ঘটনার পর লাশের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন স্বজনেরা। বাসায় একা বিলাপ করছেন সত্তরোর্ধ্ব রাবেয়া। মঙ্গলবার দুপুরে নিহত আইয়ুব আলীর ভাড়া বাড়িতে
ঘটনার পর লাশের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন স্বজনেরা। বাসায় একা বিলাপ করছেন সত্তরোর্ধ্ব রাবেয়া। মঙ্গলবার দুপুরে নিহত আইয়ুব আলীর ভাড়া বাড়িতেছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে কাওলা সড়ক ধরে দেড় কিলোমিটার এগোলেই স্থানীয় আপিল মেম্বারবাড়ি রোড। সেখান থেকে বাদশা সড়ক হয়ে সরু গলি ধরে পশ্চিম দিকে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে নিহত আইয়ুব আলীর ভাড়া বাড়ি। এক দিন আগেও যেখানে ছিল বিয়ের আনন্দ, সেখানে আজ বিষাদের ছায়া। তিন কক্ষের ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসাটি এখন নীরব, নিস্তব্ধ।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতে যেতেই দেখা গেল মূল ফটকে তালা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে একজন তালা খুলে দেন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই হাতের বাঁয়ে নিহত আইয়ুব আলীর ফ্ল্যাট। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল আইয়ুবের শাশুড়ি সত্তরোর্ধ্ব রাবেয়া বেগমকে। নাতি হৃদয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ঘটনার পর থেকে মেয়ে (আইয়ুবের স্ত্রী রেহানা), তাঁর ছেলেমেয়েরা লাশের জন্য মর্গে ছোটাছুটি করছেন। তাই ঘটনার পর থেকে একাই বাসায় তিনি।
রাবেয়ার সঙ্গে কথার শুরুতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘মাইড্যার একটামাত্র ছেলে (হৃদয়)। দুনিয়াতে হের স্বামী-সন্তান ছাড়া আপন কেউ নাই। এহন পোলার বাপডা মইর্যা গেল। আমার মাইয়াড্যার কী হইব? হেরে কেডায় দেখব, কই যাইব? ও আল্লাহ, আচমকা এইড্যা কি হইয়্যা গেল আমার...’
আঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছেন রাবেয়া। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানালেন, তাঁর আট ছেলেমেয়ে। পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলে নুরুল আমিন বছরখানেক আগে অসুখে মারা যান। রেহানা তাঁর পাঁচ মেয়ের মধ্যে চতুর্থ। মেয়ের এমন পরিণতিতে অনেকটাই বাকরুদ্ধ রাবেয়া।
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন জাহিদুল ইসলাম। মঙ্গলবার সকালে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের আগপয়লা গ্রামে
নাতি হৃদয়ের বিয়ে হয় গত শনিবার। গতকাল ছিল বউভাত। বিয়ে ও বউভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুক্রবার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসেন। অনুষ্ঠান শেষে গতকাল বিকেলেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। জামাই তাঁকে পৌঁছে দেবেন বলে যেতে দেননি। কিন্তু এর মধ্যেই এলোমেলো হয়ে গেল সব।
রাবেয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে জামাই গাড়িটা কিনছে। সে কী খুশি! আনন্দে নিজেই পোলা (হৃদয়), পোলার বউ (রিয়া) লইয়্যা চালাইয়া যাইতাছিল। যাওয়ার আগে কইয়া গেছে, পোলা আর পোলার বউরে নামায়া দিয়া আমাগোরে বাড়ি দিয়া আইব। কিন্তু এই যে গেল, এইড্যাই শেষ যাওয়া। আর কোনো দিনও আইব না।’
বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে ফিরছিলেন বাসায়। পথে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে নিহত হন পাঁচজন। সোমবার বিকেলে ঢাকার উত্তরায়
কথা বলতে বলতেই রাবেয়ার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ান ওই ভবনের চার-পাঁচজন প্রতিবেশী। আইয়ুব আলীর মৃত্যুর পর তাঁরাও শোকে কাতর। একটু পরপরই একলা বাড়িতে রাবেয়াকে দেখতে আসছেন তাঁরা।
কথার একপর্যায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বৃদ্ধা রাবেয়া বলেন, ‘এই যে এতগুলা মানুষ মরল। হেগোর কী দোষ আছিল? হেগোর দায়িত্ব কেডায় নিব। হেগোর পোলা–মাইয়্যাগোরে এখন কেডায় দেখব। যাগোর ভুলের লাইগ্যা মানুষগুলা এমনে মারা গেল, আমি হেগোর বিচার চাই। যে মানুষ গেছে তারে আর খুঁইজা পামু না, তয় সুষ্ঠু বিচার হইলে মনে শান্তি পামু।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন