দুদক কমিশনার নিয়োগে বৈঠক আজ নাম আসছে ‘গায়েবি উৎস’ থেকে, প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত হওয়া দরকার : মনজিল মোরসেদ
‘গোপন’ নাকি ‘প্রকাশ্য’- এমন কোনো নির্দেশনা নেই। কোন্ উৎস থেকে নাম আসবে, কি প্রক্রিয়ায় সেগুলো বাছাই হবে- এ বিষয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। কার কার নাম প্রস্তাবনায় এসেছে, কোন্ নাম গ্রহণ করা হচ্ছে- কার নাম বাদ পড়ছে- এ প্রশ্নেও রয়েছে অস্বচ্ছতা। এক ধরনের ‘গায়েবি বিষয়-আশয়’ নিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটিকে। বলতে গেলে এক ধরনের ‘গোঁজামিল’ নিয়েই গঠিত পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি আজ (বৃহস্পতিবার) বসছে দ্বিতীয় বৈঠকে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
সূত্রটি জানায়, দুদক কমিশনার পদে নিয়োগযোগ্য প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম চলছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। দুদক আইনের আওতায় গঠিত এ কমিটির হাতে নেই কোনো বিধান কিংবা সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফলে কি প্রক্রিয়ায় কমিটি বাছাই চলছে- এ নিয়ে দেখা দিয়েছে ধূম্রজাল।
সূত্রমতে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ৭(১) ধারায় ‘বাছাই কমিটি’র বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কমিটি কি প্রক্রিয়ায় বাছাই সম্পন্ন করবেন- এ সংক্রান্ত কোনো বিধি নেই। বাছাই প্রক্রিয়াটি ‘গোপন’ নাকি ‘প্রকাশ্য’ তাও স্পষ্ট নয়। ফলে দুর্নীতিবিরোধী স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুদকের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার পদে যোগ্য, দক্ষ এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম সুপারিশে উঠে আসবে কি-না- এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কমিশনার পদে যোগ্য, দক্ষ, নৈতিকভাবে শক্ত-সমর্থ ব্যক্তিদের না বসালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে বাধ্য।
দুদক আইন-২০০৪ এর (২) ধারায় বলা হযেছে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হইবে।’ আইনের ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হইবে এবং তাহাদের মধ্য হইতে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করিবেন।’ আইনের ৬ (১) ধারা অনুযায়ী কমিশনাররা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ধারা ৭ অনুসারে গঠিত ‘বাছাই কমিটি’র সুপারিশক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন। ‘বাছাই কমিটি’ সম্পর্কে আইনের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত পাঁচজন সদস্য সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হইবে’।
যথা: (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক; (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের-হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; (গ) বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; (ঘ) সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং (ঙ) অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব : তবে শর্ত থাকে যে, যদি উক্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি বাছাই কমিটির সদস্যপদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অব্যাবহিত পূর্বের অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আরও শর্ত থাকে যে, যদি উক্তরূপ কোনো অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি বাছাই কমিটির সদস্যপদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে বর্তমানে কর্মরত মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
(২) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক বাছাই কমিটির সভাপতি হইবেন। (৩) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাছাই কমিটির কার্যসম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবে। (৪) বাছাই কমিটি, কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে, উপস্থিত সদস্যদের অন্যূন ৩ (তিন) জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করিয়া ধারা ৬ এর অধীন নিয়োগ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করিবে। (৫) অন্যুন ৪ (চার) জন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম গঠিত হইবে। কমিশনারদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ইত্যাদি ৮ (১) আইনে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারে বা শৃঙ্খলা বাহিনীতে অন্যুন ২০ (বিশ) বৎসরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি কমিশনার হইবার যোগ্য হইবেন। (২) কোন ব্যক্তি কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি (ক) বাংলাদেশের নাগরিক না হন; (খ) কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণ খেলাপি হিসাবে ঘোষিত বা চিহ্নিত হন; (গ) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দেউলিয়াত্বের দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করেন; (ঘ) নৈতিক স্খলন বা দুর্নীতিজনিত কোন অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হইয়া আদালত কর্তৃক কারাদন্ডে দন্ডিত হইয়াছেন; (ঙ) সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থাকেন; (চ) দৈহিক বা মানসিক বৈকল্যের কারণে কমিশনের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন এবং (ছ) বিভাগীয় মামলায় গুরুদন্ড প্রাপ্ত হন।
আইনে উল্লেখিত ধারা অনুসারে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি কাজ করছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এ কমিটির প্রধান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এবং মন্ত্রিপরিষদের অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভুইঞা।
বাছাই কমিটির প্রত্যেক সদস্য একটি পদের বিপরীতে বাছাই কমিটিতে দু’জনের নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। সেখান থেকে বাছাই কমিটি একেকটি পদের বিপরীতে দু’জনের নাম প্রস্তাব করবেন প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট একটি শূন্যপদের বিপরীতে একজনকে কমিশনার পদে নিয়োগ দেবেন। তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিশন থেকে তিনি একজন কমিশনারকে ‘চেয়ারম্যান’ হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
সূত্রমতে, আগামী ১৩ মার্চ দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এবং কমিশন সদস্য এএফএম আমিনুল ইসলামের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সাপ্তাহিক বন্ধ ও সরকারি ছুটি থাকায় ১০ মার্চ তাদের শেষ কর্মদিবস। এরপরই দুদক কমিশনারের দু’টি পদ শূন্য হচ্ছে। আরেকটি পদে থেকে যাবেন কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক। শূন্য দু’টি পদ পূরণ করতে হবে বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কমিশনারদের দিয়ে।
গত ২৮ জানুয়ারি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি এ দু’টি পদের জন্য বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে গত ৪ ফেব্রæয়ারি প্রথম বৈঠক করে। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় কমিশনার পদে ‘নিয়োগ উপযোগী’ নাম কমিটির বিবেচনায় আসবে- এ বিষয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। কমিশনার পদে নিয়োগ লাভের ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’দের নামগুলো কিভাবে বাছাই কমিটির সদস্যদের হাতে এসেছে কিংবা আসবে সেটি প্রকাশ করছে না। আইনে কমিটির ‘ফরমেট’ এবং ‘যোগ্য ব্যক্তি’দের মানদন্ড নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুদক আইনে প্রথম এ বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন আইনমন্ত্রী। পরে বাছাই কমিটির নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখতে আইনমন্ত্রীর পরিবর্তে আইনে আপিল বিভাগের বিচারপতিকে বাছাই কমিটির প্রধান করার বিধানযুক্ত হয়।
যদিও ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী ২০০৭ সালে কমিশন পুনর্গঠন করা হয় বাছাই কমিটিকে পাশ কাটিয়ে। পরবর্তীতে বাছাই কমিটিকে কাজে লাগানো হলেও কমিটিকে কার্যক্রম চালাতে হয়েছে বিধি ছাড়াই। অনেকটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন করা হয় দুদক কমিশনার নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া। কার কাছ থেকে কিভাবে নামগুলো বাছাই কমিটিতে নাম আসছে জানা যাচ্ছে না।
সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা কার নাম তালিকায় রাখছেন, কার নাম বাদ পড়ছে- এটি জানাচ্ছেন না। ফলে কমিটির প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের প্রাধান্য লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। দুদকের বিগত ৫টি কমিশনের ৩টিতেই লক্ষ্য করা গেছে প্রশাসনিক ক্যাডারদের প্রাধান্য। কমিটির প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে আসা ব্যক্তিবর্গের চেয়েও দক্ষ, যোগ্যতা সম্পন্ন ‘উপযুক্ত’ অন্য সেক্টরের ব্যক্তিবর্গের নাম প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়ার দ্বার অবারিত থাকছে না।
দুদকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে দুদকের মতো স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। ওইসব দেশে সুশীল ও নাগরিক সমাজের কাছ থেকে বাছাই কমিটি উপযুক্ত ব্যক্তির নাম আহ্বান করে। সেখান থেকে বাছাই কমিটি ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’র তালিকা প্রণয়ন ও সুপারিশ পাঠায়। পুরো বাছাই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে।
এ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, গঠিত বাছাই কমিটি কর্তৃক উপযুক্ত ব্যক্তির তালিকা প্রণয়নে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বাছাই কমিটি নাম নির্বাচনে কি প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে- কেউ তা জানেন না। দুদকের চেয়ারম্যান-কমিশনার পদে আরও দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের লক্ষ্যে বাছাই প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত করে দেয়া দরকার।
এক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া বেঁধে দিয়ে বাছাই কমিটি সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারে। কারণ এসব পদে দুর্নীতিমুক্ত, দৃঢ়, কঠিন লোক প্রয়োজন। বাস্তবে ঘটছে উল্টোটি। দেশে দুর্নীতির সর্ববৃহৎ সেক্টর হচ্ছে আমলাতন্ত্র। অথচ দুর্নীতিবাজ আমলাদের বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা দুদকে দেখা যায় না। শুধুমাত্র সরকারের অনুগত সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘বাছাই’ করা হলে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বিধি-বিধানেও স্বচ্ছতা আনার দরকার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন