চিঠি- ৫২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:১২:২০ সকাল

একচালা ঘর, টিনের বেড়া। পশ্চিম পাশে রান্না ঘর, খড়ের ছাউনি। রান্না ঘরের পাশেই টিউবওয়েল বেড়া দেয়া অর্থাৎ গোসল খানা। উঠানের উত্তর দক্ষিণ দুপাশে বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া। বুঝা যাচ্ছে পর্দানশিন দরিদ্র পরিবার। কিন্তু সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম। তিনটা পোলাপান সামনে এল, চিত্রের মত চোখ জুড়ানো সুন্দর। মুকাদ্দস বলল, আমার ভাগ্নে ভাগ্নি। হাসান বুঝল এরা সুন্দরের গোষ্ঠী। মুকাদ্দস, তার বাপ, তাদের বাড়ির মানুষ ও ভাগ্নে- ভাগ্নি গুলি কেমন অদ্ভুত ধরনের গোলাপি সুন্দর, যেন রাজ হংসের ছানা। মুকাদ্দস স্যারকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। পুরানো একটা খাট, চেয়ার, টেবিল, বেতের একটা বুক শেলফ। খাটের দামি চাদরটা দেখে বুঝা যাচ্ছে মেহমান উপলক্ষে হয় মুকাদ্দসদের বাড়ি থেকে এনেছে অথবা কুলঙ্গি থেকে নামিয়েছে। টিনের বেড়ায় কিছুটা অন্তর অন্তর ওয়াল মেট টানানো। কোন দক্ষ শিল্পির সুনিপন হাত সুচের ডগা দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে চারু শিল্পের এক অপুর্ব নিদর্শন, নয়নাভিরাম দৃশ্য। কোনটা কাবা শরীফের চিত্র, কোনটা আল্লাহু- মুহাম্মদ, কোনটা সাগরে সুর্যোদয়, কোনটা দিগন্ত জোড়া সুবুজ মাঠ ইত্যাদি। কিন্তু পশু-পাখি, জীব-জন্তু বা লাভ- ভালবাসা ইত্যাদির কোন চিত্র নেই। হাসান বুঝল পরিবারটি ধার্মিক, দরিদ্র কিন্তু উন্নত রুচিশীল ও সংস্কৃতিমনা। মুকাদ্দস মুচকি হেসে চিত্রকর্ম দর্শনরত ওস্তাদকে বলল, ‘স্যার শুধু শিল্প দেখবেন শিল্পিকে দেখবেন না। ‘কে অংকন করছে এগুলি’ হাসান জিজ্ঞেস করল। সে বলল, ‘আমার ভাগ্নি কুসুম, এই কুসুম আয় আয় স্যার ডাকছেন।

কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে এসে দরজার সামনে থমকে দাঁড়াল। হাসান তাকাল কিন্তু তার চোখ যেন ধাধিয়ে গেল। মেয়েটি লজ্বা পেয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করল। কিন্তু হাসিটা তার দেহ মনে বিদ্যুতের শক দিয়ে গেল, তার ভিতরটা তোলপাড় করে যাচ্ছে। সে অবচেতন, নির্বাক, নিস্পলক তাকিয়ে থাকল। মুকাদ্দস মনে মনে হাসল, ‘কুসুম আয় চেয়ারে বস। তার কথায় চেতন পেয়ে হাসান লজ্বা পেয়ে বলল, ‘আস আস এখানে বস। হাসান হতবিহ্বল মুগ্ধ, কি বলবে ঠাহর করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করল কি পড়? মেয়েটা উত্তর দিল, ‘আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিক)। মুকাদ্দস যোগ করল, ‘কাছেই একটা আলিয়া মাদরাসা আছে, ওখানে এ বছর আলিম পরীক্ষার্থী। হাসান ভাল করে দেখার জন্য চশমা খুলতে হাত উঠাল কিন্তু ছেলেটি ওস্তাদের হাত স্পর্শ করে চোখে অনুনয় ফুটিয়ে তুলল। হাসান বুঝল, খুলল না।

সে ঘোর কাটিয়ে হালকা হওয়ার জন্য গম্ভীর হল। নিজের ছাত্রদের যেভাবে বকে তেমনি শুরু করল, ‘আলিয়ার ছাত্ররা বাংলা ইংরেজি যাই জানুক আরবী কিছুই জানে না, কারণ ওরা আরবীর রক্ষা কবচ গ্রামার পড়ে না। তুমি কেমন পড়েছ দেখি, বল তো দাখিল কোন সীগা (শব্দরূপ)? - এক বচন, পুং লিঙ্গ, কর্তৃবাচক বিশেষ্য। - অর্থ? – প্রবেশিকা। হাসান হেসে বলল, ‘বাহঃ চমৎকার, তোমার ভাগ্নি তো খুব ভাল মনে হচ্ছে। মামা ভাগ্নি হাসল। - আচ্ছা বলতো ইসমে তাফযীলকে ইংরেজিতে কি বলে? – সুপারলেটিভ ডিগ্রি। - ভাল, আচ্ছা বাংলায় এর আলামত কি? মেয়েটা অপারগতায় হাসল। হাসান বলল, ‘তর’ যেমন, উন্নততর, শ্রেষ্ঠতর, নিকৃষ্টতর ইত্যাদি, কিন্তু এর ব্যবহার ব্যাপক নয়। মুকাদ্দস বলল, ‘স্যার আপনি তো যাকেই সামনে পান শিখাতে শুরু করেন, আমার ভাগ্নিকেও কিছু শিখান, আমি আপনার জন্য পান নিয়ে আসি’ বলে চলে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কি শুধুই কুসুম? মেয়েটা বলল, ‘কুসুম আমার ডাক নাম, আসল নাম আয়েশা। - এটা কোন সিগাহ? – কর্তৃবাচক বিশেষ্য, স্ত্রী লিঙ্গ, একবচন। - অর্থ? – আল- আইশু ওয়াল ইশাতু, জিননা, জীবন যাপন করা, আয়েশা অর্থ স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন কারিণী। এ ক্রিয়ামূল থেকেই আয়েশা, আয়েশ, বদমায়াশ ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

হাসান অবাক হয়ে গেল, এই বিশ্লেষণ তো আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরাও পারবে না। তুমি কোথায় পড়েছ? প্রশংসায় মেয়েটা উৎসাহিত হয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘ফাইভে থাকতে আব্বার কাছে মিজান (গ্রামার) পড়েছিলাম। কিন্তু এই চাহনি ও হাসি তাকে ধরাশায়ি করে ফেলল। তার মনে হচ্ছে এমন সুন্দরী, ফুটন্ত গোলাপ জীবনে আর কখনো দেখেনি। তার জীবনে যে কয়টা অপ্সরী দেখেছে তার মধ্যে এই শ্রেষ্ঠ। নুরানিকে সে সুন্দরী মনে করত কিন্তু এই মেয়ের সামনে সে সূর্যের মুখে মাটির প্রদীপের ন্যায় ম্লান, নিষ্প্রভ। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হল। কোন ব্যাক্তি সারা জীবনের আরাধ্য বস্তু সামনে পেয়ে গেলে যেমন আত্নহারা ও আত্নভোলা হয়ে যায় হাসানেরও তাই হল, সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। খুটিয়ে খুটিয়ে মেয়েটির রূপ দেখছে আর কিছু বলতে হবে বলে আজে বাজে প্রশ্ন করছে। কিন্তু এতই মুগ্ধ হয়ে উঠেছে যে, কী প্রশ্ন করছে নিজেই জানে না।

গ্রীবাচ্ছাদিত বিশাল কেশগুচ্ছ কোমরের নীচে চেয়ারে ছড়িয়ে আছে। চুলের ফাক দিয়ে বেরুনো কান দু’টি যেন কৃঞ্চ পল্লবে ফুটন্ত গোলাপ। নাম কুসুম, গায়ের রংও কুসুম বর্ণ, কাচা হলুদ, লাল পরি। চাঁদের মত গোলাকৃতি মুখাবয়ব, ভরাট কপোল দু’টি রক্তজবা, খাড়া সুচালু নাক, ঠোঁট গোলাপের পাপড়ি, জোড়া ভ্রু- এর নীচে টানাটানা হরিনাক্ষি দুটি জন্ম কাজল মাখা, শুভ্র পটে ভ্রমর কৃঞ্চ রেটিনার মায়াবি চাহনি পুরুষ মাত্রেরই বক্ষ বিদীর্ন করবে। চওড়া সমান্তরাল কাধ। হাসানের দৃষ্টি বিপদসীমা ডিঙ্গিয়ে যায়, প্রশস্ত বক্ষ সুচালু পয়োধর, পুরুষ্ট মাংসল উরু তাকে অসহায় করে তোলে। পাঁচ ফুট দুই বা তিন ইঞ্চি উচ্চতার এই মেয়েটি খোদার এক অপুর্ব সৃষ্টি, জীব জগতের অনন্য নিদর্শন, নারী সৌন্দর্যের উপমা। মেয়েটি চেয়ারে বসে বারবার হাত নাড়াচাড়া করছে আর উরুর উপর হাত রাখছে। দুই রানের ছিপায় কাপড় ঢুকে গিয়ে মাংসল উরুর ভাঁজ ও খাঁজ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সে বসে বসে মেয়েটির রুপের সুধা পান করছে। মেয়েটিকে এভাবে দেখা তার জন্য জায়েয নয়, হারাম- সেই অনুভূতি তার মধ্যে নেই। কারণ এমনিতেই দীর্ঘদিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে তার নাট- বল্টু ঢিলা হয়ে আছে, তার উপর মেয়েটির রুপের ঝলক তার বিবেচনাবোধটুকুও বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সে দেখছে আর অসহায় বোধ করছে। অনেকক্ষণ হল মুকাদ্দস আসে না। সে আজে বাজে প্রশ্ন করে আর মেয়েটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করে, শিহরিত হয়, ফুলকিত হয়। পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে যা দেখলে স্রস্টার কথা মানুষের এমনিতেই স্বরণ হয়, তার মধ্যে কুসুম একটি। এমন মেয়ে একটি অঞ্চল একটি যুগ খুব কমই পয়দা করে।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর মুকাদ্দস নুডুলস, লাচ্চা ও বিভিন্ন জাতের পিঠা নিয়ে এল। হাসান মেয়েটাকে বিদায় দিয়ে বলল, ‘এত কিছু এনেছ খাবে কে? সে বলল, ‘স্যার আপনার জন্য আমাকে অনেক লজ্বা পেতে হয়। আমার মা বারবার জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে তোর স্যার কি আমাদের রান্না পসন্দ করে না, এ দুয়েক চামচ ভাত খায় কেন? আবার তরকারি দেখে বলেন, ‘তোর স্যার মনে হয় ছোট মাছ পসন্দ করে। তখন আমাকে মিথ্যা বলতে হয়, ‘স্যার সব সময় বাসায় শুয়ে বসে থাকেন, খাদ্য চাহিদা কম। যারা শুয়ে বসে থাকে তাদের পেটে চর্বি জমে যায়, বেশি খেতে পারে না। আপনার মান রক্ষার্থে মিথ্যা বলি কিন্তু বোনকে কি বলব? আপনি না খেলে সে মনে করবে গরিব দেখে অহংকার করেছেন, কষ্ট পাবে। আপনার জন্যই সে পিঠাগুলি বানিয়েছে। হাসান বলল, ‘তুমি জানই তো এখন কিছু খেলে রাতের খাওয়াটা মিস যাবে। তারপর এক চামচ সেমাই ও এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়ে বলল, ব্যস। ছেলেটা স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে বাঁচাতে এখন আমাকে খেতে হবে। সে কিছু সেমাই, নুডুলস ও কয়েকটা পিঠা খেল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আমার ভাগ্নি কেমন দেখলেন? প্রশ্নটায় কেমন যেন বে-লজ্বতা আছে বুঝে সে পাশ কেটে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ ভাল তো, সে আরবী গ্রামারের যে সুন্দর উত্তর দিল আলিয়ার ছাত্ররা তা পারার কথা নয়, মনে হয়েছে কওমী মাদরাসার ছাত্রী। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আমার ভাগ্নিকে কি আপনার পসন্দ হয়েছে? হাসান লজ্বিত হল এবং রাগও হল, এ কেমন ছাত্র- যে উস্তাদকে নিজের ভাগ্নি সম্পর্কে এমন অশ্লীল প্রশ্ন করে। সে ধমক দিল, ‘হেয়ালি করো না। তারপর লজ্বাকর প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্য বলল, ‘তুমি এত দেরি করলে কেন? – আপার সাথে আলাপ করলাম। - এত সময় কী আলাপ করলে? – আমার বোন বলল, ‘সে দরিদ্র মানুষ অলংকারাদি দিতে পারবে না, আপনাকেই দিতে হবে’ বলে সে মুচকি হাসল। কিসের যেন একটা শুভ ইঙ্গিত তার দেহ মনে বিদ্যুৎ খেলে গেল, সে শিহরিত, ফুলকিত। কিন্তু অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘বেয়াদবি করো না, হেয়ালি ছাড়। - হেয়ালী না স্যার হেয়ালি না, সত্যই বলছি। এতকিছু ঘটে যাচ্ছে আর আপনি এখনো কিছুই বুঝেন নি? হাসানের মুখ উজ্বল হয়ে উঠে, ‘কী বুঝব আমি?

ততক্ষণে তারা একটা মসজিদের পাশে চলে এসেছে। মাগরিব পড়ে হাটতে হাটতে একটা পোলের কাছে গিয়ে পৌঁছল, সিন্দুক পোল, নিচু পোস্তা। ছেলেটা পকেট থেকে রুমাল বের করে পুস্তাটা ঝেড়ে রুমাল বিছিয়ে উস্তাদকে বসতে বলল এবং সে পাশে বসল। তারপর বলল, ‘আপনাকে সব বলছি স্যার। আমার দুলাভাই কুসুমদের মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক ছিল। সে যে মাদরাসায় কামিল করেছিল- সেখানে এক জন জ্ঞানী- ইলিমদার ভাল মুহাদ্দিস ছিলেন। উস্তাদের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। ছাত্রদেরকে সে উদ্বুদ্ধ করত, ‘তোরা ভালভাবে লেখাপড়া করে মুহাদ্দিস হবি। আমিও তার ছাত্র, আমাকে প্রায়শই বলত, ‘দেখ চাকরি করলে মুহাদ্দেসি চাকরি করবি। কারণ মুহাদ্দিসরা ইহকালেও সম্মানী পরকালেও সম্মানী। কুসুম ছোট বেলা থেকেই ছিল চাঁদের মত ফুটফুটে সুন্দর এবং মেধাবী। সে সকলের সাথে বলে বেড়াত, তার মেয়েকে মুহাদ্দিস জামাই দেখে বিয়ে দিবে কিন্তু বেচারার দুর্ভাগ্য বছর চারেক আগে সে মারা যায়।

‘কেন, কি হয়েছিল’ হাসান প্রশ্ন করল। ছেলেটা উত্তর দিল, ‘সে এক ইতিহাস। দুলাভাইয়ের মাছ মারার খুব নেশা ছিল। সে সাধারণত জাল পেতে মাছ মারত। বিকালে ধান ক্ষেতে জাল পেতে আসত সেটাকে আমরা কৈ জাল বলি। কৈ, শিং, মাগুর, টাকি ও অন্যান্য মাছ আটকে থাকত। শেষ রাত্রে গিয়ে তুলে নিয়ে আসত। সকাল পর্যন্ত থাকলে চোরেরা মাছ নিয়ে যেত এমনকি জালও নিয়ে যেত, তাই শেষ রাত্রে যেত জাল তুলে এসে ফজরের নামায পড়ত। অভ্যাস অনুযায়ী সেদিনও জাল তুলতে গেল। তার সাথে কোন বাতি ছিলনা, রাতের আবছা আলোয় দেখতে পেল বিশাল বড় একটা বাইন মাছ আটকা পরেছে। সে খুব খুশি হল। জাল পেছিয়ে মাছটাকে ভালভাবে আটকালো। বাইন মাছের নাভিতে কাটা থাকে, ধরতে গেলে কাটা মারে, মাছটা কাটা মেরে মেরে তার হাত ঝাঁঝরা করে ফেলল। বহু কষ্টে অনেক আশা নিয়ে সে মাছটা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছেই আমার বোনকে ডাকল, ‘কুসুমের মা তাড়াতাড়ি আস, দেখে যাও কত বড় বাইন মাছ ধরেছি।

আমার বোন বাতি জ্বালিয়ে এসে দেখেই আর্তনাদ করে উঠল, ‘হায় আল্লাহ্‌, এটা তো সাপ। আসলে এটা ছিল একটা গোখরা সাপ, বাইন মনে করে সে ধরে নিয়ে এসেছে। হতভাগা বেচারা সাপটার দিকে কিছুক্ষণ নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকল, তারপর ‘কুসুমের মা আমি শেষ’ বলে মাটিতে ঢলে পড়ল। আর সোজা হল না। দু’দিন পর্যন্ত কত চেষ্টা করা হল। দেশ-বিদেশের কত ওঝা বৈদ্য আনা হল, হাসপাতালে নেয়া হল কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আসলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সে মারা গিয়েছিল। হাসান আফসোস করল, ট্রাজেডি, ট্রাজেডি, ভয়ঙ্কর ট্রাজেডি। আল্লাহ্‌ তাকে শহীদি দরজা নসিব করুক। কয়টা পোলাপান, তারা চলেই বা কেমনে? সে বলল, ‘পোলাপান চারটা, দুই ছেলে দুই মেয়ে, কুসুমই বড়। জমি যেটুকু আছে বর্গা দিয়েও খোরাক চলে যায়। তারপর আমরা কিছু হেল্প করি, আমার বোনও হাস, মুরগী, ছাগল রাখে, তাতে ভালই চলে যায়, কষ্ট করতে হয় না। সব কিছুই আছে কোন সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা হল কুসুম। হাসান বলল, ‘এত ভাল মেয়ে তার আবার কি সমস্যা? সে বলল, ‘সমস্যা হল কুসুমের দাখিল পরীক্ষার আগে থেকেই অসংখ্য প্রস্তাব আসতে থাকে, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ধনী, বড়লোক বিভিন্ন ক্যাটাগরির পাত্র আসতে থাকে। কেউ কেউ জোর খাটায়।

আমাদের এলাকার মোড়লের ছেলে, ঐ যে বাজারে স্কুলটা দেখলেন সেই স্কুলের শিক্ষক- সে কুসুমকে অন্যত্র বিয়ে দিতে দিবে না, তার কাছেই দিতে হবে, আমরা যা চাই তাই দিবে। হুমকি দিচ্ছে বিয়ে না দিলে মেয়ে তুলে নিয়ে যাবে। আর ওরাই এলাকায় প্রতাপশালী লোক। কিন্তু আমার বোনের এক কথা, কুসুমের বাপের আশা ছিল মুহাদ্দিস দেখে বিয়ে দিবে। কাজেই সে মৃত স্বামীর আশা পুরন করবে, মুহাদ্দিস ছাড়া বিয়ে দিবে না। সবাই আমার বোনকে বোঝায়, গো ধরে বিয়ের কাজ চলে না, মুহাদ্দিস পাবে কোথায়? একটা জেলায় কামিল মাদরাসা থাকে দুয়েকটা, মুহাদ্দিসও থাকে দুয়েক জন। আর মুহাদ্দিসরা সাধারণত বিবাহিত হয়। কিন্তু আমার বোন নাছোড় বান্দা, সে মুহাদ্দিস ছাড়া বিয়ে দিবে না। এই হল কুসুমের সমস্যা।

কী এক শুভ ইঙ্গিতে হাসানের মুখ উজ্বল হয়ে উঠে, তৃষিত চোখ দু’টিতে আশার আলো ফুটে উঠে। সে বলল, ‘জটিল সমস্যা, এই সমস্যার সমাধান করবে কেমনে? মুকাদ্দস হাসল, ‘সমাধান তো স্যার হয়ে গেছে। আপনি হয়তো ভাবছেন, ম্যাডাম সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, আসলে আমি সবই জানি। ওমর আলীর সাথে আপনার শ্বশুর এলাকায় গিয়েছি, খুটে খুটে সব জেনে এসেছি, আপনার দু’জন ভায়রার সাথে আলাপ করেছি, মাদরাসায় ছাত্র শিক্ষকদের আলাপ শুনেছি। আরো বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে বুঝতে পেরেছি আসলে ম্যাডাম একজন বদ্ধ উন্মাদ মহিলা। তাকে দিয়ে আপনারও সংসার চলবে না, তারাও আর দিবে না। এই সব কিছু বাড়িতে আলাপ করে আমার বাপ ও বোনকে উদ্বুদ্ধ করলাম এবং বললাম স্যারের কোন দোষ নাই, ঐ মহিলাটা মূলত পাগল। এরপর থেকে আমাদের পরিবারের সবাই আপনার জন্য এক পায়ে খাড়া। আর আমরা জানি মেয়ে দেখলে আপনার পসন্দ হবেই। এজন্যই আমার বোন বলেছে, সে দরিদ্র, অলংকারাদি দিতে পারবে না, আপনাকেই চিন্তা করতে হবে। তাছাড়া আমার ভাগ্নি যে শুধু সুন্দরী, মেধাবী, হস্তকর্মে নিপুন শিল্পি তাই নয় আমার ভাগ্নি বলে নয় প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বলছি এমন শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র মেয়ে অন্তত আমি আর দেখিনি। কাজেই আমার দুলাভাই যেমন তার উস্তাদকে দেখে মুহাদ্দিসের কাছে বিয়ে দেয়ার আকাংখা করত, তেমনি আমিও আমার উস্তাদ- মুহাদ্দিসকে ভাগ্নির জন্য মনোনিত করলাম, ভুল করলাম কি স্যার? সে হাসল, তারপর লজ্বিত ও নির্মিলিত চোখে উস্তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার মেয়ে কি আপনার পসন্দ হয়েছে?

মরু সাহারায় দীর্ঘ পথের অভিযাত্রি দিনের পর দিন তৃষ্ণায় ধোকে ধোকে যখন মৃত্যুর সীমানায় পৌঁছে যায় তখন সহসা চোখের সামনে সুমিষ্ট পানির ঝর্ণা দেখলে তার যে অবস্থা হয় হাসানেরও সেই অবস্থা। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে, বুক ঠকঠক করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে, কল্পনাতিত, আশাতিত কোন কিছু পাওয়ার আশংকায় সে জড়বৎ বিকল হয়ে গেছে। কাপা কণ্ঠে শুধু বলতে পারল, ‘কোন একটা এলাকায় এমন মেয়ে খুব বেশি দেখা যায় না। তারপর তারা উঠে হাটতে শুরু করল।- আচ্ছা তোমার ভাগ্নি কি বিষয়টা জানে? ছেলেটা বলল, ‘জানবে না কেন, এতদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে অবশ্যি জানে। হাসানের পা মাটি ছুয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার মনে হচ্ছে উচ্ছাসের পাখায় ভর করে সে উড়ছে, উড়ছে, স্বপ্নময় ভুবনে উড়ে যাচ্ছে। পৌঁছে গেছে এক স্বপ্নিল জগতে। সেখানে দিকচক্রবাল ব্যাপি উদ্যান, যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, যেখানে বলাকারা উড়ে বেড়ায়, হংস- মিঠুন ডানা ঝাপটায়, যার দিগন্তে সুর্য অস্ত যায়। যেখানে আছে পাখির কূজন, কুহু ও কেকার কলতান, আছে সঙ্গিত, সঙ্গিতের মাদকতা, আছে সুর, সুরের মুর্ছনা, তার হৃদয়তন্ত্রির সবগুলি তার একসাথে ঝংকার দিয়ে উঠে। পরদিন সকালে গিয়ে তারা মাদরাসা ধরল।

কী অপূর্ব, গরিবের ঘরে সাত রাজার ধন, ধরার মাটিতে স্বর্গের অপ্সরী। হরিণের চোখের ন্যায় টানা টানা দু’টি ডাগরাক্ষি, জোড়া ভ্রু, গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ওষ্ঠাধর, রক্ত জবার ন্যায় দুটি গন্ড, উন্নত ললাট, সঢৌল নাসিকা, দুধে আলতা মিশানো গায়ের রং, কোন মেয়েলোক কি এত সুন্দরী হতে পারে। আগে মনে হত নুরানিই বুঝি শ্রেষ্ঠ সুন্দরী কিন্তু এ মেয়ের সাথে তো নুরানির কোন তুলনাই চলে না। এর রুপ যেন জ্যোতি ছড়ায়, সে জ্যোতিতে পৃথিবীর যে কোন পুরুষ পতঙ্গের ন্যায় আত্মাহুতি দিতে মুখিয়ে থাকে। জীবনে সুন্দরী মেয়ে তো আর কম চোখে পরেনি কিন্তু কোন জিনিসটা এ মেয়েটিকে অনন্য করে তোলেছে, সে হয়ে উঠেছে পার্থিবতার উর্ধ্বে মহাজাগতিক স্বপ্নময় স্বর্গীয়। হ্যাঁ, সেই বৈশিষ্টটি হল তার দৈহিক পরিমাপ। কোন মহান শিল্পি তার নিপুন হাতে পরিমিত পরিমাপে এ দেহটি গড়ে তুলেছেন। আল্লাহ্‌ তা’লা বলেছেন মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন ফি আহসানি তাক্ববীম- সর্বোত্তম অবয়বে। কিন্তু এ মেয়েটিকে তিনি স্বহস্তে সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন তিনি তার নাক মুখ চোখ কান হাত পা বুক কাধ আগা পাছা, প্রতিটি অঙ্গের পরিমিত পরিমাণ পরিমাপ দিয়ে- যা তাকে করে তুলেছে নারীদের মধ্যে সুন্দরী, সুন্দরীদের মধ্যে অপ্সরী, পরীদের মধ্যে হুর, হুরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেই সেরা, সে শতাব্দীর মুকুট। একটি যুগ, একটি অঞ্চল এমন মেয়ে খুব বেশি জন্মায় না।

হাসান বিছানায় শুয়ে শুয়ে কপালে হাত রেখে আশার আলো চকচকিয়ে উঠা দু’টি চোখে স্বপ্ন দেখে আর ভাবে, কুসুমও কি আমার মত স্বপ্ন দেখছে, নিশ্চয়ই দেখছে। নিভৃত পল্লির ঝুপড়িতে শুয়ে শুয়ে তার ভ্রমর কালো দু’টি চোখে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। মেহেদী রাঙ্গা হাত, ফুল- চন্দন মেখে লাল শাড়ি পরে সে বধু সেজে বসে থাকবে। আমি যাব গহনাপত্র, রেশমি শাড়ি, ঢাকাই চুড়ি আরো কত উপহার সামগ্রী নিয়ে। মেহেদী রাঙ্গা হাতে আমার হাত ধরে সে আসবে, আসবে তার বাসর শয্যায়, কাটবে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ মধুময় রাত। আমার বুকে মাথা রেখে সে ঘুমাবে। আমার ভাত রান্না করবে, আমার কাপড় ধোবে, ঘর সংসার সামাল দিবে, বাইরে থেকে দেরি করে এলে আমার বুকে মাথা রেখে গুমরাহ মুখে বলবে, ‘একা একা আমার ভাল লাগে না। একদিন সে হবে আমার সন্তানের মা। এভাবে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তাটি মালা হয়ে আমার গলায় ঝুলে পরবে, আর ঝুলে পরবে চিরদিনের জন্য।

হাসান শিহরিত হয়, ফুলকিত হয়, উচ্ছ্বসিত আবেগে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে হাসে। হায়, আমার মত রাস্তার কুকুরকেও বুঝি কোন চোখ স্বপ্ন দেখে। আমি তো জানতাম বাবার মৃত্যুর পর দিন থেকে আমি কুকুর হয়ে গেছি। রাস্তার কুকুর, বেওয়ারিশ কুকুর- যার দ্বারা মানুষ শুধু উপকৃত হয় কিন্তু তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সারা জীবন মানুষের উপকার করেছি কিন্তু মানুষ আমার অপকার করেছে। যে ভাইদেরকে নিজের জীবন বিপন্ন করে লালন পালন করলাম তারা আমার কথা মানে না, যে স্ত্রীর জন্য এত কিছু করলাম সে আমাকে ফেলে চলে গেল। কাজেই আমি হলাম কুকুর, পৃথিবীর সবচেয়ে কমবখত। কিন্তু না, আসলে আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান, আমি যুগপুরুষ। কারণ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রত্নটি আমাকে চায়, শুধুই আমাকে চায়। কাজেই আমিই শ্রেষ্ঠ, আমি মহাভাগ্যবান। সেই সৃষ্টির আদি থেকে আমি তো এমন একজনকেই খুঁজছি। পৃথিবীর পথে পথে খুঁজে মরছি। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে, খুঁজেছি তাকে বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে। অথচ সে এক নিভৃত পল্লির ঝুপড়িতে বসে আমার পথ পানে তাকিয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে। কাজেই এটা হবে, হওয়া দরকার, বিয়েটা আবিশ্যম্ভাবী।

এতে দুপক্ষেরই উপকার। আমার প্রাপ্তি হল আজীবন আমি তো তপস্যা করেছি এমন একজনের জন্য- যে হবে রাজকুমারীর মত নির্মল সুন্দর-সে নির্মল সুন্দরী। যে হবে অতুল মেধাবী- কুসুম মেধাবী, কারণ সে যে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছে এমনটা অন্য ছাত্রদের বেলায় দেখা যায় না। সে হবে সর্বগুণে ও সর্বকাজে পারদর্শী, আর কুসুম হরফন্ন মোল্লা। কারণ তার দরিদ্র ঘরটিতে সুশৃঙ্খল, সুসজ্জিত, চারু, কারু, চিত্র ও সুচি শিল্পই প্রমাণ করে তার নিপুন হাতের শৈল্পিক কর্মক্ষমতা। কাজেই সে হবে আমার। আমার মরুময় জীবনে তার আগমন হবে অবিরাম খরায় হলদে হয়ে উঠা মরুদ্যানে প্রবল বারি বর্ষণের ন্যায়। আবার তাদের জন্যও হবে কল্যাণকর। তাদের দরিদ্র পরিবারটিকে আমি সাহায্য করতে পারব। না না, সাহায্য করার দরকার নাই। ওর ছোট একটি বোন ও দু’টি ভাই আছে, ওদের লেখা পড়ার দায়িত্ব আমি নিব, ওদেরকে শিক্ষিত করে তুলব। এটা তাদের জন্য বিরাট উপকার হবে। আর একটি ইয়াতিম পরিবারকে সহায়তার বিনিময়ে আমি পাব পরকালে উত্তম পুরুস্কার। কাজেই এই বিয়েটা হতে হবে, হওয়াটা আবশ্যক, এতে দুপক্ষেরই কল্যাণ। হাসান উচ্ছসিত, আনন্দিত, তার ভিতরের সকল ক্লান্তি, অবসাদ ও গ্লানি কেটে গেছে।

রাতে সে খেতে বসল হোটেল থেকে আনা কৈ মাছের তরকারি দিয়ে। থালা বাসন ধোয়া, ভাত বাড়া ইত্যাদি কাজ করতে গিয়ে তার ক্ষীনকায় শরীরটা হাফিয়ে উঠল। সে হাসল, দুঃখের নিশি বুঝি হল অবসান। আর তাকে কষ্ট করতে হবে না। কুসুম রান্না বান্না করে তাকে ডাকতে থাকবে, এই আসেন, তাড়াতাড়ি আসেন, ভাত তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে, কিন্তু সে লিখায় বা পড়ায় ব্যস্ত থাকবে। তখন তার হাত ধরে টেনে এনে খেতে বসাবে। সে পাত থেকে কৈ মাছ ভাজি ও ভাল ভাল গোশতগুলি তোলে স্ত্রীর পাতে দিয়ে বলবে, ‘খাও, মেয়েদের বেশি খেতে হয়। তখন তার আখি পল্লবে বিরক্তি ফুটে উঠবে কিন্তু হাসবে, উঃ, কৈ মাছের শিড় দাড়ার কাটাগুলি খুব বিচ্ছিরি। কুসুম কাটা বেছে বেছে স্বামীর পাতে দিবে। সে বলবে, ‘আরে আমাকে কেন, তুমি খাও’ বলে স্ত্রীর পাতে আবার দিয়ে দিবে। স্ত্রী রাগ দেখাবে, ‘আপনি না খেলে আমি খাব না। তারপর অর্ধেক গোশতের টুকরায় কামড় দিয়ে বাকী অর্ধেক স্বামীকে দিবে। স্বামী কোন কিছু অর্ধেক খেয়ে স্ত্রীকে দিবে। স্বামী গ্লাসের অর্ধেক পানি খেলে তারপর স্ত্রী খাবে। সবশেষে কুসুম স্বামীর প্লেট ধুয়ে দুধ দিয়ে তারপর নিজে নিবে। সব কিছুই স্বামীর সাথে সমান ভাগ করে খাবে, ফেরদৌসির মত দুধ ও ভাল তরকারি একা খাবে না।

এভাবে মধুময় কল্পনা করতে করতে হাসান খাওয়া শেষ করে। কিন্তু অবাক হয় ভাত তরকারির দিকে তাকিয়ে। কারণ দুটোই শেষ, এটা কি করে সম্ভব হল। বাড়িতে গিয়ে মায়ের সামনে ভাল ভাল তরকারি দিয়েও তো সে এতগুলি ভাত খেতে পারে না। সে অবাক হয়ে ভাবে, বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ মুসলিম শরীফের লেখকের কথা। ইমাম মুসলিম রাতে অধ্যায়নে বসলেন, পাশেই এক ঝুড়ি খেজুর রাখা। তিনি পড়ছেন আর হাত বাড়িয়ে খেজুর এনে এনে মুখে পুরছেন। পড়া ও খাওয়া একসাথে চলতে থাকল। তখন তার ধ্যান ভঙ্গ হল যখন ঝুড়ি থেকে শুন্য হাতটি ফেরত এল। তিনি ঝুড়ির দিকে তাকালেন এবং চমকে উঠলেন, সেখানে একটাও খেজুর নাই। তিনি ভয় পেলেন, পেটের অসুখ হল, তারপর ইন্তেকাল করলেন (রহঃ)। হাসান ভাবে, কুসুমের ধ্যান করে বাঘা একটা খাওয়া হল। সে জীর্ণ শীর্ণ দেহে বৃদ্ধদের ন্যায় কুচকে যাওয়া চামড়া ধরে টান দেয়, রাবারের মত দুই ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা হয়ে যায়। নারে বাপু না, আর চিন্তা নাই, তুই হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে যাবি, ভরাট হয়ে যাবি। আসছে তোর ঔষধ, আসছে তোর কুসুম। সে উচ্ছসিত, আনন্দিত।

রাত বারটার পর নিয়মানুযায়ী তাহাজ্জুদ পরল, তাসবিহ টিপে টিপে দোয়ায়ে ইউনুস পড়ল। কিন্তু নিয়মানুযায়ী আজ সে দোয়া করল না, স্ত্রীর কথা মনেও পরল না, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরল। না, সে একা নয়, সামনে তার স্ত্রী কুসুম। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসে, এই হাসিটা দুষ্টুমির। চোখের ভাষায় কথা বলে, সেখানে ঝরে পরছে সীমাহীন আহ্বান। শুয়ে আছে লাল পরী অথবা বেহেস্তি হুর। তার মনের ময়ূর পাখনা মেলে, ধীরে ধীরে কাছে ঘেঁষে, গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়, রক্ত জবার মত কপোলে অধরোস্ট চেপে ধরে, বুকের উপর খাড়া ফলা দু’টি তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দেয়। সে জড়িয়ে ধরে, আপ্লুত হয়, ভাবাকুল হয়, হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় এক স্বপ্নময় ভুবনে, যেখানে আছে শুধু ঘুম আর ঘুম, ঘুম আর ঘুম। সে ঘুমায়। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে পরদিন সকাল আটটায়। ঘুম থেকে উঠে সে নীরব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর উঠে আনন্দে উল্লসিত হয়ে পায়চারি করতে লাগল। জীবন সম্পর্কে সে আশাবাদি হয়ে উঠেছে। সে বাঁচবে এবং ভাল করেই বাঁচবে। তার হীনমন্যতার ভাবটা কেটে গেছে। মনের শক্তি বেড়ে গেছে। প্রফুল্ল মনের প্রভাব পড়েছে শরীরে। শরীরটা একটু হৃষ্ট পুষ্ট দেখা যাচ্ছে।

এখন সে বিকালে চশমাটা চোখে দিয়ে বাইরে বের হয়, ঘোরাফিরা করে, এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরে। এভাবে কয়েকটা দিন আনন্দে কেটে গেল।

জুলাই, ২০০৬ সাল। দুপুরে খাওয়ার পর হাসান বিছানায় শুয়ে শুয়ে কুসুম ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভাবছে। এ কয়দিনে তার রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবিষ্ট কুসুমের রুপের ঝলক অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তার হৃদয়তলে সিঞ্চিত কুসুমের প্রেমরস অনেকটা শুকিয়ে এসেছে। কুসুমের ডাগরাক্ষি আর বাকানো ঠোঁটের মুক্তা ঝরানো হাসির দুর্বার আকর্ষণ কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। এখন সে স্বাভাবিক, প্রকৃতিস্ত। এখন সে নিরপেক্ষ চিন্তা করার শক্তি ফিরে পেয়েছে। কুসুম ও স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে এই প্রথম সে অনুভব করল, সে একক সত্ত্বা নয়- দুই ভাগ হয়ে গেছে। মন ও বিবেক। তার মন পাগলা ঘোড়ার মত দুর্বার দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে কুসুমের দিকে। আর বিবেক উপহাসের অট্টহাসি হাসছে- রে প্রমত্ত মন মম, জীবনে ভোগ বিলাস, কামনা বাসনাই মুখ্য নয়, এখানে বিবেক, ইনসাফ, মানবতা আর মনুষ্যত্বই প্রধান। তোমার স্ত্রী সন্তান আছে, রে বেহায়া ভোগের কুকুর। তুমি কি মনে করেছ কুসুমকে নিয়ে ভোগের দরিয়ায় মওজ করবে আর ওরা শোকের দরিয়ায় হাবুডুবু খাবে? তুমি দুই নৌকায় পা দিতে পার না, কুসুমকে আনলে স্ত্রী সন্তান হারাবে আর স্ত্রীকে আনলে কুসুমকে পাবে না। আর স্ত্রীকে বাদ দিয়ে যদি তুমি কুসুমকে নিয়ে মওজ কর, তাহলে এটা হবে নিকৃষ্টতম গাদ্দারি এবং মানবতাহীন এক জঘন্য দৃষ্টান্ত। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও।

সিদ্ধান্ত? হ্যাঁ সিদ্ধান্ত। কুসুমকে নিয়ে সে যে স্বপ্ন সৌধ গড়েছিল তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। কুসুমের জন্য মনের মন্দিরে যে শীষ মহল গড়ে তুলেছিল- মরু ঝড়ে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। সে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, সে স্থবির, তার মন ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে, দেহের জোড়াগুলি খসে গেছে, ক্ষীণ- দুর্বল দেহটা অসার হয়ে বিছানায় পরে আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে দেহের ভারে খাট বুঝি ভেঙ্গে পরবে। কুসুম ছাড়া সে অচল। জীবন ব্যর্থ, বেছে থাকা অর্থহীন। সারাটা বিকাল, সন্ধ্যা এবং রাত বারটা পর্যন্ত বিছানায় পরে থাকল, উঠলও না, বাইরেও গেল না। কোন রকম নামাযটা পড়ে শুয়ে থাকল। কুসুম ছাড়া সে চলতে পারবে না। শেষ রাতে ঘুমুতে গেল পারল না। সকালে ঘুমাতে চাইল কিন্তু কুসুমের ব্যর্থ প্রেম শুধু গুমরে গুমরে কেঁদে উঠে, সে বিছানায় গড়াগড়ি যায়, ঘুম হয় না। দুই বিবাদীর মীমাংসার জন্য তৃতীয় পক্ষ প্রয়োজন হয়।

এগিয়ে এল তৃতীয় পক্ষ। মন ও বিবেকের যৌথ সত্ত্বা এগিয়ে এসে ঘোষণা দিল, স্ত্রী আসবে না কুসুম আসবে- এখন সেটা ফয়সালার সময় নয়, এখন আমার বেঁচে থাকা বড় প্রশ্ন। বেঁচে থাকতে হলে আমাকে খেতে হবে, ঘুমাতে হবে। আর তজ্জন্য কুসুমই একমাত্র আমার ধ্যান ধারণা, জল্পনা- কল্পনা ও সাধনা। সুতরাং মন অনুমতি পেয়ে যায়, উৎসাহ পেয়ে যায়, লিপ্ত হয় আত্ন প্রবঞ্চনায়। তখন সে কল্পলোকের রঙ্গিন ভুবনে কুসুমকে নিয়ে উদ্দাম খেলায় মেতে উঠে। তার আগে পিছে ডানে বামে কুসুম। শুন্যে, মহাশুন্যে, চাদে, নক্ষত্রের দীপালিতে শুধু কুসুম, কুসুমের অবয়ব, লক্ষ কোটি কুসুম। ছায়ার মত সে কুসুমের সাথে লেগে থাকে। কুসুম গোসলে যায়, সে মেজে ঘষে ডলে- মলে গোসল করিয়ে দেয়, কাপড় পরিয়ে দেয়। কুসুম খায় না, সে খাইয়ে দেয়। কুসুম তফাতে ঘুমায় না, ঘুমায় তার বাহু বন্ধনে, তার বুকে মাথা রেখে। সে আবার কুসুমের প্রেম সাগরে ডুব দেয়। আবার সে স্বাভাবিক হয়ে উঠে, প্রকৃতিস্ত হয়, খাওয়া ঘুম নিয়মের মধ্যে চলে আসে। প্রতিদিন বিকালে বাইরে যায়, ঘোরাফিরা করে, মাঝে মধ্যে বন্ধুদের আড্ডায়ও যায়।

কিন্তু বিবেক হাসে অট্টহাসি হাসে, পাগল মন মনরে, আমি চাই আমার মনকে বুঝাইতে, কিন্তু মন আমার চায় শুধু কুসুমের ঘোড়া দৌড়াইতে। লাভ নেই মন আমার, লাভ নেই, তোমার স্ত্রী- সন্তান আছে।

বিষয়: সাহিত্য

১৭৭৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

379381
০২ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:১২
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।


হৃদয়স্পর্শী অন্নেক সুন্দর একটি লিখা মাশাআল্লাহ।


জাজাকাল্লাহু খাইর।
379389
০২ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৩৫
স্বপন২ লিখেছেন : ভালো লাগলো / ধন্যবাদ
379405
০৩ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ১১:২৬
আবু নাইম লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।

হৃদয়স্পর্শী অন্নেক সুন্দর একটি লিখা মাশাআল্লাহ।

জাজাকাল্লাহু খাইর।
379408
০৩ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০১:১১
আবু আশফাক লিখেছেন : সুন্দর! সাহিত্যিক বর্ণনা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File