আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩৪

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৭:০০:৩৪ সকাল

রাজা গণেশ সিংহাসন দখন নেওয়ার পর স্বরূপে আত্নপ্রকাশ করেন এবং বাংলার মুসলমানদের উপরে দলন পীড়ন শুরু করে দেন। বাংলার মুসলমানদের উপর ব্রাহ্মবাদীদের বহু দিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোপের যেন বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ ঘটতে থাকে তার মাধ্যমে। এই নিপীড়ন নির্যাতনের মাত্রা সীমা অতিক্রম করলে বিখ্যাত নায়েবে রসূল, দায়ী ইল্লেলল্লাহ হযরত নুরে কুতুবে আলম, মুসলমানদের অভিবাবক হিসাবে এর প্রতিকারর্থে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শাকীকে তার হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা কল্পে তাকে আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ করেন। এই নায়েবে রসূলের অনুরোধ রক্ষা করতে সুলতান ইব্রাহীম তার বাহিনী নিয়ে বাংলার দিকে অগ্রসর হন। এই সংবাদ শুনে বীরের বেশে নয় বরং ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী রাজা গণেশ ভীত সস্ত্রত হয়ে পড়েন এবং আত্নরক্ষার্থে হযরত নুরে কুতুবে আলমের কাছে যান এবং তার ছেলে যদুকে তার হস্তে ইসলাম গ্রহণের জন্য সমর্পণ করেন। এই সম্পর্কে ইসলামী ফাউন্ডেসন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বই, ‘Islam in Bangladesh through ages এর ৪৫-৪৬ পৃষ্ঠায় ড. আব্দুল করিম বলেন, “ --- The shaikh (Nur Qutbul Alam) replied that he could not intercede on behalf of an infidel king but if ganesh accept Islam, he might consider his request. Ganesh agreed but his wife did not allow him to do so. So Ganesh brought his 12 years old son Jadu to the saint and represented saying ‘I have grown old and I am thinking of renouncing the world. Please accept my son, and place him on the throne after converting him to Islam”. অতঃপর চতুর গণেশ রাজ সিংহাসন ত্যাগ করত তার নব দীক্ষিত মুসলিম ছেলে যদুকে, জালালউদ্দিন মোহামদ শাহ্‌ উপাধি দিয়ে বাংলার সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেন। ফলে দায়ী ইল্লেলল্লাহ হযরত নুরে কুতুবে আলম গণেশের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হয়ে সুলতান ইব্রাহীম শাকীকে তার হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মোহামদ শাহ্‌কে আক্রমণ না করার জন্য অনুরোধ করন। সুলতান তার অনুরোধ রক্ষার্থে যদুকে আক্রমণ না করে প্রত্যাবর্তন করেন। যদিও রাজা গণেশ পরবতিতে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তার মুসলিম ছেলে সুলতান জালালউদ্দিন মোহামদ শাহ্‌কে (যদুকে) সিংহাসন চ্যুত করে আবার ক্ষমতায় বসে। এই ঘটনার অল্প কয়েক বছরের মাঝে রাজা গণেশ মারা গেলে তার ছেলে যদু পুনঃ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত সুলতান জালালউদ্দিন মোহামদ শাহ্‌কে উপাধী নিয়ে সিংহাসনে বসে এবং তার পিতার দ্বারা মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়ে ছিল তা পুরনের চেস্টা করে।

আমার ধারনা যদি ভুল না হয়, তবে হযরত নুরে কুতুবে আলমের ন্যায় ইসলাম ধর্ম প্রচারক বা নায়েবে রসূলদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রবল প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে তৎকালীন পরিস্থিতিতে এই জন্যই সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ তার মুসলিম কাজীর উপর প্রকাশ্য নির্যাতন চালায়নি এবং ঐ একই কারনে তিনি শ্রী চৈত্যনের বৈষ্ণব মুভমেন্টকে লোক চক্ষুর অন্তরাল থেকে মদদ দিয়েছেন কৌশলে। কেননা রাজা গণেশের ঘটনা থেকে, এটা পরিষ্কার যে, একজন মুসলিম শাসকের লেবাসে অমুসলীম মুভমেন্টকে সাহায্য সহযোগিতা করা ছিল তৎকালীন অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই বিপদজনক কাজ। সন্দেহর তীরটা যাতে কোন ভাবে এবং কোন কালেই তার দিকে না ঘুরে সেই জন্য সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ চতুরতার পরিচয় দেন। তিনি মুসলমানদের জন্য কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরী করে দিয়েছিলেন। এমন কী তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শাকীকে, যিনি হযরত নুরে কুতুবে আলমের অনুরোধে সারা দিয়ে মুসলিম বিরোধী সুলতান রাজা গণেশের বিরুদ্ধে আক্রমণে উদ্দত হয়ে ছিলেন তাকে আশ্রয় দিয়ে ছিলেন। ইব্রাহীম শাকী দল্লীর সুলতান কতৃক বিতাড়িত হয়ে হোসেন শাহ্‌র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি তা মঞ্জুর করে ছিলেন ঐ একই কারনে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে যে, এক্ষেত্রে যদিও তিনি এই আশ্রয় দেওয়াকে অতি তুচ্ছ ঘটনা বলে মনে করে করেছিলেন; কিন্ত বাস্তবে তা ভুল প্রমানিত হয় এবং এই অতি তুচ্ছ ঘটনার জন্যই তিনি দিল্লীর সুলতান সিকান্দার লোদীর বিরাগভাজন হন। এই অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সিকান্দার লোদী বাংলা আক্রমণ করলে কিংকর্তব্যবিমুখ সুলতান হোসেন শাহ্‌ দ্রুত তার সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সন্ধি চুক্তিতে অবাদ্ধ হন, এই চুক্তির ফলে তিনি তার রাজ্যের একটি বিশাল অংশ হারান।

সম্ভবত সুলতান আলাউদ্দিন হসেন শাহর মুল পরিকল্পনা ছিল এক, শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব মুভমেন্টের মাধ্যমে হিন্দুদের বর্নভেদ প্রথাকে পাশকাটিয়ে হিন্দু মুসলিমকে (হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিমদের) একটি প্লটফর্মে নিয়ে আশা। দুই, এই মুভমেন্টের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যর ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে মুসলিম সমাজের অভিবাবক রূপ ভুমিকা পালনকারী নুরে কুতুবে আলমের ন্যায় ঐ সকল নায়েবে রসূল বা দায়ী ইল্লেলল্লাহদেরকে মানুষের আসন থেকে উদ্ধে তুলে পৌরানিক হিন্দু দেবতাদের ন্যায় উপস্থাপন করে তাদের সমাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে অন্য খাতে(ধর্মীয়) চালিত করা। সম্ভবত এর মুল কারন ছিল এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য ইসলামী শাসকদের নয় বরং এই নায়েবে রসূলদের ব্যাক্তিত্ব, সমাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব। উল্লেখ্য বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘চৈতন্য যুগ’ নামে পরিচিত যুগটি পীর মঙ্গল কাব্য সহ বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের সাহায্য নিয়ে নায়েবে রসূলদেরকে আলৌকিক ক্ষমতাধারী সুফী, পীর, ফকীর হিসাবে চিত্রিত করেনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বস্তুত সাফল্যের মাপকাঠিতে যদি আমরা হোসেন শাহ্‌কে বিচার করি তবে সেই বিচারে সুলতান হোসেন শাহ্‌ এক শত ভাগ সফল হয়ে ছিল বলা কোন ভাবেই ভুল হবে না। কেননা আজকেও আমাদের কাছে হযরত নুরে কুতুবে আলম বা হযরত শাহ্‌ জালালের ন্যায় নায়েবে রসূল বা দায়ী ইল্লেল্ললাহগণ সেই পরিচয়ে পরিচিত অর্থাৎ পীর, সুফী ফকীর দরবেশ, যার স্বপ্ন দেখে ছিলেন হোসেন শাহ্‌ । অর্থাৎ তার আজও আমাদের কারো কারো কাছে অতি ক্ষমতাশালী ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব, যারা এই দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিলেও আমাদের দোয়া শুনতে পায়, আমাদের জন্য মঙ্গল করতে পারে---। এই বিষয়ে আমরা মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের জীবন চরিত আলোচনা শেষে বিস্তারিত আলোচনা করব।

চলবে -------

বিষয়: বিবিধ

১০০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File