প্রগতিশীল চিকিৎসক সংগঠন সমূহের জোট “ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপল’স হেলথ এর আহ্বায়ক এবং বিএমএ সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই- মাহবুব এর সভাপতিত্বে এবং “ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপল’স হেলথ এর সদস্য সচিব, অধ্যাপক ডা. শাকিল আখতার এর সঞ্চালনায় “করোনায় উম্মোচিত ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জাতীয় বাজেট” শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এতে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. এম আবু সাঈদ ও ডা. ফয়জুল হাকিম লালা। এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান, অধ্যাপক ডা. চন্দন কান্তি দাস, অধ্যাপক ডা. কাজী রকিবুল ইসলাম, ডা. হারুন- অর রশিদ, অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ, ডা. এম এইচ ফারুকী, ডা. গোলাম রব্বানী, ডা. এস এম ফরিদুজ্জামান এবং ডা. মনিষা চক্রবর্তী উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেন।
কনফারেন্সের আলোচনায় বলা হয় করোনা সংক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধারাবাহিকভাবে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা, অব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় সরকারি অর্থায়নে অনিহা, অবহেলা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও বেসরকারী করণজনিত-দীর্ঘদিনের বিরাজমান সংকট আরও নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। ‘করোনার এই মহাদুর্যোগে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উম্মোচিত, জনগণ তাদের ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে চিকিৎসকদের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে সরকার নিজ দায়িত্ব আড়াল করতে চাচ্ছে।
এই মহামারিতে ইতিমধ্যে ১৮ জন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন দেড়-সহশ্রাধিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবা কর্মী। আরও আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম কর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দেড়সহশ্রাধিক সদস্য। আমরা সকল ‘জতীয় বীরদের’ প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। একই সংগে জনগণের ন্যূনতম চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় অনেকে মৃত্যুবরণ করায় আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করছি। ‘এই প্রেক্ষাপটে আজ “ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপল’স হেলথ” এর পক্ষ থেকে জাতীয় বাজেট ঘোষণার পূর্বেই এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।
আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে নিম্মোলিখিত দাবীগুলো তুলে ধরা হলোঃ
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমাদের দাবী সমূহঃ
১। অবিলম্বে কোভিড-১৯ কে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করে প্রয়োজনে সরকারী হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতাল সমূহের কোভিড ইউনিটগুলো রিকুইজিশন করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক জেলায় ওঈট এবং নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাসহ পর্যাপ্ত সংখ্যক শয্যার করোনা ইউনিট চালু করতে হবে।
২। একযোগে সারা দেশব্যাপী কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণযুক্ত রোগী খুঁজে পরীক্ষার জন্য অবিলম্বে মানসম্মত র্যাপিড টেস্ট কিট জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
৩। করোনা রোগী চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল সরকারী ও বেসরকারী চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবা কর্মী কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ও খাবারের সুব্যবস্থা, যাতায়াতে পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা এবং প্রতিটি হাসপাতালে বা চিকিৎসাকেন্দ্রে তাদের জন্য মানসম্পন্ন ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা আবরণী (পিপিই) নিশ্চিত করতে হবে।
৪। সরকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরকার ঘোষিত ঝুঁকি বীমা ও ভাতার ক্ষেত্রে বেসরকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যখাতের কারো মৃত্যু হলে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫। এলাকাভিত্তিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সমন্বিত করে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকৃত রোগীদের আইসোলেশন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
৬। কোভিড-১৯ অত্যাধিক আক্রান্ত এলাকাসমূহকে রেড জোন গোষণা করে লকডাউন আরো দৃঢ়ভাবে (সংক্রমণ কমা শুরু না হওয়া পর্যন্ত) চালু রাখতে হবে। লকডাউন চালু রাখার সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও চিকিৎসা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৭। টঙ্গী, গাজিপুর, সাভার ও নারায়নগঞ্জ সহ সকল শিল্পাঞ্চলে অবিলম্বে কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে, শিল্পশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে শারীরীক দূরত্বসহ স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্য বাজেট সম্পর্কে আমাদের প্রস্তাব ও দাবীসমূহঃ
১। স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেটের ১৫% এবং জিডিপির ৫% বরাদ্দ দিতে হবে
২। অনুতপাদনশীল খাত সমূহে বাজেট বরাদ্দ হ্রাস করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজকল্যান খাতে বাজেটের এক তৃতীয়াংশ বরাদ্দ করতে হবে।
৩। সরকারী হাসপাতালে প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত পর্যন্ত সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে।
৪। সরকারী হাসপাতালে ইউজার ফি বাতিল করতে হবে। এ পর্যন্ত আদায়কৃত ইউজার ফি হাসপাতাল উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে।
৫। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থ্যা উন্নয়ন করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে ৫০ শয্যা ও জেলা পর্যায়ে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করতে হবে। প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য স্বাস্থ্যকর্মী (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাব অনুযায়ী) আনুপাতিক হারে কমপক্ষে ২৩ জনে উন্নীত করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
৬। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে মান সম্পন্ন চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী নিয়োগ করতে হবে ও পর্যাপ্ত ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর সংস্থান করতে হবে।
৭। জনগণের জন্য সার্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সুপেয় পানি, মান সম্মত পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্যকর আবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৯। জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে প্রাধান্যদিয়ে গণমূখী স্বাস্থ্যনীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০। শিল্পোন্নয়ন, নগরায়ণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহনের নামে পরিবেশ ধ্বংশ করা বন্ধ করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ করমসুচীর মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে হবে।
প্রিয় বন্ধুগন, স্বাস্থ্যের সংগ্রাম চিকিৎসকদের একক বিষয় নয়, শুধুমাত্র চিকিৎসক সংগঠনের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। বর্তমান করোনার বৈশ্বিক মহামারি শুধু পূঁজিবাদের আত্মঘাতী প্রবণতার উন্মোচনই ঘটায়নি; তার জনস্বাস্থ্য বিরোধী, অমানবিক ও আগ্রাসী চরিত্রও উন্মোচিত করেছে। তাই আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে চিকিৎসক সংগঠনের সাথে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে একত্রিত হয়ে একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আনদোলন গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন