ঢাকার একটি ফুড কোম্পানিতে চাকরি করেন মিজানুর রহমান। একদিন আগেই তার ছুটি শেষ হয়েছে।
এখন তার কর্মস্থলে ফিরতেই হবে। সকাল ১০টার দিকে তিনি নাটোর থেকে রওনা হয়ে দুপুর একটার দিকে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় এসে পৌঁছেছেন মাত্র।
আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য তিনি মাইক্রেবাস কিংবা প্রাইভেটকার খুঁজছিলেন। কিন্তু এক প্রাইভেটকারের ভাড়া ১৫শ’ টাকা ও মাইক্রোবাসের ৮শ’ থেকে ১ হাজার। নিরুপায় হয়ে ৪০০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে ট্রাকে চড়েই যাত্রা শুরু করেন। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খোলা ট্রাকের ভেতরে প্রায় অর্ধশতাধিক যাত্রীর মধ্যে গাদাগাদি করে যেতে হচ্ছে তাকে।
একই ট্রাকে চেপে বসেছেন মরিয়ম বেগম, শোভা খাতুন, আব্দুল খালেকসহ বেশ কয়েক গার্মেন্টসকর্মী। এদের মধ্যে দু’একজনের মুখে মাস্ক দেখা গেলে বেশিরভাগই ছিলেন মাস্কবিহীন।
মাস্কের কথা জিজ্ঞাস করলে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নেন। কেউ কেউ বিশ্বাসের সঙ্গে জোর গলায় বলে ফেলেন, `করোনা আমাগোরে না বড়লোকগোরে ধইরেবো। '
জানতে চাইলে ওই ট্রাকের চালক রানা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যাত্রীদের মাস্ক পড়ার জন্য অনেক বুঝাই, কিন্তু তারা কিছুই বোঝে না।
বুধবার (১৯ মে) বিকেলে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় গিয়ে এরকম অসংখ্য ট্রাককে যাত্রী তুলতে দেখা যায়। যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত যাত্রী। প্রতি ৫ মিনিটেই এক একটি ট্রাক ভরে যাচ্ছে। তবে কোনো ট্রাকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই দেখা যায়নি।
কথা হয় আসাদ, তারিকুল আরিফসহ একাধিক যাত্রীর সঙ্গে। তারা বাংলানিউজকে বলেন, যত কষ্টই হোক ঢাকায় যেতেই হবে। ঢাকায় না গেলে চাকরি থাকবে না। তাই করোনা ঝুঁকি ও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা ট্রাকেই ছুটে চলেছেন কর্মস্থলের উদ্দেশে।
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন ঢাকার সাভারের ব্যবসায়ী সাকিব। তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফিরছেন। দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি মাইক্রোবাসে সওয়ার হয়েছেন তিনি। পরিবারের চার সদস্যের জন্য চার হাজার টাকাই ভাড়া দিতে হচ্ছে তাকে। তারপরও ভেতরে আরও ১০ জন যাত্রী তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ তার। এখানে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন সুযোগই নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে গাদাগাদি করে ট্রাক-মাইক্রোবাসে চেপে যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে অধিকাংশের মুখে কোনো মাস্ক দেখা যায়নি। ওইসব যাত্রীরা বলেন, করোনা ভাইরাস বড়লোকের অসুখ। আমাগোরে ওই রোগ ধইরবোই না। ধইরলেও আমরা মরুম না। আমরা পরিশ্রম কইর্যা খাই। এসব অসুখ-বিসুখ আমাগোরে কাছে কিছুই না। যারা ঘুষ খায়, আর এসি গাড়ি ও এসি বাড়িতে থাকে। তারাই করোনায় মইরত্যাচে।
মাস্ক ছাড়া যাত্রী তোলার বিষয়ে কথা হয় দিলীপ, শফিকুল ও বাবুসহ বেশ কয়েক ট্রাক চালকের সঙ্গে। তারা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যাত্রীদের বললেও তারা শোনে না। তারা ট্রাকে উপর একরমক আনন্দ করতে করতেই ভ্রমণ করে।
এদিকে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. ফরিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যারা এসির মধ্যে থাকে তারাই শুধু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে-এটা সম্পূর্ণ ভূল ধারণা। ট্রাকে যেভাবে গাদাগাদি করে যাত্রীরা যাচ্ছেন করে ওই ট্রাকে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী থাকলে সবাই আক্রান্ত হবেন এটা নিশ্চিত।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের ৫ দিন আগে থেকে ৫ দিন পর পর্যন্ত যেভাবে ট্রাকে করে মানুষ যাতায়াত করেছে-তাতে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজাহান আলী বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের ছুটিতে ট্রাক-মাইক্রোবাস ও হোন্ডায় চড়েই ঢাকা থেকে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। আবার এসব পরিবহনেই তারা ফিরে যাচ্ছে। যাওয়া-আসা কোনক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়নি। আমরা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে যাত্রীদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ট্রাকগুলো আমাদের নজর এড়িয়ে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাত্রী ও ট্রাকের সংখ্যা এতো বেশি যে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন