কাগজের দাম চড়া। ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এমন অবস্থায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর অর্থের অভাবে বার্ষিক পরীক্ষার খাতা সরবরাহ করতে পারছে না। এমনকি প্রশ্নও না ছাপিয়ে দেয়া হবে ব্ল্যাক বোর্ডে। অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলে ফটোকপি করে প্রশ্ন সরবরাহ করবে সংশ্লিষ্ট স্কুল। অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দেশের ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ৬ই ডিসেম্বর থেকে। যা চলবে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষার বিষয়ে সম্প্রতি এক নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) বলেছে, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফটোকপির প্রয়োজন হলে বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন গ্রহণ করা যাবে না। চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাদা কাগজ বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য পূর্বেই শিক্ষার্থীকে অবহিত করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি শ্রেণিতে প্রতি বিষয়ে সর্বোচ্চ ৬০ নম্বরের মধ্যে বার্ষিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে হবে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগমূলক, শিখন ক্ষেত্র বিবেচনায় নিতে হবে। মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণের কাছ থেকে কোনো মূল্যায়ন ফি গ্রহণ করা যাবে না।
নির্দেশনার পর আশেকুজ্জামান নামে এক অভিভাবক ফেসবুকে লেখেন, দেশের অবস্থা কী এতটাই খারাপ যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন সরবরাহ করতে পারছে না। এই ক’টা টাকা বাঁচিয়ে দেশ কি উন্নয়নের শিখরে উঠবে। তারা কি একবারও ভাবছে না এই সিদ্ধান্তের ফলে শিশুদের মনে কতোটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সাজেদুর রহমান লেখেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক শিশু আছে যারা পরীক্ষার সময় কলম নিয়ে আসাটাই যাদের চ্যালেঞ্জ। সেখানে সাদা খাতা নিয়ে আসাটা সবাই পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আবার এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদও দেখা দিতে পারে। অনেকে দামি খাতা নিয়ে আসবে আবার কেউ সাধারণ খাতা। এতে বিভেদ বাড়বে। আবার খাতা সাশ্রয়ের জন্য কম লেখারও প্রবণতা বাড়বে। এ ব্যাপারে রংপুর জেলার পীরগাছার প্রত্যন্ত চরের আলীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিন্নাত আরা বলেন, করোনা ও বন্যার প্রভাবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনাটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
এখানে একটি শিশু একদিন স্কুলে না আসলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা আয় করতে পারে। এই শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ অভিভাবকরা চান না বাচ্চারা স্কুলে যাক। কিন্তু এবার পরীক্ষায় খাতা আনতে বলি তবে পরীক্ষায় আনতে পারবে কিনা জানা নেই। ধরেন একটা পরীক্ষার জন্য ১০ টাকার খাতা লাগবে। কিছু বাচ্চা আছে যাদের পক্ষে এই ১০ টাকার খাতা কেনার সামর্থ্য নাই। চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে ‘রং পেন্সিল ফাউন্ডেশন’। এর প্রধান উদ্যোক্তা আরমান রউফ বলেন, চরাঞ্চলের মানুষদের মাঝে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। একেবারের দরিদ্র পরিবারগুলোও চায় সন্তান প্রাথমিক জ্ঞানটা আহরণ করুক। কিন্তু কিছু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই করুণ যে চাইলেও তারা শিশুদের স্কুলে পাঠাতে চায় না। অনেক পরিবার আছে যাদের ঘরে নিয়মিত চুলা জ্বলে না। তবে সংখ্যাটা অনেক কম। আর একেকজনের ঘরে ৪ থেকে ৫টি বাচ্চা খুবই সাধারণ বিষয়। আপনি জেনে অবাক হবেন, এমন অনেক শিশু আছে যারা একটা খাতা দিয়ে পুরো বছর পার করে দেয়। এক খাতায় বাংলা, গণিত, ইংরেজি সব লেখে। আমরা যখন বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করি তখন শিশুরা আমাদের কাছে কলম চেয়ে নেয়।
কারণ একটা খাতা হলেই হলো কিন্তু কলম মেলে না সবসময়। এসব শিশু কলমটাকে যেভাবে হিসাব করে খরচ করে আপনি দেখলে অবাক হবেন। এখন যদি শিশুদের খাতা কিনে পরীক্ষা দিতে হয়। আমার ধারণা সংখ্যাটা নেহায়েত কম হলেও অনেক শিশু পরীক্ষা দিতে আসবে না। গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এভাবে প্রশ্ন দেয়ার মাধ্যমে আমাদের যেসব শিক্ষক কোচিং বা টিউশনি বাণিজ্য করান তাদের জন্য সুবিধা হতে পারে। নৈতিকতাবোধ নষ্ট করে এসব শিক্ষক যে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্ন তুলে দেবেন না আগেই তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ান তাদের অবস্থা শোচনীয়। এখন যদি সন্তানের জন্য কাগজ কিনে দিতে হয় তবে একটা চাপ পড়বে অভিভাবকদের মধ্যে। যদিও অল্প কয়েক টাকার খাতা কিন্তু এটা একটা মানসিক চাপও বাড়াবে। আর এই বাচ্চাদের পরীক্ষা নিতে কতোটাই বা কাগজের প্রয়োজন হয়। এত ব্যয় করছি আমরা দেশে। কোনো একটা খাত থেকে সংকোচন করে শিক্ষার্থীদের কিছু ব্যবস্থা করা গেল না। আর এই পরীক্ষার জন্য কতোটুকু বরাদ্দ লাগে এটা কি দেখা হয়েছে। যদি সঠিকভাবে দেখা হতো আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতো না। ডিপিই’র একজন কর্মকর্তা জানান, স্কুলের পরীক্ষার জন্য অর্থের একটা প্রভাব আছে। আছে কাগজ সংকট।
বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বই দেয়ার জন্য কাগজের ওপর বড় চাপ রয়েছে। আবার পরীক্ষার জন্য এই কাগজ দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে সংগ্রহ করবে স্কুলগুলো। এই কাগজের চাপ যাতে না হয় এজন্য এই ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, এই একটা প্রাথমিক হিসেবে দেখা যায়, এই কাগজ যদি আমরা বাজার থেকে সংগ্রহ করি তবে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কাগজ বাজার থেকে উঠে আসবে। আর অর্থনৈতিক বিষয়টা তো আছেই। বর্তমানে আমাদের উন্নয়ন ফান্ডে পরীক্ষা নেয়ার মতো অর্থ নাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমালোচনার কারণে সিদ্ধান্তে আংশিক পরিবর্তন আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সচিব দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা দেশে ফেরার পরই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিগত বছরগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক উন্নয়ন ফান্ড থেকে এসব পরীক্ষার প্রশ্ন-খাতাসহ পরীক্ষা ব্যয় মেটানো হয়। স্কুল লেভেল ইম্প্রুভমেন্ট প্ল্যানের আওতায় ২০০ শিক্ষার্থীর বেশি স্কুলগুলোতে বছরে ৭০ হাজার টাকা, ২০০ শিক্ষার্থীর কম স্কুলে ৫০ হাজার টাকা এবং ৫০০ শিক্ষার্থীর অধিক স্কুলে ৮০ হাজার টাকা দেয়া হয়। আর এসব পরীক্ষার প্রশ্ন ও খাতা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে পরিচালনা করা হয়। সার্বিক বিষয়ে জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। তাই পরীক্ষার জন্য টাকা দিতে পারছি না। তবে প্রশ্ন টাইপ করে ফটোকপি করে দেয়া হবে শিক্ষার্থীদের হাতে। এজন্য স্কুলগুলো কোনো ধরনের ফি নিতে পারবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন