রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বা সাদা পোশাকে এসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের এবং ভিকটিম পরিবারের সাথে উপহাস করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়া টুডে। গত ২ অক্টোবর ইন্ডিয়া টুডে’র প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার অনুগত দালাল মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষকসহ তথাকথিত আইনজীবী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভাড়াটিয়া লেখক খোঁজার পরপরই এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়া টুডে।
ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে আওয়ামী সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডে’র এই প্রতিবেদনটিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবদেন ও গুমের ঘটনা গুলো নিয়ে মন্তব্য দিতে গিয়ে শেখ হাসিনার বান্ধবী ও আওয়ামীপন্থী হিসাবে পরিচিত সুলতানা কামাল চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসাবে পরিচিত অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও একজন অখ্যাত আইনজীবী নানা প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের ভাষায় নিজেদের মন্তব্য দিয়েছেন প্রতিবদেনটিতে।
পাঠকের কাছে সেই প্রতিবেদনের মূলবস্তু তুলে ধরা হলো:
মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপকর্মের সাফাই গেয়ে ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ঘনিষ্ঠ বা দলটির কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত কিছু স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তথ্যের ওপর নির্ভর করে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়টিকে খণ্ডন ও হালকা করতে এবং এই গুমের দায় থেকে তাঁর ব্যক্তিগত বান্ধবী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে ভারতপন্থি মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল চক্রবর্তী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তি এবং ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের সাথে রীতিমত উপহাস করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে প্রতি বিদ্বেষীয় সুলতানা কামাল চক্রবর্তী ইন্ডিয়া টুডেতে বলেন, মানবাধিকার ইস্যুতে বিএনপির মিথ্যা মামলা করার ইতিহাস রয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদকের কাছে দেওয়া মন্তব্যে সুলতানা কামাল চক্রবর্তী বিএনপির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিএনপি কর্তৃক ভুয়া অভিযোগের ঘটনায় ইতিমধ্যে তাদের ভাবমূর্তি উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।
সম্প্রতি বাসা থেকে রাগ করে প্রায় এক মাস লুকিয়ে থেকে পুলিশে কাছে ধরা পড়া খুলনার রহিমা বেগম নামের এক বৃদ্ধার উদাহরণও এই নিম্নমানের প্রতিবেদনটিতে উত্থাপন করা হয়।
এতে বলা হয়, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটিও জাতিসংঘের প্রতিবেদন (গুম নিয়ে) নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। রহিমা বেগম গত ২৭শে আগস্ট আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে ২৪শে সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে খুঁজে পায়।
রহিমা বেগমের হারিয়ে যাওয়া ও উদ্ধারের পর পরই নেটিজেনরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে, এই ঘটনাটিকে পূঁজি করে অপপ্রচারে নেমে পড়বে সরকার।
নেটিজেনদের সেই সন্দেহ সত্য প্রমাণ করে দালালিতে ভরপুর এই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মামলার (রহিমা বেগম) মাধ্যমে বাংলাদেশে কিছু মানবাধিকার সংস্থার গুমের দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত শাহনাজ পারভিন ডলি নামের এক অখ্যাত আইনজীবীরও দ্বারস্থ হন ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদক। অখ্যাত এই আইনজীবীও সরকারের দালালি করে গুমের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা গুম শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারকে খুশি করার মতোই বক্তব্য দিয়েছেন।আওয়ামীপন্থী বেসরকারি টেলিভিশন সময় টিভিকে দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারের বিষয়টিও তুলা ধরা হয় ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে।
সেই সাক্ষাতকারে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছিলেন, “ভুয়া” গুমের ঘটনা আসলে বাংলাদেশের সমগ্র অধিকার ইস্যুর চিত্রকে কলঙ্কিত করেছে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তাদের (মানবাধিকার সংস্থাগুলো) তালিকায় ভুয়া মামলা অন্তর্ভুক্ত করার পর জাতিসংঘের পুরো প্রতিবেদনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আর এজন্য দায়ী গোষ্ঠীগুলো আসলে বাংলাদেশে মানবাধিকারের বিষয়গুলো ক্ষন্ন করছে। ।
সময় টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, জাতিসংঘের একটি গ্রুপ কীভাবে পক্ষপাতদুষ্ট স্থানীয় সংগঠনগুলোর রিপোর্ট অন্ধভাবে মেনে নিতে পারে, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে পরিচিত বিরোধী দলগুলো?
তবে ইমতিয়াজ আহমেদ, যিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনো-সাইড স্টাডিজের প্রধান ছিলেন, এবং তিনি এক সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা গুমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে জোরালোভাবে বক্তব্য দিয়ে বলেছিলেন যে এই ধরনের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা উচিত।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনটিতে ডিজিএফআইয়ের গোপন কারাগার "আয়নাঘর" এ এক সময় বন্দী করে রাখা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমানের উদাহরণ টেনে বলা হয়, ২০১২ সালে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসিনুরকে হিযবুত তাহরিরের মতো সংগঠনগুলির সাথে যোগাযোগ রেখে সেনা আইনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে দেখা গেছে।
তবে হাসিনুরের প্রসঙ্গে আলোচনায় ইন্ডিয়া টুডে’র ভাড়াটে প্রতিবেদক পরোক্ষভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা গুমের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে হিযবুত তাহরিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে গুম ও বিচারের প্রসঙ্গটি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভাড়াটে এই প্রতিবেদক।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার অনেক আগে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনাও জাতিসংঘের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষত, জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমেরিকা কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে মনে হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছেন বিদায়ী পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদও।
ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদনে জাতিসংঘের তালিকায় থাকা বাংলাদেশে গুমের শিকার বিএনপির নেতা-কর্মীদেরকে "অগ্নিসংযোগকারী ও মাদক পাচারকারী" হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, যেমনটা সব সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলে থাকেন।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকারের মন্ত্রীদের সাথে সুর মিলিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গুম হওয়া ৭৬ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জন তাদের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তবে জাতিসংঘের তালিকায় কমপক্ষে ২৮ জনের নাম রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা হরহামেশাই বলে থাকেন। আওয়ামী লীগের এই বয়ানই উঠে এসেছে ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদনে।
এতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের তালিকায় যারা রয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বাছাই করা কোনও নিরীহ ভিন্নমতাবলম্বী নয়। যারা পলাতক তারা হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে পুলিশ তাদের খুঁজছে।
আওয়ামী বয়ানের সাথে সুর মিলিয়ে ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি যানবাহনে আগুন দিয়ে বোমা হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত আরেক বিএনপি কর্মী ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রয়েছেন। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী কর্মীরা শত শত সরকারী যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে, যার ফলে কয়েক ডজন লোক মারা যায় এবং গুরুতর ভাবে পুড়ে আহত হয়। পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে এবং তাদের বেশিরভাগই গ্রেপ্তার এড়াতে পলাতক রয়েছে।
আওয়ামীপন্থী অখ্যাত এক নারী আইনজীবীর বরাত দিয়ে ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত এই সব পলাতকদের জোরপূর্বক গুমের শিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা ন্যায়বিচারের সাথে প্রহসন। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অধিকারের মতো কিছু স্থানীয় এনজিওর অযৌক্তিক তথ্য কিনে নিয়েছে তা লজ্জাজনক।
প্রতিবেদনটিতে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়ার মাধ্যমেই স্পষ্ট যে, ইন্ডিয়া টুডে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রপাগাণ্ডার একটা অংশ হিসেবে প্রতিবেদনটি করেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড বা জোরপূর্বক গুমের যে তালিকা হস্তান্তর করেছে, তাতে ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রথমে মানবাধিকারের মতো স্থানীয় এনজিও প্রকাশ করেছিল। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই তালিকা প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি বাস্তব ত্রুটিগুলি উপেক্ষা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তালিকাগুলি কেনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন