বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সুশাসনের অভাব, শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের অনেকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজনীতির নামে অস্থিরতা, যৌন হয়রানি, শিক্ষক আন্দোলন এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের কলেজগুলোতে সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে দেশের উচ্চশিক্ষা। এর মধ্যে বড় একটি কারণ যোগ হয়েছে চাকরির অনিশ্চয়তা। ফলে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ বেশি। দেশে আয়োজিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভর্তি মেলাগুলোতে’ শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি এবং তাদের প্রতিক্রিয়ায় এই আস্থাহীনতার চিত্র দেখা গেছে। এই বিদেশমুখী প্রবণতায় দেশ থেকে চলে যাচ্ছে বিপুল অর্থ ও মেধা।
এই পরিস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করাসহ দেশের কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষার ফারাক কমিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্থা অর্জন করতে হবে। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে। তাদের উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে জাতীয় উন্নয়নে মেধা কাজে লাগতে হবে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্য হচ্ছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় রেখেছেন যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালেশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশগুলোকে। এসব দেশে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশ যাওয়া মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬, কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪ এবং জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কথা : যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষায় যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী শবনব মুসতারি চৈতি জানান, দেশের অনেক ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরও বিদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য গেলে এসব সার্টিফিকেট তারা সাদরে গ্রহণ করে না। তার এক ভাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, দেশে এলএলবি সম্পন্ন করার পরও লন্ডনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের তাকে ফাউন্ডেশন কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। তা হলে এখানে লেখাপড়ার চেয়ে ওই দেশে লেখাপড়া করা ভালো।
বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ তৈয়মুর বলেন, বাংলাদেশে লেখাপড়া করেও বেকার থাকতে হয়। এখানে চাকরির নিশ্চয়তা নেই। তার বন্ধু মারজান জানায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে বড়ভাইদের সঙ্গে রাজনীতির সভা-সমাবেশ করতে হয়। এগুলো পছন্দ না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয় এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাখী আনসারী বলেন, সরকারিতে খরচ কম, রাজনীতি বেশি। আর বেসরকারিতে কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা পয়সা নিলেও লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিদেশে পড়ালেখার জন্য খোঁজখবর নিতে একটি এজেন্সির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আরেক জন অভিভাবক খন্দকার শাহজাহানের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতি চর্চাকেন্দ্র। এখানে সন্তানদের ভালো লেখাপড়া তো দূরের কথা, জীবনের নিরাপত্তা নেই। তুচ্ছ ঘটনায় ক্যাম্পাস বন্ধ। বিদেশে এসব নেই, লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরির সুযোগ পেলে আরও ভালো।
শিক্ষামেলা নয়, বিদেশে ভর্তি মেলা : বছরজুড়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক নানা কারণে দেশীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একের পর আন্দোলন সংগ্রম চলে। অন্যদিকে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিদেশি বিশ^বিদ্যালয়গুলো শিক্ষা মেলার নাম করে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় দুই-তিন দিনের ভর্তি মেলার আয়োজন করে থাকে।
গত ২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে দুই দিনের দেশের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক শিক্ষা মেলা। এই মেলা আয়োজন করেন উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কনসালটেন্সি ফার্মগুলোর সংগঠন- ফরেন অ্যাডমিশন কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন। মেলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোসহ মোট ৪০টি দেশের তিন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সুযোগ ছিল অন স্পট অ্যাসেসমেন্ট, ফ্রি অ্যাপ্লিকেশন, স্কলারশিপসহ ভর্তির সুযোগ। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ছাড়, কোনটিতে স্কলারশিপের সুযোগ, আবার খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ ইত্যাদি নানা সুযোগ সুবিধার ঘোষণা দেয় মেলায় ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভিড় ছিল উপচেপড়ার মতো।
অনিয়ম অস্থিরতা : দেশের উচ্চশিক্ষায় আস্থার অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট), যার সুনাম রয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। এ বিশ^বিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা উদ্বিগ্ন করে তোলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। সর্বশেষ গত শুক্রবার থেকে আন্দোলনে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এ বিশ^বিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর প্রতিবাদসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহনেন পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার ইস্যুতে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে আন্দোলনের মুখে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্য বিদায় নিয়েছেন চরম অসন্তোষের মধ্য দিয়ে। কিছু দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ তুলে ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি পালন করেন কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : এ বিষয়ে দেশের চাকরির সঙ্গে শিক্ষার ফারাক কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, উচ্চশিক্ষা উন্মুক্ত। যার যেখানে সামর্থ্য, সেখানেই যাবে। বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে- এখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরির চিন্তা, ভবিষ্যৎ অর্থ উপার্জনের চিন্তা মাথায় ঘোরে। আমাদের লক্ষ্যই চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা। ফলে যারা যাচ্ছেন, এরা অনেকেই আর দেশে ফেরেন না। কর্মজীবন শুরু হয়ে গেলে তারা ওইসব দেশেই স্থায়ী বসবাস করেন। এভাবে অনেক মেধা হারিয়ে যায় দেশ থেকে।
বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এর বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ‘বৈশ্বিক মাপকাঠি’তে উন্নীত হওয়ার প্রতিযোগিতা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায টিকে থাকতে হলে শিক্ষাঙ্গনে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। এর মাধ্যমে আস্থা ফেরাতে হবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মঞ্জরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, জাতীয় বাজেটের স্বল্পতা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, প্রাতিষ্ঠানিক ও দায়িত্বশীলদের দুর্নীতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সততা ও মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। নেই প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম। এসব কারণে দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করে অনেকে। ফলে চাকরির বাজারে পড়তে হয় সমস্যায়। ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নের জন্য রাজনীতির প্রভাবও কম নয়। গড়পড়তায় এসবই উচ্চশিক্ষার দৈন্যদশার মূল কারণ। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা অর্জনের বিকল্প নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন