আগামীর ভিশন কি হবে?

লিখেছেন লিখেছেন ওয়েলকামজুয়েল ০১ জানুয়ারি, ২০১৯, ০১:৪১:৩৩ রাত

ফেসবুকে হেঁটে এসে মনে হল গতকাল সকালের উৎসবমুখর বৃদ্ধাঙ্গুলি সর্বস্ব আরবান মিডল ক্লাস তারুণ্য তাদের অমোচনীয় দাগকে ভুলে যেতে চাইছে। লিবারেল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন ভেবেছিলেন ভোটাধিকারের একটু আধটু কাপড় টানাটানি হবে, ধর্ষণটা হবে জামাত বিএনপির, এবং তাদের নৌকার পক্ষে বিপক্ষে ভোট গোনায় ধরা হবে। সেই ভোট নিয়ে 'ভ্যালিড' লড়াইয়ে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার' ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন কিছুটা নাহয় হলো, এ যেন 'সুখের মতন ব্যথা'।

কিন্ত এখন ব্যথাটা প্রবল হয়ে উঠছে। কিন্ত আওয়াজও করা যাচ্ছে না। ভাইবোন, আপনাদের ব্যঙ্গ করছি না, আমিও আপনাদের মত ব্যথিত, হতাশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খরচ আছে, নাগরিক হিসেবে সেই ট্যাক্স আপনাকে আমাকে দিতে হবে তো। ভোটাধিকার কম্প্রোমাইজ করে ৩০ ডিসেম্বরের ট্যাক্স দিলেন, সামনে আবার ব্যাংক-শেয়ারবাজার-বাকস্বাধীনতা- মৌলবাদের সাথে আপোস- টাকা পাচারের মহোৎসবে শামিল হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খরচ আমাকে আপনাকে বহন করে যেতে হবে। সেজন্যে প্রস্ততি নিয়ে ২০১৯ শুরু করাই ভালো। একটু আগে সময় টিভিতে গণভবনে বিদেশি পর্যবেক্ষক দলের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিং এ একেবারে সামনে ফারমার্স ব্যাংকের লুটেরা অন্যতম উদ্যোক্তাকে হাসিমুখে বসে থাকতে দেখলাম। সুতরাং এই 'বিজয়' কাদের বুঝে নিয়ে কষ্ট করতে হবে না...

একটা ভালো দিক হচ্ছে আওয়ামী লীগ যাদের রুটি রুজি তারা চুপচাপ আছেন। কিছুটা লজ্জা শরম নিয়ে। উনারা ভবিষ্যতের দলের ভেতরের তীব্র প্রতিযোগিতায় কিভাবে ভাত কাপড়ের বন্দোবস্ত বজায় রাখবেন সেখানে মনোযোগ দিচ্ছেন বোধহয়। কিছুটা আওয়াজ তোলা শুরু করেছে অ্যাসপিরেন্ট বাটপারেরা যাদের আশা আছে কিছু পাওয়ার। তাদের এক ধরনের যুক্তি পেলাম- 'তারেকের গ্রেনেড হামলার পর রাজনীতিতে সুশীল হওয়ার সুযোগ নেই, যেভাবেই হোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায় থাকতে হবে। ভোট চুরি এইসব আলাপ সালাপ বাদ দেন...'

আমার কাছে শংকার ব্যাপার হল, ভোটে বিকল্প না থাকায় ভোটাধিকারের বিকল্প হিসেবে আমরা স্বৈরাচারের উত্থান মেনে নিয়ে শান্ত আছি। এবং 'ওয়েট এন্ড সি, ইফ সামওয়ান কামস এন্ড চেইঞ্জেস দ্যা স্ট্যাটাস কো' ধরনের কৌশল নিয়েছি। এই 'আমরা' হচ্ছে শহুরে শিক্ষিত অগ্রসর মিডল ক্লাস, যারা এই দেশে আপাতত আর কোন একটিভ রোল প্লে করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফ্যাসিজমের জন্য তিনটা জিনিস লাগে- ১। রাজনীতিতে বিকল্প বেছে নেয়ার মত অপশন না থাকা ২। লুটেরা অনুগত রাষ্ট্রীয় বন্দুক ও ৩। প্যাসিভ আরবান ভীরু ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক মিডল ক্লাস। বাংলাদেশে তিনটাই উপস্থিত, এবং এখানে আরবান মিডল ক্লাস আওয়ামী লীগকে তার চূড়ান্ত অবক্ষয়ে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপচাপ সয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিউ ইয়ার উদযাপনের পক্ষে...

তবে 'সুখে আছো যারা সুখে থাকো, এ সুখ সইবে না'। এই দেশ একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে, ২০১৯ এর শেষ ২০২০ এর শুরুতে তা দৃশ্যমান হবে। আর প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়েছে, এইখানে উন্নয়ন ও সুশাসন অকল্পনীয়। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুটা হবে আমাদের হারানোর দশক, টালমাটাল সময়...

মহামতি আবদুর রাজ্জাক ছফাকে বলেছিলেন- 'দেয়ার আর পিরিয়ডস ইন হিস্ট্রি হোয়েন ক্রলিং ইজ দ্যা বেস্ট মিন অব কম্যুনিকেশন'। এই সময়ে তাই হামাগুড়ির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই দেশে 'আওয়ামী লিবারেল ইন্টেলেকচুয়ালিজম' এর উগ্রতা ও চরমপন্থার পর আবার এক ধরনের 'নৈতিক পুননির্মাণ' এর প্রয়োজন পড়বে। সে প্রক্রিয়ায় যাতে কন্ট্রিবিউট করতে পারি তার প্রস্ততি প্রয়োজন।

যদ্যপি আমার গুরু বইতে আহমদ ছফা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বয়ানে লিখেছিলেন, ‘... সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তার লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন তো আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায়-কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে তো অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে।

জওহরলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, ‘তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়া তোল।’ শেখ সাহেব বললেন, ‘আগামী ইলেকশানে অপজিশন পার্টিগুলো ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সিট পাইব না।’ আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম, ‘আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়া দেবেন না?’ শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না’। [আহমদ ছফা/যদ্যপি আমার গুরু/ মাওলা ব্রাদার্স, জানুয়ারি ২০১৩ পৃ.-৭৩]'

সেই সুযোগ মিস করায় ক্যান্টনমেন্টের বাইরে স্বাধীনতার পর আর সত্যিকারের অপজিশন আসেনি। আওয়ামী লীগও কোনদিন চায়নি সেন্টার লেফটের অপোজিশন বাজারে আসুক, এখন তো অসম্ভব।

কিন্ত সামনে আমাদের সেই অপজিশন গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে, ন্যায়বিচারের সমাজ নির্মাণে আমাদের প্রজন্মের রাজনীতির...

সে প্রক্রিয়ার কাজও শুরু করবো। আর ততদিন ছোটবেলার শিক্ষা নিয়ে 'চোরকে বলবো চোর, ডাকাতকে বলবো লুটেরা', তা যত বিপদজনকই হোক না কেন...

বিষয়: রাজনীতি

৬৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File