সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত- ৩- ৪

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৩ জুন, ২০১৭, ১২:১২:৫৪ রাত

ইতিমধ্যে সর্বত্র প্রচার হয়ে গেল মাওঃ জালালুদ্দিন মারা গেছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কওমী পন্থি আলেমদের সংগঠন ‘ইত্তেফাকুল উলামা’ এর পক্ষ থেকে জামালুদ্দিনকে ডাকা হল। ছেলেটা আশান্বিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, রাজনৈতিক দলের কেউ প্রতিপক্ষ দলের হাতে মারা গেলে স্বদলের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়, কাজেই তাকেও সম্ভবত হেফাজতের পক্ষ থেকে কিছু অনুদান দেয়া হবে- যা এই দুঃসময়ে তার পরিবারের অনেক উপকার হবে। সে আশায় বুক বেধে ময়মনসিংহ গেল। কিন্তু সেখানকার বড় বড় আল্লামা হুজুররা তাকে নিরাশ করল। তাকে জিজ্ঞেস করল তার বাবা কয়টা গুলি খেয়েছিল, গুলি কি বুকে লেগেছিল নাকি পিঠে অর্থাৎ সে কি পলায়ন করতেছিল নাকি আক্রমণাত্মক ছিল। তারা কয় ভাই বোন, জমা জমি কতটুকু আছে, চলতে পারবে নাকি না খেয়ে মরতে হবে ইত্যাদি খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করল। তারপর বলল ‘আল্লাহর মাল আল্লাহই দেখবেন আমরা দোয়া করব।

এইভাবে তারা নেক দোয়া দিয়ে একটা অসহায় বালককে বিদায় করে দিল। কিন্তু এই আল্লামারা বুঝেও বুঝার প্রয়োজন বোধ করল না যে, এই মুহুর্তে একটি দরিদ্র ইয়াতিম পরিবারের জন্য তাদের নেক দোয়ার চেয়ে দু’মুঠো অন্ন যোগানের জন্য দু’টি পয়সা বেশি প্রয়োজন ছিল। জামালের মনটা ভেঙ্গে গেছে। সে আশা করেছিল কিছু টাকা পেলে ভালরুপে বোনের চিকিৎসাটা চলবে আর পরিবারেরও চারটে ভাতের একটা গতি হবে কিন্তু হল না। পরিবারে নগদ কোন টাকা পয়সা ছিল না। কিঞ্চিত ধান চাউল যা ছিল তা দিয়ে কোন রকম পরিবারের খাওয়া ও মেয়ের চিকিৎসা খরচ চলছে। অগত্যা চরম নৈরাশ্য ও হতাশা নিয়ে সে বাড়িতে ফিরল।

দুইদিন পর কাছের একটা মাদরাসায় আবার জামালের ডাক পড়ল, এর পরদিন মুক্তাগাছার বড় মাদরাসায় ডাকল, সে গেল কিন্তু সেই একই অবস্থা। তারা শুধু তার বাবার মৃত্যুর ঘটনা ও পারিবারিক অবস্থা ব্যবস্থা খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করল তারপর নেক দোয়া দিয়ে বিদায় করল। জামালের মনে হল তার বাবার প্রতি এরা উপহাস করেছে। আর পারিবারিক অচলাবস্থার কথা শুনে ইয়াতিম পরিবারটির প্রতি অবজ্ঞা করেছে। তার আফসোস হল যে টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া দিয়ে সে কয়েক জায়গায় গেল এই টাকাটা থাকলেও তো বোনের চিকিৎসায় কাজে লাগত। আর এই অর্বাচিনদের ডাকে দৌড়াদৌড়ি না করে বাড়িতে থাকলেও তো সময়টা বোনের খেদমতে কাজে লাগত। সে প্রতিবার আফসোস করতে করতে বাড়িতে ফিরে। মেয়ের অবস্থা আরো করুন হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে, কিছু খায় না, খেতে পারে না। সেলাইন দিয়ে রাখা হচ্ছে। হঠাৎ মাঝে মধ্যে যখন চেতন পায় তখনি মাতম শুরু করে ‘আব্বা আব্বা গো তুমি কই, আমি তোমার কাছে যামু আব্বু তোমার কাছে যামু আমাকে নিয়া যাও’ এভাবে বিলাপ করতে করতে আবার অচেতন হয়ে পড়ে।

এদিকে ঘরের সম্বল যা ছিল সব শেষ, মেয়ের চিকিৎসা খরচ চালানোর মত আর কোন উপায় নাই। মা ও বড় মেয়েটা বসে বসে কাঁদছে। জামাল অসহায় হয়ে পুকুর পারে বসে বসে ভাবে, খোদার দুনিয়া কত বিস্তৃত কত নায নিয়ামতে ভরপুর। কত মানুষের কত শান শওকত- সম্পদের পাহাড়। তাদের অনেকে পোষা কুকুর বিড়ালের পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে অথচ আজ দুটি পয়সার জন্য আমার ইয়াতিম বোনটা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। সে চরম হতাশা ও নৈরাশ্যের বোঝা মাথায় নিয়ে তার রুমে গিয়ে মরার মত পড়ে থাকল।

এশার পর মসজিদের ইমাম সাব এলেন, তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্তনা দিতে লাগলেন। সহসা তার হাত জামালের মুঠিতে গুজে দিয়ে বললেন ‘বাবা আমার পরিবারও দরিদ্র, আমি দুই হাজার টাকা বেতন পাই, সবটা দিয়ে দিলে আমার পরিবার না খেয়ে মরবে, তাই দুই পরিবারের জন্য এক হাজার করে বণ্টন করলাম। আল্লাহ যদি আমাকে সামর্থ দিতেন তাহলে এই ইয়াতিম পরিবারের সম্পুর্ণ ব্যয় আমি বহন করতাম। জামাল লজ্বা ও সৌজন্যের খাতিরে বলল, ‘না লাগবে না, আপনার বাড়িতে পাঠান। ইমাম সাব হেসে বললেন ‘লাগবে বাবা লাগবে, মেয়েটা অসুস্থ এখন টাকার প্রয়োজন। তিনি আরো কিছুক্ষণ শান্তনা ও উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন।

জামাল নিথর হয়ে বসে রইল। তার চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এক হাজার টাকা দিয়ে দুই দিন মেয়ের চিকিৎসা চলল কিন্তু পরদিন ডাক্তার জওয়াব দিন এবং পরামর্শ দিল ময়মনসিংহ চরপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করতে। অসহায় পরিবারটির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ভর্তি তো দুরের কথা যাওয়ার ভাড়ার পয়সাটাও তাদের হাতে নেই। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও সাহায্য করার মত কেউ নেউ, থাকলেও তেমন মন মানসিকতা নেই। তবে জামালের বড় খালার বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে তিন মাইল পশ্চিমে জামালপুর সীমান্তে। তার তিনটা ছেলে মোটামোটি শিক্ষিত, ছেলেগুলি পয়সা উপার্জন করে। অবশেষে মা আশায় বুক বেধে ছেলেকে বললেন ‘তোর বড় খালাকে নিয়ে আয় গিয়ে। তিনি এসে সব কিছু দেখলেন শুনলেন। তারপর বাড়িতে গিয়ে আধা মণ চাউল, কিছু শাক সবজি ও পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বড় ছেলে আরমানকে পাঠিয়ে দিলেন।

টাকা পেয়ে তারা মেজো মেয়েকে নিয়ে গিয়ে ময়মনসিংহ হাসপাতালে ভর্তি করল। কিন্তু তিনদিন পর হাসপাতাল থেকেও বিদায় দিয়ে দেওয়া হল। নাদুস নুদুস মেয়েটা শুকিয়ে অস্থি চর্মসার হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় চামড়ায় আচ্ছাদিত একটা কংকাল। অবচেতন অবস্থায় সারাক্ষণ বিছানায় লেপটে পড়ে থাকে, মা সব সময় পাশে বসে বসে পাহারা দেয়, ঔষধ খাওয়ায়, সেলাইন লক্ষ রাখে। সে মাঝে মধ্যে চেতন পেয়ে উঠে বসতে চায়, মা জড়িয়ে ধরে শুইয়ে দিতে চায় কিন্তু সে শুবে না কোথাও যেন যেতে চায়। মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আর ক্ষীণ দুর্বল দেহে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে, ‘আমি আব্বুর কাছে যামু, আম্মু আমাকে আব্বুর কাছে যেতে দাও, আব্বু আমার জন্য লজেন্স চানাচুর, তেতুল আচার নিয়ে আসতেছে, আমার জন্য নতুন ঘড়ি আর বোরকা নিয়ে আসতেছে, আমাকে ছাড়, আব্বু আমাকে ডাকতাছে, আমি যামু’ বলতে থাকে কাঁদতে থাকে আর যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করতে থাকে। তারপর এক সময় অচেতন হয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। কখনো মধ্যরাতে বা শেষ রাতে সে বাবার কাছে যেতে চায় আর তখন চৌকি থেকে পড়ে গিয়ে বেহুশ হয়ে যায়। এই ভাবে হতভাগিনী বালিকা ক্রমে ক্রমে বাবার নিকটবর্তী হতে থাকে।

সেদিন শেষ রাত্রে মা বসে বসে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যের হিসাব করছেন। সহসা তিনি লক্ষ করলেন ঘুমের মধ্যেই মেয়ে হাসছে। পরক্ষণেই সে ঘুম ভেঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরে চেচিয়ে উঠল, ‘আম্মু আম্মু আমি আব্বুকে দেখেছি। সে হাসছে, খুশিতে তার মুখটা চকচক করছে। আনন্দাতিশয্যে গলগল করে বলে যাচ্ছে ‘আম্মু জানো, আব্বু না আমাকে নৌকায় তুলে নদী দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুই পাড়ে কত সুন্দর সুন্দর মজার মজার ফল গাছ নদীতে ঝুলে আছে। আমরা নদীর কিনার ধরে যাচ্ছি। আব্বা হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে আম জাম লিচু কলা আঙ্গুর আপেল নাশপাতি ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের ফল পেড়ে আমাকে খেতে দিচ্ছে। কত মজার ফল, আমি খাচ্ছি আর মজার চোটে নাচছি। আমার নাচনে নৌকা দুল খায়, তখন আব্বা হাসে আর আমাকে ধমক দেয় ‘এই পাগলি দুষ্টুমি করবি না কিন্তু বলে দিলাম, নৌকা নাড়ালে মারমু। আর নদীটা কিসের জানো, দুধের ও মধুর। আমি অঞ্জুলি ভরে ভরে এনে দুধ ও মধু খাই। আহ কত যে মজা, এত স্বাদের দুধ ও মধু আমি জীবনেও খাইনি। তারপর সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে ‘আম্মু আমি আব্বুর কাছে যামু’ বলে কাঁদতে লাগল।

মায়ের মন কী বুঝল সেই জানে, তিনি কিছু না বলে মেয়েকে শুইয়ে দিলেন। তারপর গিয়ে জায় নামাজে ঝাপিয়ে পড়লেন। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, তীব্র কান্নার ঢেউ গলায় আচরে পড়ছে, তার কষ্ট চরমে পৌছে গেছে। বোবা কান্নায় তার মুখে কোন ভাষা জোগাল না, শুধু সেজদায় পড়ে সর্ব রিক্তের মত আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার চোখের নোনা জল মুসাল্লায় গড়িয়ে পড়ছে। মুসাল্লা ভিজে মাটিতে ছোয়ে যাচ্ছে, এক অসহায় বিধ্বার অশ্রু মাটি চোষে নিচ্ছে। মেয়েটা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকছে ‘আব্বু তুমি কোথায় আমি তোমার কাছে যাব, তোমার হাতে ফল খাব, আমাকে নিয়ে যাও। কিছুক্ষণ পর তার গলায় গরগর শব্দ উঠল সেই সাথে ক্ষীণ কণ্ঠ, ‘আব্বু আমি আসছি, আমি আসছি আব্বু তোমার কাছে......

আওয়াজ শুনে মা দৌড়ে গিয়ে মেয়ের দেহটা কোলে নিলেন। ততক্ষণে তার দেহে খিচুনি শুরু হয়ে গেছে। মায়ের কোলে মেয়ের দেহ খিচতে খিচতে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল, আর সাথে সাথে হতভাগিনী বালিকার দেহটি নিথর হয়ে গেল। একদিন যে মা নারী দেহের একটি শিশু পৃথিবীর মাটিতে মিষ্ট করেছিলেন তের বছরের ব্যবধানে তারই কোলে শুয়ে তারই বুক খালি করে সে বাবার বুকে গিয়ে আশ্রয় নিল চিরদিনের জন্য। এইভাবে বাপ পাগুলে মেয়ে বাবার বিচ্ছেদ বেশি সময় সহ্য করতে পারল না, বাবার সাথে খুনসুটি করার জন্য পনের দিনের ব্যবধানে সে জন্মদাতার কোলে ফিরে গেল। মা মেয়ের নিঃশ্বাস পরখ করে শুধু একটা চিৎকার দিল, ‘ও আল্লাহ, আল্লাহ গো’ বলে তিনি চৌকিতে পড়ে মুর্ছা গেলেন। মায়ের চিৎকার শুনে ছেলে মেয়েরা দৌড়ে এল এবং বোনের দেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মাওঃ জালালুদ্দিনের দরিদ্র কুটিরে ফের একবার কারবালার মাতম উঠল। কর্তার মৃত্যুর মাধ্যমে যে পরিবারটি নোঙ্গর কেটে শোকের সাগরে ভাসছিল কিন্তু এবারের কাল বৈশাখী সেই পরিবার রুপি ভেলাটি ভেঙ্গে লন্ড ভন্ড করে দিয়ে গেল।

কান্নাকাটি শুনে আশ পাশের মানুষজন দৌড়ে এল, আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি সংবাদ দেয়া হল। সবাই একটি কথাই বলতে লাগল, বাপের আদুরে মেয়ে বাপের শোক সহ্য করতে পারেনি, অবশেষে বাপের কাছেই চলে গেল। পরদিন জহুরের পর জানাযা দাঁড়াল। জামাল জানাযা পড়ানোর জন্য সামনে দাঁড়াল কিন্তু সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তার ক্ষীণ দুর্বল দেহটি বারবার হাটু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। অবশেষে তাদের মসজিদের ইমাম সাব তাকে ধরে পিছনে সরিয়ে বললেন, ‘তুমি পারবে না, আমিই পড়াই। তারপর দাফন শেষে সে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরল। তার কোন বাহ্যিক অনুভুতি নাই, সে জানে না সে কি জীবিত নাকি মৃত, মন মস্তিস্ক বিকল, কোন কিছু চিন্তা করতে পারছে না। শরীরটা অনুভূতিহীন একটা মুর্তি মনে হচ্ছে, পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে বারান্দায় তার রুমটিতে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ল। শীঘ্রই তার অবসন্ন ও ক্লান্ত দু’টি চোখে ঘুম নেমে এল। মা ও মেয়ে দু’টি চৌকিতে পাথরের মত নিশ্চল মৃতবৎ পড়ে আছে। আত্মীয় স্বজনরা এসেছে, তারা অভিশপ্ত পরিবারটিকে শান্তনা দিয়ে ধীরে ধীরে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেল। জামালের খালাত ভাই আরমান দুই হাজার টাকা খালার হাতে গুজে দিয়ে সেও চলে গেল।

রাতের দ্বিতীয় যাম অতীত হয়ে গেছে। হঠাৎ জামালের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার বাবার বুকে গুলি লাগার দৃশ্য, তার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। তার মৃত বোনের সেই নিস্পাপ মাসুম করুণ মুখটি- যে মুখে সে আব্বা আব্বা ডেকে চিৎকার করত। তার বুকটা ধকধক করছে, সাপের বিষের মত সর্বাঙ্গে ব্যথা ও যন্ত্রনার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। সহসা তার মনে হল তার পরিবারটা অভিশপ্ত, পৃথিবীর সাথে তাদের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদের বেচে থাকার আর কোন আশা ও অবলম্বন নাই, তারা এই পৃথিবীর অবাঞ্চিত। দু’টি বোন ও তার নিজের লেখাপড়া, বিয়ে শাদি, ভবিষ্যৎ আশা আকাঙ্ক্ষা সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেল। আর কোন আশার আলো নাই, শুধু হতাশা ও নৈরাশ্যের অন্ধকার। আর শুয়ে থাকা সম্ভব হল না, সে আস্তে আস্তে উঠে বাইরে চলে গেল।

দক্ষিণ মুখী বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠান, তারপর রাস্তা তারপর দক্ষিণ মুখী লম্বা পুকুর। সে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে চলে গেল। উদার উন্মুক্ত আকাশ, তার নিচে সুবিস্তৃত পৃথিবী। তারই বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক ভাগ্যাহত তরুন। সে সীমাহীন অসহায়ত্ব নিয়ে দুটি হাত উর্ধ্বে নিক্ষেপ করে চিৎকার করল, ‘প্রভু আমার, কেন আমাদেরকে এত বড় শস্তি দিলে, কেন আমার মাসুম বোনটাকে কেড়ে নিলে। কেন আমার বাবাকে কেড়ে নিলে। এখন আমাদের কি হবে? কে আমাদেরকে লালন পালন করবে। কে লেখাপড়া করাবে। কে বিয়ে শাদি দিবে। কে ভবিষ্যৎ করে দিবে। ফুলের মত নিস্পাপ মাসুম আমার দু’টি বোনের কি হবে। কে তাদের বিয়ে শাদির ব্যবস্থা করে দিবে। এরা কি মালিহীন বাগানের মত পরিচর্যাহীন ভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে সুভাস ছড়ানোর আগেই শুকনো মুকুলের মত ঝড়ে পড়বে। কেন আমাদের এত বড় শাস্তি দিলে খোদা, কেন এমনতরো বদ বখত করলে।

সে আর কথা বলতে পারল না, দু’হাতে মাথা চেপে ধরল, তার অবসন্ন দেহটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, মানব কষ্ট ও যাতনার চরমে পৌছল। সে পুকুর পাড়ের মাটিতে গড়াতে লাগল আর জিগর ফাটা আর্তনাদ করতে লাগল। তার ভিতরের কান্না গলা ফেটে বের হতে চাচ্ছে, সে গড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। এভাবে এক সময় সে বেহুশ হয়ে গেল আর তার নিথর দেহটি পুকুর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকল। ফজরের আজান শুনে তার চেতনা ফিরল। সে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ঘরেই নামায পড়ে বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দিল।

আজ তিন দিন ধরে মা আধা চেতন আধা হুস অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। পাড়া প্রতিবেশিরা খাওয়ার সময় চারটে ভাত নিয়ে এসে জোরজার করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে, ছেলে মেয়েরা দুয়েক লোকমা খায় কিন্তু মায়ের কিছু খাওয়া হয় না। চতুর্থ দিন গায়ের কয়েকজন মুরুব্বি মহিলা এসে মাকে বুঝাল এবং শাসাল ‘আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়া গেছে সেখানে তো মানুষের করার কিছু নাই। এ নিয়ে কান্নাকাটি করে মরলেও তো আর তাদেরকে ফিরে পাওয়া যাবে না। এখানে ধৈর্য্য ও আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া তো আর কোন উপায় নাই। অথচ এ নিয়ে চিন্তা করে তুমি নিজে তো শেষ হচ্ছই নিজের পরিবারটাকেও ধ্বংস করছ। তুমিই যদি এভাবে না খেয়ে পড়ে থাক তাহলে তোমার সন্তানদের কী হবে। এই দুঃসময়ে তুমিই একমাত্র তাদের বেচে থাকার অবলম্বন। এখন তুমিই না বাচলে ওরা বাচবে কেমনে। কাজেই উঠ, নিজের জন্য না হলেও অন্তত ছেলে মেয়েদের জন্য উঠ, ওদের সামনে হাসি খুশি থাক। ওদেরকে রান্না বাড়া করে খাওয়াও। এখন তোমার একমাত্র সম্পদ এবং সম্বল এই তিনটি সন্তান, ওদেরকে বাচিয়ে রাখ।

তাদের কথায় মায়ের চেতনা ফিরল। তিনি বুঝলেন, যা গেছে তো গেছেই এখন তার তিনটি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তিনি উঠলেন, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। তার বুকের মধ্যের মাংসপিন্ডটি যদিও এখন আর মাংসপিন্ড নেই অঙ্গার হয়ে গেছে তবুও ছেলে মেয়েদের সামনে তিনি হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করেন। তাদেরকে ডেকে কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেন, তাদের নাওয়া খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলেন। ঘরে যৎসামান্য কিছু খোরাক ছিল তার উপর বড় বোনের ছেলে দুই হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল- তা দিয়ে কিছুদিন চলল। এরপর ঘরের অবশিষ্ট আসবাব পত্র বিক্রি করে আরো কিছু দিন চলল। এবার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আর কোন সম্বল নাই, অর্ধাহারে অনাহারে দিন যেতে লাগল। অগত্যা তিনি প্রতিবেশীদের কাছে ধার কর্জ শুরু করলেন, কিন্তু এভাবেই আর কতদিন চলে। একেক জনের কাছ থেকে দুতিন বার করে ঋণ করা হয়ে গেছে। মায়ের অনাহারে ও ছেলে মেয়েদের অর্ধাহারে দিন কাটতে লাগল।



মাওঃ জালালুদ্দিন শিক্ষকতা ও ইমামতি করে যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতেন কিন্তু তিনি সন্তানদের পেছনে মাত্রাতিরিক্ত খরচ করতেন। অপব্যায়ের কারনে তার অর্ধেক ফসলি জমি বন্ধক পড়ে গিয়েছিল আর বাকি অর্ধেক বর্গা দেয়া ছিল। বর্গা জমির ধান আসতে এখনো দেরি আছে। সন্তান তিনটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মায়ের সামর্থ শেষ হল, সর্বশেষ সম্বল আধা কেজি আটা দিয়ে একদিন চালালেন আর নিজের বরাদ্দে রাখলেন শুধু টিউবওয়েলের পানি। মায়ের চোখে অন্ধকার নেমে এল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার তিনটি সন্তানের শবদেহ। তিনি অনেক কান্নাকাটি করলেন, তারপর দুপুরে খাওয়ার সময় ছেলের পাতে অর্ধেকটা রুটি দিয়ে বলতে চাইলেন, কিন্তু কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, কণ্ঠ কাঁপছে। কারণ গ্রামাঞ্চলে জমি বিক্রি করাকে মৃত্যুর শামিল মনে করা হয়। তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ছেলেকে বললেন ‘তুই আসামুদ্দির কাছে যা, জমি বেচা ছাড়া তো এখন আর কোন পথ দেখি না। কী খেয়ে বাঁচবি ঘরে তো আর কিছুই নাই’ বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন।

জামালের দেহের জোড়াগুলি ছেড়ে দিয়েছে। সে টলতে টলতে আসামুদ্দির বাড়িতে গিয়ে তাদের পরিবারের দুরাবস্থার কথা জানিয়ে বলল, ‘আমাদের জমি বেচতে হবে, আপনি গিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলে আসেন’ খাড়ার উপর এটুকু আলাপ করেই আবার সে বাড়িতে ফিরল। তার রুমে গিয়ে মরার মত শুয়ে রইল। গ্রামাঞ্চলে জমি বিক্রি করাকে অশুভ লক্ষন মনে করা হয়। তারা বিশ্বাস করে একবার জমি বেচলে পরিবারটি ধ্বংসের সিড়িতে পা রাখে, তারপর বাধ্য হয়েই প্রতি বছর জমি বেচতে বেচতে এক সময় আর জমি থাকে না, পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ জন্যই গ্রামাঞ্চলে এটাকে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে করা হয়।

জামাল শুয়ে শুয়ে ভাবছে, ‘এবার বুঝি আমাদের চূড়ান্ত ভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। আগে বাবার উপার্জনে সংসার চলত কিন্তু এখন বাবা নেই। বাধ্য হয়েই আমাদের জমি বেচে পেট চালাতে হবে। জমি বেচেই দুটি বোনের বিয়ে দিতে হবে। দরিদ্র পরিবার, হয়ত ভাল পাত্র আসবে না। ফকির মিসকিন দেখে টাকা পয়সা খরচ করে বিয়ে দিতে হবে। এভাবে জমি বেচতে বেচতে একসময় আর আমাদের কিছুই থাকবে না। তখন হয়ত অন্যের মুজুরি করে বা ভিক্ষে করে খেতে হবে আর গাছ তলায় বা ফুটপাতে পড়ে থাকতে হবে। আমরা নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে যাব, ভিক্ষুক হয়ে যাব। তীব্র যন্ত্রণায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, চরম নৈরাশ্যে জবাই করা পশুর মত সে বিছানায় পড়ে চার হাত পা মারতে থাকে, পৃথিবীটা ফাকা মনে হয়, কোথাও যেন কেউ নেই। তাদেরকে ধরে রাখবার, টিকিয়ে রাখবার, বাঁচিয়ে রাখবার মত কেউ নেই। সর্বত্র শব্দহীন শুন্যতা, হাহাকার হতাশা নৈরাশ্য। পৃথিবীর সাথে যেন তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, তারা হারিয়ে যাচ্ছে, কোন অজানা অন্ধকার অতলান্তের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে কিন্তু মা ও অন্যারা শুনবে ভয়ে সে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগল। এক সময় তার দেহটি অসার হয়ে শবদেহের ন্যায় বিছানার উপর পড়ে রইল। মজলুমের অসহায়ত্ব যখন চরমে পৌঁছে তখনি আল্লাহর সাহায্য শুরু হয়।

এশার পর জামাল তার রুমে মরার মত পড়ে আছে। হঠাৎ মসজিদের ইমাম সাব সালাম দিয়ে ঢুকে বিছানার পাশে বসলেন। তার বেদনা বিধুর মুখটার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলালেন। কিন্তু সাথে সাথে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত রুমে থেকে বেরিয়ে গেলেন। জামাল বুঝল কান্না লুকানোর জন্য তিনি বেরিয়ে গেছেন। ক্ষণেক পর চোখ মুছে আবার রুমে ঢুকে মেঝেতে দাঁড়ালেন, মুখটা গম্ভীর। মুখের বলিরেখাগুলি আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। সহসা তিনি মেঘের মত গর্জে উঠলেন ‘জামাল উঠ। সে অবাক হয়ে গেল কিন্তু এ কঠোর হুকুমের সামনে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হল। ইমাম সাব তার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালেন।

তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ‘পুত্র আমার, তোমাদের এতটা দুরাবস্থার কথা আমি জানতাম না, আসামুদ্দির কাছে জানলাম, তার কাছে নাকি জমি বেচতে গিয়েছিলে? তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘কাপুরুষ অকর্মন্য অপদার্থ ছেলে, তোমার মত এমন একটা বলিস্ট গড়ন শক্তিশালী তাগড়া ছেলে থাকতে জমি বেচতে হবে কেন? তোমার মত ছেলে রিকশা চালিয়ে, রোজানা কাম করে, গার্মেন্টস করে কত স্বচ্ছন্দে চার পাঁচ জনের সংসার চালিয়ে নিচ্ছে আর তুমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়ে মানুষের মত কাঁদছ আর তোমার বোনের মত মৃত্যুর প্রহর গুনছ। তুমি অপদার্থ অকর্মন্য, নইলে জমি বেচার নাম মুখে আনতে না। হঠাৎ তিনি দিগন্তের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘দেখ পুত্র খোদার পৃথিবী কত বিস্তৃত কত প্রশস্ত। যোগ্য ও কর্মঠরা দু’হাতে এ দুনিয়ার ভাণ্ডার লোটে নেয়। এখানে অযোগ্য ও অকর্মন্যদের কোন ঠাই নাই। এই পৃথিবীর নায-নিয়ামাত আল্লাহ কাউকে লিখে দেননি, নিজের যোগ্যতা ও কর্ম দক্ষতার বিনিময়ে তা অর্জন করতে হয়। কাজেই তুমি পুরুষ তুমি তরুন, তাহলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে কেন?

চার সদস্যের একটা পরিবার যখন তোমার উপর নির্ভরশীল, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তখন তুমি পৃথিবীর যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার পরিবর্তে নারীর মত শুয়ে শুয়ে কাঁদছ আর জমি বিক্রি করে খাওয়ার ধান্ধা করছ। এ জন্য আমি তোমাকে ধিক্বার দিচ্ছি, তিরস্কার করছি, সেই সাথে উপদেশ দিচ্ছি। উপদেশ দিচ্ছি তোমাকে উঠ, উঠ পুত্র, খোদার অবারিত পৃথিবীর উপর তোমার বাহু বিস্তার কর। সিংহের মত থাবা মার, সিংহের তেজ নিয়ে কর্ম ক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়, তোমার ভাগ্যের বন্ধ দরজায় লৌহ মুষ্টির আঘাত হানো, সামনে এগিয়ে চল। তুমি পৃথিবীর পদতলে পিষ্ট না হয়ে পৃথিবীকে তোমার পদতলে পিষ্ট কর। এই পৃথিবীর রণাঙ্গনে তুমি কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকবে না, তুমি থাকবে অগ্রগামী। এটাই তোমার কাছে আমার আশা ও দাবী।

কারণ এটাই তোমার যুদ্ধের সময়, তুমি এখন তরুণ, তারুন্যের শক্তি ও তেজ কাজে লাগাও। নিজের ভাগ্য নিজে গড়, পৃথিবীকে পদানত কর। ইমাম সাবের একেকটা কথা তার অর্গলাবদ্ধ হৃদয়ের লৌহ কপাটে এটমের মত আঘাত হানে আর মনের প্রতিবন্ধকতা গুলি চুর্ণ বিচুর্ণ করে দেয়। ইমাম সাবের প্রতিটা কথায় তার বক্ষ প্রদীপ্ত আশায় স্ফিত হয়ে উঠে, নিঃশ্বাস ঘনতর হয়, শরীরের মাংসপেশি ঠনঠন করে উঠে, তার দুঃখ ও দুশ্চিন্তা কেটে গেল। কল্পনার চোখে সে দেখতে পায় তার ভবিষ্যতের দিগন্ত পর্যন্ত আলোক উজ্বল হয়ে উঠেছে।

অবশেষে ইমাম সাব বললেন ‘আসামুদ্দির কাছে শুনে আমি তোমার সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাল একটু আগে ভাগেই জুমার নামাযে উপস্থিত থেক’ বলে তিনি বিদায় হয়ে গেলেন। ইমাম সাব জুমার আগে ওয়াজ শুরু করলেন, ‘রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, কেউ সম্পদ ও বোঝা (ইয়াতিম, বিধবা ও বৃদ্ধ) রেখে মারা গেলে সম্পদ তার পরিবারের কিন্তু বুঝা আমার অর্থাৎ তিনি তাদের লালন পালন করবেন। কাজেই ইসলামি বিধান মতে ইয়াতিম বিধবা ও বয়োবৃদ্ধ রাষ্ট্রের পোষ্য, সরকার তাদেরকে ভাতা দিয়ে লালন পালন করবে। আপনারা জানেন মাওঃ জালালুদ্দিন শাপলা চত্বরে শহীদ হয়েছেন, তার লাশটাও খুজে পাওয়া যায়নি। এখন তার পরিবারটি ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল পরিবারটির ব্যয়ভার বহন করা কিন্তু বর্তমান দাজ্জালি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার ইয়াতিমদের লালন পালন করবে তো দুরের কথা বরং ইয়াতিম বিধবার সংখ্যা বাড়াচ্ছে, আর তাদের আহাজারিতে দেশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।

কাজেই পরবর্তি দায়িত্ব বর্তায় সমাজ বা মহল্লার উপর। এই ইয়াতিম পরিবারের ব্যয়ভার বহন করা অত্র সমাজের উপর ফরয, তারা যদি কষ্ট করে বা ধ্বংস হয় তাহলে সমাজের প্রত্যেককেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামের এই সুন্দর বিধানের প্রচলন নাই। কাজেই আমি যখন শুনলাম মাওঃ জালালুদ্দিনের পরিবারটি কষ্টে আছে তখন অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমি আমার সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাওঃ জালালুদ্দিনের যোগ্য ছেলে জামালের অনুকূলে আমার ইমামতিটা ছেড়ে দেব। একটা ইয়াতিম পরিবারের সাহায্যার্থে আমি এ নিয়ত করেছি। আপনারা আমাকে দুই হাজার টাকা বেতন দিতেন আর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দিতেন কিন্তু জামালের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দিতে হবে না বিধায় এ বাবত তাকে আরো দুই হাজার টাকা দিবেন অর্থাৎ চার হাজার টাকা বেতন দিবেন। সবাই রাজি আছেন তো? মুসুল্লিরা সবাই হাত উঠিয়ে সম্মতি জানাল।

ইমাম সাব আবার বললেন ‘আরেকটা কথা, মক্তবের শিশুরা মাসিক আধা কেজি করে চাল দেয়। অথচ একটা শিশুকে বাংলা ইংরেজি প্রাইভেট পড়ালে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা দিতে হয় কিন্তু আমাকে দিচ্ছেন আধা কেজি চাউল মানে পনের থাকা। এটা যেমন আমার লজ্বা তেমনি আপনাদেরও লজ্বা হওয়া উচিত। অবশ্য এজন্য আপনারা দায়ী নন, আমরাই দায়ী। আমরা আলেমরা নিজেদেরকে খুব সস্তা বানিয়ে ফেলেছি। যাই হউক জামালের জন্য প্রত্যেক শিশুকে এক কেজি করে চাল দিতে হবে। আপনারা রাজি আছেন তো? সবাই হাত তুলে সম্মতি জানাল এবং একটা ইয়াতিম পরিবারের জন্য ইমাম সাবের এই ত্যাগের প্রশংসা করল।

জামাল আশান্বিত হয়ে উঠল, একটা ধ্বংসশীল পরিবারকে সুখি করার স্বপ্নে তার চোখ দু’টি স্বপ্নময় হয়ে উঠল। এখন সে ইমাম সাবের কাছাকাছি থাকে। এশার পর তিনি জামালকে নিয়ে বসলেন পরামর্শ দেয়ার জন্য। তিনি বললেন ‘বৎস শুন, ইয়াতিম পরিবারের উপর সর্বদা আল্লাহর রহমত থাকে। এ উম্মতের ধারাটাই হচ্ছে ইয়াতিমের ধারা, রাসূল (সাঃ) ইয়াতিম ছিলেন। তারপর ইমাম বুখারি, গাযযালী, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, আব্দুল কাদের জিলানী, শাহ জালাল ইয়ামানী (রঃ) এরা সবাই ইয়াতিম ছিলেন। এ উম্মতের মধ্যে যারা বড় হয়েছে দেখা যায় তারা সবাই ইয়াতিম। কারণ ইয়াতিমদের উপর আল্লাহর সুনজর থাকে। কাজেই তুমিও ভয় পেয়ো না, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে কাজ করে যাও, আশা করি একদিন তুমিও অনেক বড় হবে।

এখন আমার পরামর্শ শুন, মক্তব থেকে ত্রিশ চল্লিশ কেজি চাল পাবে আর ইমামতি বাবদ চার হাজার টাকা পাবে তা দিয়ে তোমার পরিবারের খোরাক ও ব্যয় সংকুলন হয়ে যাবে। অবসর সময়ে কয়েকটা টিউশনি করবে, এ টাকাটা আয় থাকবে। আপাতত কিছুদিন দুই মেয়ে ও তুমি মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ রাখ, তবে লেখাপড়া বন্ধ করবে না। কিতাব এনে বাড়িতে বসে বসে পড়বে আর পরীক্ষায় অংশ নিবে। তারপর যখন স্বচ্ছলতা আসবে তখন মেয়েদেরকে মাদরাসায় পাঠিয়ে দিবে। আর তুমি দূরে না গিয়ে মুক্তাগাছা গোরস্থান মাদরাসায় ভর্তি হবে। তাতে সংসারও দেখা শুনা করতে পারবে লেখা পড়াও চলবে।

তোমাদের কিছু জমি বর্গা দেয়া আছে, আমি বর্গাদারদের সাথে আলাপ করেছি তারা জমি ছেড়ে দিবে তখন তুমি নিজেই আবাদ করবে। পুকুরটা লিজে দেয়া আছে, শীঘ্রই তারা মাছ বিক্রি করে দিবে তখন তুমি নিজেই ফিসারি করবে, এতে অনেক লাভ। বছর খানেক পর ফসল ও ফিসারি থেকে যে লাভ পাবে তা দিয়ে বন্ধক জমিগুলি ছাড়িয়ে নিবে। ব্যস, এরপর আর তোমাদের কোন অভাব থাকবে না ইংশাআল্লাহ। তিনি আরো বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে বললেন ‘আমার বিবেচনায় যা ভাল তাই বললাম। এখন তুমি নিজে বুঝবে, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করবে, আত্মীয় স্বজন ও মুরুব্বিদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করবে, পরামর্শ ছাড়া তোমার একক সিদ্ধান্তে কোন কাজ করবে না, সর্বদা মায়ের কথা মেনে চলবে।

জামাল ইমাম সাবের হাত ধরে কেঁদে উঠল, ‘হুজুর আমাদের জন্য আপনার এত বড় ত্যাগ স্বীকারের দরকার নাই, আপনি থাকেন। আমার জন্য দোয়া করেন আমি অন্য একটা ব্যবস্থা খোঁজে নেই। ইমাম সাব হাসলেন, ‘পাগল ছেলে, তুমি তো বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না, সংসার দেখতে হবে, বোনদের দেখতে হবে। কাজেই এই ইমামতিটা তোমার একান্ত প্রয়োজন। আমার চিন্তা করো না, আল্লাহ কোথাও না কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। এরপর ইমাম সাব আরো দুইদিন থাকলেন। বিদায় উপলক্ষে সবাই তাকে কম বেশি কিছু টাকা পয়সা ও উপহার উপঢৌকন দিল। যাবার সময় জামাল তাকে কিছুটা এগিয়ে দিতে গেল। ইমাম সাব তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে বললেন ‘আমি সব সময় মোবাইলে তোমাদের খোজ খবর নিব। মাঝে মধ্যে বেড়াতেও আসব। তারপর নিজের ঠিকানা দিয়ে বললেন তুমিও আমার বাড়িতে বেড়াতে এসো’ বলে তার হাতে এক হাজার টাকা গুজে দিয়ে আল-বিদা’ বললেন।

জামাল এক দৃষ্টিতে তার পথের পানে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, যে আল্লামা হুজুররা ডেকে নিয়ে তার বাবাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল তারা কেউ এসে ইয়াতিম পরিবারটিকে এক নজর দেখল না, একটু খোজ খবর নিল না, একটি পয়সা দিয়ে সাহায্য করল না, অথচ এই দরিদ্র বেচারা তাদের জন্য নিজের চাকরিটা ছেড়ে দিল। কে জানে আর চাকরি হয় কি না হয় আর হলেই বা কখন হবে। কোন ফেরেশতাই অন্যের জন্য নিজের এত বড় কোরবানি করতে পারে। এদের জন্যই আল্লাহ জান্নাতের অঙ্গিকার করেছেন। ইমাম সাব তার দৃষ্টির সীমান্তে চলে গেছেন, সে এখনো অপলক নেত্রে তাকিয়েই আছে, তার চোখ দিয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার অশ্রু ঝড়ে পড়ছে।

বিষয়: রাজনীতি

৯২৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383348
১৩ জুন ২০১৭ বিকাল ০৫:১৩
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :
ভালো লাগলো , অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File