দেশের সড়ক মহাসড়কে কিছুতেই ফিরছে না শৃঙ্খলা। ফলে দুর্ঘটনাও কমছে না, বরং দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যু, বাড়ছে স্বজনহারাদের আর্তনাদ। সড়ক পরিবহন আইনে নানা ফাঁকফোকর ও শিথিলতা; সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়সারা আচরণ এবং চালকদের দায়িত্বহীনতা ও সচেতনতার অভাবেই মূলত এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না।
অদক্ষ চালকের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া হলে দুর্ঘটনার শঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া ওভারটেকিং ও অতিরিক্ত গতির কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও চালক দায়ী। গত বুধবার ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোলপ্লাজায় ট্রাকের ধাক্কায় বিভিন্ন গাড়ির ১৪ আরোহী নিহত হন। এর আগের দিন, গত মঙ্গলবার ফরিদপুর সদরের কানাইপুরের সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা যান। বাস ও পিকআপের সংঘর্ষে ওই দুর্ঘটনা হয়। পণ্যবাহী যান পিকআপে চেপে যাত্রীরা রওনা হয়েছিলেন। দুর্ঘটনা দুটির কারণ জানা যাবে তদন্তসাপেক্ষে। তবে দুটো দুর্ঘটনাতেই চালকদের যে গাফিলতি ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
গণপরিবহনে চালক-শ্রমিক নিয়োগে নিয়োগপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। কিন্তু তা মানা হয় না। গাড়ি থেকে অর্জিত আয়ের অংশ ভাগাভাগি করে নেন পরিবহন মালিক। একে বলা যায় অনেকটা জমি বর্গার মতো। ফলে গাড়ি চালনায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা, দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার তাড়না, বিশ্রামের অভাব এ রকম নানা অভিযোগ পাওয়া যায় হরহামেশাই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বুধবার ঝালকাঠিতে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ট্রাকটির ফিটনেস মেয়াদ আছে চলতি বছরের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সূত্রের খবর, ওই ট্রাকটির চালকের ভারী লাইসেন্স ছিল না। আর মঙ্গলবার ফরিদপুরে দুর্ঘটনার তথ্য বলছে, পিকআপে বহন করা হয় যাত্রী। পণ্যবাহী যানে যাত্রীপরিবহনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তথাপি এ ধরনের কর্মকা- মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ চালকের অনিচ্ছায় পিকআপে যাত্রীবহন সম্ভব হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া চালকদের মাদকসেবন এড়াতে ডোপটেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেটিও মানা হচ্ছে না সবক্ষেত্রে।
দেশে কী পরিমাণ চালক আছেন তার একটি তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে। সেখানে দেখা গেছে, ৭২ লাখ ৬০ হাজার ৭৭২টি কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে অপেশাদার ৫৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৮টি এবং পেশাদার ১৯ লাখ ২১ হাজার ৩৯৪টি। ভারী যান চালনার লাইসেন্স ২ লাখ ৫ হাজার ৭৭২টি, মাঝারি যান চালনার লাইসেন্স রয়েছে ৬৯ হাজার ৫৫০টি, হালকা যানের লাইসেন্স পেশাদার চালকের জন্য আছে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪৭টি এবং অপেশাদার হিসাবে আছে ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৫৯টি। মোটরসাইকেল চালনার লাইসেন্স আছে ৩৪ লাখ ২২ হাজার ৩১৯টি। তিন চাকার বাহন চালনার লাইসেন্স আছে ৯৫ হাজার ২১৬টি এবং ১৩০৯টি আছে অন্যান্য কাটাগরির। এর বিপরীতে সারাদেশে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫টি। প্রতি গাড়ির বিপরীতে আড়াইগুণ ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার কথা। আর যেসব লাইসেন্স রয়েছে সেই হিসাবে চালকের সংখ্যা ধরা যাবে না। কারণ এককজন চালক একাধিক ক্যাটাগরির লাইসেন্সধারী। যেমন- একজন চালক মোটরসাইকেলের পাশাপাশি হালকা যানেরও লাইসেন্সধারী।
এদিকে রেজিস্ট্রেশন করা অনেক গাড়ির বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। স্ক্রাপ বা ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৮টি ফিটনেসখেলাপি। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ৩৯৯৩টি, অটোরিকশা ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩টি, অটোটেম্পো ৬ হাজার ৭৮টি, বাস ২৫ হাজার ২১০টি, কার ৫৯ হাজার ১৭৪টি, কার্গোভ্যান ২ হাজার ৩১০টি, কাভার্ডভ্যান ১০ হাজার ৪৯১টি, ডেলিভারিভ্যান ৯ হাজার ৮১৮টি,
হিউম্যান হলার ১৪ হাজার ৬৮১টি, জিপ ১৪ হাজার ২৩৫টি, মাইক্রোবাস ২৬ হাজার ৫৯৮টি, মিনিবাস ১২ হাজার ৪৩৮টি, পিকআপ ৭৮ হাজার ৯৯৬টি, স্পেশাল পারপাস ভেহিকল ৬ হাজার ৯৩টি, ট্যাঙ্কার ২৩৩৪টি, ট্যাক্সিক্যাব ৭ হাজার ৩৬টি, ট্রাক্টর ৩৭ হাজার ৮৩৬টি এবং ট্রাক ৬৭ হাজার ৯১৯টি।
গাড়ির ফিটনেস নিরাপদ সড়কে সহায়ক সত্যি। কিন্তু এর চেয়েও ঢের বেশি দরকার দক্ষ চালক। গণপরিবহনের ছাদে যাত্রীবহন কিংবা পিকআপে যাত্রী
তোলার প্রথম দায় চালকের ওপর বর্তায়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী তোলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। সড়ক দুর্ঘটনারোধ ও সড়কে শৃঙ্খলা জোরদার করতে প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ব্যাপারে জোর দিয়েছে বিআরটিএ। সংস্থার পরিচালক (রোড সেফটি) স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে হাইওয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসনের কাছে। বিআরটিএর সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করা হবে অভিযান। অবৈধ নসিমন-করিমন, থ্রি-হুইলার, ফিটনেসবিহীন মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল সড়ক-মহাসড়কে চলাচল, মোটরযানের অতিরিক্ত গতি এবং মালবাহী গাড়িতে যাত্রীবহন ইত্যাদির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছে বিআরটিএ। তাই নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং ট্রাফিক পুলিশের অভিযান জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থায় চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, সড়কে প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। এ জন্য প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে। একজনের দোষে অন্য বাহনের যাত্রী চালকরাও পিষ্ট। পরিবহন মালিক-শ্রমিক-যাত্রী-পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে। ট্রাকে চেপে যাত্রী গেলে অন্যারা যেন বাধা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা যেমন দরকার তেমনি সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।
গাড়ি চালনায় ড্রাইভিং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। এ জন্য আবেদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানা গেছে, পেশাদার ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য প্রার্থীকে প্রথমে হালকা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে এর ন্যূনতম তিন বছর পর তিনি পেশাদার মিডিয়াম ড্রাইভিং লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং মিডিয়াম ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার কমপক্ষে তিন বছর পর ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এখন সেই শর্ত শিথিল করা হয়েছে। পেশাদার হালকা যানের লাইসেন্সধারী এক বছর পরে মধ্যম যানের লাইসেন্স পাবেন। আবার মধ্যম যানের লাইসেন্সধারী এক বছর পরই ভারী যান চালনার আবেদন করতে পারেন। গণপরিবহন চালানোর অনুমতিপত্র (পিটিএ) লাগে সড়ক পরিবহন বিধিমালা অনুযায়ী। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ রকম অনুমতি ছাড়াই গণপরিবহন চালানোর সুযোগ মিলছে। গণপরিবহন চালানোর অনুমতির বেলায় বিধিমালায় বলা আছে- হালনাগাদ ড্রাইভিং লাইসেন্সের অনুলিপি, নিয়োগকারী কর্তৃক প্রদত্ত অভিজ্ঞতা সনদপত্র ও নিয়োগপত্র লাগবে। সড়ক পরিবহন বিধিমালায় বলা আছে, বেপরোয়া গাড়ি চালনার প্রমাণ পেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল করার সুযোগ আছে। আদতে এর বাস্তবায়ন নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিংসহ ১৫টি কারণ বলা আছে লাইসেন্স বাতিলের কারণ হিসাবে। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কর্তনের পদ্ধতি রয়েছে সড়ক আইনে। এরও কোনো বাস্তবায়ন নেই। দুর্ঘটনারোধে এসব পদ্ধতি বা বিধান কেবল কিতাবেই আছে, বাস্তবে তা দৃশ্যমান নয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে অনেক দুর্বলতা আছে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা এ আইনের ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সড়কে নিরাপত্তা ফিরছে না।
তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার গৃহীত সিদ্ধান্তের অধিকাংশই গতানুগতিক। একইভাবে চালকদের দায়িত্বহীন মনোভাব এবং মালিকদের গাফিলতি দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এ কারণে বাড়ছে বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং। শুধু তা-ই নয়, চালকদের কর্মঘণ্টা ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তদুপরি তাদের গাড়িচালনা কার্যক্রম তদারকিতে কর্তৃপক্ষও দায়সারা। মালিকদের অবস্থাও তা-ই। এতে করে সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা; দিনদিন বাড়ছে দুর্ঘটনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন