সুন্দরবনে অসুন্দরের থাবা

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৯ জুলাই, ২০১৬, ০৮:০২:৪৬ সকাল



মানুষ বুদ্ধিমান জীব। ধর্ম গ্রন্থে তাকে সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মখলুকাত বলা হয়েছে, সেকূলার দৃষ্টিভঙ্গীতেও সেভাবেই আমরা নিজদেরকে দেখি। এর কারণ- আমাদের বুদ্ধিমত্তা আর বিবেক এর সমন্বয় –! নাহলে, অনেক বুনো প্রাণীরও বিশেষ বিশেষ দক্ষতা আমাদের চেয়ে বেশী! একটা মৌমাছি বা পিঁপড়ার বিশেষ ক্ষেত্রে যে দক্ষতা তা মানুষের চেয়ে অনেক বেশী! পার্থক্য – হল মানুষের বিবেক, বিবেচণা বোধ~!

একটা সংসারের যেমন নানা প্রয়োজন থাকে, একটা দেশেরও তেমন প্রয়োজন থাকে। কিন্তু যাদের অঢেল ‘রিসোর্স নেই, তাদেরকে ‘প্রায়োরিটি লক্ষ্য করে চলতে হয়। জুতা কেনা আগে নাকি টুপি কেনা আগে – এটা বিবেচনা করতে হয়! টিউব অয়েল এর পাইপ আর টয়লেট এর পাইপ পাশাপাশি বসানোর ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হয়। ভাবতে হয় ১০, ২০ বা পঞ্চাশ বছর পরে কি হবে তা নিয়ে! যে জাতির সে দূরদর্শীতা নেই – তারা আস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হয়, ইতিহাস তার প্রমাণ~ । তবে কে যেন বলেছিলেন- ইতিহাসের সব চেয়ে বড় সত্য এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না! কেউ নেয়না তা নয়, তবে বাংলাদেশের বর্তমান হর্তা কর্তারা যে নেন না – তার নজির আমরা দেখতে পাচ্ছি!

একটা দেশকে যদি ইনটেনসীভ কেয়ার ইউনিট ভাবা হয়, তবে এর অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা হল সেদেশের বনভূমি! বনভূমি শুধু অক্সিজেন নয়, অবকাঠামো নির্মাণ- খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান বিনির্মাণ এমনকি শিল্প কল কারখানার কাঁচামালের যোগান দেয়, এটা দেশের অশিক্ষিত মানুষও জানে!

FAO এর পরিসংখ্যান মতে ১৯৯০ - ২০০০ পর্যন্ত বাংলাদেশে সামগ্রিক ভূমির ১৪৪০০ হেক্টরে, বনভূমি হিসেবে দেখানো হয়েছে ৮৮২- ৮৮৪ হেক্টর! ২০০৫ সালে এসে তা কমে হয়েছে ৮৭১ হেক্টর! শতকরা হিসেবে বনভূমির পরিমাণ কমবেশি ৬%। এ হারে কমতে থাকলে দেশটার পুরো নাঙ্গা হতে কতদিন লাগবে – এ অংকটা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের মন্ত্রী তন্ত্রীদের ঘাড়ে ছেড়ে দেয়া যাক! অথচ একটা দেশে সামগ্রিক বনভূমির পরিমাণ হওয়া উচিত শতকরা ২৫ ভাগ। এ দুরবস্থার মধ্যেও টিকে আছে বড় দুটো বনাঞ্চল, দক্ষিণ পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণ পশ্চিমের সুন্দরবন! সে সুন্দরবন এখন চরম হুমকির মুখে!

বাংলাদেশে যে বনভূমি গূলো ভাগ্যগুণে এখন পর্যন্ত টিকে আছে, সুন্দরবন তার মধ্যে অন্যতম! এরপাশে কয়লা চালিত পাওয়ার প্লাণ্ট স্থাপন করা হলে কী কী সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই দীর্ঘ রচনা লিখেছেন! আমরা তা উল্লেখ করতে চাই না! আমরা জানি - দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য পাওয়ার প্লাণ্ট স্থাপন করা জরুরী! কয়লা চালিত স্থাপনা পরিবেশ এর জন্য ক্ষতিকর বিধায় উন্নত দেশগুলো পরিবেশ এর উপর ‘ইমপ্যাক্ট স্টাডি করে থাকে এবং অনেক দেশই লোকালয়ের পাশে এমন দূষণ সৃষ্টিকারী প্ল্যান্ট বসানোর ধারণা বাতিল করছে! তাহলে কোথায় স্থাপন করা হবে ? সুন্দরবনের ধারে! সেটা তো বাংলাদেশের জন্য আত্মহত্যার শামিল! সবে ধন নীলমণি যে বনভূমি – সেটা ধ্বংস হলে আর থাকে কী~!

এমন জায়গায় কী এটা সরিয়ে নেয়া যায় না- যেখানে ক্ষতিকর প্রভাবটা সবচেয়ে কম হবে? কয়লা চালিত প্লাণ্টে ক্ষতির পরিমাণ বেশী হলে, বিকল্প হিসেবে পরমাণু চালিত প্লাণ্ট এর কথা ভাবা যেতে পারে! সৌর শক্তির কথা ভাবা যেতে পারে, বছরে ৩৬৫ দিনের প্রায় ৩০০ দিন রোদ পাওয়া যায় এদেশে- ভাবা যেতে পারে উইন্ড টারবাইন। পরিচ্ছন্ন শক্তির এত ভাল উৎস । ভারতের সহায়তা কী সুন্দরবনের পাশে প্লাণ্ট স্থাপন না করলে পাওয়া যাবে না? যে সহায়তা দেশের জন্য ক্ষতিকর – এমন সহায়তা কোন দেশপ্রেমিক মানুষ কিভাবে বরদাস্ত করবে? ভারত ছাড়া আর কী সাহায্যকারী কোন দেশ নেই এ দুনিয়ায়!

বন শুধু গাছপালা নয়, এর সাথে সাড়া দেশের পরিবেশ, Wild LIFE, ECOSYSTEM- সবকিছুই জড়িয়ে আছে! অপারেশনের রাগীর জন্য রক্ত দেয়া জরুরী হতেই পারে, তবে সে রক্ত দিতে গিয়ে যদি অক্সিজেন ইউনিটকে সরিয়ে ফেলা হয়, তবে সে রোগীর আর চিকিৎসার দরকার পড়বে কি ? কথা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে- একটা গল্প বলে শেষ করিঃ

এক দেশে এক লোক বাস করত। একা মানুষ। তার ঘরের খুঁটি কাঠের, বাঁশের বেড়া ! সে ছিল চরম অলস~ । রান্নার প্রয়োজনে বন থেকে সে কাঠ সংগ্রহ করতে যেত না - ! আলস্য ভরে সে ভাবত – আজকে তো চলুক, কাল না হয় জঙ্গলে গিয়ে এক গাদা কাঠ কেটে নিয়ে আসব! তো আজ বেড়া থেকে সে দুটো কাঠি বের করে – আর ভাবে – কেবল দুটো কাঠিই তো! এভাবে কাল আরও দুটো – এই করতে করতে এক সময় বেড়া শেষ হয়ে গেল! এবার সে ভাবছে খুঁটি গূলো তো আছে-ঘড় আমার দাঁড়িয়ে থাকলেই হল। কিন্তু স্বভাব তো আর রাতারাতি পরিবর্তন হয় না। রান্না তো করতেই হয়! এবার সে মাঝের খুঁটি গুলোর উপর দা চালালো। কাঠের খুঁটি, কিছু চোকলা তুলে নিলে দোষ কী? এভাবে চোকলা উঠতে থাকল। প্রথমে মাঝের খুঁটি গূলো – এবার এক সময় কোণার খুঁটির চোকলা উঠতে থাকল। এভাবে একদিন সে রাতে ঘুমিয়ে আছে, সামান্য একটু ঝড়েই খুঁটি গুলো আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ঘরের চাল ধসে গেল! পরের দিন সকালে পাড়ার মানুষ দেখল- খবরের কাগজে শিরোনামঃ ঘরের চালের নীচে চাপা পড়ে অকাল মৃত্যু !

গল্পটা এখানেই শেষ! তবে সুন্দরবনের কাহিনী তো এখনো শেষ হয় নি! সদিচ্ছা থাকলে আর চেষ্টা করলে- এটাকে বোধ হয় এখনো বাঁচানো যায়, সমস্যা হল, যাদের হাতে সে ক্ষমতা, তাদের সে সদিচ্ছা আর প্রচেষ্টা আছে কী?

আমরা শুধু বলতে পারি –শুধু আমরাই নয়, সুন্দরবন ধ্বংস হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাদেরকে অভিশাপ দেবে – তাদের হঠকারী, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে!

বিষয়: বিবিধ

১২২৩ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

375491
২৯ জুলাই ২০১৬ দুপুর ১২:১৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার শিক্ষনিয় লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। সুন্দরবন এর পাশে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র হলে যে সমস্যা হবে তার হাত থেকে ভারত ও রক্ষা পাবেনা। ভারতিয় পরিবশেবাদিরা এটা বুঝলেও বাংলাদেশের ছাগল মন্ত্রি এই কথা বলছেন যে সুন্দরবন নাকি কৃত্রিমভাবে তৈরি করবেন।
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৩৭
311571
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে!
375494
২৯ জুলাই ২০১৬ দুপুর ০২:১৪
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

"পিতৃহত্যার প্রতিশাধ" যার শপথ, নীতিকথা তার কাছে বাচালতা ঠেকাই স্বাভাবিক!!
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৪১
311572
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ।
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৪২
311573
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম আস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ.. ধন্যবাদ।
375498
২৯ জুলাই ২০১৬ রাত ০৮:০৩
সামছুল লিখেছেন : সুন্দর পোস্ট অনেক ধন্যবাদ।
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৪৩
311574
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ।
375502
২৯ জুলাই ২০১৬ রাত ০৮:৩৬
শেখের পোলা লিখেছেন : ছোট বেলায় স্কুলে এক স্যার প্রায় বলতেন,'বড় বড় বাণরের বড় বড় লেজ, লঙ্কা ডিঙ্গোতে মাথা করে হেঁট।' কথাটার মর্মার্থ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের অবস্থা দেখে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি। ভাল থাকেন, দেখা হবে।
375799
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৪৪
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : সালাম জনাব।
ধন্যবাদ আপনাকে। অবশ্যই দেখা হবে!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File