সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক মিশুক মনির ও তারেক মাসুদ নিহতের ঘটনা নিয়ে সাইন্টিফিক গবেষণায় নতুন তথ্য জানা গেছে। গবেষনাটি করেছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক। ডয়েচে ভেলে তার এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চালক সম্প্রতি মারা যাওয়ার পর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার কথা। হার্ড ব্রেক অ্যাপ্লাই করলে রাস্তায় একটি স্পিড মার্ক পাওয়া যায়। আর সেই স্পিড মার্ক পেলে গাড়ির আসল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। অথচ রাস্তায় কোনো স্পিড মার্ক পাওয়া যায়নি। বৃষ্টির কারণেই রাস্তায় হয়তো স্পিড মার্ক ছিলনা। স্পিড মার্ক এমন একটি বিষয় যার কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই। এর মূল কারণ, চাকার প্রচন্ড ঘর্ষণে রাস্তার পাথর কুঁচি উঠে যায়।
সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মাইক্রোবাসের পেছন দিকে যাত্রীরা মুখোমুখি বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন। মাইক্রোবাসে মুখোমুখি কী করে বসা যায়! তার মানে সেটির আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। হঠাৎ একটি বাস দৈত্যের মতো তাদের মাইক্রোবাসে আঘাত করে। হঠাৎ হলেই তো গাড়ির স্পিড মার্ক পাওয়া যায় না। কিছু দূর আগে থেকে দেখতে পেলেও হার্ড ব্রেক কষা সম্ভব।
ওখানে একটি বড় বাস রাস্তার বাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিক্সাকে ওভারটেক করছিল। ওভারটেক করা বাসটির চালক কিন্তু বাঁকের অন্য প্রান্তে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেও তিনি ক্যালকুলেটেড ঝুঁঁকি নিয়ে অটোরিক্সাকে ওভারটেক করে আবার নির্ধারিত বাম লেনে নিজের বাসটিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক সাধারণত এ ধরনের হিসেবি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত। অটোরিক্সাকে ওভারটেক করা বাসটির পেছনেই ছিল তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটি।
সামনের বাসটিকে অনুসরণ করে সেটিও অটোরিক্সাকে ওভারটেক করতে ডান লেনে চলে যায়। তবে একজন শহুরে চালকের জন্য কাজটি ছিল মারাত্মক ভুল। সামনের বাসের মতো তিনি মাইক্রোবাসকে ফের বাম লেনে নিতে পারেননি। বরং এই ভুলের কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। উল্টোদিকে আকস্মিক এ ঘটনার জন্য চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাস চালক জামির হোসেনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কারণ, বাঁকের উল্টো দিক থেকে তিনি মাইক্রোবাসটিকে দেখতেই পারেননি। আর এজন্যই সেই দুর্ঘটনা, যেখানে বাস চালক ব্রেক কষারও সময় পাননি।
দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির অবস্থান ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর। মামলার রায়ে বিচারক যেটিকে বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে মাইক্রোবাসটি তার সঠিক লেইনেই ছিল। চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটি রং সাইডে এসে মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা মেরে রাস্তার পাশে চলে যায়। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল, একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কোনো মাইক্রোবাস যদি তার ‘সঠিক’ লেইনে থাকে (যদিও সেই অবস্থানটিও ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর), তাহলে ধরে নিতে হবে দুর্ঘটনার আগের চিত্র ছিল অন্যরকম।
কারণ, একটি বাসের যে ভর ও গতি তাতে সংঘর্ষের পর মূল অবস্থান থেকে মাইক্রোবাসটির বেশ কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার কথা। মাইক্রোবাসের জীবিত আরোহীদের বক্তব্যেও সেটি জানা গেছে। ফলে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে রাস্তার মাঝ বরাবর পাওয়ার অর্থ হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি রং সাইডে ছিল, ধাক্কা খাওয়ার পর এর টার্মিনাল পজিশনটি পাওয়া যায় মধ্য রাস্তায়। আর দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসটি সত্যিই বাম লেইনে থাকলে, ধাক্কা খাওয়ার পর সেটির রাস্তার কিনারায় বা রাস্তার পাশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এটাই হলো বিজ্ঞান, অথচ বিচার প্রক্রিয়ায় এই বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানকার ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে যা ছিল না। একইসঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতি বছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না।
বাসের সঙ্গে এর মুখোমুখি নয়, বরং আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ডিভাইডারবিহীন একটি সড়কে এ ধরনের আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হলে দুটি যানের যে কোনো একটিকে রং সাইডে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান ও সংঘর্ষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল। দুর্ঘটনার পর সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তবে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন