স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক

লিখেছেন লিখেছেন আহমেদ ফিরোজ ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৯:৫৫ রাত



১৯৭১ সালের মে মাস। নিউইয়র্কের “ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সী” নামক একটি সংস্থা তাদের ভাষায় “ঢাকার বিদ্বজনের ব্যাপক হত্যাকান্ডে উদ্বেগ” শিরোনামে একটি বিবৃতি দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে(বর্তমান বাংলাদেশ) অধ্যাপক, কলেজ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবিকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা, গুলিবিদ্ধ ও বিভিন্নভাবে নির্যাতন করছে, এমন তথ্যের বর্ণনা দিয়ে উদ্বেগ জানানো হয় বিবৃতিতে।

পরবর্তীতে উক্ত বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ জন বুদ্ধিজীবি একটি বিবৃতি প্রদান করেন। যা ১৭ই মে’র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতিতে যেই ৫৫জন বুদ্ধিজীবি স্বাক্ষর করেন, তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক একজন।

আসুন দেখে নেই কি ছিলো সেই বিবৃতিতে। যেই বিবৃতির সাথে সচেতনভাবে একমত হয়ে সৈয়দ শামসুল হক স্বাক্ষর করেছিলেন।

বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

“নিউইয়র্কের “ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সী”বলে পরিচিত একটি সংস্থা তাদের ভাষায় ‘ঢাকার বিদ্বজনের ব্যাপক হত্যাকান্ডে উদ্বেগ’ প্রকাশ করে যে বিবৃতি দিয়েছেন আমরা তা পাঠ করে হতবাক হয়ে গিয়েছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যাপক, কলেজ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পীবৃন্দ আমাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও ভবিষ্যতের জন্য আইসিইউই’র উদ্বেগ প্রকাশকে গভীরভাবে অনুধাবন করছি। যাই হোক, ঘটনার সত্যাসত্য যাছাই না করে, যা কিনা পন্ডিত ব্যাক্তিদের প্রথম গুণ বলে বিবেচিত, এরুপ সম্মানিত বিদ্বান ও সুধী ব্যক্তিরা এমন একটি বিবৃতি প্রকাশ করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। সত্যানুসন্ধানই যাদের জীবনের লক্ষ্য, তেমন একটি পেশায় নিযোজিত ব্যক্তিরাই অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমাদের মহান সঙ্গীরা পন্ডিত ও জ্ঞানান্বেষীর এই মৌল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির অভিযোগকে সম্বল করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং অভিমত প্রকাশ করেছেন।

আমাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ ও নিহতের তালিকায় তাঁদের নাম দেখতে পেয়ে হতবাক হয়েছেন। নেহাত নাচার হয়েই আমাদেরকে জানাতে হচ্ছে আমরা মৃত নই।

আমাদের পেশাগত কাজের স্বাভাবিক রীতি অনুসারেই আমরা ঢাকা টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভুত হওয়ার সুযোগ নিয়েছি। আমাদের মৃত্যুর খবর যে অতিরঞ্জিত এটা জানিয়ে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন এবং ছাত্রদের আশ্বস্ত করেছি।

ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে গোলযোগ চলাকালে আমাদের অধিকাংশই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজ নিজ গ্রামে চলে গিয়েছিলাম, এ কারনেই হয়তো ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে থাকবে। সময় নির্দিষ্ট করে বলার কারণ আছে। কেননা এই সময়টাতেই দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ পুরোদমে চলছিলো। নির্বাচনে জনগনের কাঝ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন আদায়ের মেন্ডেট পেয়ে চরমপন্থীরা স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে এক তরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে সম্প্রসারিত ও রুপায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলো, যারাই জনতার অর্পিত আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে তাদের উপর দুর্দিন নেমে এসেছিল।

এই সময়েই ব্যাপকভাবে শিক্ষার অঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাছে অপব্যবহার করা হতে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্ররা লেখা পড়া বা খেলাধূলায় ব্যস্ত ছিল না। তা ছিল বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষন কেন্দ্র, তা ছিলো মেশিনগান, মর্টার ইত্যকার সমরাস্ত্রের গোপন ঘাটি। ফ্যাসীবাদী, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক দলগত অসহিষ্ণুতার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এড়ানোর জন্য আমাদের অধিকাংশই আমাদের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করার সশস্ত্র প্রয়াস নস্যাৎ এবং প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা পূন:প্রতিষ্ঠার আগে কেউ শহরে ফিরে আসেন নি।

অবশ্য আমাদের কিছু সহকর্মী বাড়িতে না ফিরে সীমান্ত পার হয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ভারতীয় দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার ২৫শে এপ্রিলের খবরে দেখা যাচ্ছে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পনের জনকে তাদের ষ্টাফ হিসেবে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আরো শিক্ষকদের তাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ভারত সরকারের কাছে বিপুল অংকের বরাদ্দ দাবী করেছে।

পাকিস্তানি শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব-অভিযোগ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা এই সরল-সহজ আইন সঙ্গত দাবীকে এক তরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে রুপান্তরিত করায় আমরা হতাশ ও দু:খিত হয়েছি। বাঙ্গানী হিন্দু, বিশেষ করে কোলকাতার মাড়োয়াড়ীদের আধিপত্য ও শোষণ এড়ানোর জন্যই আমরা বাংলার মুসলমানেরা প্রথমে ১৯০৫ সালে বৃটিশ রাজত্বকালে আমাদের পৃথক পূর্ব বাংলা প্রদেশ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেই এবং আবার ১৯৪৭ সালে ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে যুক্ত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। উক্ত সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হওয়ার আমাদের কোন কারণ নেই।

পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আমাদের আয়ত্বের মধ্যেই এসে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই চরমপন্থীদের দুরাশায় পেয়ে বসল এবং তারা জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগেকে সংখ্যাগুরু দল হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টাটি ঘটে গেল এবং নেমে এল জাতীয় দুর্যোগ।

কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত এবং বর্তমান সরকার অবস্থা অনূকুল হওয়ার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা আবার ঘোষণা করেছেন। এমতাবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের আমাদের একাডেমিসিয়ানরা আমাদের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপের বিরোধীতা ও নিন্দা করছি। ”

(দৈনিক পাকিস্তান, ১৭/৫/১৯৭১)











উপরোক্ত বিবৃতির মাধমে সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান যে, বাংলাদেশের বর্তমানের গন্যমান্য অনেক অধ্যাপক, শিক্ষক, লেখক, কবি ও সাংবাদিকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবির ন্যয় সৈয়দ শামসুল হকও পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। এবং ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার দাবি তোলা মুক্তিকামী জনতাকে তিনি চরমপন্থী হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।

সূত্র: একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?/ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র/ পঞ্চম মুদ্রণ/ পৃঃ- ১৪২-১৪৬

(পিডিএফ লিংক)

বিষয়: বিবিধ

১৪২১৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378075
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০১:৫৪
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : মহা গন্ডগোল!
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:০৩
313373
আহমেদ ফিরোজ লিখেছেন : সত্যিকার ইতিহাস আসলেই মহা গন্ডগোল। তাইতো ওনারা নতুন ইতিহাস চর্চায় ব্যস্ত।
378086
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ০২:১১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আমি যতটুক জানি সৈয়দ শামসুল হক এর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাইকিয়াট্রিষ্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:০৪
313374
আহমেদ ফিরোজ লিখেছেন : সঠিক জানা নাই।
378089
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:৩৫
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : বোন হাসিনার কোলে একবার ঠাই করে নিতে পারলে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার প্রসঙ্গগুলো তখন মূল্যহীন।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:০৭
313375
আহমেদ ফিরোজ লিখেছেন : হুম.... ঐ ব্যপারগুলো হাইডেই রাখলাম এই লেখায়। কারন বেচারা মরলো কেবল। পিয়াস করিমরা স্বাধীনতা বিরোধীর আজাইরা অভিযোগে নিগৃহীত হয় আর শামসুলরা সত্যিকারের স্বাধীনতা বিরোধী হয়েও শহীদ মিনারে সম্মান পায়!!!
378090
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৪:২৩
আনিসুর রহমান লিখেছেন : Thanks for your informative post
378095
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:২৬
রাশেদ বিন জাফর লিখেছেন : জানলাম অনেক কিছুই

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File