‘বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ই-ভ্যালির কাছে এখন যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা মেটানো সম্ভব নয়।’ শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইভ্যালির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের এমন মন্তব্যে গভীর হতাশা নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের মাঝে। তারা বলছেন, যে উদ্দেশ্যে ইভ্যালির পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল তা আর কোনো কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। সব টাকা ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতেও এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দিন যতো গড়াচ্ছে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ততো দীর্ঘ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে কখনোই আস্থা ফিরবে না ই-কমার্সখাতে। সূত্র জানায়, বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির সাভারের দুটি গুদামে ২৫ কোটি টাকার পণ্য রয়েছে। আর গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দায় ৪০৩.৮০ কোটি টাকা। পিঙ্ক সিটির গুদামে ইভ্যালির ১৬ কোটি টাকার ২,৬৫৯টি এবং বালিয়াপুরের গুদামে ৯ কোটি টাকার ১,৭৩৬টি আইটেম রয়েছে। জুবায়ের নামে এক গ্রাহক বলেন, ই-অরেঞ্জে তার ৩ লাখ ১৬ হাজার, ইভ্যালিতে আড়াই লাখ টাকাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ লাখ টাকা আটকে আছে।
এখন পর্যন্ত এক টাকাও ফেরত পাননি। ঋণ করে তিনি টাকাগুলো দিয়েছিলেন।
এখন হতাশা জেঁকে বসেছে। উত্তরার বাসিন্দা সিরাজুল নামে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, আমি ৯৬ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করেছিলাম। সেগুলো পাইনি, পরে দোকান থেকে কিনেছি। পরে শুনি আমার মতো অনেকের কোটি টাকা আটকে আছে। কবে টাকা পাবো তা নিয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমি হতাশ। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ই-কর্মাসে আস্থা ফেরাতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। গেটওয়েতে আটকে থাকা কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে ই-কমার্সখাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। আস্থার সংকট আরও বাড়বে। জানা গেছে, গত বছরের ১৬ই সেপ্টেম্বর গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রতিষ্ঠানটির সব অফিস বন্ধ হয়ে যায়। এর একমাস পরে বন্ধ হয় ইভ্যালির ওয়েবসাইট ও অ্যাপ। গত অক্টোবরের পর ইভ্যালির ফেসবুক পেজে কোনো পোস্ট হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য বলছে, গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা ৫৪৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক রয়েছে দুই লাখের বেশি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার কম। যদিও র্যাবের দাবি, ইভ্যালি থেকে গ্রাহক মার্চেন্টের পাওনা ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত শুক্রবার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, বারবার ধরনা দিয়েও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের কাছ থেকে মূল সার্ভারের পাসওয়ার্ড উদ্ধার করা যায়নি।
এক পাসওয়ার্ডেই আটকে আছে ইভ্যালির গ্রাহকদের অর্থ। ইভ্যালির অডিট কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে চলতি মাসের শেষ নাগাদ অডিটের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এর আগে ইভ্যালির ৭টি গাড়ি নিলামে বিক্রি করে প্রায় ৩ কোটি টাকা আয় হয়েছে। ওই সময় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানিয়েছিলেন, এই টাকা ইভ্যালির গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে কাজে লাগানো হবে। এরও আগে পাসওয়ার্ড না থাকায় ভাঙা হয় ইভ্যালির দু’টি লকার। একটি লকারে মিলেছে একাধিক ব্যাংকের ১০৭টি চেকবই। আরেকটিতে ছিল ২ হাজার ৫৩০ টাকা। এদিকে ইভ্যালির সাবেক এমডি ও সিইও গ্রেপ্তার হলে তাদের মুক্তির দাবিতে বেশ কয়েকবার মানববন্ধন করে গ্রাহক, মার্চেন্টদের একাংশ। গত শুক্রবারও ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ের সামনে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সিইও রাসেলের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন একদল গ্রাহক। তাদের দাবি, ইভ্যালির রাসেলকে মুক্তি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দিলে প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াবে। গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন।
মার্চেন্টরাও পাবেন। মিলবে বিনিয়োগকারীও। ইভ্যালি নিয়ে আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, এই পরিচালনা পর্ষদ কোনোভাবেই কাউকে টাকা ফেরত দিতে পারবে না। তাদের কাছে কোনো প্রকার তথ্য নেই, টাকা দেবে কীভাবে। রাসেল ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে দাখিল করা সম্পদ ও দায়ের হিসাব দিয়ে ইভ্যালি জানিয়েছিল, তাদের মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকাই কোম্পানিটির চলতি দায়। ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার এ দ’ুটির যোগফলকে দেখানো হচ্ছে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে। মোট দায় ৫৪৩ কোটি টাকা থেকে এই অঙ্ক বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৮ কোটি টাকা, যাকে ইভ্যালি বলছে তার অস্থাবর সম্পত্তি।
বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্যমান সম্পত্তি। কোম্পানিটি নিজের ব্র্যান্ড মূল্য নিজেই নির্ধারণ করেছে। ইভ্যালির পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের ধৈর্য ধারনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। কোম্পানি বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আপনারা যেন পণ্য অথবা টাকা ফেরত পান, সেই চেষ্টা করছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন