‘৪-৫ দিন আগে থেকেই ফাহাদ আমাদের টার্গেটে ছিল। ঘটনার দিন সে গ্রামের বাড়ি থেকে আসায় আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় সন্ধ্যার পর তাকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডাকা হবে। রাত ৮টার পর ফাহাদকে ওই কক্ষে ডাকা হয়। সঙ্গে তার মোবাইল ল্যাপটপটি আনা হয়। তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফাহাদ চুপ। একপর্যায়ে তার মোবাইল ও ল্যাপটপ ঘেঁটে উসকানিমূলক কিছু তথ্য পাই আমরা। এরপর মারধর শুরু হয়। প্রথম চরথাপ্পড় মারে মেহেদি। এরপর আমি কিলঘুসি দেই। ইফতিও চরথাপ্পড় মারতে থাকে। একপর্যায়ে সামসুল আরেফিন ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসে। আমি স্টাম্প দিয়ে ফাহাদের পায়ে পেটাতে থাকি। ওর দুহাত টান টান করে স্টাম্প দিয়ে পেটাতে থাকি। ফাহাদ তখন চিৎকার করে কাঁদতেও পারেনি। অন্যরা ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছিল। এভাবে থেমে থেমে ইফতি, জিয়ন ও আমি একই কায়দায় পেটাতে থাকি ফাহাদকে।’ গতকাল শনিবার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার বর্ণনা দেন চাঞ্চল্যকর এ হত্যামামলার অন্যতম আসামি অনিক সরকার।
ফাহাদ হত্যার জেরে ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কৃৃত অনিক আরও বলেন, এভাবেই মার চলছিল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। এরপর ফাহাদকে কক্ষে রেখে দিয়ে ইফতি, জিয়ন ও আমিসহ অন্যরা ক্যান্টিনে খেতে যাই। খাবার খেয়ে ফিরে এসে দেখতে পাই ফাহাদ মেঝেতে পড়ে আছে। সে বমি করেছে। আমি ভাবি, ভান করছে। তাই আবার স্টাম্প দিয়ে তাকে পেটাই। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আবরারের পিঠে প্রায় আধাঘণ্টা স্টাম্প দিয়ে পিটানো হয়। একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
অনিক বলেন, এরপর আমি বলি ফাহাদকে যেন গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করে। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসে একজন। আবরারকে ওই কক্ষ থেকে বের করে পাশের ২০০৫ নম্বর কক্ষে নেওয়া হয়। ওই কক্ষে আবরার বমি করে। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। এরপর আমি, জেমি, মোয়াজ ও শামীমসহ ৩-৪ জন তাকে কোলে করে সিঁড়িঘরের পাশে নিয়ে যাই। এরও পরে পুলিশ ও চিকিৎসকদের খবর দেওয়া হয়। চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রেকর্ডকৃত জবানবন্দিতে অনিক আরও বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শিবির শনাক্ত করা। কিন্তু ফাহাদ মুখ খোলেনি বলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফাহাদ মারা গেছে আমরা বুঝতে পারিনি। এ ঘটনায় আমি অনুতপ্ত।
গত ৬ জুন আবরার খুন হওয়ার পরপরই ওই রাতে বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের একজন অনিক। বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পঞ্চদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তারের পর এ ১০ জনের সঙ্গে অনিককেও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। জবানবন্দির পর অনিক সরকারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
এর আগে এ মামলায় গত বৃহস্পতিবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল। গত শুক্রবার স্বীকারোক্তি দেন মেফতাহুল ইসলাম।
এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আবরারের সহপাঠী মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ড শুনানির আগে কাঠগড়ায় সাংবাদিকদের মাজেদ জানান, তিনি আবরারকে মারেননি। তিনিসহ কয়েকজন বরং বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।
গতকাল শনিবার আসামি মাজেদের দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে এবং অনিক সরকারের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের জন্য তাদের আদালতে হাজির করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর ডিবির লালবাগ জোনাল টিমের পুলিশ ইন্সপেক্টর মো. ওয়াহিদুজ্জামান আসামিদের আদালতে হাজির করেন।
যার মধ্যে ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম আসামি অনিকের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার ওই জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এর পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, আবরার হত্যাকা-ের বর্ণনার সঙ্গে তার নিজের জড়িত থাকাসহ জড়িত অপর আসামিদের নাম প্রকাশ করেছেন অনিক সরকার।
স্বীকারোক্তিকারী অনিক বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি রাজশাহী জেলার মহনপুর থানার বড়ইকুড়ি গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে। সে মামলাটির এজাহারনামীয় ৩ নম্বর আসামি। এ আসামিই আবরারকে বেশি পিটিয়েছে বলে অভিযোগ।
মামলাটিতে গত ৮ অক্টোবর অনিকসহ দশ শিক্ষার্থীর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই রিমান্ড চলমান অবস্থায় সে আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি প্রদান করলেন।
এর আগে মামলাটি অনিকের সঙ্গে রিমান্ডে যাওয়া আরও ২ জন আসামি দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরা হলেনÑ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল ও ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন।
এদিকে আসামি মাজেদের রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ওই আসামি এজাহারনামীয় ৮ নম্বর আসামি। মামলার তদন্ত, সাক্ষ্য প্রমাণে ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় এবং পারিপাশির্^ক সাক্ষ্য-প্রমাণে এ আসামি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার সম্পর্কে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইতিপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত আসামি ইফতি মোশাররফ সকালের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ আসামির নাম প্রকাশ করেছেন। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অন্য আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য এ আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
রিমান্ড শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে পুলিশের জিআরও এসআই মাজহারুল ইসলাম ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন।
তবে মাজেদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় রাষ্ট্রপক্ষে একতরফা রিমান্ড আবেদনের শুনানির পর ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে মঞ্জুরকৃত রিমান্ড ৮ কার্যদিবসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে রিমান্ড শুনানির জন্য বেলা ৩টার দিকে আদালতের কাঠগড়ায় উঠানোর পর বিচারক এজলাসে ওঠার আগে আসামি মাজেদ নিজে মারধরের সঙ্গে জড়িত নয় উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে গালিবের সঙ্গে ২০১১ নম্বর রুমে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি হলের বড় ভাই অনিক আবরারকে মারছে। আমরা জুনিয়র হিসেবে ঠেকানোর কোনো উপায় ছিল না। তার আগে রবিনসহ কয়েকজন মারছে শুনছি। পরে অবস্থা খারাপ হওয়ায় সেখান থেকে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আবরারের আঘাতের স্থানে মলম লাগায়। মিজান পানি আনতে বললে পানি এনে আবরারকে খাওয়ায়। তার সঙ্গে মোরশেদ, আফাদ, তোহা ও শামীম বিল্লাহ আরবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। কিন্তু হলের নিয়ম অনুযায়ী আমরা বড় ভাইদের জোর করে কিছু বলতে পারিনি। অবস্থা খারাপ হলে অনিক ভাইদের কাছে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলি কিন্তু তারা শোনেননি। পরে অবস্থা আরও খারাপ হলে সিঁড়ির কাছে নিয়ে রাখতে বলে। ময়াজ, তামীম ও জেমি কোলে করে সিঁড়ির কাছে নিয়ে যায়। পিছে পিছে আমিও ছিলাম। তাই সিসি টিভিতে আমাকে দেখা গেছে। সিঁড়ির কাছে নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, শিবির বলে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে। পুলিশও ডেকেছিল। কিন্তু মারা যাওয়ায় দিতে পারেনি। রাত ৩টার দিকে আবরার মারা যায়। পরে ক্যান্টিনে নিয়ে রাখে।
৬ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হল থেকে আবরার ফাহাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকা-ের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
আবরার হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন এজাহারনামীয় আসামি। গতকাল শনিবার সকালে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বুয়েটছাত্র মোয়াজ আবু হুরাইরাকে।
মোয়াজ বুয়েটের সিএসই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন