কবর-৭৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০৮:৩০ দুপুর

মা

২৫ জুলাই। হাসানের বৃদ্ধা মা দুশ্চিন্তায় বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে ঘুমিয়ে পরলেন। কিন্তু মধ্য রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি উঠে গিয়ে অযু করে এসে তাহাজ্জুদে দাঁড়ালেন। নামায পড়ে ছেলের মঙ্গলের জন্য, সুষ্টুভাবে বউ ফিরে আসার জন্য, ছেলের প্রতি বউয়ের মনের টান পয়দা হওয়ার জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করলেন, অনেক কান্নাকাটি করলেন। বাকী রাত জায়নামাজে বসে দোয়া ইউনুস পড়ে কাটালেন। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলে মিলে কয়েক খতম দোয়া ইউনুস পড়া হয়ে গেছে।

২৬ জুলাই, ২০০৬ সাল। তিনি কোনরকম ফজরের নামাজটা পড়েই বাড়ি মাথায় তুললেন। ছেলেদেরকে ডাকাডাকি হাকাহাকি শুরু করলেন, এই তোরা তাড়াতাড়ি বাজারে যা, হাসানের কাছে কল কর গিয়ে। খবর বার কি, বউয়ের খবর কি তাড়াতাড়ি জেনে আয়। উল্লেখ্য তখনো গ্রামে মোবাইল পৌঁছেনি। দোকানের মোবাইলে ঠেকা কাজ চালানো হত। ছেলেরা মাকে ধমক দিল, ‘আপনের শইল্যে (শরীরে) কোন আন্দাজ বরাদ্দ আছে নাকি, জানেন না, দশটার আগে বাজারের কোন দোকান খুলে না, এখন গিয়ে কী করব। তাছাড়া আজ রাতে পীর সাব যাওয়ার কথা। গিয়ে আলাপ সালাপ করে মীমাংসা করতে করতেও তো রাত হবে। রাতের আগে মোবাইল করেও তো কোন খবর পাওয়া যাবে না। আপনে খালি তাড়াহুড়া করলেও তো কোন লাভ নাই’। মা জানেন দশটার আগে দোকান খুলে না কিন্তু তিনি ধৈর্য্য ধারণ করতে পারছেন না, ঘরে উঠানে দৌড়াদৌড়ি করছেন পায়চারি করছেন, স্থির হয়ে বসতে পারছেন না, অস্থির হয়ে উঠেছেন।

তারপর কোন রকম নয়টা বাজতেই এক ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে বাজারে পাঠালেন আর বলে দিলেন, গিয়েই কল করবি, খবরটা জেনে সাথে সাথে বাড়িতে আসবি, বাজারে দেরি করবি না, তারপর তিনি খবরের অপেক্ষায় দম বন্ধ করে বসে রইলেন। ছেলেটা বাজারে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপর কল করে কিন্তু নারী কণ্ঠ বেজে উঠে আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি বন্ধ আছে। সে ভাবছে ভাই হয়ত মোবাইল বন্ধ করে বসে আছে অথবা চার্জ নাই। তাই মোবাইল অন করার অপেক্ষায় বসে থাকে আর কিছুক্ষণ পরপর ট্রাই করতে থাকে। আসলে ডঃ পটেটো তালাকের দিন মোবাইলটা নিয়ে হাসানের সিম ফেলে দিয়ে নতুন সিম ভরে তার সুন্দরী বউ নূরানিকে উপহার দিয়েছে। কাজেই ট্রাই করে লাভ নেই। কিন্তু ছেলেটা ভাইকে পাওয়ার আশায় বারবার কল করেই চলল।

জহুরের আযান দিয়েছে, মা পাগল হয়ে উঠেছেন, তিনি বাড়ি শুদ্ধু ছোটাছোটি করছেন আর ছেলেদের উপর বৃষ্টির মত গালি বর্ষণ করছেন। তারপর এক ছেলের কাছে গিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘এই এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টোয়ার মত কি দেখছিস তাড়াতাড়ি যা, গিয়ে দেখ ঐটা কি বাজারে গিয়ে মরল নাকি, সেই সকালে গেছে এখনো খবর নাই। ওকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসবি, যা জামালপুরে কি হল না হল আমাকে আধা ঘন্টার মধ্যে এসে খবর জানাবি’।

কিন্তু সেও গিয়ে উধাও হল। আসরের আযানের সময় দুই ভাই গুমরাহ মুখে বাড়িতে এসে হাজির হল। ইতিমধ্যে মায়ের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে গিয়েছে। তারা আসার আওয়াজ পেয়ে তিনি ঘর থেকে দৌড়ে বেরুলেন, রাগে দিশা না পেয়ে হাতের কাছে একটা কাঠের টুকরা পেয়ে তা নিয়ে আগে পাঠানো ছেলের পিঠে ধপাস করে একখান বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোকে কখন পাঠাইছি এতক্ষণে কেন? ছেলে দু’টি পিটনার ভয়ে মায়ের কাছ থেকে ছিটিয়ে সড়ে গেল। তারপর তারা মায়ের কাছ থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে রাগ দেখায়, হাসে আর বলে, আমি কি করব, সেই সকাল থেকে কল করতেছি কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ। তাকে পাওয়ার জনই তো এত দেরি হল। মোবাইল বন্ধ শুনে মা থমকে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেন মোবাইল বন্ধ কেন? এক ছেলে বলল, কি জানি তার তো অভ্যাস দু’দিন পর পর মোবাইল হারায়, না হয় চোরে নেয়। এখনো হয়ত হারাইছে না হয় চোরে নিছে। নইলে তো সারাদিন মোবাইল বন্ধ থাকার কথা না।

মায়ের মাথায় বাজ পরল, এখন তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। হঠাৎ বললেন, এই চল, আমাকে জামালপুর নিয়ে যা, যা করার আমিই গিয়ে করব। ছেলেরা হাসতে লাগল, ‘আপনে গিয়ে কি করবেন, আজ তো পীর সাবই যাইতেছে। কিছুক্ষণ পর তো পীর সাবের কাছেই খবর পাওয়া যাবে’। মা বললেন, ‘এই পীর সাবের চিন্তা বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে চল, আমি গেলে কবেই মীমাংসা হয়ে যেত, এত গন্ডগোল হতে পারত না’। ছেলেরা বলল, ‘এখন আপনের যাওয়ার কোন মানে হয়, এখন তো পীর সাবই গেছে, যা করার সেই করবে। আর কি হল না হল পীর সাবের কাছে কল করলে তো এখনই জানা যাবে। পীর সাব কিছু না করতে পারলে আপনে কাল যান। কাল আপনেরে নিয়া যাব নে’। কথাটা মায়ের কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে যা, পীর সাবের কাছে কল কর গিয়ে। যদি তিনি কিছু না করতে পারেন তাহলে আমি রাতেই যাব। কল করে সাথে সাথেই বাড়িতে আসবি, দেরি করিস না’।

একজন রওয়ানা হল, বাড়ি থেকে বাজার দেড় মাইল দক্ষিনে, মাগরিবের পর গিয়ে সে বাজারে পৌঁছল। পীর সাবকে কল করতেই তিনি বললেন, ‘আমি আসতেছি রাস্তায় আছি, অপেক্ষা কর, সাক্ষাতে আলাপ হবে’। পীর সাবের প্রাইভেট কার আছে। ছেলেটা ভাবল, প্রাইভেট কারে জামালপুর থেকে বাজারে পৌছতে আর কতক্ষণ লাগবে, বড় জোর ঘণ্টা খানেক। সে বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে এশার আযান শুরু হয়েছে, মা আরো অস্থির হয়ে উঠলেন। তখন মোবারক বাড়িতে ছিল, তাকে কয়েকটা ধমক দিয়ে বললেন, তোরা সবগুলি ছেলে এমন অকর্মন্য। একটাকে কখন বাজারে পাঠালাম এখনো তার খবর নাই। কোন কিছুই গায়ে মাখে না। তুই তাড়াতাড়ি যা, খবরটা জেনে এসে এক্ষুনি আমাকে জানা।

মোবারক এশার পর গিয়ে বাজারে পৌঁছল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পীর সাব এলেন, চেম্বারে গিয়ে বসলেন। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘কি আর করা যাবে ভাগ্যের উপর তো আর মানুষের হাত থাকে না, আমারও তো চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমি ছাব্বিশ তারিখে বসার তারিখ দিয়েছিলাম কিন্তু তারা কিছুই মানল না, আমাকেও মূল্যায়ন করল না। আমি পাটগুদাম মাদরাসায় গিয়েছিলাম, সেখানকার শিক্ষকরা বলল, আমি যাব শুনেই নাকি তারা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তেইশ তারিখ বিকালে জোরপূর্বক তালাক নিয়ে নেয়, বাচ্চা দিয়ে দিয়েছে। আর পরদিনই নাকি কোন ভার্সিটির শিক্ষকের সাথে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। কি করা যাবে, সবই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা’ বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন।

ছেলেরা বাড়ির দিকে চলল, তারা গম্ভীর নির্বাক, কেউ কারো সাথে কথা বলে না। মুখ শ্রাবনের আকাশের মত থমথমে হয়ে আছে। তারা বাড়িতে গিয়ে মাকে ঘটনা জানালো কিন্তু মা কিছুই বললেন না, কাঁদলেন না, শুধু গৃহপালিত প্রাণীর মত ফ্যালফ্যাল করে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যে মা কোন কিছু হলে ছেলেদের গালাগালি করেন, মারেন, শাসন করেন এতবড় দুঃসংবাদে তার মুখে কোন রা নেই, ভাষা নেই শব্দ নেই, কান্না নেই, অশ্রু নেই। তিনি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন আর বোবা প্রাণীর মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কিন্তু মায়ের এই নীরবতা ছেলেদের চোখে আশুর বান ডাকল। মা অনেকক্ষণ এভাবে নির্বাক বসে থাকার পর এক সময় বিছানায় গড়িয়ে পরলেন। হাসানের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার মধ্যে এই ব্যধি দেখা দিয়েছে। কোন দুঃখের সংবাদ শুনলে তিনি কথা বলতে পারেন না, কাঁদতে পারেন না, চিন্তাও করতে পারেন না। শুধু পাথরের মূর্তির মত বসে থাকেন আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

রাতে খাবার সময় মেজ ছেলের বউ মায়ের জন্য ভাত বেড়ে নিয়ে এল, ডাকাডাকি করল। ছেলেরা এসে ডাকল, কিন্তু তিনি সাড়াও দিলেন না, হু- হাও করলেন না, তার কোন চেতনা নেই, বেহুশের মত বিছানায় পড়ে আছেন। মেজ ছেলে বউকে বলল, ভাত বেড়ে রেখে যাও, শরীরটা ঠিক হলে উঠে খেয়ে নেবে নে খন। তারপর তারা চলে গেল। মধ্য রাতে মায়ের স্বাভাবিক চেতনা ফিরল, তিনি উঠে বসলেন, নিথর হয়ে কিছুক্ষণ খাটের উপর বসে থাকলেন। তারপর খাট থেকে নেমে ঘরে বাইরে বারান্দায় উঠানে অন্ধকারে পাগলের মত ঘুরতে লাগলেন। ঘুরতে লাগলেন তিনি সেই সাপের মত যে নিজের মস্তকস্থ মণি হারিয়ে পাগল হয়ে ছোটাছোটি করে। আজ তার আর তাহাজ্জুদ পড়া বা তাসবীহ পড়ার মত হুশ জ্ঞান নেই। অবশেষে ফজরের আযান দিল। সাথে সাথেই তিনি নামায পড়ে গিয়ে পাশের দরজায় হাত মারতে মারতে ডাকতে লাগলেন, ‘এই মোবারক মোবারক উঠ, তাড়াতাড়ি উঠ’। ডাকাডাকি শুনে ছেলেরা সবাই উঠল। তিনি মোবারককে বললেন, চল জামালপুর চল। ছেলেরা বুঝল এখন মাকে মানা করলেও মানবে না আর এখন যাওয়া দরকারও বটে। তারা মোবারককে বলল, তুইই যা, তুই তো আগে কয়েক বার গিয়েছিস, পথ- ঘাট, বাসা সব তোর চিনা।

মোবারক প্রস্তুত হল, সাথে পর্যাপ্ত টাকা নিল। তারপর তিন ছেলে মাকে নিয়ে বের হল। একজন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল, সামনে একটু দুরেই এক বাড়িতে রিকশা ওয়ালা আছে। তাকে ডেকে তুলে নিয়ে এল। তারপর মায়ের সাথে মোবারক রিকশায় চড়ে বসল, তখনো রাতের অন্ধকার কিছুটা রয়ে গেছে। মা সারা জীবন গায়ে কাটিয়েছেন। কোন দিন গাড়ি ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস ছিল না। আগে একবার মাকে নিয়ে মোবারক ভাইয়ের বাসায় এসেছিল। তখন তার মাথা ঘুরাতে ঘুরাতে কয়েকবার বমি হয়েছিল, আধা বেহুশের মত হয়ে গিয়েছিলেন। তখন সে এক বাসায় গিয়ে মাকে বিশ্রাম করিয়ে বাতাস করতে করতে কোন রকমে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ তারিখে মায়ের কোন সমস্যা হয়নি, কারণ তিনি আগে থেকেই আধা বেহুশ হয়ে ছিলেন, ভ্রমনের ক্লান্তি তার মধ্যে কোন প্রভাব ফেলেনি।

২৭ জুলাই এগারটার দিকে তারা এসে বাসায় পৌঁছল কিন্তু বাসার সামনে পৌঁছেই হতবাক হয়ে গেল, কারণ বাসার দরজা খোলা। ভিতরে ঢুকে বিস্ময়ের আর সীমা থাকল না, কেউ নেই নীরব নিথর। কিচ্ছু নেই, ফাঁকা খোলা উন্মুক্ত বাসা। হান্ডি পাতিল, কাপড় চোপড়, আসবাব পত্র, চেয়ার টেবিল কিচ্ছু নেই। শুধু বিছানাহীন ফাঁকা খাট, তার উপর কিছু বই কিতাবাদি এলোমেলো হয়ে আছে, আর কিছু পুরাতন কাপড় চোপড় বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে এটা কার বাসা আমাকে কোথায় নিয়ে এলে। বাসার জিনিস পত্র কই, হাসান কই’? মোবারকের মস্তকে যেন বজ্রপাত ঘটল। তার বুঝতে বাকী নাই, ভাই কোথাও চলে গেছে, হয়ত দরজা খোলা ফেলে গেছে। আর এই সুযোগে বাসার মালামাল লুট হয়ে গেছে কিন্তু মাকে কিছু বলার সাহস পেল না। মা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকার মত শুধু চারপাশে তাকাচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না এটা কার বাসা, মানুষ কই, জিনিস পত্র কই, নাকি শহরের বাসাগুলি এমনই থাকে।

মোবারক মাকে বলল, আপনে বসেন, আমি একটু খোজ নিয়ে আসি। সে বাইরে গিয়ে আশ পাশের লোক জনকে ডাকল বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করল কিছু মানুষ জড়ো হল । কিন্তু যারা ফাঁকা বাসা থেকে উপকৃত হয়েছে তারা দুরে সটকে পড়ল। উপস্থিতদের মধ্যে একেক জন একেক মন্তব্য করল। কেউ বলল, বাসার দরজা তো গতকাল থেকেই খোলা দেখছি, কেউ বলল, না আজ সকাল থেকে দরজা খোলা পড়ে আছে। কেউ বলল হাসান সাবকে তো কালও বাসায় দেখেছি। কেউ বলল, না তিনি কয়েকদিন ধরে নেই। আর কেউ কেউ কিছুই বলতে পারল না। অনেকেই ইচ্ছামাফিক মন্তব্য করতে লাগল। অবশেষে মোবারক বুঝতে পারল তার ভাই গত কাল অথবা গত রাত থেকে বাসায় নেই। বাসার দরজা খোলা রেখেই কোথাও চলে গেছে। এবার মোবারক চিন্তায় পরে গেল মাকে কি বলবে। হাসানের খোজ নাই একথা বললে চিৎকার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। তাই সে ভিতরে গিয়ে বলল, ভাই মনে হয় মুনিরাকে নিয়ে কোথাও গেছে। আর রাতে খালি বাসা পেয়ে চোরেরা দরজা ভেঙ্গে সব কিছু নিয়ে গেছে। চলেন ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় যাই, সেখানে গেলেই তার সন্ধান পাওয়া যাবে।

সহসা নৈরাশ্যে মায়ের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। তিনি আরো গম্ভীর হয়ে উঠলেন, মুখটা থমথম করছে, আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘এ কেমন কথা, বাড়িতে যায়নি তো আর কোথায় যাবে? মোবারক বলল, চলেন ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গেলেই খোঁজ পাওয়া যাবে। এরপর রিকশা নিয়ে তারা বাসায় পৌঁছল কিন্তু দরজা বন্ধ। মা দরজায় কয়েক টোকা দিতেই ফেরদৌসির মা এসে দরজা খুলল। তিনি নিরহঙ্কারী সহজ সরল মানুষ। হাসানের মাকে দেখেই সালাম দিয়ে মোসাফাহা করলেন। তিনি বিয়ানের হাত ধরেই আর্তনাদ করে উঠলেন, বিয়াইন আমার ছেলে কই। তিনি বললেন, আপনার ছেলে কই আমি কি জানি। - আপনারা জানবেন না তো কে জানবে। সে তো বাসায়ও নেই বাড়িতেও যায়নি। - তাতে আমাদের কি, আমরা কি করব।– আপনারাই তো করেছেন। আমার ছেলের কাছ থেকে জোড় করে তালাক নিয়ে বউটাকে অন্য খানে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার ছেলে কোথায় গেল নাকি আপনারা কিছু করেছেন।

ফেরদৌসির বড় বোন মাজেদা ওরফে বড়াপা সামনেই খাটের উপর বসা ছিল। কথাটা শুনেই রেগে গেল। হুট করে এসে হাসানের মায়ের মুখের উপর ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তিনি দরজায় হাত মারতে মারতে চিৎকার করতে লাগলেন, বিয়ান বিয়ান, দরজা খোলেন, আপনারা আমার ছেলেকে কি করেছেন, আমার নাতনি কোথায় কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। দরজা বন্ধ করে দেয়াতে মায়ের সন্দেহ প্রবল হয়ে উঠল, তিনি অসহায় হয়ে মাটিতে বসে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন আর বসে বসে দরজায় হাত মারতে মারতে বলতে লাগলেন, ‘বিয়ান বিয়ান, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে দরজা খোলেন, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে বলেন আমার ছেলে কোথায় আছে। আল্লাহ্‌র দোহাই, আমার ছেলেকে ফিরায়ে দেন বলতে বলতে তিনি মাটিতে বসে শিশুদের মত পা আঁচড়াতে লাগলেন আর দরজায় হাত মারতে লাগলেন।

মোবারক কাঁদতে কাঁদতে এসে মায়ের হাত ধরে বলল, আসেন যাই গা, এখানে থেকে লাভ নাই। মা তাকে এমন জোরে ধাক্কা মারল যে, ছেলেটা টাল সামলাতে সামলাতে গিয়ে অনেকটা পিছনে দাঁড়াল। মা দরজায় হাত মারতে মারতে সর্বরিক্তের মত করুণ কণ্ঠে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘বিয়ান বিয়ান দরজা খোলেন, একটু দরজাটা খোলেন। আপনেরা আমার ছেলেকে কি করেছেন, নাকি মেরে ..... কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না। তার কণ্ঠ আটকে এল। ক্ষণকাল মুখ হা করে দম বন্ধ হয়ে থাকল, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়লেন, দুই হাত নাকে মুখে মাথায় ও মাটিতে মারতে লাগলেন আর বুক ফাটা বিলাপ শুরু করলেন, ‘হায় আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ গো, ওরা আমার ছেলেকে কি করেছে, ও আল্লাহ্‌ গো ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমারে ইয়াতিম বানায়া দিছে, আমারে নিঃস্ব বানায়া দিছে---- এরপর তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। শুধু নাকে মুখে শরীরে ও মাটিতে হাত মারার ঢোস ঢাস শব্দ ও গলা দিয়ে মুমূর্ষু প্রাণীর ন্যায় একটা গড়গড় আওয়াজ বেরুতে লাগল। মধ্যাহ্ন দুপুর, মায়ের উষ্ণ আহ ও আর্তনাদ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে উঠে। মায়ের অশ্রু ঝরে পড়ে পৃথিবীর মাটিতে। প্রকৃতি কেঁপে উঠল, পৃথিবী দুলে উঠল।

মোবারক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মাজেদা ওরফে বড়াপা এই অবস্থা দেখে ইঞ্জিনিয়ারকে ধমকে উঠল, আরে তুমি এখনো যে বসে আছ। উঠ, তাড়াতাড়ি যাও, এই বুড়িটাকে ঘাড় ধরে বের করে দাও গিয়ে। এখানে এসে নাটক শুরু করেছে। ইঞ্জিনিয়ার তার বউয়ের মত হিংস্র ছিল না। সে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘আরে থাক না, মুরুব্বী মানুষ, অপমান করার দরকার নাই, কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে তো চলেই যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি, ঐ হারামিটা বাড়িতেও গেল না এখানেও নাই তাহলে গেল কোথায়। তার বউ বলল, কোন ভাগাড়ে গিয়ে মরে পড়ে আছে কে জানে, আচ্ছা আবার আত্মহত্যা করে বসল না তো? ইঞ্জনিয়ারের ললাটে বলিরেখা ফুটল, তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলল, অসম্ভব কিছু না। তালাকের পর তাকে কেমন দেখেছিলাম জান, আগুনে কারো বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান সব পোড়ে ভস্ম হয়ে গেলে মানুষ যেভাবে হাবলার মত বসে থাকে, ডগডগ করে তাকিয়ে থাকে, কথা বলতে পারে না, তাকেও তেমনি মনে হয়েছিল। কিন্তু মরলেও তো বাচ্চাটার অন্তত কোন গতি করবে, বাচ্চাটা কোথায় রাখল। তার বউ বলল, মরলে তো বাচ্চা নিয়েই মরবে। কেন পত্রিকায় দেখ না নিউজ আসে, সন্তানকে মেরে তারপর বাবা বা মা আত্মহত্যা করে। যেমন কুকুর তেমন শিক্ষা, আমরা শর্ত দিলাম সাল চিল্লা দিতে আর হারামজাদা বুক ফুলিয়ে ঘোরে বেড়ায়। এখন বুঝুক মজা। আমার মনে হয় মরে গেছে। আর মরুক বাঁচুক তাতে আমাদের কি, কুত্তাটা মরলেই আমি খুশি।

ইঞ্জিনিয়ার বলল, এত খুশি হয়ো না, সমস্যা আছে। আমরা কিছু জানি না, এরপরেও দেখলে ওর মা ভাই কিভাবে বাসায় এসে আমাদেরকে দোষারুপ করছে। এখন সত্যি সত্যিই যদি মরে যায় তাহলে কি মনে করেছ ওরা আমাদেরকে ছাড়বে নাকি। যদি মামলা ঠুকে দেয় তাহলে আমরা ফেঁসে যাব। মামলার কথা শুনে সহসা মাজেদার মুখটা কাল হয়ে গেল। সে একটা ঢোক গিলল এবং গলায় হাত বুলাল যেন গলায় ফাসির রশি ঝুলে আছে। আর কোন কথা বলতে তার প্রবৃত্তি হল না, উঠে পাশের রুমে চলে গেল। পা কাটা পঙ্গু ছেলে দারদা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। ছোট দু’টি বাচ্চা দরজা খোলে দেখতে চাইছে কিন্তু তাদের নানি আটকিয়ে রাখছে। বড় মেয়েটা জানালা দিয়ে দেখছে আর কাঁদছে। মাকে দেখেই বলল, আম্মা বুড়ি মানুষ এভাবে কাঁদছে, দরজাটা খোলে দাও ঘরে আসুক। তার মা ভেংচি কাটল, ‘আহ কি আমার দরদীটা গো, দরজা খোলে দাও, যা তুই, এত দরদ দেখাতে হবে না। ইঞ্জিনিয়ার আর তার বউ যেমন খবিস তার পোলাপানগুলিও হয়েছিল তেমনি খবিস কিন্তু বড় মেয়েটা ছিল ব্যতিক্রম, যথার্থ মনের অধিকারী। ছেলে মেয়েদের মধ্যে এ মেয়েটাই যথার্থ মানবিক হৃদয়ের অধিকারী। মায়ের ধমকে লজ্বিত হয়ে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল আর দোয়া করতে লাগল, ‘আল্লাহ্‌ খালু যেখানেই থাকুক, তাকে সুস্থ রাখো, তার মায়ের কাছে এনে দাও’।

হাসানের মা আর্তনাদ করেই চলেছে, ‘হায় আল্লাহ্‌, আমার একি হল, আমার মাইজ ঘরে ডাকাতি হল। আল্লাহ্‌ গো কেন আমার এমন সর্বনাশ করলে, কেন আমাকে নিঃস্ব করলে। পয়ত্রিশ বছর বয়সে বিধ্বা হইছিলাম কিন্তু নিঃস্ব হইনি। সাত বছর বয়সে ইয়াতিম হইছিলাম তবুও কোন দিন আমি নিঃস্ব হইনি, আমার আঁচল খালি হয়নি। কিন্তু আজ আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমার আঁচল খালি হয়ে গেল। আল্লাহ্‌ আল্লাহরে, তোর দুনিয়ায় আমি আর দুই দিনের মুসাফির। মরার বয়সে আমায় এত বড় শাস্তি দিও না খোদা, এত বড় আঘাত নিয়ে আমি মরতে পারব না। তিনি মাটিতে বসে আছেন, সহসা কাপড় সমেত বোরকা মুঠি করে উর্ধ্বে তুলে ধরে বিকট আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আল্লাহ্‌ আল্লাহরে, আমার আঁচলের ধন ফিরায়ে দে, ফিরায়ে দে আমার যক্ষের ধন, ফিরায়ে দে আমার শেষ সম্বল, ফিরায়ে দে আমার জীবনের একমাত্র সম্বল’ বলে তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন, দু’হাতে বোরকা মুঠি করে ভিক্ষার ঝোলির মত তুলে ধরে উর্ধ্বে তাকিয়ে চিৎকার করলেন, ফিরায়ে দে, আমার আঁচলের ধন আমার আচলে ভিক্ষা দে, ভিক্ষা দে। আমি বেঁচে থাকতে তুই আমার জোয়ান ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাবি এটা তো হতে পারে না। তুই কি অন্ধ চোখে দেখিস না, আমার এক পা কবরে চলে গেছে, আমাকে নিয়ে যা, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দে, আমার আঁচলে ফিরিয়ে দে। আমার ছেলেকে ছাড়া আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না। আমি এখানে মরব এখানে মরব, মরব’ বলে তিনি আবার তীব্র আর্তনাদ শুরু করলেন, মাথায় মুখে হাত মারতে লাগলেন। সেই আর্তনাদ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে নক্ষত্রমণ্ডল অতিক্রম করে উল্কার বেগে ছোটে উর্ধ্বে।

প্রথম আযলের দিন আল্লাহ রহমান (রেহেম ধাতুমুল থেকে রহমান শব্দের উৎপত্তি) তার সৃষ্টি লীলা সাঙ্গ করে কুরসিতে বসলেন। সহসা রেহেম এসে কুরসির পায়া ধরে ধাপাধাপি শুরু করল। তখন স্রষ্টা বললেন, ‘মাহ- আরে থাম, তুই কি এতে সন্তুষ্ট নস যে, যে তোর সাথে সম্পর্ক রাখবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক রাখব, যে তোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। তখন রেহেম (মাতৃ জঠর, জরায়ু, মাতৃ সম্পর্ক) বলল, হ্যাঁ, এখন আমি সন্তুষ্ট হলাম (হাদীস)। সেই মাতৃ রেহেম ফের একবার খোদার আসন ধরে প্রচণ্ড ঝাকি মারে, কেঁপে উঠে আরশে আজিম।

ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় বাচ্চাদের কান্নার রুল উঠল। মোবারক ডুকরে কাঁদছে। সহসা তার মনে হল মায়ের কান্নায় বুঝি আকাশ ভেঙ্গে পরল। সে মাকে ঝাপটে ধরে বলল, আম্মা চলেন চলেন, এখানে আর থাকা যায় না’ বলে মাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। মা বললেন, না না ছাড় আমাকে, আমি যাব না। ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। হাসান আমাকে বলত, ওরা খুব হিংস্র, আপনি গেলে আপনাকে অপমান করবে, মারবে। এখন ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমাকে ছাড়, ওরা আমার ছেলেকে যতক্ষণ ফিরিয়ে না দিবে ততক্ষণ আমি যাব না, এখান থেকে এক পা-ও নড়ব না। কিন্তু মোবারক তাকে পাঞ্জা দিয়ে ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেন, ছেলেকে অনবরত থাপড়াতে লাগলেন, শরীর ঝাকি দিলেন, পারলেন না। অবশেষে অপারগ হয়ে শিশুদের মত ছেলের হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন, ‘তুই যা, তোকে আমার দরকার নাই। তোরা আমার কে, কী করেছিস আমার জন্য আর আমার সংসারের জন্য। যে আমাকে লালন- পালন করছে, আমার সংসার চালাইছে- সে আমার বাপ, আমার বাপকে ছাড়া আমি যাব না। আমি এখানেই মরব। বস্তুত ওদের হিংস্রতার কথা শুনে মায়ের বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, হয়ত ওরা হাসানকে মেরে ফেলেছে অথবা আটকে রেখেছে। এজন্যই তার স্থির সিদ্ধান্ত ছেলেকে ছাড়া এখান থেকে যাবে না।

মোবারক অসহায় হয়ে গেল। মাকে নিয়ে যাওয়ার মত কোন উপায় পাচ্ছে না। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল, সে মাকে বলল, ওহ হ, আম্মা আপনেরে কইতে তো খেয়ালই ছিল না, ভাই তো মুক্তাগাছায়, আপাদের বাড়িতে গেছে । মা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রুঢ় কণ্ঠে বললেন, তুই হাছা কইতাছস নাকি মিছা কথা। ‘হাছা কথা’ সে মেঘ থমথমে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল। মা বললেন, ‘তাইলে আগে কইলে না কেন? ‘আগে মনে আছিল না’ বলে মাকে আর কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে ‘চলেন তাড়াতাড়ি মুক্তাগাছা যাই’ বলে টেনে নিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠল। কিছুদুর গিয়ে একটা সি এন জি রিজার্ভ করল। হঠাৎ তার মনে হল এ সম্ভাবনাও তো আছে, হয়ত ভাই কোথাও থেকে বাসায় এসে গেছে। সে সি এন জি নিয়ে আবার বাসায় গেল। ভেতরে গিয়ে আবার বেরিয়ে এল, মা জিজ্ঞেস করলেন এখানে আবার কেন আসলি? মোবারক বলল, ভাবলাম খালি বাসা, তাই বাসার দায়িত্বটা কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে যাই। একটু দুরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মাকে শান্তনা দেয়ার জন্য সে মহিলার কাছে গেল এবং দু’কথা বলে চলে এসে মাকে বলল, বাসা এ মহিলাই দেখবে।

ঘণ্টা খানেক পর তারা মুক্তাগাছায় বোনের বাড়িতে পৌঁছল। মা ঘরে গিয়ে সরাসরি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল হাসান এসেছে এখানে? মেয়ে বলল না। সাথে সাথে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে মোবারকের দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘মিছা কথা কইলি কেন, আবার চল, জামালপুর চল, হাসান ওখানেই আছে’ বলে তিনি গাড়িতে চড়ে বসলেন। ওদিকে মেয়ে ও নাতি নাতনিরা নানীর জন্য চেচামেচি শুরু করেছে। মোবারক তাদেরকে বুঝিয়ে বলল, ‘ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা থাকার সময় নয়, বেড়ানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। হাসান নিরুদ্দেশ শুনে তাদের কপালে চিন্তার ভাজ পরল। মোবারক চালককে ডেকে মায়ের থেকে একটু দুরে নিয়ে গিয়ে বলল, ফুলপুর চলেন। চালক না করল। কিন্তু ভাড়া দ্বিগুন করে দিলে সে রাজি হল। রাস্তায় গিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন আমরা জামালপুর যাচ্ছি তো? মোবারক না বলল। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, আমি জামালপুর যাবই। শুনেছি ওরা খুব হিংস্র, হাসানকে ওরা কোথাও আটকে রেখেছে। যদি বের করে না দেয় তাহলে পুলিশ নিয়ে যাব। ছেলেকে ছাড়া আমি বাড়িতে যাব না।

মোবারক বুঝায়, ‘আপনে পাগল হইছেন নাকি তারা আটকে রাখবে কেন। তাদের যা দরকার, তালাক নিয়ে নিয়েছে, তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, মুনিরাকেও দিয়ে দিয়েছে। এখন ভাইকে আটকে রাখবে কোন দরকারে। ওরা খারাপ হলেও এতটা খারাপ নয় যে আটকে রেখে টাকা দাবী করবে বা অন্য কোন বিপদে ফেলবে। আসলে ভাই হয়ত কোন আত্মীয় বাড়িতে আছে অথবা এখন বাড়িতে চলে গেছে। চলেন বাড়িতে যাই গা, তাহলেই সব কিছু বুঝা যাবে।

কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হয় না, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্তনা দিয়ে রাজি করাল। বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন হাসান যায় নাই। তিনি সাথে সাথে সি এন জিতে চড়ে বসলেন এবং এক কিলো ব্যবধানে বাপের বাড়ি গেলেন। চেয়ারম্যান বাড়ি, আগে থেকেই প্রতাপশালী, বিশাল বড় গোস্টি। গোস্টিতে বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে আছে প্রায় অর্ধ শত, সম্পর্কে অধিকাংশই ভাতিজা। তিনি এসব ছেলেদের ডাকাডাকি কান্নাকাটি করে জড়ো করলেন। তারপর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ছেলেদেরকে হাসানের খোজে পাঠালেন। কেউ কেউ গেল বিভিন্ন আত্মীয় বাড়ি। বাকীরা দুই তিন জন করে দল গঠন করে কয়েক দল করে গেল ময়মনসিংহ, শেরপুর ও জামালপুর শহরে। এভাবে তিনি চারিদিকে নেটের মত অনুসন্ধানি দল ছড়িয়ে দিলেন, কাউকে যাতায়াত খরচ দিলেন কাউকে দিলেন না। তারপর তিনি রাতে বাড়িতে গিয়ে গোসল করে জায়নামাজে ঝাঁপিয়ে পরলেন।

বিষয়: সাহিত্য

১৪৯৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381284
১৪ জানুয়ারি ২০১৭ দুপুর ১২:৩৯
আবু নাইম লিখেছেন : হাসানের বৃদ্ধা মার মত দুশ্চিন্তায় আমাদের অবস্থা আরও খারাপ.পরের গুলি দ্রুত দেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File