পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বারবার নির্দেশ দেওয়ার পরও থানাগুলোতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। থানায় সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়ছে। অবৈধ অর্থের বিনিময়ে থানার দায়িত্ব পাচ্ছেন অনেক ওসি। ফলে তারা সেবা দেওয়ার চেয়ে অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগ দেন বেশি। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার ওসি খায়রুল ইসলামের বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘নগদ ৬০ লাখ টাকা দিয়ে চেয়ারে বসেছি, ফ্রিতে সেবা দিতে আসিনি।’ তার এই বক্তব্যের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তিনি এমন কথা বলেছেন সেটা প্রমাণিত হলে বাহিনীর শৃঙ্খলা পরিপন্থি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু এই ঘটনা নয়, অনেক জায়গায় ওসিদের ঔদ্ধত্য এমনই।
পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘ওসি পদায়নে অর্থের লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। সদর দপ্তর থেকে কঠোরভাবে এগুলো মনিটরিং করা হয়। চট্টগ্রামের ঘটনাটিতে তিনি আদৌ এমন কথা বলেছেন কি না? বা টাকা দিলে কাকে দিয়েছেন? সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সর্বশেষ অপরাধ সভায়ও আমি কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি, থানায় ভালো সেবা না মিললে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। কারণ মানুষ সেবা পেতে প্রথমে থানাতেই যায়। সেখানে অবশ্যই মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।’
২০২১ সালে ফরিদপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের সময় গ্রামবাসীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেই ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়। ঐ মামলাগুলোতে টাকার বিনিময়ে কিছু মানুষকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর টাকা না দেওয়ায় অনেক নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে ঊর্ধ্বতনরা নিশ্চিত হন ওসি এই অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। পরে তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নে বদলি করা হয়। সম্প্রতি সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে একটি রেঞ্জে। দায়িত্ব পেয়েছেন একটি থানার। ঐ থানায় যোগ দিয়ে তিনি আগের মতো মানুষকে হয়রানি শুরু করেছেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকার মানুষ।
একজন অভিযুক্ত ওসির আবার কীভাবে পদায়ন হয়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল অবৈধ অর্থের লেনদেনের বিষয়টি। আগে ডিআইজি চাইলেই একজন ওসিকে পদায়ন করতে পারতেন। এখন ডিআইজির সঙ্গে এসপিরও সম্মতি থাকতে হয়। ফলে এই ধরনের দুর্নীতিবাজ ওসিদের পদায়ন হয় অবৈধ অর্থের লেনদেনেই। এই লেনদেনের সঙ্গে শুধু ডিআইজি নয়, এখন এসপিরাও জড়িত। সব ক্ষেত্রে যে এমনটি হয় তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় যোগ্য ব্যক্তিরা ওসিদের দায়িত্ব পাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ নেই।
তবে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার ওসি খায়রুল ইসলাম যেটা বলেছেন, ‘নগদ ৬০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চেয়ারে (ওসির চেয়ার) বসেছি। ফ্রিতে সেবা দিতে আসিনি। মন্ত্রী, এমপি, মেয়র বা নেতাদের দিয়ে তদবির করিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারো কথার আমি ধার ধারি না...।’ এই ধরনের বক্তব্য শুধু খায়রুলের না, অনেক ওসির বক্তব্যও এমন। সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে তারা দুর্ব্যবহার করেন। এসব ঘটনায় ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই ধরনের ওসির সংখ্যা বাড়ছে।
অথচ করোনা মহামারির সময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দারুণভাবে ইতিবাচক আলোচনায় এসেছিল পুলিশ। কিন্তু কতিপয় ওসির কারণে পুলিশের সেই ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে এই ধরনের ওসির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। পুলিশের প্রতি মানুষের ধারণাও বদলে যাবে।
গত ১৭ মে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে দুই দিনব্যাপী পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স কোয়ার্টারলি কনফারেন্সে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সার্ভিস ডেলিভারি সেন্টার হিসেবে থানাকে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ অনেক ভালো কাজ করছে বলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে, পাশাপাশি পুলিশের প্রতি জনগণের প্রত্যাশাও বেড়েছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা প্রদানের জন্য থানার ওসিদের আরো সচেষ্ট হতে হবে। অবহেলা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন