প্রতিটি শিক্ষাবর্ষেই বৈধ উপাচার্য ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে গড়ে ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। চলতি শিক্ষাবর্ষেও একই সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ উপাচার্য নেই বলে জানিয়েছে উচ্চশিক্ষা তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে গত ৩ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউজিসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দেওয়া একাডেমিক সনদের স্বাক্ষরকারী হবেন রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য কর্তৃক নিয়োগকৃত বৈধ উপাচার্য ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
বর্তমানে দেশে ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হলেও বৈধ উপাচার্য আছে মাত্র ৭৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। অর্থাৎ বাকি ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় বৈধ উপাচার্য ছাড়াই শিক্ষার্থীদের সনদ দিচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বৈধ উপাচার্য ছাড়া সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সতর্ক করা হয়েছে। সতর্কবার্তায় বলা হয়, অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস ও প্রগ্রাম এবং আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি ভর্তি হয়ে প্রতারিত হলে এবং পরবর্তী সময়ে আইনগত সমস্যা সৃষ্টি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত বা শিক্ষার্থীদের সনদ বাতিল হলে তার দায়িত্ব ইউজিসির ওপর বর্তাবে না।
জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকেই উপাচার্য ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে গড়ে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে সক্রিয় ১০৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৬টিতে বৈধ উপাচার্য ছিল না। ২০২১ সালে ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈধ উপাচার্য ছিল না ৩০টিতে। ২০২০ শিক্ষা বর্ষে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতে বৈধ উপাচার্য ছিল না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, অনিয়মের কারণে দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কঠোর অবস্থানে যেতে পারেনি ইউজিসি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকেই নিয়ম লঙ্ঘন করছে। এর মধ্যে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি শুরু থেকেই বেআইনিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই দীর্ঘদিন ধরে আইন না মেনে পরিচালনা করা হলেও দারুল ইহসান ছাড়া কোনোটি বন্ধ করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ইউজিসি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৈধ উপাচার্য নিয়োগে গড়িমসিসহ আইন ভাঙার প্রবণতা রয়েছে।
এতে শিক্ষার্থীদের সনদের বৈধতার সমস্যা ছাড়াও মানসম্মত পাঠদান ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ইউজিসির প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অডিট করে না, আয়-ব্যয়ের হিসাবও দিচ্ছে না।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে। মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন আমরা তাই করব। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সূচনা থেকেই উপাচার্য ছাড়া সার্টিফিকেট প্রদানসহ কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এখন থেকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার আগে বিধি-বিধান মানার বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে নিশ্চিত করা হবে।’
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, যে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে সতর্কতা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে বৈধ উপাচার্য না থাকার পাশাপাশি কোনো কোনো শিক্ষায়তনে অননুমোদিত ক্যাম্পাস পরিচালনা, অনুমোদনহীন প্রগ্রাম থাকা এবং আসন সংখ্যার বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার মতো বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান।
তথ্য মতে, উপাচার্য পদের পাশাপাশি উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ ফাঁকা রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি এবং দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা। ইউজিসি বারবার চিঠি দেওয়ার পরও অনুমোদনহীন ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় আইন অনুযায়ী তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বৈধ নয়। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত সনদেরও আইনগত বৈধতা নেই।
ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছর জানুয়ারি থেকে সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকায় বৈধ উপাচার্য নেই। কার্যক্রমে সাময়িক অনুমতির মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনোনীত অডিট ফার্ম থেকে নিরীক্ষা করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) গঠন সংক্রান্ত জটিলতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মামলা চলমান রয়েছে।
ইউজিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, বৈধ উপাচার্য না থাকায় বাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চিটাগাং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, দি পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, গণবিশ্ববিদ্যালয়, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বরিশাল, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন