পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘হাওরের মানুষ সারাজীবন ধূতি পরে মাছ ধরবে, আপনারা গুলশান-বনানীতে আরামদায়ক জীবনযাপন করবেন তা কাম্য নয়’।
তিনি বলেন, ‘গত ৩০-৩৫ বছরে হাওরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার অনেক ক্ষতি করেছে বন্যা। বিশেষ করে এ অঞ্চলে মানুষের যোগাযোগের যে সড়কগুলো ছিল তা প্রায় সব শেষ। আমরা হয়তো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল, হাটবাজার দ্রুত নির্মাণ করতে পারব। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে সড়ক নির্মাণ করা। আমি শঙ্কিত আমার জীবদ্দশায় এ সড়কগুলো আগের মতো দেখে যেতে পারব কি না’।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সিলেট বিভাগ সাংবাদিক সমিতি আয়োজিত ‘সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন বন্যা: কারণ, পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতি হয় বলে হাওরের উন্নয়ন বন্ধ করে দেব এটা হতে পারে না। হাওরের মানুষের তো এমন ভাগ্য নয় যে আজীবন তাদের পানির নিচে বসবাস করতে হবে। তারা সারাজীবন ধূতি পডরে মাছ ধরবে, আর আপনারা গুলশান-বনানীতে আরামদায়ক জীবনযাপন করবেন তা কাম্য হতে পারে না। অথচ দেশের এই পরিবর্তনেও তারা হকদার’।
তিনি বলেন, ‘হাওয়রবাসীর উন্নয়ন করতে গিয়ে অন্যদের সমস্যা হবে-এই হিসাব বিজ্ঞানীরা করবেন। কাজেই এটা নাই, ওটা নাই বিবেচনার চেয়ে সমাধানের পথ বের করতে হবে’।
এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রথমে ত্রাণ তারপর নির্মাণ। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শিগগিরই সিলেট-সুনামগঞ্জে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে’।
তিনি বলেন, বিনামূল্যে বীজ ও সার ক্ষুদ্র চাষিদের মাঝে প্যাকেট করে বিতরণ করা হবে। হাওরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ মানুষের কাঁচা ঘরে বসবাস করে। বন্যার পানি কমে গেলেও তারা ঘরে উঠতে পারছে না। কারণ ঘরের মেঝে এখনো শুকায়নি। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যাদের কাঁচা ঘর তাদের সিমেন্টের খুঁটি ও মেঝে পাকা করে দিতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি কমবে’।
আলোচনায় সিলেটে বন্যা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।
তবে এ জন্য সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার জানত না যে এত বড় বন্যা আসবে। সিলেটের বন্যা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার অভাব ছিল, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে এখানে সরকারের দোষ দেওয়া যায় না। প্রতি বছর যদি এমন বন্যা হতো আর যদি সরকার প্রস্তুত না থাকত, তাহলে আমি নিজেই দোষ দিতাম।
তিনি বলেন, অনেকে বন্যায় নৌকার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসলে যারা নৌকার মালিক, তারাও তো বন্যার নিচে তলিয়ে গেছেন।
ইমরান আহমদ বলেন, প্রতি বছর এমন বন্যা আসবে না, এটা বলা যাবে না। বন্যা আসবে এমনটি ধরেই প্রস্তুতি রাখতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, বন্যা প্রতিরোধে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, বিলসহ অন্যান্য জলাশয় খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জলাশয়সমূহের পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে বন্যার তীব্রতা কমানো সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। অবাধে বৃক্ষ নিধন, পাহাড়, টিলা কর্তন বন্ধ করতে হবে।
পরিবেশমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুরমা ও কুশিয়ারার নদীপথ পুনরায় চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
যে কোনো দুর্যোগে অসহায় মানুষের সহযোগিতায় সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান মন্ত্রী ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমরা অজান্তে আমাদের বিল এরিয়া বা যেগুলোকে জলাশয় বলি, সেগুলোকে ভরাট করে আমরা কৃষিজমি করে ফেলছি। আমরা মনে করি, কৃষিজমি হলে ব্যক্তি পর্যায়ে লাভজনক হওয়া যায়। কিন্তু আমরা জানি না, জলাভূমির আউটপুট কোনো অংশে কম না। হাওর এলাকার যেসব রাস্তা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, সেগুলো সংকুচিত করে প্রয়োজনে ব্রিজগুলো ওপেন করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগামীতে কপ-২৭ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিবেচনায় বাংলাদেশকে জাতিসংঘের অভিন্ন জলাশয় চুক্তিতেও স্বাক্ষর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা নদী দখল করছি, কিন্তু নদীর জন্য জায়গা ছাড়ছি না। ৯০ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর নেদারল্যান্ড নদী শাসন করতে গিয়ে যেটা করল, তা হলো তারা নদীর আশপাশে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর মূল ভূমির যেন কোনো পরিবর্তন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাওরে এলজিইডি যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তা ওই এলাকার নদীর হাইড্রোলজির কথা চিন্তা না করেই করেছে। হাওরে যে ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো অপটিমাইজ করে এখন নতুন করে সেই রাস্তাগুলো সংযুক্ত করতে হবে জাতীয় সড়কের সঙ্গে।
ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইপিডির পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, হাওর এলাকায় যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে গ্রহণ করা হবে, তাতে প্রতিবেশ ও পরিবেশ কোনোভাবেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পাশাপাশি হাওর এলাকার জলাশয় ও নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতেও উদ্যোগ নিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন