অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে সমাদৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধর্ম ও মতের মানুষ তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিগত কয়েকদিনে কিছু ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা সেই সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গত ১২ই মার্চ থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। রোজা উপলক্ষে ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রথম কয়েক দিনে বেশ কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। প্রথম রমজানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মিলিত ইফতারে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গণইফতারের আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। উৎকণ্ঠা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আয়োজনটি নির্বিঘ্নে শেষ হয়। তবে পরদিন রমজান নিয়ে শিক্ষার্থীদের আলোচনা সভা নির্বিঘ্নে শেষ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ ভবনের মসজিদে রমজান নিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের পূর্ব নির্ধারিত সেই আলোচনা সভায় হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত পাঁচ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের চালানো এ হামলায় ক্যাম্পাসের সমালোচনার ঝড় ওঠে, প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। এক সপ্তাহ পার হতে চললেও এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রশাসন আশ্বাস দিলেও ভুক্তভোগীসহ অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী এই হামলার ঘটনায় আদৌ সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।
এ ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলোচনায় আসে কোরআন তেলাওয়াতের এক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গিয়ে।
পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানিয়ে গত ১০ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ‘আল কোরআন রিসাইটেশন প্রোগ্রাম’ নামে কোরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
‘আরবি সাহিত্য পরিষদ নামে’ বিভাগটির শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত কোরআন তেলাওয়াতের এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। কোরআন তেলাওয়াতের এই কর্মসূচির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। তবে কিছু মানুষ ঢাবির মতো এলাকায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের সমালোচনা করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রগতিশীল’ চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
শুরুতে এ নিয়ে নীরব থাকলেও নানা মহলের আলোচনার পর ১৩ই মার্চ এ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তৎপরতা দেখায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেদিন অনুষ্ঠান আয়োজকদের পরিচয় জানতে চেয়ে আরবি বিভাগের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির।
প্রশাসনের এ পদক্ষেপ গণমাধ্যমে আসার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় যে, শাস্তি পেতে যাচ্ছেন কোরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠান আয়োজনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে অনুমতি না নিয়ে আয়োজন করায় তাদের ব্যাপারে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।
কলা অনুষদ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ নিয়ে গতকাল আরবি বিভাগ ও ডিনের মধ্যে একটি দীর্ঘ মিটিং হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালও এ নিয়ে বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে ওই সূত্র। তবে এ ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি কলা অনুষদের অধ্যাপক ডিন ড. আবদুল বাছিরের।
জানতে চাইলে আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এহসানুল হক জোবায়ের মানবজমিনকে বলেন, প্রশাসন কি পদক্ষেপ নেবে এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে মাননীয় ডিন মহোদয়ের এই চিঠির জবাব দেয়ার জন্য আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষ নই। বিভাগের শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক, সামাজিক, এলাকাভিত্তিক অনেক অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করে। যেহেতু সেগুলোর সঙ্গে সরাসরি বিভাগের সংশ্লিষ্টতা নেই, তাই এ ব্যাপারে তথ্য দেয়াটা আমার কিংবা বিভাগের এখতিয়ারে পড়ে না।
অনুষ্ঠানটির আয়োজক আরবি সাহিত্য পরিষদের দায়িত্বে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, বটতলায় (অনুষ্ঠানস্থল) প্রতিদিনই অনেক প্রোগ্রাম হয়। ইফতার কর্মসূচি, উন্মুক্ত ক্লাস, সংগীত সন্ধ্যা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের এসব প্রোগ্রামের কয়টি অনুমতি নিয়ে হয়?
আরবি বিভাগের এ শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমরা এর আগেও পবিত্র শবেবরাতের দিন বটতলায় ইসলামিক সংগীতের একটা আয়োজন করেছিলাম।
সে সময় প্রক্টর ও ডিন অফিসে আমরা অনুমতির জন্য গিয়েছিলাম। তখন আমাদের অনুমতি দেয়া না দেয়া নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু বলেনি দুই পক্ষ। অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
আমার ভেবেছিলাম কোরআনের এই প্রোগ্রামটি নিয়েও প্রশাসনের কোনো আপত্তি থাকবে না। অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবেই সম্পন্নও হয়েছিল। পরে ফেসবুকের নানা আলোচনার পরে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে কোনো ধরনের চাপে নেই উল্লেখ আরবি বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা সবাই যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি।
বিগত কয়েকদিনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই অবস্থানের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন দেশের বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের নেতারা। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আয়োজনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদারতার আহ্বান জানান। ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আয়োজক শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন