘যাও আমি সমিতির জন্য আশীর্বাদ করব, নফল নামাজ পড়ে আল্লার কাছে দোয়া করব। আল্লাহ এই সমিতি শুধু টিকিয়েই রাখবেন না এর উন্নতি বিধান করবেন। সমগ্র পৃথিবীতে তোমাদের এই সমিতির সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, এর আদলে দেশে বিদেশে অসংখ্য সমিতি গড়ে উঠবে। তোমরা বিশ্বাস কর আর না কর কিন্তু যদি উপহাস না কর তাহলে তোমাদেরকে একটা সুসংবাদ দিতে চাই, তোমাদের এই সমিতি একদিন নোবেল প্রাইজ পাবে। যেদিন পাবে সেদিন তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমার কবরে গিয়ে ফাতেহা খানি পাঠ করো’ বলে তিনি বিচানায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন। চিরকুমাররাও কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

এখন সমিতির সদস্য আছে মাত্র ত্রিশ চল্লিশ জনের মত, এরাই হলো প্রকৃত চিরকুমার এবং খাটি সদস্য। কিন্তু তাদের পক্ষে বাকী সদস্যদের নিয়ে মিটিং করা বা পরামর্শ সভা করা কঠিন সমস্যা হয়ে দেখা দিল। কারণ সমিতি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। আবার কারো বাসায় মিটিং করবে তো দূরের কথা অভিভাবকরা চিরকুমার সদস্য জানতে পারলে ঠেঙ্গিয়ে বাসা থেকে বের করবে। অগত্যা তারা চলে গেল ব্রহ্মপুত্রের তিরে। সেখানে সুন্দর একটা বাগান আছে, মেহগুনি আকাশী শিশু কড়ই আম জাম কাঁঠাল লিচু ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের দেশি বিদেশি গাছের বাগান। তারা এ বাগানে গিয়ে আস্তানা গারল, বিকাল থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত এই বাগানে বসে আড্ডা দেয়, পরামর্শ করে। কখনো হোটেল বয়দের মোবাইল করে এখানে বিরিয়ানি আনিয়ে খায়, কখনো যাওয়ার সময় হোটেল থেকে খেয়ে বাসায় চলে যায়। তারা বাগানে বসে বসে এই বিপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করে।

একদিন হুমায়ূন বলল ‘আচ্ছা লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবীর কাছে গেলে কেমন হয়? জাফর বলল ‘ঐ নকীবুদ্দিনের কথা বলছ, আরে ঐ ব্যাটা কি করবে সে তো একটা মূর্খ। তখন অন্যরা বলল ‘আরে না, সে মূর্খ হলে কি হবে দেশটাকে সেই ওলট-পালট করে। আমাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখালিখি করে সেই তো দেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে, নইলে ওই নারী নেত্রী আর মহিলা কর্মীরা আমাদের কিছুই করতে পারত না। এই লোককে আমাদের দলে ভেড়াতে পারলেই কেল্লা ফতেহ, আর কোন বিপদ থাকবে না। নাদিম মুস্তফা বলল ‘কিন্তু এই লোচ্চা টাকা ছাড়া দলে আসবে না, সে পাঁচ পয়সা পেলেও ঘোষ খায়। হুমায়ূন বলল, এজন্যই তো আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। সে সমিতির ক্যাশিয়ার সুভাষ চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল ‘কিরে সুভাষ পত্রিকা কেমন চলছে আর ব্যাংকেই বা কত টাকা জমিয়েছ কিছুই তো হিসাব দিচ্ছ না।

সুভাষ হাত তালি মেরে একটা হাসি দিয়ে বলল ‘আরে ফাটাফাটি অবস্থা একেবারে শাপে বর। গন্ডগোলের কারণে চিরকুমার সমিতি জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, এতে আমাদের পত্রিকার কাটতি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত তিনটি প্রেস অনবরত ছাপিয়ে যাচ্ছে তবুও চাহিদা মিটছে না। পুরান পত্রিকাও সমানতালে চলছে, ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমে গেছে। হুমায়ুন বললো ‘আচ্ছা ঠিক আছে, সুভাষ কাল তুমি নাদিমকে সাথে নিয়ে দশ লাখ টাকা তুলবে, সন্ধ্যের পর কয়েকজন মিলে লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবীর দরবারে যাব।

১৫

সন্ধ্যার পর একটা ব্যাগ হাতে তারা কয়েকজন এসে দেখল বুদ্ধিজীবীর দরবারে অনেক লোক, এ যেন লেখক সাংবাদিক কবি সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মিলন মেলা। হুমায়ুন তার পি এসকে ডেকে পরিচয় দিয়ে সাক্ষাতের অভিলাষ ব্যক্ত করল। পি এস গিয়ে কানে কানে বলল ‘স্যার সমিতির সভাপতি, হাতে ব্যাগ আছে, টাকার ব্যাগ। লাঙ্গল্যা বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মুচকি হাসলো। তারপর দর্শনার্থীদের চা খাইয়ে ও সংক্ষিপ্ত আলাপ করে তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে চিরকুমারদের ডেকে বলল, অবশেষে অরিন্দম কহিলা বিষাদে। এতদিনে লেজ গুটিয়ে আত্নসমর্পণ করতে এলে, আগে আসলে কিন্তু তোমাদের এই বিপদে পড়তে হতো না। কারণ মহিলা এমপি আর নারী নেত্রীরা মুরগির বাচ্চার মত চিউচিউ করে তোমাদের কিছুই করতে পারত না। আমিই পত্রিকায় লিখে ও টকমারানি করে জনগণকে তোমাদের বিরুদ্ধে খেপিয়েছি। কারণ তোমরা আমাকে খেরাজ দাওনি, অথচ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলি আমাকে খেরাজ দিয়ে বেঁচে আছে। এখন নিয়মিত খেরাজ দিয়ে গেলে তোমাদের আর কোন ভয় নাই কিন্তু না দিলে চিরকুমার সংঘ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যাই হোক কত টাকা এনেছ?

হুমায়ুন গর্ব সহকারে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল ‘দশ লাখ। লাঙ্গল্যা একটা উস্টা মেরে ধাক্কা দিয়ে ব্যাগটা নিচে ফেলে দিয়ে বলল, যাও মিয়া দশ লাখ টাকা তো আমার এক বউয়েরই হবে না। আমার তিন বউয়ের জন্য ত্রিশ লাখ আর আমার জন্য বিশ লাখ। এই পঞ্চাশ লাখ যদি দিতে পার তাহলে এসো নচেৎ এসো না। আর তখন তোমরাও থাকবে না তোমাদের সমিতিও থাকবে না। হুমায়ুন কাচুমাচু করে বলল ‘স্যার পঞ্চাশ লাখ দিলে আমাদের জন্য ঠিক মত কাজ করবেন তো? লাঙ্গল্যা খেঁকিয়ে উঠল ‘আরে মুর্খ কয় কি, আমি মোনাফিক না কি? আমি ঘুষ খাই এটা সরকার ও প্রশাসনসহ সবাই জানে কিন্তু এটাও জানে লাঙ্গল্যা কখনো মোনাফেকী করে না। আমি টাকা নেই কাজ করি, এজন্য এটাকে আমি পারিশ্রমিক বলি ঘোষ বলি না।

আচ্ছা বল তো আমাকে লাঙ্গল্যা বলা হয় কেন? আমি মূর্খ অশিক্ষিত, আগে হাল চাষ করতাম এ জন্য নয়। এর শানে নুযুল হলো- আগে আমি হাল চাষ করার সময় লাঙ্গল ছেড়া মেরে অন্যের ক্ষেতের আলের নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে মাটি সরিয়ে দিতাম, তারপর ভাঙ্গা আল কোদাল মেরে কেটে আমার ক্ষেত বাড়াতাম। একইভাবে এখন আমার লাঙ্গল মানে কলম দিয়ে ছেড়া মেরে সত্য হউক আর মিথ্যা হউক যে কোন মতবাদকে উল্টিয়ে দিয়ে নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করি- তা মিথ্যা হলেও। এ জন্যই দেশের সুশীল সমাজ আমার নামকরণ করেছে লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবী বলে।

আমাকে খেরাজ না দেয়ার কারণে তোমাদেরকে আমি বিপদে ফেলেছিলাম। নারী নেতৃদের আমিই উস্কে দিয়েছি। মহিলা ওসিকে আমিই পাঠিয়েছি আবার ওর বিয়েও আমিই দিয়েছি। আনন্দমোহন কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে পড়ে পারভেজকে তো তোমরা চেন, তোমাদের সমিতির সদস্য। তার চেহারা কেমন বলতো? সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ওহঃ একেবারে সালমান খান। লাঙ্গল্যা বললো ‘হ্যাঁ কিন্তু একদম গাধা, জীবনে চাকরি করতে পারবে না। এজন্য দু’জনকে ডেকে এনে ওসিকে বললাম ‘আপনার পয়সা আছে এখন নায়ক মার্কা একটা স্বামী দরকার, এই যে নায়ক এনে দিলাম। পারভেজকে বললাম ‘তোমার টাকা নাই চাকরি নাই চাকরির যোগ্যতাও নাই। কাজেই তোমার একটা পয়সাওয়ালী বউ দরকার। এই যে বউ এনে দিলাম, অবশ্য বউ তোমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবে তাতে সমস্যা নাই। কারন গোলাপের পাপড়ির মত ওর গাল এখনো ঠসঠসে, রক্ত জবার মত পুরুস্ট ওষ্ঠাধর, ডাব্বুস ডুব্বুস বুক, আরাম পাবে।

ওসি খেঁকিয়ে উঠল ‘আপনি এসব কি বলছেন আমাকে অপমান করছেন। আমিও ঝাঁজিয়ে উঠলাম ‘ঠিকই বলেছি, আমি আপনাকে বউ বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে তিন হাঙ্গাল্যা বলে অপমান করেছেন। কাজেই আমার যা খুশি বলবো বাধা দিলে পত্রিকায় বলবো, এবার আসুন। তখন তারা দুজন হাত ধরাধরি করে চলে গেল। কয়েকদিন পর তাদের বিয়ে হয়ে গেল, স্বামি পেয়ে ঐ মহিলার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আর কোন সমস্যা নাই। এখন বল বাকি টাকা কবে দেবে? হুমায়ন হাতজোড় করে বলল ‘স্যার কাল বিকালের মধ্যেই দিয়ে যাব। লাঙ্গল্যা বলল ‘ঠিক আছে। এক সপ্তাহ পর আমার সাথে যোগাযোগ করে গিয়ে ওসির সাথে দেখা করবে। সে তোমাদের অফিসের তালা খুলে দিয়ে আসবে, সেই ব্যবস্থা আমি করবো।

তারপর তোমরা মেয়েদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাও আমি আছি তোমাদের সাথে, আমিও ওদের বিরুদ্ধে। কারণ আমি এ পর্যন্ত মাত্র তিনটা বিয়ে করেছি আর একটা করার চেষ্টা করতেছি কিন্তু কেউ রাজী হয়না। যেই শুনে সেই আমাকে তিন হাঙ্গাল্যা তিন বিয়াত্যা বলে গালি দেয়। কাজেই আমিও ঐ শালিদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই। যাই হোক তোমাদের পক্ষে কাজ করার জন্য আমার দুটি শর্ত- আমাকে কচিকাঁচা দেখে একটা মেয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো আমাকে মাসে মাসে খেরাজ দিতে হবে, নইলে বউদের পোষতে পারব না। এই শর্তে কি রাজি আছ? অগত্যা সবাই বলল ‘জ্বি রাজি আছি। লাঙ্গল্যা বলল ‘এবার আসো। আমি কোন অকর্মণ্য অপদার্থ বিয়ের মুরোদ নাই এমন নপুংসকদের চা খাওয়াই না। তারপর চিরকুমাররা চলে গেল।

লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবীর তৎপরতায় গণেশ উল্টে গেল, লাঙ্গলের ফলার মতো তার ধারাল তিক্ত ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং লেখা লেখিতে নারী নেত্রীরা সব ঘায়েল হয়ে গেল। সে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রমান করলো যে, জীব বৈচিত্র্যের জন্য যদি সকল প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাহলে সমাজ বৈচিত্র্যের জন্য চিরকুমারদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ফলে চিরকুমার সমিতি হালে পানি পেল। সমিতির অফিস আবার জমজমাট হয়ে উঠল, বিরিয়ানির গন্ধ পেয়ে যুবক তরুণরা আবার এসে ভিড় করতে লাগল। এখন সমিতির অফিস কানায় কানায় ভরে গেছে, চিরকুমাররা জেঁকে বসেছে।

১৬

একদিন সভাপতি সমিতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করলো। সে বলল ‘প্রিয় কমরেডগণ, চিরকুমারত্বের মধ্যে কোনো গৌরব নাই বরং গৌরব অর্জনের লক্ষ্যে চিরকুমার থাকা। সেই গৌরবটা হলো দেশ ও জাতির সেবা করা। আমাদের সমিতির উদ্দেশ্য হলো ছেলেদেরকে নপুংশক বা খাসি বানিয়ে বীর্যক্ষয় রোধ করে বীর্যবান করে তোলা। তারপর এই শক্তি দেশ ও জাতির সেবায় ব্যয় করা। এখন সমিতির ভাগ্যাকাশ থেকে কালো মেঘে কেটে গেছে আমরা বিপদমুক্ত। কাজেই আর দেরি না করে আমরা এখনই দেশ জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চাই। কিন্তু কিভাবে করব, কি কি প্রকল্প হাতে নিতে পারি- সে বিষয়ে সমিতির গণ্যমান্য নগন্য সর্বস্তরের সদস্যদের পরামর্শ আহবান করছি। তোমরা একে একে সবাই নিজেদের মতামত পেশ কর। তারপর আমরা নীতি নির্ধারকরা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করব।

আসলে অল্প কিছুসংখ্যক সদস্য আছে যারা সমিতির অঙ্গীকার অনুযায়ী সত্যিই চিরকুমার থাকতে চায়। কিন্তু অধিকাংস যুবক তরুণের দল জুটেছে শুধু আনন্দ ফুর্তি করার জন্য, বিরিয়ানির প্যাকেটে ভাগ বসানোর জন্য। এরা হল দুষ্ট পোলাপানের দল। আর এই দলের নেতা হল কৃষি ভার্সিটির ছাত্র কামাল পাশা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলো ‘মহামান্য সভাপতি এবং অন্যান্য সদস্যবৃন্দ, আমার বাড়ি ফুলপুরের বালিয়া ইউনিয়নে। আমার বাবা একজন কৃষক, তাই কৃষি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।

আমরা জানি গ্রামের লোকেরা উৎপাদন করে আর শহুরে লোকেরা বসে বসে খায়। আর সেই খাদ্যটা বর্জ্যরুপে ট্রেনের মাধ্যমে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু তারা উৎপাদনের কোন বিনিময় দেয় না। তবে এখন থেকে দিতে হবে, আমি সেই প্রস্তাব পেশ করছি। কেউ হাসবেন না আর এটাকে ঠাট্টা-মশকরাও মনে করবেন না। আপনারা নিজেরাও গভীরভাবে চিন্তা করলে এর সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন। প্রস্তাবটা হলো মানুষের বর্জ্য উন্নত মানের জৈব সার, এটা উৎপাদনের জন্য খুবই উপকারী এবং পরিবেশ বান্ধব। তাছাড়া এটা যুগপৎ সার ও সেচের চাহিদা পূরণ করে। কাজেই শহুরে মানুষের বর্জ্য গ্রামীণ ক্ষেতে-খামারে পৌঁছে দিতে হবে এবং তা নিজ দায়িত্বে পৌঁছাতে হবে।

প্রস্তাব শুনেই আসরে হাসির হিড়িক পড়ে গেল কিন্তু বক্তা নির্বিকার বক্তব্য চালিয়ে গেল। সে বলল, কারন গ্রামের লোকেরা ফসল উৎপাদন করে নিজ দায়িত্বে শহরে নিয়ে আসে, শহরবাসীদের কখনো গ্রামের বাজারে গিয়ে চাল ডাল মাছ মাংস শাক সবজি কিনতে হয় না। ঠিক একইভাবে শহুরে লোকেরাও নিজ নিজ বর্জ্য নিজ দায়িত্বে গ্রামের ক্ষেত-খামারে পৌঁছে দিবে। যেমন তারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজ নিজ গাড়ি নিয়ে, বা রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে ক্ষেত খলায় বসে মল- মুত্র ত্যাগ করে আবার চলে আসবে। ভারতীয়দের মত একে অন্যের সামনে হাগা মুতা করবে তাতে লজ্জার কিছু নাই। কারণ যে কাজ সবাই করে তাতে লজ্জা থাকে না। তবে নারীদের জন্য ক্ষেত বা মাঠ পৃথক করে দেওয়া যেতে পারে। এটা একটা মহাপ্রকল্প, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভারত উত্তরোত্তর উন্নতি করছে। এজন্যই ভারতে কোন টয়লেট নেই, নারী-পুরুষ সবাই বাইরে গিয়ে হাগা মুতা করে।

সবাই বেদম হাসতে লাগল কিন্তু সমিতির নেতারা রাগে ফুঁসতে লাগলো। হুমায়ুন লাফিয়ে উঠে বলল ‘তোমরা পেয়েছটা কি, এটা কি কৌতুক অভিনয় কেন্দ্র নাকি? এটা সভ্য শিক্ষিত মানুষের আসর, এখানে ভদ্রলোকের মত আলোচনা করবে। আসলে এখানে অনেকেই আসে আনন্দ করার জন্য সমিতির উন্নতি-অগ্রগতি তাদের লক্ষ্য নয়, মজা করে সময় কাটানোই উদ্দেশ্য।

তখন পাশার এক বন্ধু দাঁড়িয়ে বললো ‘এখানে কৌতুকের কি পেলেন, পাশা তো ঠিকই বলেছে। শহুরে লোকেরা শুধু নির্লজ্জের মতো বসে বসে খায় কিন্তু সেই খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখে না। এখন সেই দিন হয়েছে বাসি, আর কোন ছাড় দেয়া হবে না। নিজ দায়িত্বে কৃষকের ক্ষেতে তাদের মল- মুত্র পৌঁছে দিতে হবে। ময়মনসিংহ শহরে আধা কোটি লোক বাস করে, ঢাকায় দেড় কোটি থাকে, অন্যান্য শহরেও তথৈবচ। এই বিপুল জনগোষ্ঠী যদি নিজ নিজ জেলার ক্ষেত খামারে গিয়ে বর্জ্যত্যাগ করে তাহলে হাজার হাজার টন সারের কাজে দেবে। আর মুতু করলে মাঠের মাঠ পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারবে, বন্যা ছুটে যাবে। তাতে প্রচুর জ্বালানি খরচ বেঁচে যাবে। কিন্তু নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে এটা কষ্টকর বিধায় আমার প্রস্তাব হলো আমাদের সমিতি এই প্রকল্প চালু করুক যে, শহরবাসীদের বর্জ্য প্যাকেটিং করে কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিবে।

তখন জাফর ইকবাল ধমকে উঠল ‘এই তোমরা কি ফাজলামো শুরু করেছ? তখন আরেক ছাত্র হাসি চেপে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ফাজলামো কিসের শহুরে লোকেরা শুধু বসে বসে খাবে আর গ্রামের লোকেরা বলদের মত খেটে মরবে- এটা আমাদের সমিতির নীতি হতে পারে না, এটা গণতন্ত্র না। আরেক ছাত্র বলল ‘আমাদের নেতারা সবাই শহুরে, এজন্য তাদের আঁতে ঘা লেগেছে। তখনই নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। তা দেখে সভাপতি অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা করল।

পরদিন সন্ধ্যায় আবার অধিবেশন শুরু হল। সভাপতি বিনয়ের সাথে বলল ‘প্রিয় কমরেডগণ ইয়ার্কি-ফাজলামি নয় বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা পেশ কর যাতে আমরা মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারি। কিন্তু চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী, দুষ্ট পোলাপানের দল উপদেশ শুনতে যাবে কোন দুঃখে। মাধ্যমিক পড়ুয়া এক ছেলে দাঁড়িয়ে বলল ‘আমার মা অসুস্থ বিধায় রান্নাবান্নার দায়িত্ব আমার বোনের ওপর। কিন্তু আমার বোনটা হলো পেত্নী, কখনো মাথার চুল বাধে না। ফলে প্রতিবার খাওয়ার সময় ভাত তরকারিতে চুল পাওয়া যায়। এতে আমাদের খাওয়ার খুব সমস্যা হয়। তাছাড়া মৃত্যুভয়ও আছে, কারন পেটে চুল গেলে তা হজম হয় না, নাড়ি পেঁচিয়ে খাদ্য আটকে দেয় তখন মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। কাজেই মহামান্য সভাপতির কাছে আমার প্রস্তাব হলো ‘আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে একটা বৈদ্যুতিক চিরুনি কারখানা করা হোক- যে চিরুনি দিয়ে মাথা আচড়ালে উঠন্ত চুলগুলি উঠে যাবে, তখন আর এমনিতে মাথার চুল ঝড়বে না।

আরেক ছাত্র দাড়িয়ে বলল ‘না এ প্রস্তাব কখনোই মানা যাবে না। কারণ এতে মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যাবে, মেয়েরা এই চুল দিয়েই ছেলেদের পাবনার রোগী বানায়। যেমন বাংলার চিরায়ত লোকসংগীত ‘খাইরুন লো, ও তোর লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়ে পাগল করলে দেশ। কাজেই মেয়েদের চুল হলো ছেলেদের সর্বনাশের মূল। সেজন্য আমার প্রস্তাব হলো আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে এমন একটা শ্যাম্পু উৎপাদন করা হোক যা মাথায় দেয়ার সাথে সাথে চুল উঠে টাক্বু হয়ে যাবে। তখন ছেলেরা খাদ্যমন্ত্রীর মত তাদেরকে টাক্বু চাচি বলে ডাকবে আর কেউ বিয়ের জন্য আগ্রহী হবে না। আহসান হাবিব রাগে চিৎকার করলো ‘এই তোমরা পেয়েছটা কি শুনি, এটা কি চার্লি চ্যাপলিনের প্রশিক্ষণ শালা নাকি? কর্মীরাও চেঁচিয়ে উঠল ‘কেন ওরা তো ঠিকই বলেছে, আমরা ওদেরকে সমর্থন করলাম। ব্যস শুরু হয়ে গেল ঝগড়া, সভাপতি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করল।

১৭

পরদিন সময় মতো অধিবেশন শুরু হলো। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আলী আহসান বক্তব্য শুরু করল ‘আমাদের পরিবারটা আলট্রা মডার্ন, কোনদিন ধর্মকর্ম পালন করতে দেখিনি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। আর পশ্চিমা সংস্কৃতির সংবিধান হলো মেয়েদের কটি ও বুকের উপর এক চিলতে করে কাপড় থাকবে বাকি শরীর প্রদর্শনী করতে হবে। কিন্তু পুরুষ পায়ে মোজা, মাথায় ক্যাপ ও চোখে চশমাসহ সমগ্র শরীর আচ্ছাদিত করে রাখবে, শুধু নাকটা উন্মুক্ত থাকবে। কাজেই আমাদের পরিবারের মেয়েরা বোরকা পড়বে তো দূরের কথা তাদের পোশাক দেখলে বুঝা যায়- হয় তারা অতিশয় কৃপণ অথবা দেশে কাপড়ের দুর্ভিক্ষ চলছে। আচ্ছা চলুক কোন সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা হল আমার কয়েকটা চাচাত বোন। তাদের কাপড়ের এতই সমস্যা যে বুক ঢাকতে পাড়ে না। এতে আমার চিরকুমারত্ব সর্বদা হুমকির মুখে থাকে।

যাই হোক এখন আমার প্রস্তাব হলো আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে একটা গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করা হোক। এই গার্মেন্টসে মেয়েদের জন্য পাখি জামার মত মোটা কাপড়ের ঢিলে ঢালা কারুকার্যময় আকর্ষনিয় জামা প্রস্তুত করা হবে- যাতে মেয়েরা এগুলি পছন্দ করে কিনে। আর ছেলেদের জন্য অত্যাধুনিক মানের ডিজাইন করা হাফপ্যান্ট ও সেন্টু গেঞ্জি প্রস্তুত করা হোক- যাতে তারা শিক্ষালয় অফিস-আদালত মিল কারখানা সর্বত্র জাতীয় পোশাকের ন্যায় এ সংক্ষিপ্ত পোষাক পরিধান করে পশ্চিমাদের জবাব দিতে পারে। সর্বোপরি মেয়েদের জন্য অত্যাধুনিক ডিজাইনের বোরকা বানানো হোক। কারণ মেয়েদেরকে বোরকার মধ্যে না ঢোকাতে পারলে ছেলেদেরকে চিরকুমারত্বের খোঁয়াড়ে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ওরা শিকল ছিরে হলেও মেয়েদের রসাতলে যাবেই। কাজেই আমার প্রস্তাব পাশ করা হোক।

হুমায়ন ধমকে উঠল ‘তোমরা আমাদেরকে খেলনার পুতুল পেয়েছ নাকি? আমরা বলছি দেশ-জাতি ও মানব সেবা নিয়ে আলোচনা করতে আর তোমরা বাজে অশ্লীল আলোচনা শুরু করেছ, মেয়েদেরকে নিয়ে স্ফুর্তি করছ। দুষ্ট পোলাপানের দল চেঁচিয়ে উঠলো ‘এটাই ঠিক আলোচনা, এই প্রস্তাব পাস করেন। আবার হৈ চৈ ও কথা কাটাকাটি শুরু হল, সভাপতি সমাপ্তি ঘোষণা করল।

পরদিন সভাপতি দুষ্ট সদস্যদের সুযোগ না দিয়ে নিজেই বক্তব্য শুরু করল ‘প্রিয় সভ্যগন চিরকুমার সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই হলো মানব সেবা। একজন মানুষ বিয়ে করে স্ত্রীর দাসত্ব ও খেদমত করে জীবন কাটিয়ে দেয় কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য হলো বিয়ে না করে স্ত্রীর পেছনে ব্যয়িত শক্তিটা দেশ জাতির সেবায় উৎসর্গ করা। যদি আমরা এই অবরুদ্ধ শক্তিটাকে জাতীয় খেদমতে প্রয়োগ না করি তাহলে তা বিস্ফোরণ ঘটাবে, বিয়ে করতে মন চাইবে। তাছাড়া ছেলেরা পৃথিবীতে জন্মই নেয় দাসত্ব করার জন্য, হয় সে বিয়ে করে নারীর দাসত্ব করবে অথবা দেশ-জাতির। কিন্তু নারীর দাসত্ব হল নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত কাজ আর দেশ-জাতির দাসত্ব হল গৌরব ও মহত্বের কাজ। কাজেই আমরা জঘন্য কাজ না করে গৌরবের কাজ করব- জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করব। আর এই কাজটা ময়মনসিংহ থেকেই শুরু করতে চাই।

আমরা জানি বাংলাদেশের শহরগুলির মধ্যে সব চেয়ে নোংরা ও আবর্জনাময় শহর হল ময়মনসিংহ। এজন্যই এ শহরকে দেশের ডাস্টবিন বলা হয়, দেশের সকল মশা মাছি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে, সেই সাথে ম্যালেরিয়া টাইপয়েড ইত্যাদি মশাবাহিত রোগগুলি গৃহিণীর মত আমাদের বেডরুমে ঢুকে গেছে। শহরের মানুষকে নিরাপদ ও নিরাময় রাখতে হলে এসব ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। কাজেই আমার প্রস্তাব হল, শুক্রবারে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। শুক্রবার ভোরে তোমরা সকলেই একটা করে দা ও কোদাল নিয়ে সমিতির অফিসে চলে আসবে। এখানে বিরিয়ানি খেয়ে আমরা সবাই দলবেঁধে কাজে লেগে যাব। সমিতির পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হল।

তখন এক দুষ্টু ছেলে দাঁড়িয়ে বলল ‘সভাপতির সিদ্ধান্তটা মহৎ কিন্তু সমস্যাটা বৃহৎ। কারণ আমরা কঠোর আত্মসংযম করে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে চিরকুমার থাকছি মেয়েদের দাসত্ব থেকে বাঁচার জন্য। এখন প্রস্তাবিত কাজ করলে তো সেই মেয়েদের দাসত্বই করা হলো। কারণ শহরে শুধু পুরুষ থাকে না মেয়েরাও থাকে। কাজেই শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার মানে হলো মেয়েদের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে দেয়া, অর্থাৎ তাদেরকে মাগনা কামলা দেয়া। কিন্তু আমি অন্তত মেয়েদের কামলা হতে রাজি নই। তবে দুই শর্তে রাজি আছি, হয় শহর ভাগ করে অর্ধেকাংশ মেয়েদেরকে দেয়া হোক বাকি অর্ধেকে পুরুষ থাকবে। আমরা পুরুষদের অংশ পরিষ্কার করে মেয়েদের অংশে ময়লা ফেলে দিয়ে আসব। সেখানে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া মশা উৎপন্ন হবে, মেয়েদের আক্রমণ করবে তখন তারা বিনাযুদ্ধে নিপাত যাবে।

অথবা মেয়েরা এভাবেই থাকুক সমস্যা নাই কিন্তু আমাদের মাথাপিছু একটা করে ধাড়ি মেয়ে বরাদ্দ দিতে হবে। তখন আমরা যুগল বন্দী হয়ে শহর পরিষ্কার করব, তাতে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান শ্রম ও সমান সুবিধা ভোগ করবে। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো আমাদের প্রত্যেকের মাথাপিছু একটা করে ধাড়ী মেয়ে বাজেট করা হোক। তখন দুষ্টু পোলাপানের দল সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ‘হ্যাঁ হ্যাঁ এই প্রস্তাব পাশ করা হউক। তখন আমরা যুগল বন্দী হয়ে সব কাজ করব কাউকে কিছু বলতে হবে না। সভাপতি রাগে বসে বসে ঘামছে। জাফর ইকবাল চেঁচিয়ে উঠলো ‘এই তোমরা কি মানুষ নাকি অন্য কিছু, এটা কি নৃত্য গীতের আসর পেয়েছ? এখানে কাজের কথা হচ্ছে আর তোমরা সবাই ইয়ার্কি মারছ। দুষ্টের দল চেচাতে লাগল ‘এটাই আসল কাজের কথা, এর চেয়ে বড় কোন কাজের কথা নাই। কিছুক্ষণ উল্টাপাল্টা চাপাচাপির পর সভা ভঙ্গ হয়ে গেল।

সমিতিতে বেশ কিছু মাদ্রাসা ছাত্র আছে। পরদিন এক মাদ্রাসা ছাত্র দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করল। সে বলল ‘সভ্য সমিতির সুসভ্যগন, মানবজাতির প্রত্যেকেরই একটা লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে। সাধারণত ছেলেদের উদ্দেশ্য থাকে বিয়ে করবে সংসার করবে স্ত্রীর দাসত্ব করবে। আর এ দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যই চিরকুমার সমিতির জন্ম। কিন্তু আমরা তো শুধু চিরকুমার সেজে বসে থাকলে চলবে না, অন্তত জীবন কাটানোর জন্য একটা না একটা কিছু করতে হবে। আর এ করণীয় কাজটাই হলো মানব সেবা, মানবসেবা হল ধর্মের একটা অংশ। আমরা যদি ধর্মের সেবা করি তাহলে মানবসেবাও হয়ে গেল আল্লার কাজও হয়ে গেল।

এখন প্রশ্ন হলো ধর্ম সেবার বিভিন্ন লাইন আছে আমরা কোন লাইনে কাজ করতে পারি? এ বিষয়ে আমার অভিমত হলো তাবলীগী লাইনে যাওয়াই ভালো। প্রথমে আমরা সবাই এক চিল্লা করে দিব, তারপর পালাক্রমে তিন চিল্লা দিয়ে দিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ব। আগেকার দিনের ওলি-দরবেশদের মত আমরা দেশে দেশে ইসলাম ও মানব সেবার দাওয়াত দিতে থাকব। তখন আমাদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড ওলি-দরবেশদের ন্যায় হলেও গোপন কর্মকাণ্ড হবে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান পাদ্রীদের ন্যায়। মধ্যযুগে তারা ছোট ছোট ছেলেদেরকে ধরে এনে বৈরাগ্যবাদে দীক্ষা দিত। ঠিক একইভাবে আমরাও গোপনে যুবক তরুণদের চিরকুমারত্বে দীক্ষা দিব, দেশ-বিদেশে চিরকুমার সমিতি গঠন করে যুবকদের সদস্য বানাবো। এভাবে সারা পৃথিবীতে আমাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়বে। এতে এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি শিকার হয়ে যাবে- মানব সেবা হবে, ইসলামের কাজ হবে, সেই সাথে আমাদের সমিতির কাজও হয়ে যাবে। কাজেই সভাপতির কাছে আমার আবেদন এই প্রস্তাব পাশ করা হোক।

সভাপতি বলল ‘উত্তম প্রস্তাব এবং অভিনব প্রস্তাব। এতে আমরা ইহকাল ও পরকালের সাফল্য লাভ করতে পারবো, এ প্রস্তাবে আমি অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। প্রিয় সভ্যগন আপনারা রায় প্রদান করেন। প্রতিপক্ষের একজন দাঁড়িয়ে বললো ‘হা হা এটা উত্তম প্রস্তাব তবে শর্ত হলো আমরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারব না। আমরা ধর্ম সেবা করব, সমাজসেবা করব সবই ঠিক আছে কিন্তু শর্তটা হলো আমরা জামাত নিয়ে যে এলাকায় যাব সেই এলাকার মানুষকে আমাদের থাকা- খাওয়ার দায়িত্ব বহন করতে হবে। আমি আবার মসজিদে থাকতে পারি না, কারণ স্বপ্নে শয়তান এসে শরীর নাপাক করে দেয়। কাজেই আমরা যাদের সেবা করব তারা যদি আমাদের যাবতীয় খরচ বহন করে তাহলে আমি চিল্লা দিতে রাজি আছি, ভাইয়েরা কি বল? সবাই চেঁচিয়ে উঠলো ‘ঠিক ঠিক আমরা হব তাঁদের শিক্ষক ও মুরুব্বি, কাজেই আমাদের খরচ তাদেরকেই বহন করতে হবে।

মাদ্রাসার আরেক ছাত্র দাড়িয়ে বলল ‘আমার প্রস্তাব হলো সবাই গিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করি। তাহলে এটা চিরকুমারত্বের সম্পূরক হবে। তখন সবাই উচ্চকন্ঠে হাসতে লাগলো আর হাত তালি দিতে লাগল। সভাপতি রাগে চিৎকার করল ‘তোমরা তো সমিতিটাকে তাসের আড্ডায় পরিণত করেছ’ বলে সে হনহন করে বেরিয়ে গেলো সাথে সাথে সভা ভঙ্গ হয়ে গেল।

১৮

পরদিন আগেভাগেই নেতৃ পর্যায়ের কয়েকজন আলোচনা করে আহসান হাবীবকে বক্তব্য দেয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো। সভা শুরু হলে হাবিব বক্তব্য দেওয়া শুরু করল। সে প্রথমে সমিতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করলো তারপর মানবসেবার গুরুত্ব বর্ণনা করে বলল ‘আমরা যদি মানব সেবা না-ই করি তাহলে আমাদের চিরকুমার থাকার সার্থকতা কোথায়? আমরা এভাবে নিষ্কর্মা বসে থাকলে তো পৃথিবীতে আমাদের জন্মটাই বৃথা হয়ে গেল। কত মানুষ কত কষ্ট করছে। রেললাইনে ফুটপাতে নদীর ধারে কত মানুষ নিরন্ন বিবস্ত্র হয়ে পড়ে আছে। আমরা যদি তাদের কোন উপকার না করতে পারি তাহলে মানুষ হিসাবে আমরা অভিশপ্ত। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো কাল থেকে আমরা সমিতির সদস্যরা শহরে ঘুরে ঘুরে ভাসমান মানুষের একটা তালিকা করব। তারপর রেললাইনের ধারে বা অন্য কোথাও সরকারী খাসজমি দখল করে টিনের চাপড়া বা গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করব। এরপর তালিকাভুক্ত লোকদেরকে এখানে আশ্রয় দিব। সেই সাথে মাথাপিছু বিশ হাজার করে টাকা দিব- যাতে তারা সেলাই মেশিন কিনে বা হস্তশিল্পজাত কাজ করে বা ছোটখাটো ব্যবসা করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আর এসব ব্যয় সংকলনের জন্য আমরা সকলেই চাঁদা দিব, সমিতি থেকে কিছু গ্রহণ করব আর বিত্তবানদের থেকে চাঁদা আদায় করব। কাজেই আমার প্রস্তাব হলো কাল থেকেই আমাদের কার্যক্রম শুরু করা হোক, আপনারা কি বলেন?

আসলে সমিতির সদস্যরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে এবং উচ্চশিক্ষারত। এরা ভোগ-বিলাসে জীবন কাটিয়েছে কোনদিন কষ্টের মুখ দেখেনি। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে মানব সেবা করতে হলে কষ্ট করতে হবে। শহরে ঘুরে ঘুরে নোংরা মানুষের তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হবে, তার ওপর চাদাও দিতে হবে। কাজেই এ ব্যাপারে তারা উৎসাহী হতে যাবে কোন দুঃখে? এখানে তো তারা এসেছে শুধু আনন্দ করার জন্য। তখন একজন দাঁড়িয়ে বলল ‘কাল থেকেই কাজ শুরু করতে হবে তবে শর্ত সাপেক্ষে। আমরা শুধু বৃদ্ধ পুরুষদের তালিকা করব, নারী ও অবিবাহিত ছেলেদের তালিকা করা যাবে না। কারণ নারীরা তো এমনিতেই আমাদের দুশমন আর অবিবাহিত ছেলেরা আমাদের সাহায্যে হৃষ্টপুষ্ট হয়েই বিয়ে করবে। কাজেই এদেরকে সাহায্য করা আমাদের জন্য হারাম।

সভাপতি আর সহ্য করতে পারল না। সে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করলো ‘এই বিরিয়ানি খোরের দল বের হ, এক্ষনি বেরিয়ে যা। তোরা এখানে এসেছিস শুধু বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য আর সমিতিকে বাঁশ দেয়ার জন্য। বুঝাই যাচ্ছে তোরা থাকলে আমরা কোন কাজ করতে পারব না, এখনি বেরিয়ে যা। আমরা তোদের নাম কেটে দিবো। তখনই প্রতিপক্ষের নেতা কামাল পাশা দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ‘দেখলে দেখলে ভাইরা, ওদের সাহস কত বড় বাড়িওয়ালার বাড়ি না উদ্বাস্তু কয় চিনি না। ওরা উচ্ছন্নে যাওয়া কয়েকটা বখাটে সমিতিটা দখল করে লুটেপুটে খাচ্ছে আর আমাদের ওপর নেতাগিরি ফলাও করছে। ওরা ওপরে ভান করে চিরকুমার অথচ সমিতির টাকায় মেয়ে নিয়ে হোটেলে রাত কাটায়।

এ কথা বলার সাথে সাথে প্রকৃত চিরকুমাররা ক্ষেপে গেল। কিন্তু সংখ্যায় তারা মাত্র ত্রিশ চল্লিশ জনের মতো আর প্রতিপক্ষরা কয়েকশ। নেতারা চিৎকার করলো ‘এই তোরা সমিতি থেকে বেরিয়ে যা। কামাল পাশা চিৎকার করলো ‘সমিতি কারো বাবার তালুকদারি না। তোরা এসেছিস সমিতির টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার জন্য, তোরা থাকলে সমিতি ধ্বংস হয়ে যাবে, তোরা এক্ষন বেড়িয়ে যা সমিতি আমরা চালাবো। তারপর সে ছাত্রদের উসকে দিল ‘ভাইয়েরা এই লুটেরাদের বের করে দাও, আমাদের ওপর ওদের নেতাগিরি করার কোন অধিকার নেই। ওদের তাড়িয়ে সমিতি আমরা চালাবো, আক্রমণ কর। সাথে সাথে প্রতিপক্ষ ছাত্ররা নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা করল, কিলাকিলি মারামারি ধুন্ধুমার কান্ড। তখন নিরপেক্ষ ছাত্ররা উভয় দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া থামিয়ে দিল। তারপর একে অন্যকে গালাগাল করতে করতে সবাই চলে গেল।

সিরাজ হায়দার কিছুদিন পূর্বে মারা গেছে, তার সকল সম্পদ সমিতির নামে উইল করে দিয়ে গেছে। কাজেই সমিতির সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করার মতো আর কেউ নেই। অগত্যা নেতারা পরামর্শ করল প্রতিপক্ষ ছাত্ররা সংখ্যায় বেশি ওদের সাথে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। কাজেই ওদের সাথে আপোষ রফার মাধ্যমে চলাই ভালো। আগামী বছর সম্মেলনের সময় সুযোগ বুঝে এদের নাম কেটে বের করে দিলেই হবে। ওদিকে প্রতিপক্ষরা সমিতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে, এখন তাদের বিরিয়ানির সাথে সাথে অন্যান্য খাবার যুক্ত হল। সেই সাথে কয়েকদিন পর পর বিভিন্ন শিল্পীর সংগীতানুষ্ঠান। আনন্দ স্ফুর্তি নিয়মিত চলতে লাগলো, মানব সেবার আলোচনা গোল্লায় গেল। সভাপতি ও অন্যান্য নেতারা কম আসে, আর আসলেও কোণঠাসা হয়ে বসে থাকে কোনো উচ্চবাচ্য করে না।

শ্রাবণ মাস। নাগাতার কয়েকদিন বৃষ্টি হলো, তার উপর ভারতীয় পানিতে বাংলাদেশ ভাসছে। জামালপুর-শেরপুর ও উত্তর চরময়মনসিংহ বন্যায় তলিয়ে গেছে। সভাপতি জরুরি অধিবেশন আহ্বান করে বলল, ‘প্রিয় ভাইয়েরা, চিরকুমার সমিতির উদ্দেশ্যই হলো মানব সেবা কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে আজ পর্যন্ত আমরা দেশ-জাতির জন্য কিছুই করতে পারিনি। এখন দেশ পানিতে ভাসছে, বিপন্ন মানুষের আর্তনাদে পাষাণ গলে যাচ্ছে। এ অবস্থায়ও যদি আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে আমরা শিক্ষিত তো দূরের কথা মানুষ হিসাবেই গণ্য হব না। কাজেই এসো বিপন্ন মানবতার সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করি। এখনই প্রমাণ করার উপযুক্ত মওকা যে চির কুমাররাই হল প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও মানব সেবক। সুতরাং আমার প্রস্তাব হলো আর দেরি না করে এখনি বন্যার্ত মানুষকে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, এ বিষয়ে আর কোন ইয়ার্কি ঠাট্টা না করে সবাই সুচিন্তিত মতামত পেশ কর।

এক দুষ্ট ছেলে দাঁড়িয়ে আগের মতোই বলল ‘হাঁ বিপন্ন মানুষের সেবা করতে আমরা রাজি আছি তবে অবিবাহিত যুবক যুবতীদের বাদ দিয়ে--- তখনই প্রতিপক্ষ দলের লিডার কামাল পাশা লাফিয়ে উঠে প্রতিবাদ করল ‘না না ভাই, অনেক ইয়ার্কি ফাজলামো হয়েছে আর নয়। বন্যার্তদের করুন দূরাবস্তা আমি নিজের চোখে দেখেছি, এ অবস্থায়ও যদি আমরা তাদের সাহায্যে হাত না বাড়াই তাহলে আমরা আর মানুষ থাকলাম কোথায়? সে তার উপদেশমূলক বক্তব্য চালিয়ে গেল। ওদিকে জাফর সভাপতির কানে কানে বলল ‘দায়িত্বটা নিজে না নিয়ে ঐ পালের গোদাটার উপর ছেড়ে দাও, তাহলে সবাই ঠিকমতো কাজ করবে। তখন সভাপতি বলল ‘কামাল পাশা এ কাজের দায়িত্ব ভার তোমার উপর অর্পণ করা গেল, তুমি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

পাশা সলজ্জ হাসি হেসে হাত জোড় করে বলল ‘না না ভাইজান। আপনি শুধু আমাদের সভাপতি নয় সিনিয়র বড় ভাইও। আগে জাস্ট আনন্দ করার জন্য আমরা ইয়ার্কি ফাজলামো করেছি আপনি মাফ করে দেন। কিন্তু এখন আর ইয়ার্কির সময় নাই, আমরা আন্তরিকভাবে বন্যার্তদের সাহায্য করতে চাই আপনি আমাদের পরিচালনা করুন। হুমায়ুন খুশি হল, তারপর কিছুক্ষণ আলোচনা করে দুই শত প্রতিনিধি দল তৈরি করা হলো, প্রত্যেক দলে সদস্য সংখ্যা তিন- চারজন। একশ দল উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় চলে যাবে আর একশ দল বাস ট্রেন ও বিত্তবানদের থেকে চাঁদা তুলবে, বিভিন্ন উৎস থেকে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করবে, প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী বাজার থেকে কিনবে, তারপর সেগুলি উদ্ধার কর্মীদের হাতে পৌঁছে দিবে। আবার তাদের শিবিরে আশ্রিত শরণার্থীদের সহযোগিতা করবে।

প্রত্যেক দলে তিন- চারজন করে সদস্য, তাদের মধ্যে একজনের দায়িত্ব হলো শুধু ফটো ও ভিডিও করা। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পুরোদমে চলতে লাগলো। অতিশয় বুদ্ধিমান সভাপতি নেতা পর্যায়ের দশ সদস্য বিশিষ্ট একটা কমিটি গঠন করে দিল, তাদের কাজ হল সমিতির কার্যক্রম প্রচার করা। উচ্চশিক্ষিত এই সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের ফটো ও ভিডিও গুলি পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিল। তাতে সারা দেশে চিরকুমারদের কার্যক্রম নিয়ে বাহবা পড়ে গেল। সবাই প্রশংসা করতে লাগলো। আগে তাদের সম্পর্কে জনগণের যে নেতিবাচক মনোভাব ছিল তা কেটে গিয়ে প্রশংসায় রূপান্তরিত হলো। চিরকুমার সংঘের উপর দেশে ধন্য ধন্য পড়ে গেলো।

এই সুযোগে চিরকুমার কর্তৃপক্ষ জেঁকে বসল। তারা গ্রীষ্মকালীন চিরকুমার বার্তা বের করল, তাতে বন্যার্তদের সাহায্যের বিবরণ ও চিত্রগুলি দিয়ে বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করলো। সেই সাথে মানবসেবায় তাদের কার্যক্রমের বিশাল কাল্পনিক ফিরিস্তি তুলে ধরল। এতে মানুষ চিরকুমার সমিতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করল, শত্রুদের মুখে চুনকালি পড়লো, নারী নেত্রীরা পিছু হটল। ওদিকে লাঙ্গল্যা বুদ্ধিজীবীকে সমিতি থেকে মাসে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা খেরাজ দেয়া হয়। সে পত্র-পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে চিরকুমারদের পক্ষে ওকালতি করে যাচ্ছে। ফলে দেশের সর্বত্র চিরকুমার সমিতির জয়জয়কার, মুখে-মুখে প্রশংসা। দেশ-বিদেশে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ল।

চিরকুমারদের এখন আর কোন শত্রু নাই, তারা আরাম আয়েশে দিন কাটায়। বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমিতিতে খাওয়া-দাওয়া ও সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। দিনের বেলা তারা বাসায় বা বাইরে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেয়, গল্প গুজব করে সময় কাটায়। এখন আর তাদের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নাই। কাজেই তারা চিরকুমারত্বের ওপর আরো দৃঢ়ভাবে শপথ গ্রহণ করল। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের আসল চ্যালেঞ্জটি তাদের নাক বিঁধাবার জন্য ওৎ পেতে বসে রইল।

বিষয়: সাহিত্য

২৬০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File