ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রবেশপথ নির্মাণ এবং মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিসহ আট দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের আহ্বান ও আশ্বাসের পরও ক্লাস, পরীক্ষা ও ল্যাব বর্জন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষার্থীরা।
এতে সেশনজটে পড়া বা শিক্ষাবছর পেছানোর শঙ্কায় রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী। ডিসেম্বরের মধ্যেই ক্লাস ও ল্যাব শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হবে কি না সে নিয়ে সংশয় রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষাক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও যৌক্তিক বিষয়ে আটটি দাবি জানানো হলেও বুয়েট প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করছে না। দাবি মানার বিষয়ে মৌখিক আশ্বাস দিলেও কার্যত বাস্তবায়ন নেই। ক্লাস-ল্যাব বর্জনে শিক্ষাবছর পেছালেও অচলাবস্থা নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেই। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তারা ক্লাসে ফিরতে চায় এটি যেমন সত্য, তেমনি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাসে ফিরবে না।
এদিকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না ফেরায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৮ নভেম্বর ক্যাম্পাসে নোটিশ টানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমানের সই করা ওই নোটিশে বলা হয়েছে, ২৬ ও ২৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনভিপ্রেত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে উপাচার্য সব আশ্বাস বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। তবু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কার্যক্রমে ফেরেনি। শিক্ষার্থীদের এরূপ কর্মকাণ্ড বুয়েটের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনতিবিলম্বে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ২৬ অক্টোবর বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জের ধরে ২৭ অক্টোবর সংঘর্ষে জড়ায় দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আটকে মারধর করা হয়েছে—এমন অভিযোগে বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি মারধর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা। ওই ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট কর্তৃপক্ষ আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সংঘর্ষের পরদিন থেকেই নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলন করছে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পলাশী ও বকশীবাজার মোড়ে গেট নির্মাণ, অতিরিক্ত প্রহরী মোতায়েন, ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ক্যাম্পাসের ভেতরের ফুট ওভারব্রিজ বন্ধ করা, বহিরাগতদের হামলার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করা, বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং মাদক কারবারি রাজুসহ সহযোগীদের আটক ও মামলা করার দাবিতে ২৯ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ক্লাস-ল্যাব বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। তবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানায় ক্লাস-ল্যাব বর্জন অব্যাহত রেখেছে তারা।
দাবির বিষয়ে সুরাহা না হওয়ায় নতুন কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আজ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একত্র হয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে তারা।
আন্দোলনের সমন্বয়ক ১৩তম ব্যাচ ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী প্রার্থ প্রতীম দাস গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাবির বিষয়ে প্রশাসন কর্ণপাত না করায় বাধ্য হয়েই নতুন কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে কিংবা দুপুরের পর সবাই একত্র হয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব। ’
বুয়েটের ১৫তম ব্যাচ ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান সারোয়ার সৈকত বলেন, ‘যৌক্তিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছি। তবে আমাদের বিষয়ে কর্ণপাত করছে না প্রশাসন। দৃশ্যমান অগ্রগতি ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী প্রবেশপথ নির্মাণ চাই। মাদক কারবারে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও এখনই জামিনে বেরিয়েছে। অচলাবস্থা নিরসন না হলে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস, ল্যাব ও পরীক্ষা হওয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ’
আন্দোলনের সমন্বয়ক প্রার্থ প্রতীম দাস বলেন, ‘আমরা ক্লাসে ফিরতে চাই, তবে প্রশাসনের উদাসীনতায় কোনো সমাধান হচ্ছে না। আমরা ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেব এটা ঠিক, তবে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাও জরুরি। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করছে না প্রশাসন। আমাদের দাবির কয়েকটি পূরণ করা হলেও বাকিগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। অতিদ্রুত এ সমস্যার সমাধান চাই। ’
১৪তম ব্যাচ ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অভিষেক মুখার্জি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগেও নানা দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, তবে এবারের আন্দোলনে সব শিক্ষার্থী এক হয়েছে। দাবি মেনে নিলেই ক্লাসে ফিরতে চায়, কিন্তু প্রশাসন সমাধান করতে চাইছে না। ইতিমধ্যে অনেকটা পিছিয়েছি আমরা। অতিদ্রুত বিষয়গুলোর সমাধান প্রয়োজন। ’
জানা যায়, বুয়েটে প্রতি শিক্ষাবর্ষে দুটি টার্ম, যা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার হিসেবে গণ্য হয়। এক টার্মে ১৪ সপ্তাহ ক্লাস ও ল্যাব। ল্যাব ও ক্লাস শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহ পর ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই টার্মের দুই সপ্তাহ কমিয়ে ১২ সপ্তাহ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে তিন সপ্তাহ ক্লাস বর্জন করেছে। সেই হিসাবে যদি সময় না বাড়ানো হয় তবে এই টার্ম শেষ হবে ৯ সপ্তাহেই। এতে বাকি সিলেবাস ও ল্যাব শেষ করতে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। সময়ের চাপে দ্রুত কিংবা আধো আধো করেই শেষ হবে টার্ম।
বুয়েটের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যেই সব শিক্ষা বর্ষের ক্লাস ও ল্যাব শেষ হয়। আর এই সময়ের পর থেকে তিন সপ্তাহ বিরতি বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে জানুয়ারির মধ্যেই চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়। শিক্ষার্থীরা বলছে, চলতি টার্মে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্লাস ও ল্যাব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বাকি ক্লাস ও ল্যাব কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা ডিসেম্বরেই। কিন্তু ক্লাস-ল্যাব বর্জনে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা কার্যক্রমে এরই মধ্যে তিন সপ্তাহ পিছিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে চূড়ান্ত পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে।
বুয়েট প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দাবি মেনে নিয়েছে প্রশাসন। ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার কাজ চলছে। সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ফুট ওভারব্রিজ ও বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। মাদক কারবারি রাজুসহ তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পলাশী ও বকশীবাজার মোড়ে ব্যারিয়ার গেটও নির্মাণ করা হয়েছে। বুয়েট ক্যাম্পাস দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করেছিল প্রশাসন। তবে গাড়ির চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যানজট সৃষ্টি হলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছে বুয়েট প্রশাসন। এখন সীমিত আকারে যানবাহন চলছে।
গত রবিবার দুপুরে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে প্রশাসনিক ভবন ছাড়া কোথাও কোনো শিক্ষার্থীর দেখা পাওয়া যায়নি। ক্লাসরুম আর ল্যাবরেটরিও ছিল ফাঁকা। ক্যাফেটেরিয়া, ল্যাইব্রেরি ও শহীদ মিনারে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। ক্যাম্পাসে শিক্ষকদেরও আনাগোনা কম। শিক্ষার্থীরা বলছে, আটটি দাবির কয়েকটি মেনে নেওয়া হলেও অন্য দাবির বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ক্যাম্পাসের দুই প্রবেশপথে স্থায়ী গেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মাদক কারবারি রাজু ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও ধরার আগেই তারা জামিন পেয়ে গেছে।
বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি। ’ আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন