পরীক্ষকদের কেলেঙ্কারির পরও তিরস্কারের বদলে পুরস্কার
বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের দুই প্রধান পরীক্ষকের খাতা মূল্যায়নে খামখেয়ালিপনা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলেও তাদের এমপিও (মাসিক পেমেন্ট অর্ডার) স্থগিত করা হয়। বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে এমপিও ছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এই দুই পরীক্ষকের ভুলের কারণে ২০১৬ সালের এএসএসি পরীক্ষায় ফেলের কষ্ট সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে সর্বজিত ঘোষ হৃদয়।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে এক হাজার ১৪১ জন ফেল করলে শুরু হয় তোলপাড়। এর মধ্যে বরিশাল মহানগরীর উদয়ন স্কুলের ছাত্র সর্বজিৎ ঘোষ হৃদয় চার বিষয়ে জিপিএ-৫ পেলেও হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফেল করে। ফেলের কষ্ট সইতে না পেরে সাততলা ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বোর্ড কর্তৃপক্ষ ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন করে ফল প্রকাশ করে। এতে জিপিএ-৫ পায় সর্বজিৎ। এছাড়া সংশোধিত ফলে এক হাজার ৯৯৪ জনের ফল পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করে এক হাজার ১৪১ জন। নতুন করে জিপিএ-৫ পায় ১৫ জন ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিদের্শে গঠিত বোর্ডের তদন্ত কমিটি দুই পরীক্ষককে দোষী সাব্যস্ত করেন। অভিযুক্তরা হলেন, বরিশাল মহানগরীর ব্রজমোহন (বিএম) স্কুলের শিক্ষক জুরানচন্দ্র চক্রবর্তী ও বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি নিয়মিত যুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক বীরেন চক্রবর্তী। দোষী প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের জুন মাস থেকে তাদের এমপিও স্থগিত রয়েছে। এরপর গত অক্টোবরে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক ‘রহস্যজনক’ কারণে ঘটনাটিকে দুই শিক্ষকের ‘অনাকাঙ্খিত ভুল’ আখ্যা দিয়ে বেতন ছাড়ের সুপারিশ করে আবেদনপত্র পাঠান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি)।
পরবর্তীতে মাউশি এমপিও ছাড়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা এমপিও ছাড় করতে ফাইলটি তোলে। এ প্রক্রিয়ায় মোটো অংঙ্কের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, এমপিও ছাড়ের জন্য শাখা থেকে ফাইল তুলেছে। বিষয়টি আমার দৃষ্টিতে এলে আপাতত স্থগিত রেখেছি। শিক্ষকরা মানবিক কারণে বেতন ছাড়ের জন্য আবেদন করলেও তাদের ভুল না দায়িত্বহীনতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে তা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অভিযুক্ত শিক্ষক বীরেন চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি তো অন্যায় করিনি, ভুল করেছি। ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছি। ভুল করলে তো আবেদন করতেই পারি। বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যারের হাত পা ধরে কান্নাকাটি করার পর তিনি সুপারিশ করেছেন’। আপনার কারণে একজন মেধাবী ছাত্র আত্মহত্যা করেছে, এটা কোন ধরনের ভুল? এই প্রশ্ন করলে তিনি কোন জবাব দিতে পারেননি।
সর্বজিতের বাবা শেখর ঘোষ বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে দুই শিক্ষকের বেতন স্থগিত করায় ছেলে হারানোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছিল। শিক্ষকরা অনেক দিন পালিয়ে ছিলেন। বোর্ড চেয়ারম্যান দুই শিক্ষকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বেতন ছাড়ের সুপারিশ করেছেন। বেতন ছাড়ের বিষয়টি তাকে জানালে ক্ষোভ প্রকাশ করে হৃদয়ের বাবা বলেন, দুই শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সমস্যা হবে। বরিশাল বোর্ড সূত্র জানায়, নৈর্ব্যক্তিক উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় দুই প্রধান পরীক্ষক ‘খ’ ও ‘গ’ সেট গুলিয়ে ফেলেন। তারা ‘খ’ সেট প্রশ্নের মূল্যায়ন করেন ‘গ’ সেটের উত্তরপত্রের মাধ্যমে আর ‘গ’ সেটের মূল্যায়ন করেন ‘খ’ সেটের উত্তরপত্রের মাধ্যমে। ফলে ‘খ’ সেটে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের উত্তরের সঙ্গে প্রধান পরীক্ষকের ভুল উত্তরমালার সমন্বয় হয়নি, যার খেসারত দিতে হয় পরীক্ষার্থীদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন