"আমার হাত-মুখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। আমাকে কোনো কথা বলতে দেয়া হয় নাই। এরপর দেখলাম সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পরদিন ভোর চারটার দিকে আমাকে সাদা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে আসা হলো মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে। আমি বারবার বলেছি, আমার তথ্য আমার পরিবারের কাছে দিন। আমি আমার পরিবারের ফোন নম্বর দিয়েছি। কিন্তু, তারা আমার এই ন্যুনতম অধিকার আমাকে দেয়নি। পরবর্তীতে জেল থেকে এসে জানতে পেরেছি যখন আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ডিবি র্যাব সবাই আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল। পরে আমার সহযোদ্ধা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার চাপে আমাকে তিনদিন পর কোর্টে তোলে।"
বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) করেছিল বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখা 'গুম ও সাদা পোশাকে গ্রেপ্তারকৃতদের স্মৃতিচারণ ও ছাত্র-জনতার সমাবেশে' রোমহর্ষক এমন বর্ণনা দেন মাজাহরুল ইসলাম। তার মতই এমন অনেকে নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এই অনুষ্ঠানে। আমার দেশ-এর পাঠকদের জন্য গুম থেকে ফিরে আসা ছাত্রনেতাদের সেইসব বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা মাজহারুল ইসলামকে কয়েক বছর আগে গুম করা হয়েছিল। কিন্তু, তাকে তুলে নেয়ার মুহূর্তের ভিডিও তার সহকর্মীরা ধারণ করায় সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
সেই রোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, "গ্রেফতারের পর এই রাষ্ট্র আমার সব ধরণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে। আমাকে হয়তো গুম করেই দিতো। আমি তেমনই আশঙ্কা করছিলাম। আমার সহযোদ্ধারাও একই আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু, আমার সিলেটি সহযোদ্ধারা যখন আমাকে গুম করেছে সেই মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতে পেরেছিল। সেই ডকুমেন্টের জন্য চাপে পড়ে আমাকে গুম করতে পারে নাই।"
ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা শাকিলুজ্জামানকে গুম করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে।
তিনি বলেন, "২০২১ সাল। ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে সাদা পোশাক আমি ও আমার দুই সহযোদ্ধা গুমের শিকার হই।"
তিনি বলেন, "তারা আমাকে গাড়ী তোলার পরই নির্যাতন শুরু করে। পরিস্থিতিটা এমন সৃষ্টি করে যে আশেপাশে কালো গাড়ীতে তুলে র্যাব আমাকে গুম করে। এরপর তারা আমাকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নেয়ার পর তারা আমার চোখ বাঁধে। গামছা দিয়ে চোখ বাঁধার পর ফাঁসির আসামিদের যে জমটুপি পরায় তেমন কালো জমটুপি পরায়। আমার দুই হাতে হাতকড়া পরায়। এই অবস্থায় তারা আমাকে গাড়ীর ভেতরে তোলে। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে আমার দুই পাশে ও পেছনে দুইজন থাকে। এরপর গাড়ী চলতে থাকে। এরপর তারা আমাকে একটা বিল্ডিংয়ে নেয়। এটা আমি বুঝতে পারি। সেখানে তারা আমাকে ব্যাপক টর্চার করে। আমি কেন আন্দোলন করে এমন অনেক প্রশ্ন করে। রাজনীতি করতে নিষেধ করে তারা। এরপর রাত ২টা থেকে ৩টার দিকে গাড়ীতে নিয়ে ঘুরায়। তখন এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে এখনই আমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে।"
তিনি বলেন, "এভাবে তিনদিন রাখার পর আমাকে মতিঝিল থানায় নেয়। সেখানেও দুই দিনের রিমান্ড নেয়। রিমান্ডের পর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ মাস রাখা হয়।"
গুম থেকে ফিরে আসা ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা তারিকুল ইসলাম বলেন, "যখন আমাকে আটক করা হয় তখন আমি জানতে চাইলাম আমার অপরাধ কী? রাত ৯টাপর দিকে আমাকে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি প্রশ্ন করি কোথা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? রাত ১০টার দিকে রমনা থানায় নিয়ে গেলেন। তিন দিন পর তারা আমাকে সেখান থেকে গ্রেফতার দেখালেন।"
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা রাশেদ খান।
হেফাজতের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, "আমি যে বাড়ীতে ছিলাম সেই বাড়ী থেকে নিচে নামছি হুট করে কয়েকজন ব্যক্তি সাদা পোশাকে তারা আমাকে বলে এই রাশেদ দাঁড়া। তাদের হাতে ওয়াকিটকি। আমি বুঝতে পারি তারা হয়তো আমাকে গুম করতে এসেছে। এজন্য আমি সেখান থেকে দৌঁড় দেই। আমার সাথে কয়েকজন সহযোদ্ধা ছিলো। দৌঁড় দিয়ে আমরা পাশের এক বাসায় আশ্রয় নেই। এরপর সেই সাদা পোশাকধারীরা সেই বাসাতে ওঠে আমাকে তুলে নিয়ে আসে। ৫ তলাতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। ৫ তলা থেকে নিচ তলা পর্যন্ত টানতে টানতে আমাকে নির্যাতন করা হয়। আমাকে ভাসানটেক থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তার মানুষজন যখন দেখছে তখন তারা বলতে থাকে- এই কেউ কথা বলবা না। চোর ধরেছি, জঙ্গি ধরেছি। এরপর আমাকে ডিবিতে নেয়া হলো। সেখান থেকে আমাকে ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে নেয়া হলো। সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। কোনো প্রশ্ন না। পুলিশের একজন এডিসি বললে চোখ বাঁধ। চোখ বাঁধার পর মুখের ভেতর গামছা ঢুকালো। ঢুকিয়েই আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়া হলো।"
তিনি বলেন, "আমার অণ্ডকোষে বারবার এমন লাথি মারতে থাকলো যে আমার মনে হতে লাগলো যে আমি মরে যাব। আমাকে রক্তাক্ত করা হলো।"
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন