ডিয়ার মুসলিমস, ইসলাম ইজ নট অ্যা ম্যাটার অব জোকস (পর্ব ছয়)

লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ২৮ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:৩১:৩৩ সন্ধ্যা

পূর্ববর্তী পর্বের লিংকঃ ডিয়ার মুসলিমস, ইসলাম ইজ নট অ্যা ম্যাটার অব জোকস (পর্ব পাঁচ)

প্রিয় বন্ধুরা,

আসসালামু আলাইকুম। বড় একটা বিরতি নিয়ে আবার ফিরে এলাম চলমান সিরিজ নিয়ে। আজ ৬ষ্ট পর্বে আলোচ্য বিষয় হবে ‘শিরক ও বিদ’আত।’

এটি আসলে একটি ব্যাপক বিষয়। মুসলমানদের আকীদা, বিশ্বাস ও আমলে শিরক বিদআতের অনুপ্রবেশ, এর ইতিহাস, ইসলাম বিকৃতি এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য এক বা একাধিক গ্রন্থের প্রয়োজন। তবে আমি চেষ্টা করবো সংক্ষেপে এ বিষয়টি তুলে ধরতে। সংক্ষেপে আলোচনা করতে গেলেও কয়েকটি পর্ব প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি সাথেই থাকবেন।

বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের মুসলমানদের আকীদা ও আমলে শিরক ও বিদয়াত এর ছড়াছড়ি। এর উৎস বা কারণ নানাবিদ।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম তাঁর গবেষণালব্ধ সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ এ বিদয়াত চালু হওয়ার চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

এক -বিদয়াতী- নিজের থেকে তা উদ্ভাবন করে সমাজে চালু করে দেয়। পরে তা সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় হলো, কোনো আলিম ব্যক্তি হয়তো শরীয়তের বিরোধী একটা কাজ করেছেন, করেছেন তা শরীয়তের বিরোধী জানা সত্ত্বেও; তা দেখে জাহিল লোকেরা মনে করতে শুরু করে যে, এ কাজ শরীয়তসম্মত না হয়ে যায়না। এভাবে এক ব্যক্তির কারণে গোটা সমাজেই বিদয়াতের প্রচলণ হয়ে পড়ে।

তৃতীয় এই যে, জাহিল লোকেরা শরীয়তবিরোধী কোনো কাজ করতে শুরু করে। তখন সমাজের আলিমগণ সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন, তার প্রতিবাদও করেননা, সে কাজ করতে নিষেধও করেননা-বলেন না যে, এ কাজ শরীয়ত বিরোধী, তোমরা এ কাজ কিছুতেই করতে পারবেনা। এরূপ অবস্থায় আলিমদের দায়িত্ব, সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদয়াত বা শরীয়ত বিরোধী কাজের প্রতিবাদ বা বিরুদ্বাচরণ না করার ফলে সাধারণ লোকদের মনে ধারণা জন্মে যে, এ কাজ নিশ্চয়ই নাজায়েজ হবেনা, বিদয়াত হবেনা। হলে কি আর আলিম সাহেবরা এর প্রতিবাদ করতেননা। অথবা অমুক সভায় এ কাজটি হয়েছে, এ কথাটি বলা হয়েছে, সেখানে অমুক অমুক বড় আলিম উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যখন এর প্রতিবাদ করেননি, তখন বুঝতেই হবে যে, এ কাজ বা কথা শরীয়তসম্মত হবেই, না হলে তো তাঁরা প্রতিবাদ করতেনই। এভাবে সমাজে সম্পূর্ণ বিদয়াত বা নাজায়িজ কাজ ‘শরীয়তসম্মত’ কাজরূপে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে পড়ে।

চতূর্থ এই যে, কোনো কাজ হয়তো মূলতই ভালো, শরীয়তসম্মত কিংবা সুন্নাত অনুরূপ। কিন্তু বহুকাল পর্যেন্ত তা সমাজের লোকদের সামনে বলা হয়নি, প্রচার করা হয়নি। তখন সে সম্পর্কে সাধারণের ধারণা হয় যে, এ কাজ নিশ্চয়ই ভালো নয়, ভালো হলে কি আলিম সাহেবরা এতদিন তা বলতেননা! এভাবে একটি শরীয়তসম্মত কাজকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তবিরোধী কাজ বলে লোকেরা মনে করতে থাকে আর এ-ও একটি বড় বিদয়াত।

বিদয়াত প্রচলিত হওয়ার আর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। আর তা হলো এই যে, মানুষ স্বভাবতই চিরন্তন শান্তি ও সুখ- বেহেশত লাভ করার আকাঙ্খী। আর এ কারণে সে বেশি বেশি নেক কাজ করতে চেষ্টিত হয়ে থাকে। দ্বীনের হুকুম আহকাম যথাযথভাবে পালন করা কঠিন বোধ হলেও সহজসাধ্য সওয়াবের কাজ করার জন্য লালায়িত হয় খুব বেশি। আর তখনি সে শয়তানের ষড়যন্ত্রে পড়ে যায়। এই লোভ ও শয়তানী ষড়যন্ত্রের কারণে সে খুব তাড়াহুড়ো করে কতক সহজ সওয়াবের কাজ করার সিদ্ধান্ত করে ফেলে। নিজ থেকেই মনে করে নেয় যে, এগুলো খুব নেক কাজ, সওয়াবের কাজ। তা করলে এত বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে যে, বেহেশতের চিরস্থায়ী শান্তি সুখ লাভ করা কিছুমাত্র কঠিন হবেনা। কিন্তু এ সময়ে যে কাজগুলোকে সওয়াবের কাজ বলে মনে করে নেয়া হয়, সেগুলো শরীয়তের ভিত্তিতে কিংবা বাস্তবিকই সওয়াবের কাজ কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবার জন্য ইসলামী যোগ্যতাও যেমন থাকেনা, তেমনি সে দিকে বিশেষ উৎসাহও দেখানো হয়না। কেননা তাতে করে চিরন্তন সুখ লাভের সুখ স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর তাতেই তাদের ভয়।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, একটি দ্বীনি সমাজে দ্বীনের নামে বিদয়াত চালু হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং তা মানব ইতিহাসে অভিনব কিছু নয়। দ্বীন যখন প্রথম প্রচারিত হয়, তখন তার ভিত্তি রচিত হয় ইলমের উপর। উত্তরকালে সেই ইলম যখন সমাজের অধিকাংশ বা প্রভাবশালী লোকেরা হারিয়ে ফেলে, তখন দ্বীনের প্রতি জনমনে যে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ থাকে, তার মাধ্যম দ্বীনের নামে অদ্বীন ও বেদ্বীন ঢুকে পড়ে। মানুষ অবলীলাক্রমে সে কাজগুলো দ্বীনি মনে করেই করতে থাকে। ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আরবরা ইবরাহীম-ইসমাঈল(আ) এর বংশধর ছিল। তাদের মধ্যে তওহীদ বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তথায় তওহীদী দ্বীন প্রবল হয়েছিল কিন্তু তার পরে সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাদের আকীদা ও আমালে ‘হক’ এর সাথে ‘বাতিল’ সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। ভালো কাজ হিসেবে একসময় মূর্তিপূজা, পাথর-পাহাড় পূজাও ব্যাপকভাবে চালু হয়ে পড়ে। রাসূলে করীম(স) এর আগমনকালে তাদের দ্বীনি ও নৈতিক অবস্থা চরমভাবে অধঃপতিত হয়েছিল।

মৌলিক আলোচনার পূর্বে একটু ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি! বিষয়টি ধান ভানতে শীবের গান মনে হলেও শিরক ও বিদআতের কার্যকারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজনেই এর গুরুত্ব রয়েছে।

আমাদের দেশে শিরক ও বিদয়াত এর অনুপ্রবেশ কিছুটা ঘটেছে পারস্য হতে আসা ভ্রান্ত শিয়া আকীদার ধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমে। আরো বিভিন্ন ভাবে এসবের বিস্তার ঘটলেও এর ব্যাপক ও ভয়াবহ বিস্তার ঘটে মূলত মুঘল সম্রাট আকবার এর কুখ্যাত দ্বীনি এলাহি এর মাধ্যমে। ৯০% পৌত্তলিক ধর্মের সাথে ১০% ইসলাম মিশিয়ে যে মনগড়া রীতিনীতি চালু করেছিলেন বাদশাহ আকবর সে উদ্ভট ধর্মবিশ্বাসের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্বীন এ ইলাহী’। এছাড়া শ্রীচেতন্যের আবির্ভাব এবং হোসেন শাহের শ্রীচেতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শত শত হকপন্থী আলেম উলামাসহ মুসলিম নিধন -এগুলিও বড় কারণ। এসব আলোচনার পূর্বে আর একটু পেছনে ফেরা যাক।

মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী প্রান্তরে মুসলিম রাজ্যের পতন পর্যন্ত পাঁচশত চুয়ান্ন বৎসরে একশ বা ততোধিক শাসক বাংলার শাসন পরিচালনা করেন।

বাংলা ------ খিলজীদের অধীনে-------------১২০৩-১২০৭ খৃঃ

বাংলা ------ দিল্লীর অধীনে --------- --------১২২৭-১৩৪১ খৃঃ

বাংলা ----ই্লিয়াস শাহীর বংশের অধীনে(১ম)---১৩৪২-১৪১৩ খৃঃ

বাংলা ----গণেশ জালালুদ্দীনের অধীনে --------১৪১৪-১৪৪১ খৃঃ

বাংলা ----ই্লিয়াস শাহীর বংশের অধীনে(২য়)---১৪৪২-১৪৮৭ খৃঃ

---------হাবশী শাসনাধীনে বাংলা ------------১৪৮৭-১৪৯৩ খৃঃ

---------হুসেনশাহী বংশের অধীনে বাংলা-------১৪৯৩-১৫৩৮ খৃঃ

---------পাঠানদের অধীনে বাংলা--------------১৫৩৮-১৫৬৪ খৃঃ

---------কররাণী বংশের অধীনে বাংলা---------১৫৬৫-১৫৭৬ খৃঃ

---------মোঘল শাসনাধীনে বাংলা----------১৫৭৬-১৭৫৭ খৃঃ।

মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে এদেশে আগমন করার পর মনেপ্রাণে এদেশকে ভালবাসেন, দেশ ও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের জন্য প্রচুর কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ করেন। তাঁরা স্থায়ী আবাসভূমি হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করেন, বংশপরস্পরায় এদেশে বসবাস করেন, এদেশেই মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশত বৎসরাধিককাল বাংলার মসনদে থাকলে ও ভিন্ন ধর্মের প্রতি কোনো নিপীড়ন ও অত্যাচার মুসলিম শাসকদের দ্বারা হয় নি। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেও হিন্দুদের নিয়োগ দেয়া হত। সাধারণ হিন্দুরাও সুশাসনের কারণে শাসকদের প্রতি ছিল কৃতজ্ঞচিত্ত। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সুযোগ পেলেই নিপীড়ন করতো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের। মুসলিম ধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমে ইসলামেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে এ সময়। ইসলামের মাহাত্মে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে হিন্দুরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকেন।

কিন্তু ঐদিকে ফুঁসতে থাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তবে সরাসরি মোকাবেলার সাহস হয়না, গোপন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চক্রান্ত খুঁজতে থাকে তারা।



এমনি এক কুটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পৌত্র গিয়াসুদ্দীন আযম শাহকে হত্যা করেন রাজা গণেশ। অথচ গিয়াসউদ্দীন আযম শাহই তাঁর শাসনকালে এ গণেশকে রাজস্ব ও শাসন বিভাগের অধিকর্তা বানিয়ে প্রিয়পাত্র হিসাবে স্থান দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতক গণেশ গিয়াসউদ্দীনের পৌত্র শামসুদ্দীনকেও হত্যা করে গৌড় ও বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন।


সিংহাসনে আরোহণ করেই রাজা গণেশ গণহারে মুসলিম হত্যাকান্ডে মেতে উঠেন। বহুসংখ্যা মুসলিম আলেম, ধর্মপ্রচারক, অলী দরবেশ, মনীষী, পন্ডিত ও শাস্ত্রবিদকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজা গণেশ।

একদা শায়খ মুঈনুদ্দীন আব্বাসের পিতা শায়খ বদরুল ইসলাম বিধর্মী রাজা গণেশকে কুঁজো হয়ে সালাম না করার কারণে গণেশ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শায়খকে ডেকে পাঠান। শায়খের প্রবেশের জন্য দরজা এমন সংকীর্ণ ও খর্ব করে তৈরি করা হয় যেন উপুড় হয়ে প্রবেশ করতে হয়। শায়খ রাজার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে প্রথমে পা দুখানি কামরার ভিতরে প্রবেশ করান এবং মস্তক অবনত না করেই প্রবেশ করেন। কারণ, ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো মুসলমানই আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মস্তক অবনত করতে পারেন না। রাজা গণেশ তাঁকে তৎক্ষণাত হত্যা করেন এবং অন্যান্য আলেমকে একটি নৌকায় করে নদীগর্ভে নিমজ্জিত করে মারেন।

মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। পরবর্তীতে ঘটনাচক্রে রাজা গণেশ এর পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালালুদ্দীন নাম ধারণ করেন এবং পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিছুকাল পরে (১৪৪২ খৃঃ) ইলিয়াস শাহী বংশ আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে।

হোসেন শাহের ধর্ম বিকৃতি, শ্রী চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও লাখো মুসলিম নিধন

হোসেন শাহ সম্পর্কে অনেক প্রশংসা ও স্তুতিবাক্য করেছেন হিন্দু ঐতিহাসিকগণ। এসব মিথ্যা প্রশংসার মূল কারণ হচ্ছে ঐসব ঐতিহাসিকের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। নিরপেক্ষ ও মোহের উর্ধে্ব উঠে তারা ইতিহাস বিশ্লেষণ না করে হোসেন শাহ কর্তৃক মুসলমানদের সর্বনাশে উল্লাস প্রকাশ করেছেন।

হোসেন শাহ ছিল হাবশী শাসক মুজাফফর শাহ এর সামান্য কর্মচারী। সুচতুর হোসেন ছলে বলে কৌশলে ও শাসক মুজাফফর শাহকে নানাভাবে সন্তুষ্ট করে একসময় প্রধান উজির পদে নিয়োগ লাভ করেন। এ নিয়োগ এর পর হোসেন শাহ তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন হিন্দু আমাত্যবর্গদের সাথে নিয়ে। মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেন সুলতান মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে। আবার বাদশাহকে পরামর্শ দিয়ে অবাঞ্চিত ও ভুল কাজ করাতেন যাতে জনগণ বিদ্রোহ করে। এভাবে আমীর উমরাহ ও সেনাবাহিনীকেও ক্ষেপিয়ে তোলা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। এক পর্যায়ে হোসেন শাহ ও বাদশাহ মুজাফফর শাহের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষে একলক্ষ বিশ হাজার সৈন্য নিহত হয়, নিহত হন মুজাফফর শাহও। অনেকের মতে প্রাসাদরক্ষীকে হাত করে হোসেন প্রাসাদ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্বীয় হস্তে হত্যা করেন আপন প্রভুকে।

এ উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণের এক অগ্রদূত, শির্ক বিদয়াতের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ, বহু ভাষাবিদ ও অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী মাওলানা আকরাম খাঁ (দয়াময় আল্লাহ এ মহান মনীষীকে বেহেশতে নসীব করুন) তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুসলিম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ এ উল্লেখ করেছেন, “ সকল শ্রেণীর মুসলমান সামন্ত এবং হিন্দুরাজগণ তাহাকেই (হোসেন শাহ) রাজসিংহাসনের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিয়া রাজপদে অভিষিক্ত করেন। তিনিও তাঁহাদের মনোরঞ্জনার্থ নির্দিষ্ট সময়মতো গৌঢ় রাজধানী লুন্ঠনের আদেশ দেন। ঐ সময়ে গৌঢ় নগরে অনেক ধনশালী হিন্দু রাজা সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।”

মজার ব্যাপার এই যে, হোসেনের আদেশে যারা লুন্ঠন করেছিল তাদেরকেই আবার হোসেন এর আদেশে হত্যা করা হয়। এদের সংখ্যা ছিল বার হাজারেরও বেশি। হোসেন তার আপন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য লক্ষ লক্ষ লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেন। হয়তো লুন্ঠনের আদেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান হত্যার বাহানা মাত্র। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান; পৃঃ ৪০)।

হোসেন শাহ বা সাইয়্যেদ হোসেন মক্কী (?) রাজপদে অধিষ্টিত হয়ে তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নতুন করে ঢেলে সাজান। তাঁর উজির ও প্রধান কর্মকর্তা হলেন- গোপীনাথ বসু ‍ওরফে পুরন্দর খান, রাজ চিকিৎসক মুকুন্দ দাস, প্রধান দেহরক্ষী কেশব ছত্রী, টাকশাল প্রধান অনুপ।

স্যার যদুনাথ সরকার, বৈষ্ঞব লেখকদের বরাত দিয়ে বলেন যে, শ্রীচৈতন্য যে অবতার ছিলেন তা হোসেন শাহ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। I Don't Want To See I Don't Want To See I Don't Want To Seeচৈতন্য গৌঢ় নগরে আগমন করলে হোসেন তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং রাজকর্মচারীদের প্রতি ফরমান জারি করেন যে প্রভু চৈতন্যকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং তার ইচ্ছেমত যত্রতত্র ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়।

“হিন্দু লেখকগণের মতে হোসেন শাহীর সিংহাসনে আরোহণের পর হইতে গৌঢ় দেশে ‘রামরাজত্ব’ আরম্ভ হইয়া গেল। মাননীয় দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয় এ বিষয়ের ভূমিকা হিসাবে বলিতেছেনঃ মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণ বাঙালী হইয়া পড়িলেন। মসজিদের পাশে দেবমন্দিরের ঘন্টা বাজিতে লাগিল, মহরম, ঈদ, শবেবরাত প্রভৃতির পার্শে দূর্গোৎসব, রাম, দোলন উৎসব চলিতে লাগিল।... এহেন পরিস্থিতির মধ্যে সুলতান সাহেবের অভ্ভ্যুদয় ঘটিল। তিনি রাজকীয় ঝামেলা হইতে মুক্ত হইয়া খুব সম্ভব সর্বপ্রথম চৈতন্যদেবের খেদমতে উপস্থিত হইলেন এবং তাহার ভক্ত শ্রেণীভুক্ত হইয়া গেলেন। ‘চৈতন্য চরিত্রামৃতে’ লিখিত আছে যে, ইনি (হোসেন) শ্রীচৈতন্যের একজন ভক্ত হইয়াছিলেন।”(মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, মাওলানা আকরম খাঁ, পৃঃ ৯৮)।

শ্রী চৈতন্যকে বৈষ্ঞব সমাজ শ্রীকৃষ্ঞের অবতাররূপে এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ঞরূপে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো। গোটা হিন্দু সমাজে শ্রী চৈতন্য এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ “বাংগালীর হৃদয় মন সকল বন্ধন ছিন্ন করে রাধা কৃষ্ঞের গীতিকার দ্বারা সম্মোহিত হয়। বৈষ্ঞব ধর্মের আবেগ অনুভূতিতে, কাব্যে গানে, সামাজিক সহনশীলতা এবং ধর্মীয় অনুরাগে মনের উচ্ছ্বাস পরবর্তী দেড় শতাব্দী যাবত অব্যাহত থাকে। এ হিন্দু রেঁনেসা এবং হোসেন শাহী বংশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।”

(যদুনাথ সরকার, দ্য হিস্ট্রি অব বেঙল, ২য় খন্ড, পৃ ১৪৭)।

প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কি ছিল তা আমরা তার নিজের ভাষাতেই জানতে পারি।

“পাষন্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার,

পাষন্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার।”


মনু মতে পাষন্ডি হচ্ছে বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী ও অহিন্দু। এখানে পাষন্ডি বলতে মুসলমানদেরকেই সুস্পষ্টভাবে বুঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ মুসলিম নিধনই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।

শ্রীচৈতন্যকে সহযোগিতা ও লাখো মুসলিম হত্যাকারী মুসলিম নামধারী হোসেন শাহীকেও এজন্য অবতার বলে গণ্য করে হিন্দুসমাজ।

“নৃপতি হুসেন শাহ হয়ে মহামতি

পঞ্চম গৌঢ়ে যার চরম সুখ্যাতি।

অস্ত্রশস্ত্রে সুপন্ডিত মহিমা অপার

কলিকালে হবু যেন কৃষ্ঞ অবতার।”( বংগভাষা ও সাহিত্য, দীনেশ চন্দ্র সেন)।

বাংলা গ্রন্থ প্রণেতা মালধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত এবং যশোরাজ খান তাঁদের সাহিত্যে হোসেন শাহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সহ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। মালধর বসু ভগবতীর দশম ও একাদশ স্কন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি শ্রীকৃষ্ঞের প্রণয়লীলা বিষয়ক ‘শ্রীকৃষ্ঞ বিজয়’ নামক মহাকাব্য রচনো করেন। হোসেন প্রীত হয়ে তাকে গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেন।

গোপীনাথ বসু ‘কৃষ্ঞমঙ্গল’ নামে মহাকাব্য রচনা করেন এবং বিপ্রদাস মনসামঙ্গল রচনা করেন। এসব গ্রন্থাদি রচনায় হোসেন শাহ ও তার পুত্র নসরত শাহের বেশ প্রভাব ছিল।

এসব অশ্লীল কিচ্ছা কাব্যের প্রভাব মুসলিম সমাজে এতটা পড়ে যে, মুসলিম সমাজে মনসা পূজা প্রচলিত হয়।

এসবের প্রভাবে ও হোসেন শাহের প্রচেষটায় মুসলমানরা শিরকী ও কুফরী ধ্যান ধারণায় লিপ্ত হয়ে পড়ে ক্রমাগত।

এভাবে আমরা দেখতে পাই, হোসেন শাহীর আমলেই বাংলার মুসলমানদের আকীদা, বিশ্বাস ও ধর্ম পালনে সর্বপ্রথম পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।

(চলবে)।

বিষয়: বিবিধ

১৯৮৮ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

259403
২৯ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১১:৪৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে সুণ্দর আলোচনাটির জন্য ধন্যবাদ।
বিদয়াত কে অনেকেই বুঝেও পালন করেন এই যুক্তিতে যে বাপদাদাদের করতে দেখে এসেছেন।অারেকটি কারন হচ্ছে সল্প পরিশ্রমে অধিক লাভের চেষ্টা! নিজের সন্তানকে কুরআন শরিফ পরান শিখান না লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে অন্যদিকে পয়সা দিয়ে খতম পড়িয়ে সওয়াব আদায় এর চেষ্টা।
বাংলার ইতিহাসে দেখা যায় সবসময় ই মুসলিম সুলতানরা হিন্দুদের যোগ্যতা অনুসারে মর্যাদা দিয়েছেন। এটা তাদের উদারতা বা ইসলাম বিরোধিতা নয় বরং প্রশাসনিক কর্তব্য। তবে এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে কয়েকবারই বিপদের সম্মুখিন হয়েছেন তারা। শায়খ নুর কুতুবুল আলম চিঠি দিয়ে সাবধান করে দেওয়ার পরেও সুলতান আযম শাহ এর মত ন্যায়পরায়ন ব্যাক্তি সাবধান হননি যারফলে তার পরবর্তি বংশধররা রাজ্যচুত্য হয়। সেই ভাবে পরবর্তিতে আবার ফিরে পেয়েও রুকুনউদ্দিন বারবক শাহ ও সেই হিন্দু অভিজাত শ্রেনির ষড়যন্ত্রের শিকার হন।
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:১৫
203392
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : ধন্যবাদ প্রিয় সবুজ ভাই। আমি জানতাম, এ পোস্ট আপনার দৃষ্টি এড়াবে না। সাথে থাকুন। আগামী পর্বে দ্বীন এ ইলাহী নিয়ে আলোচনা হবে এবং তারপর মৌলিক অালোচনা।
259430
২৯ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০২:৫০
ইমরান ভাই লিখেছেন : ভাই, একটু সময় হলে পড়বো ইনশাআল্লাহ। ব্যাস্ত আছি।
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:১৬
203393
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : সাথে থাকুন। আগামী পর্বে মদ্যপ আকবরের দ্বীন এ ইলাহী নিয়ে আলোচনা হবে এবং তারপর মৌলিক অালোচনা।
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৩৫
203676
ইমরান ভাই লিখেছেন : ঠিক আছে। Talk to the hand
259488
৩০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৩:৫৬
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাল ও গুরুত্ববপূর্ণ একটি বিষয়ে হাত দিয়েছেন৷ ধন্যবাদ৷৷
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:১৭
203394
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম। সাথেই থাকুন। আগামী পর্বে দ্বীন এ ইলাহী নিয়ে আলোচনা হবে এবং তারপর মৌলিক অালোচনা।
259569
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:৪৬
নেহায়েৎ লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম সালাম। জাজাকাল্লাহু খাইরান। এই লেখাটা থামাবেন না। আল্লাহর রহমতে চলতে থাকুক। আকিদা ও শিরক-বিদাত বিরোধী লেখা অনেক দরকার। গতকাল শাহজাদপুর আকিদা বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনলাম। মাশা আল্লাহ অনেক কিছু জানতে পারলাম।
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:৫৬
203389
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : দুঃখজনক হচ্ছে আমাদের আলেমরা ইতিহাস পড়ে দেখেন না। হোসেন শাহ সর্বপ্রথম পৌত্তলিকদের সাথে মিলিয়ে এদেশে ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করেছে। বেহুলা লক্ষীন্দরের নোংরা অশ্লীল ভাষার অযোগ্য কিচ্ছা কাহিনীতে আকৃষ্ট করে অজ্ঞ মুসলমানদের দ্বারা মনসা পুজা করিয়েছে। বাকী সর্বনাশটা করেছে লম্পট বাদশাহ আকবার।
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:১২
203391
নেহায়েৎ লিখেছেন : আরও বড় দুঃখ হলো এই মিশ্র খিচুরী আকিদা বিদাতীরা এখনও ধরে রেখেছে। সেখান থেকে বের হতে চাচ্ছে না!
259799
৩০ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:৩৪
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : কোথায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট? রাজ্যতো প্রায় অচল।
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:৫৪
203697
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : Yawn Yawn Smug Smug Worried Worried
264021
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৪
জাগো মানুস জাগো লিখেছেন : jazakallah khair.....will be comments after fully read.

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File