বিকাল ৪টায় লাগা আগুন দাউ দাউ করে জ্বলেছে রাত ১০টা পর্যন্ত। পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ধ্বংসস্তূপ পুড়েছে আরও কয়েক ঘণ্টা। ছয় ঘণ্টা জ্বলা এ আগুন প্রায় ৩০ কোটি টাকার পণ্য ভস্ম করে দিয়েছে বলে দাবি করছেন নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের পোশাক কারখানা জাহিন নিটওয়্যারের মালিক। আর শ্রমিকরা বলছেন, এ আগুন পুড়িয়েছে তাদের স্বপ্ন ও স্মৃতি।
জাহিন নিটওয়্যারের চারটি ইউনিটে লাগা আগুন দৃশ্যত নিভলেও এখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে মালিক ও শ্রমিকদের মনে। সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কারখানার চারটি ইউনিট। শনিবার কারখানার বিভিন্ন ইউনিটে পোড়া কাপড় থেকে এখনও ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়েছে চারটি ইউনিটে থাকা বিপুল পরিমাণ ফেব্রিকস, সুতা, উৎপাদিত তৈরি পোশাক, নিটিং মেশিন, সুইং মেশিন আরও কত কী। এ ছাড়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চার ইউনিটের ছাদ হিসেবে নির্মিত স্টিলের ছাদ। দুই ও চার নম্বর ইউনিটের দুটি শেড ধসেও পড়েছে। মালিক পক্ষের দাবি, সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
এর আগে, শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) বিকাল ৪টায় এ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৬ ইউনিটের পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময়ের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সোনারগাঁ ফায়ার স্টেশন কর্মকর্তা তানহারুল ইসলাম জানান, শনিবার সকাল ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান শেষ করেন। আগুনে কেউ হতাহত হননি।
তবে, আগুনে চারটি ইউনিট পুড়ে যাওয়ায় কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আগুনে পুড়ে গেছে হাজারও শ্রমিকদের স্মৃতিবিজড়িত কারখানা। মাস শেষ হয়ে এসেছে, এ অবস্থায় মালিক কি বেতন দিতে পারবেন? নতুন করে কবে কারখানা চালু হবে? চালু না হলে কী করবেন- এমন সব প্রশ্ন তাদের মনে। তবে জানা নেই উত্তর।
শ্রমিক নিজাম উদ্দিন, সালেহা বেগম, রাইসা বেগমসহ কয়েকজন আগুনে পুড়ে যাওয়া চার নম্বর ইউনিট দেখতে আসেন। মোবাইল ফোনে আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপের ছবি তুলতে তুলতে জানান, এই কারখানায় তাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। চার বছর ধরে কারখানায় কাজ করেন সালেহা ও রাইসা। প্রতিদিন এসে কাজ করতেন। কিন্তু শুক্রবারের আগুনে পুড়ে গেছে।
তারা জানালেন, আগুনে মালিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, একইভাবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ কাজ করলে মালিক টাকা দিতেন। এখন কী বেতন দেবেন? এ নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলেও জানালেন।
এদিকে, শনিবার দুপুরে বিকেএমইএ-এর সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ পাঁচ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান, বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এবং বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আইয়ুবসহ বেশ কয়েকজন আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানা পরিদর্শন করেন।
সেলিম ওসমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘জিহান নিটওয়্যার কারখানার আগুন একটি দুর্ঘটনা। আগুনে কারখানার চারটি ইউনিট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারখানাটি ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। এখানে কর্মরত শ্রমিকরা যাতে কর্মহীন বা বেকার না হয়ে পড়ে সেজন্য অর্থায়নকারী ব্যাংক এবং শ্রম মন্ত্রণালয়কে কারখানার পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স, শ্রম মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করলে কারখানাটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
জাহিন নিটওয়্যার কারখানার এমডি জামাল উদ্দিন জানান, আগুনে কারখানার দুই নম্বর ইউনিটের দ্বিতীয় ফ্লোরের সুইং, ফিনিশিং সেকশন ও রফতানির জন্য রাখা বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত পণ্য; চার নম্বর ইউনিটের নিটিং সেকশন, বিপুল পরিমাণ সুতা, এর থেকে তৈরি গ্রে ফেব্রিকস, প্যাটার্ন কাগজ ও নিটিং মেশিন; পাঁচ নম্বর ইউনিটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার সুইং, ফিনিশিং সেকশন ও তৈরি পণ্য এবং ছয় নম্বর ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় রাখা বিপুল পরিমাণ রফতানি পণ্যের কার্টন পুড়ে গেছে। এ ছাড়া চারটি ইউনিটের স্টিলের ছাদ এবং শেড আগুনের তাপে গলে ধসে পড়েছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘আগুনে ১৭ লাখ টন ফেব্রিকস, কয়েক লাখ পিস উৎপাদিত পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে আরও বেশ কয়েকদিন লাগবে। তবে আগুনে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে ৩০ কোটি টাকার বেশি হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারখানায় চারটি ইউনিটে একযোগে কী কারণে আগুন ছড়িয় পড়েছে এবং আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে হলো তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
কারখানার নির্বাহী পরিচালক সফিউদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘৪০০ বছরে তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয় গেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সুনাম এবং সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছিলাম। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ হতো। কিন্তু ভয়াবহ আগুন সব কিছু নিয়ে কেড়ে নিয়েছে।’ তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে- এ জন্য সরকারের সহযোগিতা চান।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, ‘আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ও আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে ঢাকা থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আশা করছি, আগামী দুই একদিনের মধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটিই সব কিছু খতিয়ে দেখবে।’
কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি ছিল কি না? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব কিছুই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন