হিন্দুস্তানী নয়, চাই ইসলামবান্ধব বাঙালি সংষ্কৃতির চর্চা
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল রাহাত ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ০৯:৩১:১৭ সকাল
সংষ্কৃতি একটি জাতির পরিচয় বহন করে চলে। ভাষা, বর্ণ, কৃষ্টি-কালচার, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও জাতীয় অর্জনগুলোকে ঘিরে একটি জাতির সংষ্কৃতি গড়ে ওঠে। আবার ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহ সংষ্কৃতিকে প্রভাবিত করে থাকে। ফলে কালক্রমে সংষ্কৃতিও বিকশিত ও বিবর্তিত হয়। এতে দুষের কিছু নেই। কোন জাতির অতীত সংষ্কৃতিতে কুসংস্কার বা মন্দ কোন প্রথা থাকলে তা বর্জন করাই বরং বাঞ্চনীয়। অতীত সংষ্কৃতিকে ধরে রাখতে সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলা হয়। কিন্তু অতীতের কিছু সংষ্কৃতি বিবর্তিত ও বিকশিত হয়ে বর্তমান নাগরিকদের চিন্তা চেতনাকে ধারণ করতেই পারে। তবে এই বিকাশ ও বিবর্তন যদি অন্য দেশ থেকে ধার করে বা জনগণের মূল চেতনা পরিপন্থী আচার-অনুষ্ঠান চাপিয়ে দিয়ে করা হয় তখন আপত্তি করার প্রয়োজন আছে।
কোন আচার-অনুষ্ঠান সংষ্কৃতি হতে হলে হাজার বছরের পুরানো হতে হবে সেই যুক্তি অবশ্যই অমুলদ। কারণ ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে আমাদের যে সংষ্কৃতি গড়ে উঠেছে তা ১০০ বছরেরও পুরানো নয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার ধর্মীয় চেতনার সাথে চরমভাবে সাংঘর্ষিক ভিনদেশী ও হিন্দুধর্মের নানা আচার-অনুষ্ঠানকে হাজার বছরের বাঙালি সংষ্কৃতি হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া কোন ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা হিন্দু ধর্মের বিরোধী বা হিন্দুদের সংষ্কৃতি আমাদের দেশে চলবে না। হিন্দুসহ সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করতে পারে। এমনকি হিন্দুরা বর্ষবরণে মূর্তি-মূখোশ ব্যবহার করলে তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয় যদি তা সার্বজনীন ও মূখ্য হিসাবে না থাকে। কিন্তু আমরা যেটা চাই তা হল ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কিছু সার্বজনীন করা যাবে না। সাধারণ মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রকৃত অর্থে সংষ্কৃতির উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় চেতনার প্রভাব থাকবে এটাই গণতান্ত্রিক চেতনা। প্রতিবেশী ভারতে জাতীয় উৎসব ও চলচ্চিত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনাকে ধারণ করা হয়, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিমরা আপত্তি করে না। তাই আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তি দিয়ে ইসলামবান্ধব সংষ্কৃতির বিরোধিতা করা অমূলদ। হাস্যকর বিষয় হল, ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আউড়িয়ে হিন্দুস্তানী সংষ্কৃতি গিলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
মুসলিম দেশে সাংষ্কৃতিক সংঘাত একটি নিয়মিত ব্যাপার। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়। সাম্প্রতিক সুপ্রিমকোর্টের সামনে গ্রিক থেমিস মূর্তি স্থাপন, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করা, ও হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলিমদের অংশগ্রহণ এই সংঘাত ও নানা বিতর্ককে উসকে দিয়েছে। অন্য সকল ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় পন্ডিতদের চেয়ে ইসলাম ধর্মের পন্ডিতরা ইসলামের মূলনীতির ব্যাপারে বেশী স্পর্শকাতর। ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা বা ধর্মীয় চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু মেনে নিতে তারা রাজি নয়। তাই ইসলামের জ্ঞানের মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক কোন কিছু সার্বজনীন করা হলে আলেম সমাজ জাতিকে সতর্ক করতে নানা প্রতিবাদ-সভা সমাবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে, শিরকের ব্যাপারে মুসলিম জাতিকে সচেতন করা আলেম সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব। কারণ ইসলামের মূলনীতি অনুসারে শিরক ও ঈমান এক সাথে অবস্থান করতে পারে না। যেভাবে আলো অন্ধকারকে সরিয়ে দেয়, তেমনি শিরকও ঈমানকে সরিয়ে দেয়। ঈমান ছাড়া কোন আমলের মূল্য আল্লাহ তায়ালার কাছে নেই। তাই মুসলিম উম্মাহর ঈমান রক্ষা করা আলেম সমাজের অন্যতম প্রধান দ্বায়িত্ব।
থেমিস দেবী ছিল গ্রিক পৌত্তলিক মুশরিকদের ন্যায় বিচারের দেবী। কিন্তু গ্রিক থেমিস দেবীর মূর্তি যতই ন্যায় বিচারের প্রতীক হউক না কেন মুসলিম সমাজে এই মূর্তি মাননসই নয়। যারা থেমিস দেবীর মূর্তি স্থাপন করেছেন তাদের তা অজানা থাকার কথা নয়। ন্যায়-বিচারের সার্বজনীন প্রতীক হিসাবে দাঁড়িপাল্লা তো আমাদের আছে। এই প্রতীকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কারো আপত্তি নেই। তাছাড়া এই প্রতীক আপনাই ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় বহন করে। যেহেতু সুপ্রীমকোর্ট সার্বজনীন ও মহামান্য প্রতিষ্ঠান, সেই সাথে দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী মুসলিম সেহেতু গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক থেমিস দেবীর মূর্তি মেনে নেওয়া যায় না। এই মূর্তি সরানো হলে অন্য কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় চেতনা বা সংষ্কৃতি আঘাতপ্রাপ্তও হবে না। এই মূর্তি স্থাপনের জন্য জনগণের মধ্য থেকে কোন দাবিও ছিল না। তাই এই মূর্তি সরিয়ে ৯০ ভাগ মুসলিমের ধর্মীয় চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের জন্য সহায়ক হবে। ঘোর বিরোধিতা স্বর্থেও মূর্তি সরানো না হলে তা জনগণের কাছে ফ্যাসিবাদী আচরণ হিসাবে গণ্য হবে। তাছাড়া এই গ্রিক মূর্তি গায়ে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে তা বঙ্গীকরণ করার যে চেষ্ঠা হয়েছে তা দেশীয় সংষ্কৃতির জন্য অপমানজনক, প্রধানমন্ত্রী এটাকে হাস্যকরও বলেছেন। এমনিতে প্রতিবেশী ভারতের অপসংষ্কৃতির কবলে দেশীয় সংষ্কৃতি বিলুপ্ত হতে চলছে সেখানে সুদূর গ্রিক সংষ্কৃতি আমাদানি শুরু হলে আমরা আত্নপরিচয়হীন জাতিতে পরিনত হব।
মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি হিন্দুয়ানী কালচার। ইসলামদের মূল চেতনার সাথে এর তির্যক সম্পর্ক রয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বড় বড় পুতুল, হুতোম পেঁচা, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর মুখোশ, কার্টুন ও প্রতিমা নিয়ে নারী-পুরুষ একসঙ্গে ঢোল বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করে সড়ক প্রদক্ষিণ করার রীতি চালু করা হয়েছে, যা ইসলাম কোনভাবে সমর্থন করে না। সাধারণ জনতার আবেগকে পুঁজি করে ইসলামবিদ্বেষী একটি মহল সুকৌশলে হিন্দুয়ানী শিরকী দেব-দেবীর প্রতি ভালবাসা মুসলিমদের মাঝে মাননসই করার চেষ্ঠা করছে। তাঁর অংশ হিসাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাধ্য করা হরেছে। বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ পরে বা মুর্তি নিয়ে যাত্রা করলে মঙ্গল হয়, গ্লানি মুছে যায় এই ধারণা ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক। ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণ কেবল আল্লাহ তায়ালা থেকে আসে। কোন মূর্তি বা মুখোশ থেকে নয়। মূলত হিন্দু সমাজে শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিনে মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পেঁচা, রামের বাহন হিসেবে হনুমান, স্বরসতীর বাহন হিসাবে হাঁস, রামের সহযাত্রী হিসাবে গাভী, দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহের মুখোশ পরে ও দেবতার প্রতীক হিসেবে সূর্য এবং অন্যান্য জীব-জন্তুর মুখোশ পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১লা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার সমর্থকরা মিথ্যাচার করে বলছেন এটি হাজার বছরের বাঙ্গালি সংষ্কৃতি।
প্রকৃত অর্থে সংষ্কৃতিতে শ্রেষ্ঠত্ব বলে কিছু নেই। একটি জাতির কাছে যা বর্জনীয় অন্য জাতির কাছে তা আরাধ্য হতে পারে। তাই বলা হয়, “এক দেশের বুলি, আরেক দেশের গালি”। বহুদিন ধরে ভারতের নানা কূটতরামির সিরিয়াল স্টার জলসা, জি-বাংলার বিরুদ্ধে সমাজের সকল স্তর থেকে প্রতিবাদ হয়ে আসছে। সস্প্রতি ডাবলিং করা তুর্কি সিরিয়াল সুলতান সুলাইমান, সীমান্তের সুলতান ও ইরানি সিরিয়াল ইউসুফ-জুলেখার বিরুদ্ধেও খোদ শোবিছ পাড়া থেকেই আপত্তি করা হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্র দেশের সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শনের বিরুদ্ধে অনেকে আপত্তি করছে ব্যবসায়িক ও সাংষ্কৃতিক কারণে। সুতরাং ভিনদেশী সংষ্কৃতির আমদানির বিরুদ্ধে শুধু আলেম সমাজ নয়, যেখানে যাদের স্বার্থে আঘাত আসছে সেখানে তারাই আপত্তি করছে।
বিষয়: বিবিধ
১২২৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন