রাজধানীর কিছু এলাকায় কল্যাণ সমিতির নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে অবসরপ্রাপ্ত আমলা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের। চাকরি জীবনের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখতেই তাদের এসব পদে আসা।
সামাজিক সংগঠনের নেতা হিসাবে এদের অনেকেই চাকরি জীবনের চেয়েও বেশি প্রতাপশালী হয়ে উঠেছেন। নেতা পরিচয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছেন তদবির বাণিজ্যে। লক্ষ্য একটাই অবসর জীবনেও ক্ষমতার ছড়ি ঘুরানোসহ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ কল্যাণ সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার এ ধরনের প্রভাবশালীদের দখলে। নির্বাচনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে নতুন যারা আসেন তারাও মরিয়া হয়ে ওঠেন।
মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের। আবার অনেক জায়গায় কমিটি দখল নিয়ে মামলা পালটা মামলা, হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এসবের পর নির্বাচন হলে সেখানেও তারা ব্যয় করছেন লাখ লাখ টাকা।
নেতৃত্বে প্রভাবশালীরা : রাজধানীর বেশির ভাগ কল্যাণ সমিতির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের তালিকায় আছেন সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা, টেলিফোন বোর্ডের সাবেক সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক এবং বর্তমান পদস্থ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও বাদ যান না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটি এলাকায় মোহাম্মদী কল্যাণ সমিতির নেতৃত্ব প্রভাবশালীদের দখলে। কমিটি দখল করে রাখায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন বন্ধ। এ বিষয়ে মামলাও হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরে কমিটির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন নজরুল ইসলাম মুকুল। কিন্তু তিনি এখন ভয়ে তটস্থ। কমিটির প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতেও রাজি নন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম মুকুল যুগান্তরকে বলেন, কমিটির নেতারা অবৈধভাবে চেয়ার দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া কমিটির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপ ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
মোহাম্মদী কল্যাণ সমিতির কার্যালয় মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৪ নম্বর রোডে কুবা মসজিদের দোতলায়। পহেলা মে দুপুরে সেখানে গেলে কার্যালয়টি বন্ধ পাওয়া যায়। সমিতির সভাপতি খশুরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র বলছে, মোহাম্মদী কল্যাণ সমিতি মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে। বর্তমান কমিটির বৈধতা নেই।
বনশ্রী সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির নিরুর বিরুদ্ধেও গুরুতর সব অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া সমিতির প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করেন। সেগুনবাগিচা কল্যাণ সমিতির কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বনশ্রী সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির নিরু রোববার যুগান্তরকে বলেন, সোসাইটির নেতৃত্ব নিয়ে একটি অভিযোগ করেছিল যা উচ্চ আদালত থেকে মীমাংসা হয়েছে। এখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। ভালো কাজ করতে গেলে সমালোচনা হবেই। এটা স্বাভাবিক।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির নেতা পুলিশ ইন্সপেক্টর একেএম নাসিরুল্লাহ। তবে তিনি অবসরপ্রাপ্ত নন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশে কর্মরত। অথচ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিনি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখলে রেখেছেন। কারণ নাসিরুল্লাহ উত্তরায় প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত। তিনি ১২ নম্বর সেক্টরের স্থায়ী বাসিন্দা।
৫ মে এই সেক্টরে গিয়ে দেখা যায়, ৯ নম্বর রোডে পার্কসংলগ্ন তার বাড়িটি ৬ তলা। বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই বাড়ি তিনি কিভাবে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন, নাসিরুল্লাহ অঢেল সম্পদের মালিক।
কর্মরত পুলিশ অফিসার হয়েও সমিতির নেতৃত্ব কিভাবে দিচ্ছেন জানতে চাইলে একেএম নাসিরুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সামাজিক সংগঠনে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আইনে কোনো বাধা নেই। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অনুমোদন রয়েছে। তা ছাড়া তিনি একা নন, কর্মরত অনেকেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। নির্বাচন ঘিরে নানা ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলো স্বাভাবিক বিষয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমিতির নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা ওড়ে। নির্বাচনের আগে পোস্টার, ব্যানার ফেস্টুনে এলাকা ছেয়ে যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গরু জবাই করে সদস্যদের খাওয়ানো হয়। কোনো কোনো আবাসিক এলাকায় সভাপতি বা সেক্রেটারি পদে ৫০ লাখ টাকাও খরচ হয়। নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক নেতার বিরুদ্ধে সমিতির তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে।
রাজধানীর বেশির ভাগ সমিতির হিসাব অডিট হয় না। অথচ কল্যাণ সমিতির প্রধান কাজ বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, চিত্তবিনোদনসহ বসবাসের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা। সরকারি প্রকল্প হলে সুযোগ সুবিধা বুঝে নেওয়া বা আদায়ে ভূমিকা রাখা। কিন্তু বেশির ভাগ সমিতির নেতারা মূল ভূমিকা পাশ কাটিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। নেতাদের অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন আবাসন, পানি এবং নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায়। ফলে স্বার্থের দ্বন্দ্বে কমিটির দখল নিয়ে মামলা হামলাও থেমে নেই।
উত্তরা ১৩ নম্বর কল্যাণ সমিতির অর্থ সম্পাদক কাজী মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা অবসরে গেলে তারা চেয়ারের ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু অনেকেই অবসর জীবনে এ বিষয়টি মানিয়ে নিতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠনের নেতা হতে পারলে তাদের ক্ষমতা ও সম্মান কিছুটা হলেও বহাল থাকে। মানুষ সমীহ করে কথা বলে।
উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এই যেমন ধরেন সিকিউরিটি গার্ডরা সালাম দিয়ে দাঁড়ায়। মসজিদে জায়নামাজ বিছিয়ে জায়গা সংরক্ষিত রাখে। টাকা পয়সা ওয়ালা মানুষেরা তো এসবই চান। তারা সাধারণ মানুষের কাতারে অনেকেই নেমে আসতে চান না।’ এসব কারণে রাজধানীর প্রভাবশালী এলাকার হাউজিং সমিতির নেতা হওয়ার জন্য এমন মানসিকতার কর্মকর্তারা মরিয়া হয়ে মাঠে নামেন। কেউ কেউ চাকরিতে থাকাবস্থায় এসব পদ দখলে নেন, কেউ নেওয়ার চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, কমিটির প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে তদন্ত করতে আসে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মাঝখান থেকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ভালো অঙ্কের সম্মানি নিয়ে চলে যান। আবার অনেক ক্ষেত্রে যারা অভিযোগ করেন তাদের স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কথিত নেতাদের দিয়েও হুমকির ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের শহর-৬ এর কর্মকর্তা কেএম শহীদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘বেশির ভাগ হাউজিং সোসাইটি বা কল্যাণ সমিতি দখল পালটা দখল এসব নিয়ে ঝামেলা আছে। অথচ এসব সংগঠনের নেতৃত্বে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা আছেন। অনেক সময় আমরা বিবাদ মীমাংসার জন্য গিয়ে তাদের বলি, আপনাদের তো পাওয়ার আর কিছু নেই। এখন দেওয়ার সময়। কিন্তু তারা মানতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে এমন সব ব্যক্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন যে তাদের সামাজিক অবস্থানের সামনে আমাদের পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তারা নিতান্তই তুচ্ছ। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যত আমাদের কিছুই করার থাকে না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন