ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন নাটোর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রকিবুল হাসান ইসামীসহ পাঁচজন। অন্যরা হলেন- ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের পিপলস প্রেসের কর্মচারী খান বাহাদুর, তার আত্মীয় সাইফুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র বনি ইসরাইল ও মারুফ হোসেন। এর আগে বিভিন্ন সময় সিআইডির হাতে গ্রেফতার আরও ১৯ জন প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত গ্রেফতার ২৪ জনই দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। কোনো ঘটনায় গ্রেফতার সকল অভিযুক্তের দোষ স্বীকার করে নেওয়ার ঘটনা ব্যতিক্রম বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। আর অভিযুক্ত প্রায় সবার বক্তব্যে উঠে এসেছে প্রশ্ন ফাঁসের নাটের গুরু ক্রীড়া কর্মকর্তা ইসামীর।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ৫ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা ২০১৫ ও ‘১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ওই চক্রের অন্যদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পুরো চক্রটিকে শনাক্ত করা গেছে।
সিআইডির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত অনেকে বিলাসী জীবন-যাপন করতেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় তারা খেতেন দামি হোটেলে। প্রায়ই দলবেঁধে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যেতেন। চড়তেন দামি গাড়িতে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার অন্যতম হোতা ইসামী ও নাভিদ আনজুম তনয়ের ব্যাংক হিসাবে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে।সিআইডি সূত্র আরও জানায়, কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতরা নানাভাবে জালিয়াতি করে আসছিল। কারও দায়িত্ব ছিল ফার্মগেটের ‘পিপলস প্রেস’ নামে ছাপাখানা থেকে প্রশ্ন ছেপে তা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে টার্গেট করা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। কেউ আবার টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করতেন। কেউ কিনতেন বিশেষ ডিভাইস। কারও কাজ ছিল শিক্ষার্থীদের উত্তর মিলিয়ে দেওয়ার। প্রশ্ন দেওয়ার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো।
কেন আগে প্রশ্নপত্র পেলেও ব্লুটুথের মাধ্যমে পরীক্ষা শুরুর পর শিক্ষার্থীদের উত্তর জানানো হতো- এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, জালিয়াত চক্র মনে করত, আগে থেকেই ফাঁস করা প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের জানানো হলে তাদের মাধ্যমে অন্যরাও সেই প্রশ্ন পেয়ে যেতে পারে। যাদের সঙ্গে তাদের টাকার দেনদরবার হয়নি এমন কারও হাতে প্রশ্ন যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইতেন না তারা। তাই অনেক সময় আগে প্রশ্ন পেলেও পরীক্ষা শুরুর পরই বিশেষ ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর জানাতেন তারা।
সিআইডির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ইসামী ২০১৬ সালে ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেলেও মূলত তার মাধ্যমে আগেই দেশে প্রশ্ন জালিয়াত চক্রের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এরই মধ্যে ওই চক্রের অন্তত ৫০ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন-মহীউদ্দিন রানা, আবদুল্লাহ আল মামুন, ইশরাক হোসেন রাফি, ফারজাদ সোবহান নাফি, আনিন চৌধুরী, নাভিদ আনজুম তনয়, এনামুল হক আকাশ, নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, বায়েজিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভি আহম্মেদ, প্রসেনজিৎ দাস, আজিজুল হাকিম, তানভির হাসনাইন, সুজাউর রহমান, রাফসান করিম ও আখিনুর রহমান অনিক, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক অলিভ কুমার।
সিআইডি জানায়-মেডিকেল, এসএসসি, এইচএসসি, শিক্ষক নিবন্ধন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতিতে জড়িত ছিলেন তনয় ও আনিন চৌধুরী। তনয়ের হিসাব নম্বরে ৬০ লাখ টাকা লেনদেন হওয়ার তথ্য মিলেছে। সব মিলিয়ে জালিয়াত চক্রের দেড় কোটি টাকার হিসাব পেয়েছে সিআইডি।
সূত্র : সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন