শ্রমিক আন্দোলনঃ কোথায় থেকে কি?

লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ০৯ জানুয়ারি, ২০১৯, ১১:২৮:৫৩ রাত

আওয়ামীলীগ সরকার যদি মনে করে, দেশের সোনার ডিম পাড়া শ্রমদাস গার্মেন্টস শ্রমিকদের চিপে তাদের থেকে জ্যুস বের করে সেই জ্যুস গার্মেন্টস মালিক, প্রশাসন, মিলিটারি, পুলিশ, র‍্যাব, কালচারাল এলিট, মিডিয়া মালিক সহ বিভিন্ন শ্রেণির এলিটদের বিলি বন্টন করে ২০৪১ পর্যন্ত পায়ের উপরে পা তুলে দিন গুজার করে যাবে তাইলে হিসাবটা ভুল করছে।

এই গার্মেন্টসের মেয়েদেরকে পৃথিবীর সর্ব নিম্ন মজুরি দিয়ে, বাধ্যতামূলক প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা ওভার টাইম দিয়ে এবং উচ্চ কস্ট অফ লিভিনের মধ্যে এমন ভাবে পিষা হইছে যে এখন অনেক চিপলেও আর জ্যুস বের হবেনা।

আইএলও এর ‘বৈশ্বিক পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি-২০১৫’ রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি যেখানে ৫০০০ টাকা সেখানে, ভারতে ৭৮ ডলার (৬৬৫২টাকা) , ইন্দোনেশিয়ায় ৯২ ডলার(৭৭২৮ টাকা) এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানে ৯৯ ডলার(৮৩১৬ টাকা) এবং মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার (১৮৯০০ টাকা)।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতির যে ফানুস্ উরাইছেন গার্মেন্টস আর রেমিটেন্স দিয়ে সেটার বিনিময়ে যদি তাদের একটা সুন্দর জীবন দিতেন তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্ত সেটা না করে, পৃথিবীর সর্ব নিম্ন বেতন পাওয়া এই শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবীর মিছিলে গুলি করে শ্রমিক হত্যার পরে, এই রাষ্ট্রের নিজের উন্নয়ন নিয়ে কোন গর্ব করার অধিকার থাকেনা।

আমাদেরকে একই সাথে প্রশ্ন করতে হবে,

পৃথিবীর সর্ব নিম্ন মজুরি যদি বাংলাদেশে হয় তবে, মালিকেরা কেন বলতেছে, বেতন বাড়লে তাদের ফ্যক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে।

গত ১৮ অক্টোবারে বনিক বার্তার রিপোর্টে দেখলাম, বেশ কিছু ফ্যক্টরি শ্রমিক ছাটাই শুরু করেছে এবং প্রথম পর্যায়ে এখন তারা বয়স্ক শ্রমিক এবং হেল্পার ছাটাই শুরু করেছে। যেখানে বয়স্ক শ্রমিক ছাটাইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চ বেতনের শ্রমিক কমাইয়া নিয়ে আসা এবং হেল্পার ছাটাইয়ের উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাড়তি বেতনটা শ্রমিকদেরকে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে আদায় করিয়ে নেয়া।

তাহলে কথা হইলো, আমাদের গার্মেন্টস ফ্যক্টরি গুলোতো অন্যান্য দেশের সাথে কম্পিটিটভ রেটেই অর্ডার পায়। আবার একই সাথে তারা পৃথিবীর সর্ব নিম্ন বেতন দেয়। তাহলে কেন তারা বেতন বাড়াতে পারবেনা? কিংবা বেতন বাড়লেও সেইটা কেন তারা শ্রমিক ছাটাই করে শ্রমিকদের কাছ থেকেই আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করতেছে।

এখানে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মালিকদের উচ্চ প্রফিটের হিস্যাটা ধরে রাখা।

এটা এখন বারগেনিনের ইস্যু না। এইটা এখন সরকার এবং শিল্প মালিকদের জন্যে পলিটিকাল ইস্যু। পলিটিকাল স্যাটেল্মেন্ট এবং রেন্ট নেগোসিয়েশান ইস্যু।

শ্রমিকের বেতন বাড়লে মালিকের প্রফিটতো কমবেই। কিন্ত আমাদের শিল্প মালিকরা জানে তারা একটা অনির্বাচিত সরকারকে, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে তাই তারা এখন সেটার রিটারন চায়। তাই তারা দাবী করতে পারে, আমাদের বখেরা কমাতে পারবেনা। সো গুলি করে মেরে হোক, দমন করে হোক আমাদের প্রফিটের পার্ট ধরে রাখতে হবে।

তখন তারা যুক্তি দেয় যে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের প্রডাক্টিভিটি কম।

এইটা একটা অপযুক্তি।

বাংলাদেশে প্রোডাক্টিভিটির আলাপ গুলো এমন ভাবে করা হয় তাতে মনে করা হয় যে, বাংলাদেশের , একজন অপারেটর একজন ভিয়েতনামি বা ইন্ডিয়ান অপারেটর থেকে প্রতি ঘন্টায় কম উৎপাদন করে । সেইটা না।

প্রডাক্টিভিটি সেই ভাবে হিসাব হয় না।

মোট খরচকে পার পিস উদপাদন দিয়া ভাগ করেই প্রডাক্টিভিটির হিসাব হয় এবং এই খানে প্রডাক্টিভিটি লসের মূল দায়টা কিন্ত সরকারের।

বাস্তবতা হচ্ছে, কুইক রেন্টালকে সামাল দিতে উচ্চ বিদ্যুতের চার্জ, লোডশেডিনের জন্যে জেনারেটর, তেলের বিল, পৃথিবীর অলমোস্ট সর্বোচ্চ পরিবহন খরচ, পদে পদে ঘুষ, পোর্টের অদক্ষতা, কাস্টমসের দুর্নীতি, বন্ডের দুর্নীতি, ঢাকা এয়াপোরটে খোলা মাঠে ক্লিয়ারিনের দেরীর কারনে মাল নষ্ট হতে শুরু করে, বিভিন্ন কারনে যে খরচ ও সময় নষ্ট হয়, তার সব কিছুই মূলত প্রডাক্টিভিটি লসের গিয়ে যোগ হয় যার কারনে প্রতি ইউনিটের উদপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্ত, সেই লসটাই স্রমিকের প্রডাক্টিভিটি কম বলে চালানো হয়। ফলে প্রডাক্টিভিটি কম বলে পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে কম মজুরি দেয়ার কোন যুক্তি নাই।

আমাদের দেশের একজন অভিজ্ঞ অপারেটর তার সামনে বসিয়ে রাখা সুপারভাইজারের ২৪ ঘণ্টা তত্ত্বাবধানে টয়লেটে যেতে গেলেও পারমিশান নিয়ে যায় এবং তাকে কোন ধরনের ফুরসত দেয়া হয় না।

পৃথিবীর কোন দেশেই শ্রমিককে এই ভাবে ট্রিট করা হয় না। ফলে প্রডাক্টিভিটি কমের ইস্যুটা, বাংলাদেশের প্রতিদিন বাধ্যতা মূলক ৪ ঘণ্টা ওভার টাইম করা, ছুটির দিনে ওভারটাইম করা শ্রমিকের কম গতির কাজের লস না। সেখানে একজন শ্রমিককে তার সর্বোচ্চ নিংড়ে চিরে চেপটা করে তার সকল জ্যুস কেড়ে নেয়া হয়। এই জন্যে গার্মেন্টসে বার্ন আউট খুবই হাই। এই শিল্পের ৩০ বছর বয়স হওয়ার পরেও দেখবেন, অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রডাক্টিটিভি কমের দায়ে যে নারী শ্রমিকদের অভিযুক্ত করা হয়, তাদের এমন ভাবে নিংড়ে নেয়া হয় যে ৫ থেকে ৮ বছরের উপরে কোন অপারেটর এই ইন্ডাস্ট্রিতে টেকে না। অন্য দিকে গ্রাম থেকে কয়েক বছরের জন্যে শহরে এসে নিজেকে নিংড়ে দেয়া শ্রমিকের জন্যে রিয়ালিটি হচ্ছে, এই সরকারের লুট এবং দুর্নীতি এবং অদক্ষতার কারনে তার জীবন ধারনের খরচও এখন অনেক অনেক গুন বেড়ে গেছে।

যদিও সরকারি ডাটায় আমাদের বছরে বছরে মাত্র ৪%, ৫% গ্রোথ দেখানো হচ্ছে কিন্ত আমরা জানি, বিগত এক দশকে চালের দাম, তেলের দাম, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, চিকিৎসার দাম, বাচ্চাদের স্কুলের খরচ অনেক অনেক গুন বেড়েছে।

ভারতের সাথে তুলনা করে দেখেন, সেখানে ডিমের দাম, তেলের চাম ,চালের দাম বাংলাদেশ থেকে কম। ইউরোপ আমেরিকার বন্ধুরাও বলতেছে, বাড়ি ভাড়া বাদ দিলে সেখানে কম খরচে খাওয়া যায়। ঢাকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ব্যায়ের কয়েকটা শহরের মধ্যে একটা। এবং বছরে বছরে খরচ বাড়তেছে। তো । শ্রমিক যাবে কই ?

কারন এই এক্সট্রা ৫০০ টাকা যদি সে না পায় তবে, শ্রমিক তার মায়ের ওষুধ কিনতে পারবেনা। তার বাচ্চার খাবারে দৈনিক ক্যালোরি কমায় দিতে হবে। মাসিক বেতন হলেও সে দোকান বাকিতে চলে।

একটা সময়ে একজন শ্রমিক কয়েক বছর কাজ করে, রাতে বিরাতে ওভারটাইম করে নিজেকে নিংড়ে ধ্বংস করে দিয়ে একটা ভালো অঙ্কের টাকা সে বাড়িতে পাঠাতে পারতো। কিন্ত সেই এক্সেসটা এখন সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা ভাড়া ওয়ালারা নিয়ে যাচ্ছে তার খুব উচ্চ কস্টের বিনিময়। ফলে, শ্রমিকদেরও আর কোন উপায় নাই।

কোন ধরনের প্রতারণা বা আশ্বাসের বিনিময়ে এই বেতনে তার আর পোষাচ্ছেনা। তাই এখন সে বেতন বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছে।

ফলে এক দিকে এক সময়ে সুপার নরমাল প্রফিট করা পৃথিবীর সর্ব নিম্ন বেতন দেয়া শিল্পে উদপাদন কস্ট আগের থেকে অনেক বেড়ে যাওয়ার কারনে প্রফিট ধরে রাখা সামাল দিতে শ্রমিক ছাটাই করছে মালিক অন্য দিকে, কসট অফ লিভিং বেড়ে যাওয়ার কারনে বাড়তি বেতন না পেলে শ্রমিকদের জীবন আরো সংকুচিত হয়ে পরে। এবং শ্রমিকদের জন্য এইটা অস্তিত্বের লড়াই।

এবং উভয় ক্ষেত্রেই, এই বাড়তি খরচটা সম্পূর্ণ অদক্ষ এবং দুর্নীতি মগ্ন একটা বুরোক্রসিকে এবং বিভিন্ন ধরনের মনোপলি এলিটদেরকে এবং কুইক রেন্টাল আওয়ামী ভাই ব্রাদার গোষ্ঠীকে খুশী করার জন্যে হাই ইন্ডাইরেক্ট ডিউটি এবং বিভিন্ন ধরনের রেন্ট এলোকশানে ঢুকছে।

ফলে এক দিকে হাই কস্ট অফ লিভিং আরেক দিকে উচ্চ প্রফিট লোভী মালিকের বাড়তি চাপ নেয়া তার পক্ষে আর সম্ভব না। তাই সে এখন তার বেতনে কোন ধরনের জারিজুরি কারিগরি মানতে রাজি না।

কারন, তার আসলে এর বেশী নিজেকে নিংড়ে দেয়ার সুযোগ নাই। একজন মানুষ ১৬ ঘন্টার উপরে চাইলেও কাজ করতে পারবেনা। এবং এর চেয়ে কম মজুরিতে সে সারভাইভও করতে পারবেনা।

কিন্ত সরকার ভাবতেছে, সে সব সাইডে খাইতে পারবে।

সে উচ্চ ইন্ডাইরেক্ট ট্যাক্স দিয়ে এই শ্রমিকের কেনা দুধ, ডাল, কেরোসিন, যাতায়তের পেট্রোল সব কিছুতে খেয়ে হাতির মত একটা প্রশাসনকে চালিয়ে যাবে। আবার গার্মেন্টসের মালিকদেরকে একটা অবৈধ সরকারের সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্যে এডভান্স ট্যাক্স কমিয়ে দিবে আবার শ্রমিকদের গুলি করে তাদের নিজেদের নিম্ন মজুরি মেনে নিতে বাধ্য করবে।

মানুষের জীবনের বেচে থাকার হিসাব মোবাইলে লিখার মত ম্যানিপুলেট করে মিলায় দেয়া যায় না এবং এই ভাবে সব সাইডে রেন্ট দিয়ে সরকারের আয়ও বায় ও মিলানো যায় না ।

আমরা তাই পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নায্য আয়ের এই আন্দোলন সমর্থন করি। তাদেরকে তাদের জীবন যাপনের জন্যে তাদের শ্রমের প্রাপ্য মজুরি দিতে হবে।

যাদের শ্রমের বিনিময়ে এই রাষ্ট্রের উন্নয়নের বড়াই তাকে গুলি করে হত্যা আর যার সমর্থনে অবৈধ সরকার টিকিয়ে রাখা তার জন্যে ট্যাক্স কাট সেই ধরনের রাষ্ট্র আমাদের দরকার নাই

জিয়া হাসান

বিষয়: বিবিধ

৭৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File