সাহাবী সালমান ফার্সি রা.র ইসলামে আসার রোমাঞ্চকর কাহিনী (ইসলামে আসার কাহিনী সিরিজ-২)+ ১এমবির ইবুক

লিখেছেন লিখেছেন ইসলামিক রেডিও ০৮ মে, ২০১৫, ০৮:৩৬:১৩ রাত



আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে সালমান ফার্সি রা. নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে নিচের গল্পটি বলেন, ‘‘আমি ছিলাম এক পার্সিয়ান। ইসবাহানের কাছে জেয় নামের এক গ্রামের লোক আমি। আমার বাবা ছিলেন তার গ্রামের সর্দার এবং আমি ছিলাম আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তার সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র।

তিনি আমাকে এতই পছন্দ করতেন যে সবসময় চোখের সামনে রাখতে কখনোই আমাকে ঘরছাড়া হতে দিতেন না; আগুনের কাছেই রাখতেন- ঠিক মেয়েদের মত। আমি অগ্নিপূজকদের ধর্মে কঠোর সাধনা করতাম। পরে আমি তাদের পবিত্র আগুনের রক্ষাকারী হয়ে যাই। আমি সারাদিন সেই আগুন দেখাশুনা করতাম যেন ওটা কখনো নিভে না যায়। আমার বাবার ছিল বিশাল বাগান। একদিন তিনি কিছু নির্মাণ কাজে খুব ব্যস্ত থাকাতে আমাকে বললেন, ‘‘সালমান, আমি এই বাড়ির কাজ নিয়ে আজ খুব ব্যস্ত, তুমি আজকে বাগানে যাও আর কিছু কাজ ছিল; ওগুলো করে আস,’‘ কি কি কাজ করার ছিল তা তিনি আমাকে বলে দিলেন। আমি বাগানের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে এক খ্রিস্টান চার্চ চোখে পরে আমার। তাদের প্রার্থনার আওয়াজ আসছিল আমার কানে। বাসায় বন্দী থাকাতে বাইরের পৃথিবীর ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল না বললেই চলে। তাই পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় তাদের প্রার্থনার শব্দ শুনে আমি ওদের ওখানে ঢুকে পরি। তাদের প্রার্থনা আর ধর্ম দেখে আমি তাদের ব্যাপারে আগ্রহী হলাম।

আল্লাহর শপথ! আমার মনে হলো এই ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই থেকে গেলাম। বাবার কথাগুলো বেমালুম ভুলে গেলাম! আর বাগানে যাওয়াই হল না। এই ধর্মের আদি স্থান কোথায় তা তাদের জিগ্যেস করলাম। তারা সিরিয়ার কথা বললেন। এরপর আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যাই। এদিকে উনি চারিদিকে লোক পাঠিয়ে আমাকে খুঁজছেন। তার সারাদিনের কাজ ভেস্তে গেছে। ফেরার পর তিনি আমাকে বললেন, ‘‘সালমান, কই ছিলে এতক্ষণ? আমি তোমাকে কিছু কাজ দিয়েছিলাম; ওগুলো করনি? আমি বললাম, ‘‘ গির্জাতে প্রার্থনারত কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তাদের ধর্মে যা দেখলাম তা আমার মনে দাগ কাটল। আল্লাহর শপথ! সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই ছিলাম। তিনি বললেন, ‘‘হে আমার সন্তান! ওই ধর্মে কোনো ভালো কিছু নেই। তোমার আর তোমার বাপ দাদার ধর্ম এর চেয়ে অনেক ভালো। আমি বললাম, ‘‘ না, আল্লাহর শপথ! আমি যা দেখেছি তা আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো। উনি আমার কথায় বেশ ঘাবড়ে গেলেন আর আমার পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে বাসায় বন্দী করে রাখলেন। আমি গির্জার সেই খ্রিস্টানদের খবর পাঠালাম- সিরিয়া থেকে কোনো ব্যবসায়ী কাফেলা এলে তারা যেন আমাকে জানায়। তাদের একজন আমাকে জানাল তাদের কাছে সিরিয়া থেকে একটা কাফেলা সত্যিই এসেছে কয়েকদিন আগে। তাদেরকে তারা আমার কথাও জানিয়েছে। আমি তাকে বললাম কাজ শেষে যখন ওরা দেশে ফিরবে তখন যেন আমাকে খবর দেয়। ওদের যখন যাওয়ার সময় হলো তখন তারা আমাকে খবর দিল। আমিও আমার পায়ের শিকল খুলে ছুড়ে ফেললাম আর ওই কাফেলার সাথে চললাম; একেবারে সিরিয়া পর্যন্ত চলে এলাম। সিরিয়া পৌছানোর পর আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এই ধর্মের সব চেয়ে ভালো ব্যক্তি কে? তারা বলল, ‘চার্চের বিশপ।’ আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘‘আপনাদের এই ধর্ম আমার ভালো লেগেছে। আমি আপনার সাথে থেকে চার্চের সেবা করতে চাই। সাথে আপনার কাছে এই ধর্মের ব্যাপারে শিক্ষা আর প্রার্থনা করা যাবে। ‘‘তিনি এতে সায় দিলেন আর আমিও তার সাথে রয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটা ছিল খুব মন্দ প্রকৃতির। তিনি চার্চের অনুসারীদের দানশীলতার আদেশ আর উৎসাহ দিতেন; অথচ সেই দানের টাকার বেশির ভাগ উনি গরিবদের না দিয়ে নিজের জন্য রেখে দিতেন। এইভাবে তার সাতটা সিন্দুক সমান সোনা আর রূপা জমা হলো। তার কাজকর্মে আমি তাকে যারপর নাই ঘৃনা করতাম। তারপর একদিন তিনি মারা গেলেন। ওখানকার খ্রিস্টানরা সব তাকে কবর দেয়ার জন্য আসল। আমি তাদের বললাম এত একজন মন্দ লোক ছিল। সে তোমাদের দানশীলতার আদেশ আর উৎসাগ দিত, অথচ যখন তোমরা তা নিয়ে আসতে, তার পুরোটাই সে নিজের জন্য রেখে দিত, কোনো অংশই সে গরিবদের দিত না। তারা বলল, ‘‘এর প্রমান কি? তার সে সম্পদ কোথায় আছে দেখাও আমাদের!’‘ আমি তাদের দেখিয়ে দিলাম আর বের হয়ে আসল তার লুকানো সেই সাতটা সিন্দুক; সোনা রূপায় ভরা। তারা সবাই বলল, ‘‘ আল্লাহর শপথ! আমরা এই লোককে কবর দিব না।’’ তারা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে পাথর ছুড়ল। এরপর তারা তার জায়গায় নতুন এক লোককে নিয়ে এনে নিয়োগ দিল। তিনি দুনিয়াত্যাগী আর পরকাল প্রত্যাশী ছিলেন। তার দ্বীনদারির কোনো তুলনায় ছিল না।

ভালো লাগলে এগিয়ে চলুন ও ই-বুক নিন এখানে

বিষয়: বিবিধ

২৫৭৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

318906
০৮ মে ২০১৫ রাত ১০:৩৫
মনসুর লিখেছেন : মাশাআল্লাহ, সুন্দর লিখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, জাজাকাল্লাহু খাইরান। শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ।
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
318958
০৯ মে ২০১৫ রাত ০৪:৫১
শেখের পোলা লিখেছেন : এখানেই এগিয়ে নিয়ে চলুন৷ অন্যত্র নয়৷
০৯ মে ২০১৫ সকাল ০৭:০৭
260134
মুহাম্মদ_২ লিখেছেন : শেখের পোলা,এখানে পড়ুন।
318964
০৯ মে ২০১৫ সকাল ০৭:০৬
মুহাম্মদ_২ লিখেছেন : শেখের পোলা,এখানে পড়ুন.

সালমান ফার্সী
সালমানের সাথে ফার্সী লিখতে আমার কষ্ট হচ্ছে। তবুও তার ঘটনা সংক্ষেপে হলেও গভীর অর্থবহ করার জন্য তার পারস্যবাসী মূলের প্রতি ইংগিত করতে তা লিখলাম। সালমান কিন্তু কখনো তার নামের সাথে অন্য কোনো শব্দ যোগ করতো না। আরব বর্ণবাদীরা একবার তাকে তাদের রঙ্গে রঞ্জিত করতে জিজ্ঞাসা করেছিলো যে সালমান তোমার পূর্ণ নাম কি? উত্তরে সে কিংবদন্তীর আল্লাহ্র বান্দাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলো “আমি ইসলামের সন্তান সালমান! আমি ইসলামের সন্তান সালমান!! আমি ইসলামের সন্তান সালমান!!!" এর বাইরে বংশের, দেশের বা বর্ণের কোনো পরিচয় তার মুখ থেকে প্রশ্নকর্তা বের করতে সক্ষম হয়নি। সঠিক ঈমান অন্তরে প্রবেশ করলে কোনো মানুষ আর আরবী, আজমী, ইরানী বা হিন্দী হতে পারেনা। আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত হয়, যাকে আল্লাহ্ ক্বোরআনে সিবগাতুল্লাহ বা আল্লাহর রং বলেছেন। এ রঙ্গেই নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সঃ রা রঞ্জিত হয়েছিলেন। মুহাম্মাদ সঃ নবী হওয়ার পর আর আরবী বা ক্বোরেশী ছিলেন না। শুধু আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু, আল্লাহর দাস ও আল্লাহর রাসূল হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন ইব্রাহীম আঃ ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ছিলেন না। আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলীরা ইসলামে ঢুকেও গোত্ররোগ ত্যাগ করতে সক্ষম হয়নি বলে তাদের উপর আল্লাহর রং লাগেনি। কিন্তু যায়দ, বিলাল, আম্মার, সালমান ও উসামাহরা সে রোগমুক্ত হতে পেরেছিলো। সালমান তাদের জলন্ত প্রমাণ। পারস্যের এক সমৃদ্ধ কৃষিজীবী পরিবারে সালমানের জন্ম। প্রচুর পাথেয় নিয়ে মহাসত্যের সন্ধানে সালমান গৃহত্যাগ করে। একাধিক ইয়াহুদী রাব্বাঈর আশ্রমে তাদের সংস্পর্শে বহুদিন একের পর এক কাটায়। ইয়াহুদীদের কাছে কাঙ্খিত সত্যের সন্ধান না পেয়ে পরে আবার একাধিক খৃষ্টান যাজকের পৌরোহিত্যের অধীনে বহু দেশে বিদেশে জীবন অতিবাহিত করে। শেষে এক যাজককে জিজ্ঞাসা করলে সে আল্লাহর বান্দা তার শিষ্য সালমানকে তার মৃত্যুর মুহুর্তে জানায় “চূড়ান্ত সত্যের শেষব্যক্তি আবির্ভূত হবেন আরবদেশের খেজুর বাগানে ঘেরা এক গাঁয়ে। তিনি মানুষের দানভিক্ষা খাবেন না। উপহার ও উপঢৌকন গ্রহণ করবেন ও খাবেন। তিনি হবেন খাতামুন নাবিয়্যীন। যদি সম্ভব হয়, তা হলে তুমি তাঁর সন্ধানে বের হও।” দামেশকের আম্মুরিয়ায় সালমানের শেষ অবস্থান ছিলো। সেখানে সালমান কোনো সঠিক আরব ব্যবসায়ী ক্বাফেলার অপেক্ষা করছিলো। শেষ পর্যন্ত বনু কালবের এক আরব ব্যবসায়ী ক্বাফেলার সন্ধান পেলে সালমান তাদের বলে যে তারা যদি সালমানকে নিয়ে সে খেজুরবাগানে ঘেরা জনবসতিতে পৌঁছাতে পারে, তাহলে সে তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও পুরস্কার প্রদান করবে। আরবরা পয়সার লোভে সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো বটে, কিন্তু তারা মধ্যপথে মরু স্বভারের বিশ্বাস ঘাতকতায় সালমানের সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায় এক স্থানে। যার নাম ওয়াদিউল্ ক্বোরা। সেখানে জনৈক ইয়াহুদীর নিকট দাসরূপে সালমানকে বিক্রি করে দেয়। যেমনটি যায়দকে বিক্রি করেছিলো। এবার সালমান সত্যের সন্ধানে এসে দাসদশায় পতিত হয়ে সে ইয়াহুদীর দাসত্ব আরম্ভ করে। তার কিছুদিন পর সে ইয়াহুদীর এক আত্মীয় বেড়াতে এসে তাকে ক্রয় করে ইয়াসরিবে নিয়ে আসে। এ ইয়াহুদী ব্যক্তি বনু ক্বোরায়যার লোক ছিলো। সে সালমানকে ইয়াসরিব নিয়ে আসলে সালমান সেখানে তার সর্বশেষ যাজকের বলা খেজুরের বাগান দেখতে পেয়ে দাসত্বের জীবনে সে এক অজানা তৃপ্তি অনুভব করে। সালমানের ভাষায় ঃ “তখন কিন্তু নবী সঃ এর আবির্ভাব ঘটেছে। তবে তা মাদীনায় নয়, মক্কায়। কিন্তু দাসত্বের বাঁধনে পড়া ছিলাম বলে আমি তাঁর সন্ধান করতে পারিনি। তার কিছুদিন পরই রাসুল সঃ হিজরত করে মাদীনায় পৌছান। একদিন আমি এক খেজুর গাছের মাথায় কর্মরত ছিলাম। তখন মনিব সে গাছের তলায় বসা ছিলো। ঠিক তখনই তার এক চাচা এসে বললো, “সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে! মাদীনার আউস্ ও খাযরাজরা ক্বোবায় মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির চার পার্শ্বে ভীড় জমিয়েছে। সে নাকি বলেছে যে সে নবী!” সালমান বলেছে যে সে তার মনিবের চাচার কথা শোনা মাত্রই যেনো তার সারা গায়ে কম্পন সৃষ্টি হয়ে জ্বরের তাপমাত্রা শেষ ডিগ্রীতে চড়েছে। তার মনে হচ্ছিলো যে সে তখনি গাছের চূড়া থেকে পড়ে যাবে। তাই তাড়াহুড়া করে গাছ থেকে নেমে এসে মনিবের চাচার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, “আপনি একটু পূর্বে কী জানি বলছিলেন, তা কি আরেক বার আমাকে বলবেন।” একথা শোনা মাত্রই মনিব কষিয়ে আমাকে এক চড় মেরে বললো, “তোমার তা শুনে কি কাজ, তুমি তোমার কাজ করো গিয়ে?” আমি থাপ্পড় খেয়ে পুনঃ আমার কাজে লাগলাম বটে, কিন্তু সর্বক্ষণ আমার মনে শোনা সংবাদ ঝড় তুলছিলো।
সন্ধ্যা হতেই আমার জমানো কিছু খেজুর নিয়ে ছুটলাম যেখানে রাসূল সঃ উঠেছিলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে বললাম যে আমি জানতে পেরেছি যে আপনি একজন সাধক। আমার কাছে কিছু খেজুর ছিলো, তা আমি আপনার জন্য সদ্ক্বা স্বরূপ নিয়ে এসেছি। আপনার সঙ্গে তো অনেক দরিদ্র ব্যক্তি রয়েছে। আপনি তা আপনার জন্য ও আপনার দরিদ্র সঙ্গীদের জন্য গ্রহণ করুন। তিনি আমার কথা শুনে তা গ্রহণ করলেন এবং সঙ্গীদের খেতে দিলেন। নিজে ছুলেন না। তা দেখে আমি মনে মনে বললাম, এ গেলো এক পরীক্ষা। তারপর আমি চলে আসলাম। এসে আমি পুনঃ খেজুর জমাতে আরম্ভ করলাম। ইতিমধ্যে রাসূল সঃ ক্বোবা ছেড়ে মাদীনা পৌঁছে গিয়েছেন। তারপর আমার জমা করা খেজুর নিয়ে আমি পুনঃ রাসূল সঃ এর দরবারে উপস্থিত হলাম। আমি তাকে বললাম যে, সে দিন আমি দেখেছি যে আপনি সদ্ক্বা-ভিক্ষা খান না। তাই আজ আমি আপনার জন্য কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনি গ্রহণ করুন। রাসূল সঃ তা গ্রহণ করে নিজেও তা থেকে খেলেন এবং তাঁর সঙ্গীদেরও খেতে দিলেন। তা লক্ষ্য করে বুঝলাম যে, দ্বিতীয় লক্ষণও পাওয়া গেলো। তারপর আমি তাঁকে আমার সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললাম। তিনি তা শুনে খুব খুশী হলেন এবং আমার ঘটনা ও আমার বিবরণ তার সঙ্গীদেরও শোনালেন। সবাই আমার বৃত্তান্ত শুনে বিমোহিত হলো। তারপর রাসূল সঃ আমার মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এ হ’লো “সালমানু মিন্না আহ্লাল বাইত” এর ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস। রাসূল সঃ বলেছেন, “সালমান আমার আহলে বাইত, আমার পরিবার ভূক্ত ও আমার পরিবারের সদস্য।” সালমান আল্লাহর রং সিব্গাতুল্লাহর রংধনু। ইসলামে পূর্ণপ্রবেশ করলে মানুষ আদম হয়ে যায়। যে আদম আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর দাস ও আল্লাহর খালিফা ব্যতীত অন্য কোনো পরিচয় তার নেই। তাই খাঁটি আদম সন্তানের কোনো জাত থাকেনা, তাদের পিতা আদমের জাতের বাইরে। আদমের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাদের পিতা-মাতা বাবা আদম ও মা হওয়ার শত্রু ইবলিসকে সঙ্গে নিয়ে সন্তান জন্ম দেয়, তারাই আল্লাহর রং ত্যাগ করে রক্ত, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীতে এতো জাত ও জাতির জন্ম দিয়ে বর্তমান জাতি সংঘ, ইউনাইটেড নেশনের দুষ্ট চক্রের সদস্য বৃন্দ। ক্বোরআনে আল্লাহ্ বলেছেন যে শয়তান তার অনুসারী মানব দম্পতির সাথে স্ত্রী সহবাসে শরিক হয়। وشاركهم في الأموال والأوللاد (সূরা বনী ইসরাঈল-৬৪) জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও বর্ণবাদীরা মানুষ ও ইবলিসের প্রজন্ম (সূরা কাহ্ফ্-৫০)। সালমান রাসূল সঃ এর সাথে যায়দের মতো আরেক বিস্ময়কর সংযোজন। যায়দ রাসূল সঃ এর নবী জীবনের পূর্বে ও প্রারম্ভে এবং সালমান নবী সঃএর জীবনের পরিপক্ক কালে। যায়দ রাসুল সঃ এর নবী জীবনের কঠিনতম তায়েফ যাত্রা ও তার সে দুঃস্বপ্নময় কষ্টের সঙ্গী, যে কষ্ট রাসূল সঃ কখনো ভুলেননি। তাই তায়েফের কষ্টকে তিনি তাঁর জীবনে সবচেয়ে কষ্টের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। আর নবী জীবনের সকল সঙ্গীদের নিয়ে যে কঠিনতম পরীক্ষায় রাসূল সঃ কাটান, তা হলো মাদীনা অবরোধের ঘটনা। প্রায় মাদীনা এক মাসের বেশি সকল দিক থেকে অবরুদ্ধ ছিলো। মক্কা, তায়েফ, ইয়ামেন ও নজ্দসহ সকল আরব মুশরিকরা মাদীনায় রাসূল ও তাঁর সঙ্গী তিনহাজার জনসংখ্যাকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার জন্য ইয়াহুদীদের প্ররোচনা ও পরিকল্পনায় বারো হাজার সৈন্য নিয়ে মাদীনা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। কাফেরদের সম্মিলিত শক্তির মরণকামড় এ অভিযানের সংবাদ পেয়ে রাসুল সঃ ও তাঁর সঙ্গীরা ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। মাদীনা রক্ষার প্রানান্তকর দুশ্চিন্তায় আল্লাহ্ সালমানকে রহমতের ফেরেশতা রূপে তাঁর রাসূলের সামনে তুল ধরেন। সালমান রাসুল সঃ কে পরামর্শ দেয় যে মাদীনার দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে পর্বতমালার বেষ্টনী। সেদিক সমূহে শত্রুদের ঠেকানো কঠিন হবেনা। সামান্য সংখ্যক লোক দিয়েই তা রক্ষা করা যাবে। কিন্তু সব বিপদ হয়েছে উত্তর দিক থেকে। উত্তর দিকেই মদীনায় প্রবেশের খোলা পথ। সালমান রাসুল সঃ কে পরামর্শ দিলো যে মাদীনাকে রক্ষা করার একমাত্র পথ হলো গোটা উত্তর দিক জুড়ে গভীর খাল বা পরিখা খনন। মরুবাসী আরবরা যেহেতু কখনো সংঘবদ্ধ জাতি ছিলোনা, ছিলো শুধু কাফেলা লুটতরাজ করা মরুদস্যু ও গোত্রীয় মারামারির জাত, তাই তারা পরিখা খনন করে শত্রু প্রতিহত করার কোনো রণকৌশল জানতোনা। সালমানের পরামর্শে রাসূল সঃ এর নেতৃত্বে তিন হাজার লোক দিন রাত ২৪ ঘন্টা পরিখা খননে লেগে গেলো। একমাস ধরে অনাহার ও অর্ধাহার অবস্থায় এ পরিখা খনন সমাপ্ত করা হয়। এ সময়ই রাসূল সঃ ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে পরিখা খনন করেছেন। পরিখা খননের মাঝে, মধ্যে এমন এক পাথর পড়ে যে তাকে আর কোনো অবস্থায়ই কেউ ভাংতে সক্ষম হচ্ছেনা। আল্লাহর রাসূল সঃ পেটে পাথর বেঁধে গর্তে নেমে স্বয়ং পাথর ভাঙ্গা হ্যামার হাতে নিলেন। রাতের বেলা ছিলো। আঘাত করতেই বিদ্যুতের মতো চমকে উঠে চারদিক। রাসূল সঃ ও সালমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করছেন। প্রতি আঘাতে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তাতে রাসূল সঃ ও সালমান দেখতে পাচ্ছেন যে একেক চমকে পারস্য, ইয়ামেন ও রোমান সিংহাসনের পতন হচ্ছে। রাসূল সঃ হ্যামারের আঘাতে চটানপাথর চৌচির হয়ে তিন টুকরা হয়ে ভেঙ্গে যায়। অভুক্ত পেটে পাথরবাঁধা নবী ও তাঁর অনাহার ক্লিষ্ট অনুসারীরা যেখানে আত্মরক্ষার জন্য পরিখা খনন করছেন, সেখানে আল্লাহ্ তাদের তখনকার পরাশক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের বিদ্যুৎবার্তা ইন্টানেটে দেখাচ্ছেন। ঈমানের চোখ খুললে মানুষ যেমন পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর দক্ষিণ দেখে, তেমনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎও দেখে। আর ঈমানে অন্ধ হলে সকল অতীত ও ভবিষ্যত ভুলে মানুষ শুধুমাত্র বর্তমান নিয়ে সব আদর্শত্যাগী অধম পশু হয়ে যায়। আল্লাহ্ ক্বোরআনে সংক্ষেপে এ শ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, যারা পার্থিব জীবনে এরূপ অন্ধ হয়, পরকাল সম্পর্কে এরা আরো অন্ধ এবং চরম বিপথগামী হয়। وَمَن كَانَ فِي هَٰذِهِ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًا (বনী ইসরাঈল-৭২)
রাসূল সঃ যেরূপ তাঁর আদর্শপিতা ইব্রাহীম আঃ এর অনুরূপ সকল গোত্রবাদ ও বর্ণবাদের উর্ধ্বে উঠে নবূওত প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সালমান, যায়দ, আম্মার ও বিলালরা ঠিক সে মান ও পরিমাপে রাসূলের অনুসারী হয়েছিলো। ফলে আল্লাহ্ তাদের দৃষ্টিশক্তিও খুলে দিয়েছিলেন। আজ ১৪১২ বছর পরও একটি ঈমানী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি যদি ১৪১২ বছর পেছনে গিয়ে রাসূল সঃ এর অসমাহিত লাশের পাশে দাঁড়ায়, আর ভাবে যে রাসূল সঃ মারা গেলেন। তিনি কি রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিমুহুর্তে যে অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছেন, তার সেনাপতি সম্পর্কে বলেছেন, যে, “এর পিতা আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে আমীর হওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলো, এবং আমার নিকট অবশ্যই সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তম ছিলো। তারপর, এ, অর্থাৎ উসামাহ্ আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তম”। তাও রাসূল সঃ তাঁর মৃত্যুশয্যায় কসম খেয়ে বলেছেন! এ সেনাপতি নির্বাচন, তাকে আমীর বলে উল্লেখ করা, তার অভিযানে না গেলে অভিশপ্ত হওয়া এবং তার অধীনে আবু বকর, উমর, পরবর্তী সকল খলীফায়ে রাশেদ কথিত ব্যক্তিবর্গ ও আশারায়ে মুবাশ্শারাকে বাধ্যতামূলক তার আনুগত্য করার নির্দেশ প্রদান কী কখনো শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন অভিযানের জন্য হতে পারে? রাসূল সঃ কি মৃত্যুর পর পুনঃ ফিরে আসবেন যে তারপর তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে দিয়ে যাবেন? তারপর তিনি “আল্ আইম্মাতু মিন ক্বোরেশ” বলে ক্বোরেশ গোত্রের ঔরসের মধ্যে ইসলামী ইমামতকে চিরস্থায়ী ঢুকিয়ে যাবেন? এ তো শুধুমাত্র সূরা মুহাম্মাদের ২৫ নং আয়াতে বর্ণিত মুর্তাদরাই ভাবতে, বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, “হেদায়েত ব্যক্ত করে দেয়ার পর যারা পিছনে জাহিলিয়্যাতের দিকে ফিরবে, তারা অবশ্যই শয়তানের শিষ্য। শয়তান তাদের বানান শিক্ষা দিয়ে, বাক্য গঠন করে, “ডিকটেট” করেছে।” ক্বোরআনের এ আয়াতটিতে “সাউয়ালা” ও আমলা” দু’টি খুব অর্থপূর্ণ শব্দ বলা আছে। সাউয়ালা শব্দের বাংলা প্ররোচিত করা, রাজী করা। ইংরেজীতে To tempt, allure, entice দ্বিতীয় শব্দ আমলার অর্থ বানান ও অক্ষর বলে শিখানো বা লিখানো। ইংরেজীতে Spelling and dictation ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আয়াতটি পড়া মাত্রই বক্তব্য দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায়। إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ এ রোগে আক্রান্তদের মুর্তাদ হওয়ার সংলাপও আল্লাহ্ পরবর্তী আয়াতে উল্লেখ করেছেন। ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ
কারণ হলো, ওরা আল্লাহর নাযিলকরা বিধান অপছন্দকারীদের গোপনে গোপনে বলে, “সময় মতো (?) কোনো কোনো ব্যাপারে আমরা তোমাদের অনুসরণ করবো”। আল্লাহ্ ওদের গোপন অভিসন্ধির খবর রাখেন। (সূরা মুহাম্মাদ-২৬) আল্লাহ্ গোপন জেনে সে গোপন তাঁর রাসূল সঃ কে জানিয়ে দেন। ফলে রাসূল সঃ তাঁর বিদায়ের সময় আসন্ন বুঝে সূরা ক্বাসাসের ৫ ও ৬ নং আয়াতের মর্মানুযায়ী মুস্তাদআফ ইমামত প্রতিষ্ঠা করে যান। তাতে মুর্তাদ ব্যতীত কারো সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। সরলমনা ঈমানদারদের তারপরও কোনো দ্বিধা থাকলে রাসূল সঃ এর মৃত্যুর পূর্বে বলা বোখারীর দুটি হাদীস পড়লে তা’সমপূর্ণ দুর হয়ে যায়। হাদীস দু’টি হলো:
(১)عن سالم عن أبيه استعمل النبى صلى الله عليه و سلم أسامة فقالوا فيه فقال النبى صلى الله عليه وسلم قد بلغنى أنكم فلتم في أسامة وإنه احب الناس إلى
(২)و عن عبد الله بن عمر رضى الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه و سلم بعث و أمر عليه أسامة بن بن زيد فطعن الناس في إمارته فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم إن تطعنون في إمارته فقد كنتم تطعنون في إمارة ابيه من قبل ، وأيم الله إن مان لخليقا للإمارة وإن كان لمن أحب الناس إلى وإن هذا لمن أحب الناس بعده
(১) সালিম তার পিতা থেকে বর্ণনা করছে যে রাসূল সঃ যখন উসামাহ্কে নিয়োগ করেন, তখন লোকেরা তার সমালোচনা করলে রাসূল সঃ বলেন, “আমার কাছে খবর পৌছেছে যে তোমরা উসামাহর নিয়োগ সম্পর্কে আপত্তি করছো। জেনে রাখো, সে আমার নিকট সকল মানুষ থেকে প্রিয়তম”। রাসূল সঃ সোমবার বেলা দশটার দিকে ইন্তিকাল করেন। শনিবার সকালে রোগশষ্যা ত্যাগ করে মসজিদে নববীর মেম্বারে উঠে এ ঘোষণা করে যান। (২) আব্দুল্লাহ্ ইবন উমর বর্ণনা করেছে যে রাসূল সঃ এক সমরাভিযান প্রস্তুত করে উসামাহ্কে তার আমীর নিয়োগ করেন। সে নিয়োগের বিরুদ্ধে লোকেরা আক্রমনাত্মক সমালোচনা উত্থাপন করে। তার উত্তরে রাসূল সঃ বলেছেন, “ইন তাত্ আনূ, অর্থাৎ আমার নিয়োগকে তোমরা যদি ছুরিকাঘাত করো (?)”। আরবীতে কাকেও পেছন থেকে ছুরিকাঘাত বা আক্রমন করাকে “তাআন্” বলা হয়। সোজা কথা দাঁড়ায়, “তোমরা যদি আমার উসামাহ্র নিয়োগকে ছুরিকাঘাত করতে চাও, তোমরা পূর্বে যেমন তার পিতার নিয়োগকেও করতে চেয়েছিলে, তা সফল হবে না। কারণ, আমি আল্লাহ্র শপথ করে বলছি যে, উসামাহ্র পিতা যেমন সন্দেহাতীত নেতৃত্বের যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলো, সে সঙ্গে সে আমার নিকট সকল মানুষের তুলনায় প্রিয়তমও ছিলো। এ উসামাহ্ তার পিতার পর আমার নিকট সকল মানুষ থেকে প্রিয়ভাজন” (বোখারী দেখো, ষষ্ঠ খন্ডের “রাসূলের অসুস্থতা ও মৃত্যু” অধ্যায়ের ১৯ পৃষ্ঠা)। রাসূল সঃ এর আমীর নিযুক্তি ও উসামাহর অভিযানকে যে বা যারা ছুরিকাঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলো, তারা কি মাদীনার ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের কেউ বা আব্দুল্লাহ ইবন উবাইর দল ছিলো? তার পূর্বেই তো মাদীনা থেকে ইয়াহুদীরা সমূলে নির্বাসিত ও বিতাড়িত হয়েছিলো! তখনতো মাদীনার শতমাইলের মধ্যেও কোনো ইয়াহুদী ছিলোনা! তা হলে রাসূল সঃ এর বিদায়কালীন নিযুক্তিকে কারা ছুরিকাঘাত করতে সচেষ্ট হয়েছিলো??? তিনি কাগজ কলম চাইলে তা দিতেও তো কোনো ইয়াহুদী মুনাফিকরা বাধা দেয়নি! এরা যদি ঘনিষ্ঠরা না হয়ে দূরের লোকেরা হতো, তাদের বিরুদ্ধে সিদ্দীকে আকবর ও ফারুকে আযমদের তরবারী কই?! তার তো কোনো উল্লেখ আমরা পাই না? তা কেনো?! এসবের পেছনে ঐ মিয়ারাই ছিলো, যারা পরবর্তী সকল অঘটন ঘটিয়ে উসামাহ্, ইবন মাসউদ, বিলাল ও সালমানদের পেছনে ঠেলে দিয়ে মুয়াবিয়া, খালেদ, আমর ইবনুল আস ও মুগীরাদের সামনের কাতারে এনে ইয়াযীদ ও মারওয়ানদের আমীরুল মু’মিনীন, খলিফা ও ইমামুল মুসলিমীন হওয়ার পথ করে দেয়। যার ফলে সালাত ভিত্তিক সমাজ আজ “ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লীন” দের পাপে অভিশপ্ত। রাসূল সঃ যে মে’রাজের সালাত শিক্ষা দিয়ে বলে গিয়েছেন صلواكما رأيتمونى اُصلى “সালাত আদায় করতে দেখেছো, সে ভাবে তোমরা সালাত আদায় করবে” সে সালাত আদায় করেও আমরা তাঁকে দাফন করতে ব্যর্থ হয়েছি। সে থেকে আমাদের প্রত্যেক কাজে ব্যর্থতা। ধাপে ধাপে অধঃপতন وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُم مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ “যারা আমার আয়াতকে অবিশ্বাস করে, অবশ্যই আমি তাদের ধাপে ধাপে নির্মূল করবো। তারা তা টেরও পাবেনা।” (সূরা আরাফ-১৮২) মুস্তাকবিরী থেকে তওবা করে মুস্তাদআফদের পথ না ধরলে এ ভাগ্য পরিবর্তন হওয়ার নয়। রাসূল সঃ সালমানের পরামর্শ অনুযায়ী পরিখা খনন করে আমাদের তার বরকত ও ফল প্রত্যক্ষ ভাবে দেখিয়ে গিয়েছেন। আম্মারের আবদার ও জমানো পাথর দিয়ে ক্বোবায় মসজিদুত্তাক্বওয়া বানিয়ে আজো বিশ্ব থেকে আসা হজ্ব ও ওমরা পালনকারীদের জন্য আলোর দিশা ছড়ানো হচ্ছে। আল্লাহ্ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। কিন্তু তিনি পৃথিবীতে তাঁর বান্দাদের হাতে তা করিয়ে থাকেন। সালমানের পরামর্শে পরিখা খননের ফলে আল্লাহ্র রহমতে মাদীনায় আল্লাহর রাসূল সঃ, তাঁর দ্বীন ও তিন হাজার মু’মিন নিরাপদ হয়। তা না হলে কী হতে পারতো তাকি ভাবা যায়? তারপর বারো হাজার শত্রুর একমাস কাল অবরোধে রাসূল সঃ ও তাঁর সঙ্গীদের অন্তরাত্মা ভয়ে কন্ঠনালীর কাছে পৌছে গিয়েছিলো বলে আল্লাহ্ ক্বোরআনে বলেন। সে বর্ণনা এখনো পড়ে সারা শরীর হীম হয়ে অবশ হয়ে যেতে চায়। মহান আল্লাহ্ বলেন ঃإِذْ جَاءُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا
“স্মরণ করো সে অবস্থার কথা, যখন তোমাদের শত্রুরা উপর ও নিচ থেকে এসে তোমাদের ঘিরে ফেলেছিলো, ভয়ে তোমাদের চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিলো। কলিজা মুখের কাছে চলে এসে গিয়েছিলো এবং আল্লাহর সমপর্কেই তোমরা নানান কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছিলে। আদৌ আল্লাহ্ আছেন কি নেই! ইত্যাদি। এভাবে তখন চরম ঝাঁকুনী দিয়ে মু’মিনদের পরীক্ষা করা হয়েছিলো। فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا তারপর আমি আমার সৈন্য ও ঝড় পাঠিয়ে তোমাদের রক্ষা করি ও শত্রুদের পরাস্ত করি।” আহার নিদ্রাহীন দীর্ঘ একমাস অবরোধে ও তার পূর্বে দিবা রাত্রি একমাস ধরে পরিখা খননের ক্লান্তি ও উৎকন্ঠার পর আল্লাহ্ হঠাৎ করে এক রাত্রে এক ঝড় ও ঠান্ডা বৃষ্টি দেন যে তা শত্রুদের সকল তাবু উড়িয়ে নিয়ে যায়। পশু, উট-ঘোড়া বাঁধার খুঁটি উপড়ে তার পিটুনীতে ভয়ে পশুদের যত্রতত্র পলায়ন, পাকানো খাদ্যের ডেগ ও চুলার আগুন উড়ে হঠাৎ করে কাফের সেনাদের উপর পতন। সব মিলিয়ে ওদের উপর ছোটো খাটো ক্বেয়ামত ঘটে যায়। ফলে যে যেভাবে পেরেছে শত্রুরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। ঠিক পূর্বের দিন রাসূল সঃ ও তার সঙ্গীদের যে দুরাবস্থা ছিলো, তা সম্মিলিত শত্রুবাহিনীর উপর এক রাতের ব্যবধানে ঘটে যায়। সকালের আলোতে আল্লাহ্র রাসুল সঃ ও তাঁর মুস্তাদআফরা দেখতে পায় যে, পরিখার অপর পাড়ে মুস্তাকবিরদের কোনো চিহ্নও নেই। আলহামদুলিল্লাহ! এখনো আমরা রাসূল সঃ এর সঠিক অনুসারী হলে কি আল্লাহ্ আমাদের পক্ষে সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেন না? নূহের শত্রুদের চল্লিশ দিনের বন্যায় নিশ্চিহ্ন করেছেন। শক্তিশালী সামুদদের একটি মাত্র প্রচন্ড শব্দ দিয়ে পঙ্গপালের মতো মেরে বিছিয়ে দিয়েছেন। আদ্দের সাত রাত ও আট দিনের ঘূর্ণীঝড়ে উৎপাটিত করেছেন। সে আল্লাহ্ মু’মিনদের সাহায্য করার অঙ্গীকারে এখনো তাঁর আরশে আসীন। এসো বিশ্বের নির্যাতিতরা, আমরা সালমানদের অনুসরণে পুনঃ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হই। তখনকার দিনে আরবদ্বীপের বাসিন্দারা বহির্বিশ্বের মানুষদের আজমী বলতো। ইরাক হয়ে ইরানের সাথে স্থল যোগাযোগ ছিলো বলে ইরানীরাই তাদের প্রতিবেশী আজমী ছিলো। রাসুল সঃ যখন সূরা মুহাম্মাদের শেষ আয়াত পাঠ করে শোনান যে তাঁর সঙ্গী আরবরা যদি তাঁর শিখানো আদর্শ পরিত্যাগ করে, তা হলে আল্লাহ্ তাদের পরিবর্তন করে তার স্থলে অপর জাতিকে আল্লাহ্র দ্বীনের পূর্ণ বিজয়ের দায়িত্ব দিবেন। এ কথা শুনে, উপস্থিত সাহাবীরা সে সম্ভাব্য জাতি কারা হতে পারে, জিজ্ঞাসা করলে আল্লাহর রাসূল সঃ সালমানের কাঁধে হাত তুলে বলেন, “এ সালমান ও তার জাতি।” অর্থাৎ অনারব, আজমীরা। এর আরো ব্যাখ্যা করে রাসূল সঃ বলেন যে, ভূপৃষ্ঠ থেকে আল্লাহর দ্বীন পরিত্যক্ত হয়ে আকাশে উঠে গেলেও সালমানের মতো লোকেরা সে দ্বীন পুনঃ ধরায় নামিয়ে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করবে। (মুসলিম, আবু হুরায়রা থেকে এ ঘটনা বর্ণনা করেছে) পরিখা খননের সময় পাথর ভাঙ্গার আঘাতে চমকানো আলোতে সালমান যে তখনকার পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েন দেখতে পায়, পারস্য জয় হলে সালমানকে সে মাদায়েনের আমীর নিযুক্ত করা হয়। সেখানে শাহী প্রাসাদে সালমান এক রাতও কাটায়নি। রাষ্ট্র পরিচালনার দপ্তর হিসেবে প্রাসাদ ব্যবহৃত হলেও সালমান প্রাসাদের বাইরে একটি কুঁড়েঘর তৈরী করে তাতে বাস করে। রাষ্ট্রীয় ভান্ডার থেকে কোনো ভাতা সালমান গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রীয় কাজের ফাঁকে বসে নিজ হাতে সে খেজুর-খাগড়ার ঝুড়ি ও মাদুর বানাতো, তা দিয়েই সালমান জীবিকা নির্বাহ করতো। অতীব দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলতে হয় যে, যায়দ, সালমান ও উসামাহ্দের বাদ দিয়ে যেহেতু ইসলামের ভিতই রচিত হয় না এবং ইসলামের নাম ব্যতীত পরবর্তী আরবী সাম্রাজ্যের বংশপরিচয় দেয়া যায় না, তাই সালমানদের নাম মুহাদ্দিস ও মুফাস্সিররা নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তার পরবর্তী বংশধরদের কোনো হাদিসই বই কিতাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার একক চেষ্টায় যদি বিশ্বে পুনঃ বারাকাহ, যায়দ, বিলাল, ইবন মাসউদ, আম্মার ও উসামাহ্দের কাফেলা ও সৈন্য বাহিনী পুনঃ দাঁড়িয়ে যায়, তা হলে আমি নিশ্চিত যে, বিশ্বে নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সঃদের রিসালাত ও শারিয়াতের ইমামত গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার এ লিখনীকে বিশ্বেমানবের নাজাতের জন্য হযরত নূহ আলাইহিস্ সালামের কিস্তির মতো বাজারে ভাসিয়ে সে নূহ আঃ এর দোয়া দিয়েই হযরত সালমান ইবনুল ইসলাম, সালমান ইব্নুল ইসলাম ও সালমান ইবনুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী শেষ করছি। “হে আমার প্রতিপালক, ধরাপৃষ্ঠে আপনি কাফেরদের একটি ঘরও রাখবেন না। আপনি যদি রাখেন, তারা শুধু আপনার বান্দাদের বিপথগামী করতেই থাকবে এবং তারা কাফের পাপীষ্ঠই জন্ম দিবে। হে আমার প্রতিপালক আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে মাগফিরাত দান করুন। যারা খাঁটি মু’মিন রূপে আমার ঘরে প্রবেশ করবে, তাদের ক্ষমা করুন ও অন্যান্য মু’মিন নরনারীদেরও। কিন্তু অত্যাচারীদের শুধু ধ্বংসের পর ধ্বংসই করতে থাকুন।” আমীন। সালমানের পরিচয়ের সাথে হযরত নূহের প্রসঙ্গ টানার কারণ হলো যে, সালমান মতান্তরে দু’শ, আড়াইশ এবং তিনশ বছর নাকি আয়ূ পেয়েছিলো। হযরত নূহ ন’শ পঞ্চাশ বছর আয়ূ পেয়েছিলেন। সালমান তাঁর চেয়ে কম আয়ূ পেলেও তার সমসাময়িকদের চেয়ে বেশী আয়ূ পেয়েছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু খাতামুন নাবিয়্যীন সঃ কে পেতে তার যে পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত আছে বলে আমার জানা নেই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File