চিলেকোঠার বারান্দাটা

লিখেছেন লিখেছেন অগ্রহায়ণ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৪:১৭:০৫ বিকাল

অনু কে যত বার দেখি আমার চোখ আটকে যায়। আমি নস্টালজিক হয়ে যায়। আমার অতীত আমাকে বার বার টেনে নিয়ে যায় চিলেকোটার বন্ধ বারান্দায়।

আমি তখন অনেক ছোট। অবশ্য সবকিছু বুঝতে শিখেছি। কিন্তু আমার কথা বলার সুযোগ ছিল না।

বড়দা তখন বিএ পাস করে বেরিয়েছে। চাকরি বাকরি খুজছে। সারাদিন চাকরির পিছে ছুটাছুটি করে যখন ঘরে ফিরত, আব্বা একটু উচু গলায় বলত- কি বড় সাহেবের কোন গতি হল। নাকি শুধুই ঘুরাঘুরিতেই জীবন যাবে।

বড়দা কিছুই বলত না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলত। মাথা নিছু করে ভাত খেয়ে বেরিয়ে যেত। রাতে ঘুমানোর সময় আমার পাশে শুয়ে বলত, এই ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে রে অগ্র।

বড়দা কে কখনোই হাসতে দেখা যেত না। শুধু যখনি আইরিন আপু কে দেখত অথবা কথা বলত তখনি মুখে হাসি দেখা যেত।

আইরিন আপুরা আমাদের মহল্লার সবচেয়ে অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের একটি। সারাক্ষন কি সুন্দর সেজে গুজে থাকত। দেখতে একেবারে পরীর মত লাগত। আর যখন বড়দা'র সাথে কথা বলত তখন কি যে নার্ভাস দেখাত থাকে।

আমি সব লক্ষ করতাম ওদের গতিবিধি। একটা অবাধ্য কৌতুহল জাগত আমার। আইরিন আপু ওদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাড়িয়ে বড়দা'র সাথে ঈশারায় কথা বলত। আমি বুঝার চেষ্টা করতাম তারা কি বলছে।

মাঝে মাঝে আমাকে ওদের চিটি চালাচালি করে দিতে হত। এতে অবশ্য আমার লভ্যাংশ আমি কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতাম। বিশেষ করে আইরিন আপুর কাছ থেকে কত টাকা, কত খুটি নাটি উপহার যে নিয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই।

একদিন বিকালে চিলেকোটার ঘরে আমি আর বড়দা শুয়ে আছি। এমন সময় বাড়ির নিচে থেকে হইচইয়ের আওয়াজ পেলাম।

আমি আর বড়দা নিচে গেলাম দৌড়ে। গিয়েই আমরা বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম।

বাড়ির উঠানে আইরিন আপুর বাবা এসে ঘর বাড়ি মাথায় তুলেছে। যাচ্ছে তাই বকে যাচ্ছে বড়দা কে নিয়ে। আমার বাবা কে নিয়ে। আমাদের ফেমেলি নিয়ে।

আমার বাবা আইরিন আপুর বাবার সামনে অসহায়ের মত দাড়িয়ে ছিল। যেন একটা পাথর। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ ও করেননি। দরজার আড়ালে আম্মা মুখে আচল দিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। তার চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছিল বোবা কান্না।

রাতে খাবার টেবিলে হঠাৎ আব্বা চেচিয়ে উঠলেন, আর কত জ্বালাবি আমাকে। এবার আমাকে মুক্তি দে। বিএ পাস করে ঢেই ঢেই করে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস। চাকরি বাকরির চিন্তা তো নেই। বাপের হোটেল আছে না।

আম্মা আব্বা কে বাধা দিয়ে বললেন, আহা বাদ দাও না এখন। খাবার সময় শাসন করতে হবে না।

আব্বা আরো ক্ষেপে গেলেন, সারা জীবন ই তো শুধু গিলেই যাচ্ছে। এত বছর যদি একটা গরু পোষতাম তাহলেও আমার অনেক লাভ হত। এই ছেলে যে আমার সে পরিচয় দিয়েও গিন্না লাগে.......

পরদিন দুপুরে বড়দা কোত্তেকে জানি এসে দৌড়ে দোতলায় উঠে গেল।

বিকেল পর্যন্ত বড়দা'র আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।

সন্ধ্যার সময় হঠাৎ আম্মা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমি পড়ার টেবিল থেকে তাড়াতাড়ি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে থমকে গেলাম।

আম্মা বেহুশ হয়ে পড়ে আছে বারান্দায়।

আর......সিলিংয়ের সাথে ঝুলে আছে বড়দা'র অভিমানি দেহ।

নিথর..... নিশ্চুপ।

বড়দা চলে যাবার এক মাসের মাথায় আইরিন আপুর বিয়ে হয়ে গেল।

তখন আমি বড়দা'র মৃত্যুর জন্য আইরিন আপুকে দায়ী করতাম।

কিন্তু বছর তিনেক পর যখন শুনলাম আইরিন আপুর তালাক হয়ে গিয়েছে। কোলে তার মেয়ে অনু আর একটা লাগেজ নিয়ে ঊঠে এসেছে বাপের বাড়ি।

তখন তার প্রতি সমস্ত ক্ষোভ নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোড়া পেতে যখন আমি আর আম্মা উঠানে বসে থাকি, তখন পাশের বিল্ডিং থেকে আইরিন আপু তার মেয়ে কে পড়ানোর শব্দ শুনি।

কখনো ছোট্ট অনু গলা ফাটিয়ে কাদঁতে থাকে। কখনো আওয়াজ করে নামতা পড়ে।..... তিন তের ঊনচল্লিশ......চার তের বায়ান্ন.....

আম্মা বিষন্ন হয়ে ও বাড়ির জানালায় চেয়ে থাকে। আর আমি আকাশের তারা দিকে তাকিয়ে বড়দা কে খুজি।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৯৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300549
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৫:০০
হতভাগা লিখেছেন : ''তখন আমি বড়দা'র মৃত্যুর জন্য আইরিন আপুকে দায়ী করতাম ''


০ বড়দা তো তার বাবার ঝাড়ি খেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে । দায়ী হলে বাবাই দায়ী হবেন । অগ্র পশ্চাত বিবেচনা না করে আইরিন আপুকে শুধু শুধু দোষী মনে করতেন ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File